মুসলিম শাসকদের মধ্যে যেমন শীর্ষে, তেমনি পৃথিবীর ইতিহাসেও অন্যতম সেরা শাসক তিনি। সুলতান সুলেমান খান। অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান। সুলতান সুলেমানকে নিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে আলোচিত-সমালোচিত টিভি সিরিয়াল মুহতাশিম ইউজিয়েল। আমাদের এই উপন্যাসের ভিত্তি সেই টিভি সিরিজ বা উপন্যাস নয়। মূলত ইতিহাসের নানা বইপত্র ঘেঁটে সুলতান সুলেমানের আমলটি তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতিহাস আশ্রয়ী এই উপন্যাসের মূল ভিত্তি অটোমানদের ইতিহাস। বাকিটুকু লেখকের কল্পনা। রকমারির নিয়মিত বিশেষ আয়োজনের কারণে মাঝখানে কয়েকটি পর্ব প্রকাশ পায়নি। এখন থেকে আবার নিয়মিত এটি প্রকাশিত হবে। প্রতি শনিবারের এ বিশেষ আয়োজনে আজ ছাপা হলো ২৬তম পর্ব।
[পূর্ব প্রকাশের পর]
সুলেমানের বিজয় যাত্রার খবর অল্প সময়ের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্বে। অনেকেই ভাবেনি নতুন অটোমান সুলতান এমন করে যুদ্ধজয়ী হবেন। সম্রাট লুই পালিয়ে বাঁচলেও বার্তা যেটা পাওয়ার সেটা ঠিক পেয়ে গেছেন। এবার বোধহয় আর শেষ রক্ষা হবে না!
কিন্তু এই লোকটা একটু ভিন্ন কিসিমের। কাপুরুষের মতো পালিয়ে এসেও তার মুখভর্তি নানা গপ্পো। এই করব, সেই করব আরও কত কি। কিন্তু ভিতরে ভেয় পেয়ে গেছে সে নিজেও। সবচেয়েও বড় কথা তার আশপাশের সবাই দারুণ ভড়কে গেছে। লুই যতই তার কাছের সেনা ও অন্যদের ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করুন না কেন, সুলেমানের ভয় ঠিকই সবাইকে আঁকড়ে ধরেছে। ইউরোপে সুলেমানের এই অগ্রযাত্রা মানতে পারছে না ভ্যাটিকান প্রাসাদ। পোপের কথা একটাই, অটোমানরা ইউরোপে ঢুকে পড়েছে, এবার আর হেলাফেলার সুযোগ নেই। একটা কিছু করতেই হবে। কিন্তু সেটা কী? জানেন না পোপ নিজেও। ভাবার জন্য সময় চাইলেন। হাঙ্গেরির রাজা লুই এর বোকামির বিষয়েও আলাপ হলো। বেটাকে দিয়ে কিছু হলো না। পাগলটা যদি একটু ঠিক থাকত তাহলে সবটাই অন্যরকম হতে পারত। কিন্তু ওর পাগলামিও সুলেমানকে খেপিয়ে তুলেছে। ভ্যাটিকানের সবাই একটা জিনিস পরিষ্কারভাবেই বুঝতে পেরেছে, সুলেমানের স্বভাব ওর বাবার মতোই একরোখা। শুধু কী তাই? সুলেমানের বাবা সেলিম খান যা করতে পারেননি, সুলেমান সেটাই করে দেখাচ্ছেন। তাই সুলেমানকে এখন আর খাটো করে দেখার কিছু নেই।
শরীরের ক্লান্তি ভুলে আস্তে আস্তে সপ্রতিভ হয়ে উঠেছেন সুলেমান। রাজমুকুট মাথায় পরার পর এটাই সম্ভবত তার সবচেয়ে সুবর্ণ সময়। যুদ্ধ জয়ের আনন্দ তুরস্কের আকাশে-বাতাসে। রাজধানীতে পৌঁছার পর সাধারণ মানুষের যে ভালোবাসা আর উচ্ছ্বাস দেখেছেন, তখনই তার যুদ্ধ যাত্রার ক্লান্তি কোথায় যেন দৌড়ে পালিয়েছে। প্রাসাদে ফেরার পর আবার অন্যরকম আনন্দ। প্রিয়তমা হুররেম মা হচ্ছেন। রোডস বিজয়ের চেয়ে এই আনন্দ কোনো অংশে কম নয়।
নিজের বিছানায় বিশ্রাম নিতে নিতে পুরনো ভাবনাগুলো ছুঁয়ে গেল সুলেমানকে। এই রাজপ্রাসাদ, এই সিংহাসন আর রাজমুকুট কোনো সহজ জিনিস নয়। অথচ বছর তিনেক আগেও সবকিছুকে কত সহজ মনে হতো। বাবা সেলিম খানকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। তখন মনে হতো সুলতান হওয়ার কী সুবিধা। শুধু নির্দেশ করতে হয়। সব কাজ বাকিরাই করে। উজিররা ভাবে প্রস্তাব করে, সেনাপতির নেতৃত্বে সেনারা লড়াই করে। সুলতান কেবল সিদ্ধান্ত নেন আর নির্দেশ প্রদান করেন। সুলেমানের খুব মনে হতো এর চেয়ে আনন্দের জায়গা আর এর চেয়ে সহজ কাজ আর কী হতে পারে। কিন্তু রাজ্যের সর্বোচ্চ আসনে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা যে কত বড় কঠিন কাজ এই ব্যাপারটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন তিনি। কত রকম চাপ। নিজের ভিতরে পুরে রাখা স্বপ্ন পূরণের চাপ, রাজ্যের সাধারণ মানুষের চাপ আছে সৈন্যদের দাবি-দাওয়া পূরণের চাপও। পরিবারের কথা না হয় বাদই দেওয়া হলো। সবচেয়ে বড় চাপ ষাট লাখ তুর্কির ভবিষ্যতের সঙ্গে ইসলামকে সমুন্নত রাখা। নইলে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। রোডসের ক্লান্তি আর যুদ্ধের বিভীষিকার কথা ভুলে থাকতে চাইলেন। রক্ত আর লড়াইয়ের বাতাসভর্তি জীবন থেকে একটু মুক্তি চান।
মাহিদেভরানের আগমনের শব্দ পাওয়া গেল। ধীরপায়ে সুলতানের কক্ষের দিকে এসে হাজির হয়েছেন। কুর্নিশ করলেন। কাছে এসে কাফতানে চুমু খেলেন ছোট্ট করে। সুলতানকে কিঞ্চিৎ বিরক্ত মনে হলো।
‘হুজুর আমায় ক্ষমা করবেন। আপনি ফেরার পর থেকে আপনার মঙ্গে দেখা করার জন্য আমি ব্যাকুল ছিলাম। কিন্তু আপনি আমার কোনো খোঁজই নেননি।’
সুলেমান কোনো উত্তর দিলেন না। হয় তো উত্তর দেওয়ার কোনো প্রয়োজনই মনে করেননি। আবার মুখ খুললেন মাহিদেভরান। তার দুই চোখ গড়িয়ে পানি ঝরছে।
‘সুলতান। আমাকে ক্ষমা করুন। আমি যত অন্যায় করি না কেন আপনার ভালোবাসা থেকে আমায় বঞ্চিত করবেন না। আপনি এমন রাগ করে থাকলে আমি বেঁচে থাকতে পারব না।’
বলেই সুলতানের পা জাপটে ধরলেন মাহিদেভরান। এবার একটু গলল সুলতানের মন। মাহিদেভরানকে টেনে ওঠালেন। তারপর একটু কী যেন ভাবলেন সুলতান।
‘ঠিক আছে শান্ত হও মোস্তফার আম্মা। আমি রাগ করিনি। কিন্তু আশা করব কোনো ভুল যেন আর ভবিষ্যতে না হয়। তোমাকে ভুলে গেলে চলবে না, তুমি শাহজাদার মা। সুলতান সুলেমানের স্ত্রী। আমি তোমার সঙ্গে পরে কথা বলব। এখন যাও। মোস্তফাকে সময় দাও।’
পুরোপুরি না হলেও খানিকটা খুশি ঠিক ছুঁয়ে গেল মাহিদেভরানকে। দ্রুত সুলতানের কক্ষ থেকে বিদায় নিলেন।
সুলতান ফেরত গেলেন আগের ভাবনায়। কেন যেন এখন আর মাহিদেভরানের কোনো কিছুই তাকে আগের মতো ছুঁয়ে যায় না। ভালোবাসা বুঝি এমনই। প্রত্যাশার অন্দরে প্রাপ্তির সুবাতাস না থাকলেই পাল্টে যায় সবকিছু।
প্রায় একই প্রসঙ্গ গলিয়ে সামনে চলে এলো হুররেম খাতুনের মায়াভরা মুখখানি। কী বুঝলেন কে জানে হঠাৎই হাঁটা দিলেন হুররেমের কক্ষের দিকে। যদিও ফেরার পর তার সঙ্গে এরই মধ্যে একবার দেখা করেছেন সুলতান, এরপরও তার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছা করছে সুলতানের।
নিঃশব্দে ঘরের ভিতর প্রবেশ করলেন সুলতান। ইশারায় মেয়েটাকে বেরিয়ে যেতে বললেন। হুররেম খাতুন তখন বিছানায় শুয়ে। চোখ দুটো বন্ধ। মেয়েটার দিকে সুলতানের বিমুগ্ধ দৃষ্টি। কী দারুণ লাগছে তাকে। বাদামি চুলগুলো বালিশের বাইরে অগোছালো করে রাখা। বাদামি রঙের সিল্কের জামাটাও চুলের মতো এলোমেলো। চকচক করছে যেন। সব মিলিয়ে হুররেম খাতুনের চেহারাও যেন অন্যরকম দ্যুতি ছড়াচ্ছে।
‘হুররেম...’
সুলতানের মৃদু উচ্চারণেই চোখ খুলে গেল হুররেমের।
‘সুলতান...’
বলেই উঠতে যাচ্ছিলেন তিনি। সুলতান থাকে পুনরায় শুইয়ে দিলেন।
‘তুমি শুয়েই থাক। আমি তোমার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি। তখন তো তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিলাম। তেমন কথা হয়নি।’
‘আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা রাজাদের রাজা। আপনি আমাকে স্মরণ করেছেন।’
‘কিন্তু আমি যে এত দিন বাইরে ছিলাম, তুমি আমাকে স্মরণ করনি?’
‘শুধুই কী স্মরণ?’
একটু আনমনা দেখাল হুররেমকে।
‘দারুণ ভয়ে ছিলাম।’
‘ভয়? কিসের ভয়?’
সুলতান দারুণ ব্যস্ত হয়ে উঠতে চাইলেন। হুররেম মুখ খুলতে গিয়েও কথা ঘুরিয়ে ফেললেন। আয়েশা হাফসার নির্দেশ। সব কথা সুলতানকে এখনই বলার দরকার নেই। সব উনি নিজে ঠিক করে দেবেন। তাই নিজের বিপর্যয়ের কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন।
‘আপনি যুদ্ধে যাবেন আর ভয় না পাওয়ার কোনো কারণ আছে নাকি।’
‘যুদ্ধ তো আমাদের রক্তে মিশে আছে হুররেম।’
‘তা ঠিক। কিন্তু তুষারপাত শুরু হওয়ার পর দারুণ ভয় পেয়েছিলাম। আপনি যদি আর না ফিরতেন তাহলে আমার কী হতো?’
‘কিছুই হতো না। এই যে আমি ফিরে এসেছি।’
মৃদু হাসলেন সুলতান। বাইরে তাকিয়ে ইশারায় মেয়েটাকে ডাকলেন সুলতান। তার আর হুররেমের জন্য খাবার নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন।
মিনিট দশেকের মধ্যে খাবার চলে এলো। সুলতানের প্রিয় কাবাব আনা হয়েছে। আছে মসলা দিয়ে রান্না করা ভেড়ার মাংস, অল্প আঁচের আগুনে পোড়ানো মুরগি এবং বেগুনের মধ্যে ভাত দিয়ে একটা খাবার। সুলতান আর হুররেম দুজনে গপ্পো করতে করতে খেতে লাগলেন। খানিক পরে এলো নোনতা ক্রিমে তৈরি অনন্য স্বাদের মিষ্টান্ন। সঙ্গে বরাবরের মতো বড় গ্লাসভর্তি শরবত। সুলতান নিজেই হুররেমকে খাবার এগিয়ে দিলেন। এই সময়ে হুররেমের একটু বেশি যত্ন-আত্তি করা দরকার। অল্পতেই খাবার শেষ হলো। কিছুক্ষণ পর হুররেমের ঠিক পাশেই বিছানায় গাটা এলিয়ে দিলেন। এরপর হুররেমকে বললেন-
‘আমাদের যুদ্ধ নিয়ে কেউ কিছু বলেনি?’
‘প্রাসাদে কত রকম আলাপ হয়েছে।’
‘কী রকম?’
‘এই যেমন জিতবেন কী জিতবেন না। কী হবে। আরও কত কী।’
‘তাই?’
‘তোমার কী ধারণা ছিল?’
‘আমি জানতাম আপনি ঠিক বিজয়ী হয়ে ফিরবেন।’
‘আচ্ছা।’
মৃদু হাসলেন সুলতান। টুকরে ঘুরে গিয়ে হুররেমের কপালে একটা চুমু এঁকে দিলেন।
‘আপনি যখন রোডস দখল করলেন তখন সবাই অনেক খুশি হয়েছে। সবাই বলাবলি করছিল যে, বিজয়ী ফাতিহর পরে আরেকজন সুলতান এমন স্মরণীয় বিজয়ের স্বাক্ষর রাখল। অনেকের মতে, আপনি নাকি সর্বকালের সেরা অটোমান সম্রাট হবেন। আর এরই মধ্যে আপনি তার প্রমাণ পর্যন্ত রাখা শুরু করে দিয়েছেন।’
‘সে জন্য কিন্তু আমরাও কম কষ্ট করিনি। দামটাও কম চুকাতে হয়নি। আমাদের অনেক সৈন্য হারিয়েছি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ একেবারে কম নয়।’
‘এই ধরনের ক্ষতির ব্যাপারটিও কিন্তু নতুন নয়। চিন্তার কী। আমাদের সেনাবাহিনীর শক্তি কোনো অংশে কম নয়। খুব তাড়াতাড়িই আমাদের সেনাবাহিনী সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেবে।’
‘হুমম।’
সুলতান এসব নিয়ে হুররেমের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন না। আসলে সেনাবাহিনী আর যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পর্কে ঘরে বসে ধারণা করাটা খুবই কঠিন।
‘সুলতান। এসব বাদ দিন না। জয়ীর বেশে ফিরেছেন। এখন আর পেছনের কথা ভেবে কী হবে।’
সুলতানকে স্থির করার চেষ্টা করলেন হুররেম।
‘বাদ বললেই কি আর বাদ দেওয়া যায় হুররেম। সব আমার চোখের সামনেই ঘটেছে। এর আগে কখনই এত বেশি মৃত্যু এত কাছ থেকে দেখিনি। রাতের অন্ধকারেও আমি মৃত সৈন্যদের আর্তনাদ শুনতে পাই। আহত সৈন্যদের নির্বাক চোখের অশ্রু এখনো আমার বুকের ভিতর বিঁধে আছে।’
এবার আর কোনো উত্তর দিতে পারলেন না হুররেম। কেবল ফ্যালফ্যাল করে সুলতানের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। সুলতানও নিশ্চুপ।
মনের ভিতর কত রকম ভাবনা। আসলে যুদ্ধের অমন বিভীষিকা চাইলেই মন থেকে ঝেড়ে ফেলা যায় না।
চলবে... পরবর্তী পর্ব আগামী শনিবার