রবিবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

চলচ্চিত্র কোথায় দাঁড়িয়ে

সংস্কৃতি চর্চায় চলচ্চিত্রের ভূমিকা অন্যতম। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমাদের চলচ্চিত্র দর্শকদের মন জয় করেছিল। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ নিয়মিত ছুটত সিনেমা হলে। কিন্তু কয়েক দশক ধরে চলচ্চিত্র শিল্পে ধস নেমেছে। দর্শক বাড়লেও তারা হলমুখী হচ্ছে না। ঘরে বসে তারা বিকল্প মাধ্যমে সিনেমা দেখছেন। কেউ বলছেন, চলচ্চিত্রের মান নেই, হলের দুরবস্থা, দর্শক-চাহিদা না বুঝতে পারা, শিল্পীদের নিষ্ঠার অভাব আবার ভালো সিনেমা নির্মাণ হলেও রয়েছে পাইরেসি, ভ্যাট-ট্যাক্সের ভার। এসব নিয়ে

বাংলাদেশ প্রতিদিন ও নিউজটোয়েন্টিফোর যৌথভাবে ইডব্লিউএমজিএল কনফারেন্স রুমে গতকাল ‘চলচ্চিত্র কোথায় দাঁড়িয়ে’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। নঈম নিজাম-এর সভাপতিত্বে, সামিয়া রহমান-এর সঞ্চালনায় সেই বৈঠকের চুম্বকাংশ তুলে ধরেছেন— পান্থ আফজাল, তানিয়া জামান, আবদুল কাদের ও সাইফ ইমন  ছবি তুলেছেন : সামির খান। অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করেছে নিউজটোয়েন্টিফোর

 

 

 

 

 

নঈম নিজাম : চলচ্চিত্র নিয়ে আমাদের এক সময় স্বর্ণযুগ ছিল আর এখন নেই, আমি এটা বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি আমাদের আগেও চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে কাজ করতে হয়েছে, এখনো তাই। আশির দশকে ফারুক ভাই সুজন সখী আর অনেক দর্শকনন্দিত ছবির নায়ক। আমরা সে সময় জলজ্যান্ত এই কিংবদন্তিদের সামনে আড্ডা দিতাম। তখন চলচ্চিত্রে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আবহ দুটোই ছিল। এক কথায় তখন চলচ্চিত্রে একটা প্রাণ ছিল। আমার এক বন্ধু অবুঝ মন ছবিটি দেখেছিল প্রায় ২৭ বার। তখন কি প্রতিযোগিতা ছিল না? অবশ্যই ছিল। আসলে প্রতিযোগিতা সব সময়ই ছিল। ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় হল তো বটেই, এর বাইরেও মানুষ ভিসিআর ভাড়া করে ছবি দেখত। আমি মনে করি, প্রতিযোগিতা আর লড়াইয়ের জায়গা সে সময়ও ছিল, এখনো আছে। এক সময় এক এক ধরনের ঝোঁক নিয়ে মানুষের আগ্রহ থাকে। মানুষ বরাবরই ভিন্নতা চায়। আমজাদ সাহেবও কিছু দুর্দান্ত ছবি বানিয়েছিলেন, যা বাংলা ফিল্মকে নিয়ে গিয়েছিল অনন্য উচ্চতায়। আগের সেই দিনগুলো বদলেছে ঠিকই সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে চলচ্চিত্রের ধারাও। আগের দিনের হলের চিন্তায় থাকলে হয়তো উন্নতি সাধন হবে না। আমি মনে করি, দেশের বড় শপিং মলগুলোর মতো হলগুলোও বাড়ানো উচিত। আমাদের বাইরের দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। আমাদের চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে অনেক দূর। এ জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাও বড় ভূমিকা পালন করবে। বাণিজ্যিকীকরণের অভাব ও সঠিক বিনিয়োগের দিকটিও এখানে দেখার বিষয়। আমরা ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ আপনাদের সঙ্গে আছি এবং থাকব।

 

ফারুক : আসলে চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলার শুরুতেই আসে সেন্সর বোর্ড। কেননা ছবি তৈরির পর প্রথম পদক্ষেপই থাকে সেন্সর বোর্ডের। আমাদের অতীতে এমনও ছবি আছে যা আগামী একশ বছরেও মানুষ ভুলতে পারবে না। এগুলোর পেছনের অনেক গল্পও ছিল। রয়েছে তৈরির সময়কার পরিশ্রম, ভালোবাসা আর প্রতিযোগিতার কথা। অনেকেই বলেন, বাইরের সিনেমা দেখানো বন্ধ করেন। বন্ধ করার প্রশ্ন কেন আসবে? বলিউড, হলিউড, জাপানি, চাইনিজ, ইরানি ছবি সারা পৃথিবীতে চলে। এগুলো দিয়ে আমরা হিসাব করি, প্রতিযোগিতায় নামি। ওদের চেয়ে ভালো মানের ছবি তৈরি করি। তবেই তো বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্ববাসী চিনবে।

 

ইফতেখার নওশাদ : আমার মনে হয়, হল মালিকদের সঙ্গে প্রযোজকদের দূরত্ব হয়নি। বর্তমানে সিনেমার মালিকরা বুকিং এজেন্টদের কাছে ছেড়ে দিয়েছে। এখনকার প্রযোজকরা ভালো মানের সিনেমা দিতে পারছেন না বলে হল মালিকরাও খুব একটা সুবিধাজনক ব্যবসা করতে পারছেন না। 

 

 

 

মুশফিকুর রহমান গুলজার : আসলে হল মালিকদের সঙ্গে প্রযোজকদের যোগাযোগের কোনো সুযোগ হয় না। এর ফলে মাঝ পথে বুকিং এজেন্ট বাড়তি মুনাফা লুফে নেন হল মালিকদের কাছ থেকে আর প্রযোজকদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।

 

সুদীপ্ত দাশ : মূলত বুকিং এজেন্টদের কাজটা অনেক প্রাচীন এবং সম্মানিত ব্যক্তিরা আগে এ কাজগুলো করে থাকতেন। কিন্তু বর্তমানে যারা এই কাজটি করছেন তারা বেশির ভাগই কোনো না কোনোভাবে প্রযোজকদের অফিসের কর্মকর্তা কিংবা এজেন্ট হিসেবে প্রযোজকদের কাছে আসেন। যারা বেশির ভাগই অসৎ পন্থা অবলম্বন করে থাকেন।

 

 

 

ছোটকু আহমেদ : চলচ্চিত্র দাঁড়ায় একটি গল্পের ওপর। চলচ্চিত্রের গল্পগুলো তখন স্বর্ণযুগের মধ্যে ছিল, যার জন্য চলচ্চিত্রগুলো খুব ভালো চলত। বুকিং এজেন্ট এসব কোনো ঝামেলা ছিল না। আসলে গল্প ভালো হলে সিনেমা মার্কেট পাবে এটাই স্বাভাবিক। ভালো স্ক্রিপ্ট ও ডিরেক্টর না থাকার কারণে অনেক সময় এই ঝামেলার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ভালো মানের সিনেমা দেখতে দর্শক যে হলে যাবে তার প্রমাণ মিলেছে আয়না বাজির মতো সিনেমাতে। বর্তমানের ডিরেক্টরগুলোর অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার অভাবের কারণে এ সমস্যাটা বেশি হচ্ছে। টেলিফিল্ম বা নাটক বানিয়েই তারা চলচ্চিত্রের মতো বিশাল প্রজেক্টে কাজ করছে।

 

অমিতাভ রেজা : চলচ্চিত্র হলো একটি জাতির সৃজনশীল বহিঃপ্রকাশ। আমরা যারা সিনেমা নির্মাণ করছি সেখানে সংস্কৃতি আছে কি না দেখতে হবে। আসলে সংস্কৃতির চর্চা যারা করেন তাদের সঙ্গে আমাদের ওঠাবসা করতে হবে। না হলে আমরা গল্প পাব কোথা থেকে। বাংলাদেশে যে পরিমাণ গল্প রয়েছে তা নিয়ে আমরা ছবি বানাতে চাই কিনা সেটাই হলো মূল কথা। আর একটা কথা ডিজিটাল সমস্যা গোটা পৃথিবীর সমস্যা। বর্তমান যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। বর্তমান তরুণ সমাজ এত স্মার্ট, তারা যা কিছু খুব তাড়াতাড়ি ধরতে পারে।

 

বদিউল আলম খোকন : গল্প এবং পরিচালক দুটোর কোনোটারই বাংলাদেশে অভাব নেই। অভাব আছে কেবল আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির। আগেরকার প্রযোজকরা যখন ছবি নির্মাণ ও অর্থায়ন করতেন তারা ডিরেক্টরদের কাছে প্রথম শর্ত হিসেবেই রাখতেন একটি সুন্দর গল্প। যার মাধ্যমে আমার ব্যবসা সফল হবে। কিন্তু বর্তমানের প্রডিউসাররা আর সেই ধারাতে নেই। এখন ছবি তৈরি নির্ভর করছে প্রডিউসারের ওপর। এখানে মেধাসম্পন্ন ডিরেক্টর ও গল্প কোনোটারই অভাব নেই।

 

 

ওমর সানী : আমাদের চলচ্চিত্রে আসলেই কোনো শিল্পী সংকট নেই। ৯০ দশকের দিকেও শুনেছি সিনেমা চলে না। নানা সমস্যায় এফডিসি। বিষয়টা হচ্ছে, তখন কিন্তু সব ছবিই কমবেশি ব্যবসা করত। কিছুটা ক্ষতি হলেও প্রডিউসারদের লগ্নিকৃত টাকা উঠে আসত। সমস্যা তখনো ছিল এখনো আছে হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে। সবকিছুকে ঠেলে ভালো গল্পের মিশেলে ছবি তৈরি করা হলে অবশ্যই সিনেমা ব্যবসা সফল হবে। বর্তমানে যে ছবি তৈরি করা হয় তা খুব একটা ভালো গল্পের নয়। ভালো গল্প দাঁড় করাতে না পারলে হাজার কোটি টাকা খরচ করলেও কোনো লাভ হবে না। আমাদের সিনেমা হলের পরিবেশও খুব একটা সুবিধের নয়। এগুলোও নজরে আনা উচিত।

 

মুশফিকুর রহমান গুলজার :  আমি বলব শিল্পী সংকট আছে।  বর্তমানে আর সেই ভ্যারাইটিজ হিরোর অপশনটা নেই। এখন এক শিল্পীতে মজে থাকতে চান প্রডিউসাররা। যার ফলে বর্তমানে শাকিব খানের ছবি আছে বললে হল মালিকরা ছবি চালাতে চান অন্যথায় তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। বাইরের দেশগুলোতে ই-টিকিটের ব্যবস্থা রয়েছে, যা আমাদের এখানে নেই। আমরা ঢালাও কোনো অভিযোগ করি না কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে টিকিটের কারণে ব্যবসা সফল হয় না।

 

 

কাজী হায়াৎ : বলা হচ্ছে, যে শিল্পী সংকটের কথা তা এখনো আছে। ১০ লাখ টাকা দিয়েও তাদের শিডিউল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে আবার ১২ লাখ টাকাও চাচ্ছেন।

 

 

 

 

ফারুক : আসলে শিল্পীর সংকট বলে কোনো সংকট পৃথিবীতে নেই। চরিত্রই বলে দেবে কোন শিল্পী প্রয়োজন। যাকে নিয়ে চরিত্র তৈরি করা হবে তার শিডিউল ম্যানেজ করতেই হবে।

 

ছোটকু আহমেদ : বাংলাদেশে অবশ্যই শিল্পী সংকট আছে।  সিনিয়র কোনো শিল্পীর কাছে বড় ভাই চরিত্রে অভিনয়ের অফার করলে বলে নায়কের পার্ট দিতে। আমার মনে হয় তাদের মেনটালিটির পরিবর্তন দরকার।

 

আমজাদ হোসেন : আমরা গাছ রেখে শাখা-প্রশাখা নিয়ে কথা বলছি। তাই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। প্রথমে বলব, বিদেশি ছবির নকল বানাতে বানাতে আমাদের বাংলা ছবির নিঃশ্বাস, বিশ্বাস ও আবেগ ভুলে গেছে। যখন রূপবান হয় তখন টেকনিক্যাল প্রবলেম দেখিনি কেউ। গ্রামনির্ভর এই দেশ শুধু ঢাকার ওপর নির্ভর করে নয়, এখনকার সিনেমায় কি প্লে হচ্ছে, কোথাকার গল্প, কোথাকার সিন দেখানো হয়, তা আমাদের অপরিচিত। আমি বারবার বলব এটি বাংলাদেশ। এখানে চরিত্র আলাদা, এখানে ঘটনা আলাদা। এখানকার গল্প আলাদা, এখানকার ড্রামা আলাদা। এখানকার গান আলাদা।

 

ওমর সানী : অনেক সময় বলা হয় এই আর্টিস্ট ছাড়া ছবি চলবে না। প্রযোজকরা নায়ক-নায়িকা নির্ধারণ করে দেন।

 

মুশফিকুর রহমান গুলজার :  ১০ বছরে, পাঁচ বছরে এমন একটি ঘটনা ঘটতেই পারে। মেকিং অ্যাটিচিউড আলাদা। তাই অনেক সময় ব্যবসা সফল হয় না। ধারা ভিন্ন বলে কোনো কথা নয়, যেমন মনপুরা ছিল ট্রেডিশনাল ধারার। সেখানেও প্রেম ছিল, গান ছিল, নায়কের অবনতি ছিল। এমন একটি ছবি যদি দর্শক নিতে পারে তাহলে আমরা বলতেই পারি দর্শকের মনের মতো হলে অবশ্যই সিনেমা নেবে।

 

ওমর সানী : ভালো গল্প লাগবে, ভালো আর্টিস্ট লাগবে, ভালো টেকনিশিয়ান লাগবে, তবেই ভালো কিছু করা সম্ভব। কিছু নির্মাতা সিনেমা বানান গুলশান-বনানীর জন্য।

 

ফারুক : কোনটা আর্ট আর কোনটা কমার্শিয়াল তা পৃথিবীর কোনো ইতিহাসে লেখা নেই। ফিল্ম নিজেই একটি আর্ট।

 

আবু সাইয়িদ : অজ্ঞাতনামাও ভালো ছবি, আয়নাবাজিও ভালো ছবি। কিন্তু নির্মাণশৈলীর ভিন্নতার কারণে অজ্ঞাতনামা ব্যবসাসফল হয়নি।

 

অমিতাভ রেজা : কোনো ছবি যদি ব্যবসাসফল হয়, তবে সেটা ভালো ছবি, কোনো ছবি যদি ব্যবসাসফল না হয় সেটা বাজে ছবি, তা মানতে রাজি নই। সিনেমার সফলতা সময়ই বলে দেয়। অজ্ঞাতনামাও খুব ভালো। কিন্তু তা বেশি ব্যবসাসফল হয়নি। এখানে যদি মার্কেটিং-এ ভালো সাপোর্ট পেত তবে ব্যবসাসফল হতো। এটি বড় একটি কারণ। এটা যখন ইউটিউবে ফাঁস হয় তখন অসংখ্য মানুষ সেটা দেখে।

 

আমজাদ হোসেন : রাজ কাপুর জোকর নামের একটি ছবির জন্য পাঁচ বছর পর্যন্ত মার্কেটিং করে, তবু তা ব্যবসাসফল হয়নি। সেটা সুপার ফ্লপ হয়। তবে পাবলিসিটিও মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণ। কোনো পত্রিকায় তেমন কোনো তথ্য প্রকাশ হয় না। জনগণকে জানানো হয় না। তাই ছবি অনেক সময় দর্শক পর্যন্ত পৌঁছায় না।

 

ফারুক : আমার নিজের অভিনীত ঝিনুকমালা ছবিটি প্রথমে জানতাম ফ্লপ। আমাকেই ছবিটি কিনে নেওয়ার কথা বলা হলো। তখন আমি তো এমন ফ্লপ ছবি নেব না। সরাসরি নিষেধ করলাম। পরে একজন এসে ছবিটি পরিচালকের কাছ থেকে নিতে চাইলেন। পরিচালক ছবির জন্য টাকা চাইতেও লজ্জা পেলেন। বললেন ছবির ৩০ শতাংশ লাভ আমাকে দিও। পরবর্তীতে সেই ছবি যখন সিনেমা হলে ছাড়া হলো তার টাকা রাখার জায়গা পেল না দুজনে। তাই ছবি প্রকাশের আগে বলা যায় না কোনটি দর্শক নেবে আর কোনটি নেবে না। এ জন্য দরকার ছবি প্রকাশের সুযোগ। আর সিনেমায় ডিজিটালকে মানতে পারে না। তিনি মনে করেন ছবির আবেগ প্রদর্শনে এই সিস্টেম অনেকটাই ব্যর্থ। আগে যেমন নেগেটিভ কেটে জোড়া দেওয়া ইত্যাদি করা যেত। এখন তার সুযোগ নেই। অনেক পরিচালক ও তারকার মিউজিক সেন্স নেই। তারা ঠিকমতো এই আবেগগুলোকে প্রদর্শন করতে পারেন না। এখানে ভালো কিছু করতে চলচ্চিত্রের গুণের ব্যাপার, জ্ঞানের ব্যাপার। এখানে কারও কিছু করার নেই। এখানে দর্শক-শ্রোতার আবেগের জায়গায় ঢুকতে হবে। তা না হলে কিছুই সম্ভব নয়।

 

অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড : শুধু মনে মনে বলি এই সমস্যা সেই সমস্যা। আমরা চলচ্চিত্র নির্মাণ করি কিন্তু প্রদর্শন করব কোথায়? এর ওর হাত পা ধরতে হয়। কারও কাছে সিনেমা নিয়ে গেলে বলেন তিন মাস পর যোগাযোগ করবেন। এই পরিস্থিতিতে পরিচালক প্রযোজকের দূরত্ব তৈরি হয়। ছোটবেলায় পরিবার পরিজনদের সঙ্গে গিয়ে সিনেমা দেখেছি। খুব উত্ফুল্লের সঙ্গে সবাই মিলে নাইট শো দেখে বাড়ি ফিরেছি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মতো মহকুমা শহরের রাস্তায় রাতেও কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু আজ দেখা যায় নিরাপত্তার অভাবে মেয়েরা হলে গিয়ে সিনেমা দেখে না।

খালি সিনেমা হচ্ছে না, এই কথা বলি। সিনেমার গল্প পাল্টেছে। ধরন বদলেছে, তা মানতেই হবে। আজকের সময়ে পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে আমরা ছবি বানাতে শিখেছি। তা প্রদর্শনের সুযোগ দিন। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে আমাদের দেশের কি ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে তা বলা হয়েছে অন্তর্ধান ছবিতে। এই গল্প দিল্লি ফেস্টিভ্যাল, কলকাতা ফেস্টিভ্যালে যখন নেওয়া হয় তখন এটা নিয়ে স্টেটমেন্ট লিখল টাইমস অব ইন্ডিয়া, আনন্দবাজার পত্রিকা। অথচ বাংলাদেশিরা তা দেখতে পাইনি। আমাকে এই ছবি দর্শকদের দেখাতে হলে ধরনা দিতে হবে সবার কাছে। টেলিভিশন চ্যানেলে যেতে হবে। প্রযোজকদের টাকা দিতে হবে। টিভি মিডিয়ায় দিয়ে বলব এটা টেলিফিল্ম। অথচ সিনেমার ফরম্যাটে বানিয়ে টিভির ফরম্যাটে চালাতে হচ্ছে।

 

ইফতেখার নওশাদ : আসলে আমরা সিনেমা চালাতে প্রতিবন্ধকতা করি না। আমাদের হাতে অন্য সিনেমা থাকলে একটু বিলম্ব হয়। তবে সিনেমার স্ট্যান্ডার্ড ঠিক না থাকলে টিভিতে যায়।

 

শহীদুল্লাহ ফরায়জী :  চলচ্চিত্র না চললে সংস্কৃতি সংকট তৈরি হবে। চলচ্চিত্রেই জীবনের সামগ্রীকতার প্রতিফলন দেখা যায়। সবাই বলছেন আমাদের সিনেমা সংকটে আছে। রাষ্ট্রের দায় হচ্ছে সিনেমা হলগুলো নির্মাণ করা। লজ্জার বিষয় যেখানে আমাদের দেশে ১২০০ সিনেমা হল ছিল, এখন সেখান থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২০০/৩০০ সিনেমা হল। আমাদের সিনেমা হলগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সিনেমা হল তৈরি হতে পারে। অন্যান্য ক্ষেত্র যেমন সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তেমনি এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ আমরা যদি সংস্কৃতিই টিকিয়ে রাখতে না পারি তবে রাষ্ট্র দিয়ে কী করব।

 

অনুপম হায়াত : চলচ্চিত্র এখন ক্যান্সার আক্রান্ত। আমি সংকটগুলোকে নির্দিষ্ট করার চেষ্টা করেছি। শুরুতেই আছে প্রযুক্তিগত সংকট। এরপর আছে প্রদর্শনগত সংকট। সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মতো হয়ে যাচ্ছে। রুচিগত সংকটও আছে। পুঁজি ও প্রযোজনা সংকটের পাশাপাশি রয়েছে বিষয়বস্তুর সংকট। নির্মাতার মেধা সংকট। আমরা কী নকল চলচ্চিত্র বানাব নাকি দেশীয় চেতনা তুলে ধরব, এটা একটা বিষয় আছে। আবার আছে প্রচারজাত সংকট। এটিও একটি বিশাল ব্যাপার। এখন চরচ্চিত্রের প্রিমিয়ার শো হয় না।

 

 

সামিয়া রহমান : এখন প্রিমিয়ার শো হয়তো।

 

 

 

 

অনুপম হায়াত : আগে ঘোড়ার গাড়িতে করে সপরিবারে সিনেমা দেখতে যাওয়া হতো। এখন আর তা হচ্ছে না। তার ওপর টিকিটের দাম ২৫০ টাকা। আবার সিনেমা হল কম হওয়ায় সিনেমা দেখতে অনেক দূর যেতে হচ্ছে। আরেকটি সমস্যা হলো পাইরেসি। এসব সমস্যা নিয়ে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করে তার সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে।

 

কাজী হায়াৎ : আমার ছবি পাইরেসি হওয়ার পর ডিসি এবং ডিবির কাছে গেলাম। কারণ আমার ছবিটি তখন ক্যাবল লাইনে চলছে। কপিরাইট ছিল না বলে তারা কিছুই করতে পারেনি। আজ সারাবিশ্ব্বে সিনেমার অবস্থা খুবই নাজেহাল। বোম্বেতেও পাইরেসি সমস্যার প্রকট। মানুষের বিনোদন মাধ্যমে পরিবর্তন আসছে। মানুষ এখন ক্রিকেট নিয়ে বেশি বিনোদিত হয়। আইপিএর, আইসিএল চলার সময় চলচ্চিত্র মুক্তি পায় না। তা ছাড়া সিনেমা হলগুলোতে সিকিউরিটির অবস্থাও খুব নাজুক।

 

ওমর সানী : আমাদের এই চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আর শিল্পীরা যা খুশি তা করবেন আর আপনারা পরিচালকরা মেনে নেবেন কেন? আবার প্রযোজকরাই বা কেন মেনে নেবেন?

সামিয়া রহমান : কিন্তু বলা হচ্ছে, প্রযোজকরা ডমিনেট করছেন।

 

ওমর সানী : হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। প্রযোজকরাই ডমিনেট করছেন।

 

ফারুক : ছবিতে মূল হচ্ছে স্টরি, স্ক্রিন প্লে, শট ডিভিশন, ডায়ালগস এসব নিয়ে বানানো হয় ছবি। অর্থলগ্নি কে করল সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

 

সামিয়া রহমান : আমাদের চলচ্চিত্রের সমস্যাগুলো আগে চিহ্নিত করতে হবে।

 

মুশফিকুর রহমান গুলজার :  এখন এমন এমন ছবি আমাদের সেন্সর বোর্ডে আসে যেগুলোর প্রযোজকই হচ্ছেন নায়ক আর নায়িকা হচ্ছেন তার বান্ধবী। এরা কালের গহ্বরে হারিয়েও যাচ্ছে।

 

আমজাদ হোসেন : ৫০ বছর যাবৎ কেন হলের মালিকদের সঙ্গে বসেন না?

 

ফারুক : এটা ভুল। সম্পূর্ণ ভুল। আমি ছিলাম। আমার জীবন আমি নষ্ট করে দিয়েছি এই ইন্ডাস্ট্রির জন্য।

 

আমজাদ হোসেন : তখন বিরাট একটা আন্দোলন হয়েছিল।  কিন্তু এরপর আর তা হয়নি। এখন প্রযোজক সমিতি ও পরিচালক সমিতির সবাইকে বসতে হবে হল মালিকদের সঙ্গে। এই তিনে মিলে সরকারের কাছে যেতে হবে সমস্যার উত্তরণে।

সামিয়া রহমান : আমি সংকট ও উত্তরণের পথগুলো জানতে চাই—

 

এস এ অলিক : সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কীভাবে উত্তরণ করা যাবে। এখানে মেধা সংকট বলা হয়েছে। কিন্তু মেধা সংকট আমাদের নির্মাতাদের মধ্যে নেই। মেধা সংকট আমাদের শিল্পীদের মধ্যেও নেই। মেধা সংকট আসলে আমাদের ডিস্ট্রিবিউটরদের মধ্যে রয়েছে। একজন প্রযোজক ভালো ছবি নির্মাণ করতে গেলে একজন ভালো পরিচালক খুঁজে বের করবেন। আর অন্যদিকে ওই পরিচালক একজন ভালো লেখক খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন। একটি লেখক যখন একটি ভালো গল্প খুঁজে বের করবেন, তখন কিন্তু এর জন্য একটি ভালো চরিত্র দাঁড় করাবেন।

 

সামিয়া রহমান : তাহলে কি আমরা বলতে পারি আমাদের চলচ্চিত্র জগতে প্রচুর নির্মাতা রয়েছেন, অনেক ভালো লেখক রয়েছেন কিন্তু আমরা তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারছি না?

 

এস এ অলিক : ইদানীং অনেকেই সকালবেলা এসে বিকালেই ছবি নির্মাণ করছেন। দর্শক কী চাচ্ছে, কোন সিনেমা হলে কী ধরনের দর্শক যেতে চায় এসব স্টাডি করে ছবি নির্মাণ করা উচিত। এসব কিন্তু আমাদের প্রযোজক, পরিচালকরা ভাবছেন না।

 

দেবাশীষ বিশ্বাস : আসলে চলচ্চিত্র এখন দাঁড়িয়ে নেই, একেবারে শুয়ে পড়েছে। এখন হিরো-হিরোইন উভয়ই প্রযোজক ধরে আনেন। প্রযোজক নিয়ে আসেন এবং প্রযোজক তার সম্পূর্ণ প্রভাব পরিচালকদের ওপর চাপান। বলছেন তাকে নাও, ঐটা কর, অমুক ধরনের ছবি বানাতে হবে।

 

 

সামিয়া রহমান : তাহলে অ-তারকারাই ছবি করছেন?

 

দেবাশীষ বিশ্বাস : তারকারাই টিকে আছেন। অ-তারকারাই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছেন। এখনো সময় আছে আমাদের কাজ করতে হবে, হাল ধরতে হবে। আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করলে এই ভালোবাসার স্থানটি আবার যৌবন ফিরে পাবে। ভালোর দিকেই যাবে আশা করছি।

 

সামিয়া রহমান : দর্শকদের রুচির কথা বলছিলেন...

 

ছটকু আহমেদ : একেকজনের রুচি একেক রকম। যদি দর্শকদের রুচি আর আমাদের রুচির মধ্যে মেল বন্ধন করতে পারি তাহলেই ছবিটি সুপারহিট হচ্ছে।

 

মুশফিকুর রহমান গুলজার :  আমাদেরকে র‍্যাব সাহায্য করছে। পাইরেসি সমস্যা র‍্যাবের মাধ্যমে অনেকটাই কমেছে। আইন ঠিকমতো প্রয়োগ হচ্ছে না। আসলে সবার সচেতনতা দরকার। আইন করে সব সময় সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। যারা হল চালান তারাই মেশিন দেবেন। কিন্তু হচ্ছে উল্টা। বাংলা চলচ্চিত্র এখন কোমায় চলে গেছে। সেখান থেকে তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। হল মালিকদের দায়িত্ব আছে। সে ভূমিকারও স্বীকৃতি দিতে হবে।

 

বদিউল আলম খোকন : হল মালিকগুলো প্রযোজকদের প্রাপ্য সঠিকভাবে মিটিয়ে দিক, তাহলেই হবে। সকাল বিকাল উদ্ভাবিত প্রযোজক নয়, পুরো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে এককেন্দ্রিক করতে হবে। এখানে সরকারের সহায়তার হাত এগিয়ে না এলে হবে না। বর্তমানে আসা ডিজিটাল মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে আমাদের চলচ্চিত্রকে সামনের দিকে নিতে হবে। এ জন্য সেন্ট্রাল সার্ভারের মাধ্যমে চলচ্চিত্রকে নির্মাণ ও প্রদর্শন করা হয় তাহলে পাইরেসি থেকে রক্ষা পাব। এতে প্রযোজকের পুঁজির নিশ্চয়তা দিতে পারব, তার লাভও দিতে পারব।

 

ওমর সানী : সমাধান চাইলে শিল্পী সমিতি, পরিচালক সমিতি, প্রযোজক সমিতি সবাই এক হয়ে শক্ত আইন গঠন করে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

কাজী হায়াৎ : বাংলাদেশে যে সিস্টেমে সিনেমা প্রদর্শিত হয় তা বিশ্বের কোথাও হয় না। সেখানে ডিস্ট্রিবিউটাররা সিনেমা হল ভাড়া নিয়ে সিনেমা চালায়। সরকার বিনোদন কর তুলে নিয়েছে। অথচ সিনেমা হলের টিকিটে দেখেন করের কথা উল্লেখ আছে।

 

শহীদুল্লাহ ফরায়জী : প্রতিটি শপিং মলে সিনেমা হল থাকতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিটি উপজেলায় সিনেপ্লেক্স থাকতে হবে।

 

অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড : নির্মাতাদের হল মালিকদের সঙ্গে একটি ভালো সম্পর্ক করতে হবে। ছবি প্রদর্শনের জায়গাও তো হল। অনুপম হায়াৎ : আমাদের সমস্যা সমাধানে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বশেষ আশ্রয়স্থলও সরকার। এফডিসি করছে সরকার। চলচ্চিত্রকে রক্ষাও করতে পারে সরকার।

 

দেবাশীষ বিশ্বাস : তিন পক্ষকে মিলে এক হয়ে সরকারের কাছে যেতে হবে। তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

 

আবু সাইয়িদ : সরকার ছাড়া এই সংকট দূর করা সম্ভব নয়। আমাদের দায়বদ্ধতাও বাড়াতে হবে। 

 

ফারুক : সরকারের প্রতি এসব আবেদন নয়, আমাদের গুণ প্রকাশ করে উত্তরণ করতে হবে।

মুশফিকুর রহমান গুলজার : সম্মিলিতভাবে সবাইকে এগিয়ে এসে একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যারা কাজের জন্য বেশি সময় দেয়, কাজ নিয়ে ভাবে, গবেষণা করে তাদেরকে সিনেমা নির্মাণে আনতে হবে।

আমজাদ হোসেন : সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।

সর্বশেষ খবর