শনিবার, ১১ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধারাবাহিক উপন্যাস

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব ৩০

রণক ইকরাম

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব ৩০

মুসলিম শাসকদের মধ্যে যেমন শীর্ষে, তেমনি পৃথিবীর ইতিহাসেও অন্যতম সেরা শাসক তিনি। সুলতান সুলেমান খান। অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান। সুলতান সুলেমানকে নিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে আলোচিত-সমালোচিত টিভি সিরিয়াল মুহতাশিম ইউজিয়েল। আমাদের এ উপন্যাসের ভিত্তি সেই টিভি সিরিজ বা উপন্যাস নয়। মূলত ইতিহাসের নানা বইপত্র ঘেঁটে সুলতান সুলেমানের আমলটি তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতিহাসাশ্রয়ী এ উপন্যাসের মূল ভিত্তি অটোমানদের ইতিহাস। বাকিটুকু লেখকের কল্পনা। উপন্যাসের শুরুর দিকে যুবরাজ সুলেমানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন পাঠক। সিংহাসনে তখন সুলেমানের বাবা সুলতান প্রথম সেলিম। সুলতান সেলিমের সর্বশেষ বিজয়, অসুস্থতা ইত্যাদি পথপরিক্রমায় অটোমান সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন সুলেমান খান। এর মধ্যেই হেরেম সংস্কৃতি, প্রাসাদ, প্রশাসনসহ নানা দিক উঠে এসেছে। সুলেমান খানের ক্ষমতা গ্রহণের পর নতুন সূর্যোদয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করে অটোমান সাম্রাজ্য। সে যাত্রায় পীরে মেহমুদ পাশাকে স্বপদে বহাল রেখে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন সুলতান। সবার প্রত্যাশার বাইরে পারগালি ইব্রাহিমকে বানিয়েছেন নিজের খাসকামরা প্রধান। সুলেমান রোডস অভিযানে সাফল্যের পর ফিরে এসেছেন। হুররেম খাতুন সন্তানসম্ভবা। পদ হারাতে চলেছেন পীরে পাশা।  রকমারির প্রতি শনিবারের এ বিশেষ আয়োজনে আজ ছাপা হলো ৩০তম পর্ব।

 

 

ইব্রাহিম নিশ্চুপ। সুলতানের কথার কোনো জবাব দিলেন না।

‘কী হলো ইব্রাহিম? বলো কাকে বানানো যায় প্রধান উজির?’

‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না সুলতান। আপনিই বরং বলুন।’

‘কেন তোমার কোনো প্রস্তাবনা নেই?’

‘আমি পীরে পাশার কথা ভাবছি সুলতান।’

‘তাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। উনাকে আমি মিসরের গভর্নর বানিয়ে পাঠিয়ে দেবো।’

‘ওহ!’

ইব্রাহিমের মনের ভেতর নানা রকম চিন্তা ঢেউ খেলাচ্ছে। সুলতানের চোখজুড়ে রাজ্যের রহস্য যেন। কী চাইছেন সুলতান?

‘আমি বলি কী.. তুমিই বরং প্রধান উজির হয়ে যাও। উজিরে আজম পারগালি ইব্রাহিম। হা হা হা।’

শব্দ করে হাসলেন সুলেমান। সুলতান খুব কমই এমন শব্দ করে হাসেন। তাই ইব্রাহিম ঠিক বুঝতে পারলেন না সুলতান রসিকতা করছেন, নাকি সত্যি সত্যি তাকে উজির বানাতে চাইছেন। সুলতানের দিকে কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন তিনি।

‘কী হলো ইব্রাহিম? পারবে না আমার প্রধান উজির হতে?’

‘কিন্তু হুজুর, আমি তো ভিনদেশী। আমি কী করে এত বড় অটোমান সাম্রাজ্যের প্রধান উজির হবো? তাছাড়া আরও অনেক উজির আছেন যারা দিনের পর দিন অটোমানদের সেবা করে গেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ উজিরে আজম হওয়ার কথাও ভেবেছেন নিশ্চয়ই।’

‘তাদের কথা ভাবার দরকার নেই।’

‘কিন্তু জাঁহাপনা, আমাকে খাস কামরা প্রধান বানানোর পরও রাজসভায় অনেক কথা হয়েছে। এবার বলছেন উজির হতে! তাহলে তো আরও ঝামেলা বেধে যাবে।’

‘রাজসভার কথা কখনোই থামবে না। সেটা ভেবে সুলতান সুলেমানের চিন্তা পাল্টে যাবে না। আমি যা চাই তা আদায় করে নিই। আর যেটা পাওয়ার নয়, সেটা আমি কখনোই পেতে চাই না। আমাকে তো তুমি চেনোই ইব্রাহিম। আচ্ছা, তুমি কী ভয় পাচ্ছো ইব্রাহিম?’

‘অনেকটা!’

ইতস্তত করছে পারগালি। এমন অদ্ভুত মুহূর্তের মুখোমুখি এই জীবনে আর কখনোই হয়নি সে।

‘আমি তো ভেবেছিলাম তুমি অনেক খুশি হবে। তা না, উল্টো অমন ভয় পেয়ে গেলে তুমি।’

‘না মানে...’

‘ভয়টা কিসের, পারগালি?’

‘মৃত্যুর।’

‘মৃত্যুর?’

‘জী।’

‘কেন? কাকে?’

‘আপনাকে হুজুর। কারণ প্রধান উজির সবসময় মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকেন।’

এবার চমকে উঠলেন সুলতান সুলেমান। তিনি যেভাবে সরল অঙ্ক কষেছেন, বিষয়টা কিন্তু অতো সরল নয়। ইব্রাহিমকে প্রধান উজির করার পরই একমাত্র ছোটবোন হেতিজা সুলতানকে তার হাতে তুলে দিতে চাচ্ছেন সুলতান। কিন্তু অটোমানদের ইতিহাস বলছে এ সাম্রাজ্যের উজির হওয়া মানে মৃত্যু পরোয়ানা হাতে নিয়ে নেওয়া। সুলেমানের বাবা সেলিম খানের রাজত্বকালে আটজন প্রধান উজিরের প্রাণদণ্ড দিয়েছিলেন। এসব সুলেমানের অজানা নয়। এবার উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ইব্রাহিমের কাঁধে হাত রেখে মৃদু চাপ দিলেন।

‘আমি সুলতান সুলেমান। কথা দিচ্ছি আমার শাসনে তুমি তেমন কোনো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবে না।’

ইব্রাহিম ঘুরে দাঁড়ালেন। আবেগে আপ্লুত হয়ে সুলতানের হাতে চুমু খেতে যাবেন তখনই সুলতান উল্টো তাকে জাপটে ধরলেন। ইব্রাহিমের চোখে খুশির ঝর্ণাধারা। টের পেলেন সুলতান।

‘সে কী পারগালি। কাঁদছো নাকি?’

‘নাহ! কই?’

চোখে অশ্রু নিয়েও হাসি হাসি মুখ করার চেষ্টা করলেন পারগালি।

‘আমি চাই তুমি সারা জীবন এমন করেই আমার পাশে থাক। তোমার মতো এমন একজন বিশ্বস্ত সঙ্গী থাকলে আমি সারা পৃথিবী জয় করতে পারব ইব্রাহিম।’

‘আমায় দোয়া করুন সুলতান। আমার রক্তের শেষবিন্দু থাকা পর্যন্ত যেন আপনার বিশ্বাস ধরে রাখতে পারি। যে দায়িত্ব আপনি আমায় দিলেন, মহান আল্লাহ যেন সফলভাবে সেটি পালনের শক্তি দেয়।’

‘ইনশাআল্লাহ।’

 

সদ্য শুরু হওয়া নতুন গ্রীষ্মের অলস পড়ন্ত বিকাল। প্রাসাদের কার্নিশে বাকবাকুম ডেকে চলছে কতগুলো পোষা কবুতর। দূর আকাশে পাটে বসেছে সূর্য। গোধূলির আলোয় চকচক করছে মসজিদের গম্বুজ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনজিলার সঙ্গে কথা বলছেন বালিদ সুলতান আয়েশা হাফসা। কত কত ভাবনার দোল!

‘বুঝলে মনজিলা, মাঝে মাঝে রূপের সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধি থাকাটা খারাপ না।’

‘কিন্তু সুলতানা, হুররেম খাতুনতো একটা কথাই বারবার বলছে।’

‘কী কথা?’

‘সে ঘোর সন্দেহে আছে। তার নাকি সন্তানের মুখ দেখার সৌভাগ্যই হবে না। তাকে নাকি মেরে ফেলা হবে।’

‘ভয়ে বলছে? নাকি এটাও তার একটা চাল?’

‘ভয়ও হতে পারে আবার চালও হতে পারে। ওকে বোঝা আসলেই অনেক দায়।’

‘এখন শেষ সময় এসে গেছে। ক’দিনের মধ্যেই শাহজাদা আসবে। তোমাকে চোখ কান খোলা রাখতে হবে মনজিলা।’

‘অবশ্যই সুলতানা। আপনার নির্দেশনা মতোই সব করছি।’

‘তাহলে আরেকটা কাজ কর।’

‘কী?’

‘হুররেম খাওয়ার আগে কোনো এক দাসীকে দিয়ে খাবার পরখ করিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা কর। পোশাক পরার আগেও তাই যেন করা হয়। যেমনটি সুলতানের ক্ষেত্রে করা হয়। কারণ পোশাকেও বিষ মাখিয়ে রাখতে পারে কেউ। সবাইকে বলে দিও এ আমার নির্দেশ। এর যেন হেরফের না হয়।’

চোখ মুখের দৃঢ়তায় নির্দেশের গুরুত্ব বোঝালেন আয়েশা। হুররেম মেয়েটাকে তার ঠিক পছন্দ নয়। কিন্তু মেয়েটার সাহস আর লড়াকু মনোভাব মুগ্ধ হওয়ার মতো। সে তুলনায় মাহিদেভরানকে নেহায়েত সাদামাটাই বলা চলে। হুররেমের গর্ভে যদি শাহজাদা আসে তাহলে সব ঘটনাই পাল্টে যাবে। সহজেই ধরে নেওয়া যায় নতুন একটি সমস্যার উদয় হবে। বিষয়টা এখনই টের পাচ্ছেন বালিদ সুলতান। কিন্তু করার কিছুই নেই। এটাই অটোমানদের দীর্ঘদিনের চর্চা। বদলাবে কে?

একটা দাসী এসে খবর দিল সুলতান সুলেমান আয়েশার দর্শনপ্রত্যাশী।

‘পাঠিয়ে দাও।’

সুলতানের আসার কথা শুনে নিয়ম মতো মনজিলাও সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন। এসেই মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করলেন সুলতান। শরীরের খোঁজ করলেন।

‘আমার মনে হয় তুমি বিশেষ কিছু বলতে এসেছ সুলেমান।’

পুত্রের চোখে চোখ রেখে তীর ছুড়লেন বৃদ্ধা।

‘কী করে বুঝলেন?’

সুলেমানের কণ্ঠে বিস্ময়।

‘মায়ের মন।’

‘হুম। আপনার জবাব নেই। হেতিজার বিয়ের কথা বলেছিলেন।’

‘কিছু ভেবেছো?’

‘জী।’

‘কী?’

‘পারগালি ইব্রাহিমকে আপনার কেমন লাগে?’

‘পারগালি?’

যেন আকাশ থেকে পড়লেন আয়েশা।

‘কী বলছ তুমি?’

‘কেন? কী হয়েছে?’

‘ও একটা ভিনদেশী। ওর জাত-পাত কিচ্ছু আমরা জানি না। ওর হাতে তুমি রাজকন্যা তুলে দিতে চাইছ?’

‘এভাবে কেন বলছেন আম্মা। ছোটোবেলা থেকেই আপনার সামনে বেড়ে ওঠেছে সে। কতবার আমার জীবন বাঁচিয়েছে।’

‘তার পুরস্কার তুমি তাকে দিয়েছ। অনেকের বিরোধ সত্ত্বেও অটোমান ঐতিহ্য ভেঙে একজন বিদেশির হাতে তুলে দিয়েছ শীর্ষ চার সিলমোহরের একটি। তুমি ওকে তোমার খাস কামরা প্রধান নিযুক্ত করেছ। তাহলে এখানে হেতিজার প্রসঙ্গ আসল কী করে?’

‘এবার আমি তাকে প্রধান উজিরও বানাতে চাই।’

‘কী...?’

এবার আরও বেশি চমকে ওঠলেন আয়েশা। সুলেমানের চোখের দিকে তাকিয়ে টের পেলেন পুত্র তার সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছে। এখন বিরোধ করা হচ্ছে বোকামী। অটোমানদের নিয়ম অনুসারে বালিদ সুলতান সমান ক্ষমতার অধিকারী হলেও শেষ পর্যন্ত সুলতানের সিদ্ধান্তই সবার শিরোধার্য। তাই বৃদ্ধ বয়সে পুত্রের সঙ্গে লড়াইয়ে না যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। নিজেকে অনেক কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করলেন আয়েশা।

‘তাহলে পীরে পাশা?’

‘ওনাকে মিসরের গভর্নর করে পাঠাব।’

‘এর পেছনে যুক্তি?’

‘পীরে পাশার বয়স হয়েছে। এখন তার বিশ্রামের সময়। আমার সঙ্গে তাল মেলানোর মতো ক্ষমতা তিনি আগেই হারিয়েছেন।’

‘ইব্রাহিমের কী যোগ্যতা আছে এ পদ পাওয়ার?’

‘ওর সবচেয়ে বড় যোগ্যতা ও আমার বিশ্বস্ত। আমার জন্য জীবন দিতে পারে। ও বিচক্ষণ এবং মেধাবী। রণকৌশল ভালো। রাজ্যশাসনও কম বোঝে না। তরুণ এবং উদ্যমী। আমি আরও আগ থেকেই টুকটাক অনেক বিষয়ে ওর সঙ্গে কথা বলেছি। সব মিলিয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে ও এই পদের জন্য যোগ্য।’

‘এর বাইরে কোনো যোগ্য লোক নেই। অন্য পাশাদের মধ্যে। ইব্রাহিমকে পাশা বানানো যেতে পারে। একেবারে প্রধান পাশা কেন?’

‘না। এর বাইরে পাশাদের মধ্যে কিংবা সভাসদদের মধ্যে যারা আছে, এরা প্রত্যেকেই ভয়ঙ্কর লোভী এবং স্বার্থপর। নিজের স্বার্থের জন্য এরা সব করতে পারে।’

‘ইব্রাহিম কী লোভী নয়?’

‘না। তুমি কী করে নিশ্চিত হচ্ছ?’

‘আমি ছোটবেলা থেকে ওকে চিনি।’

‘তোমার চেনায় ভুল থাকতে পারে।’

‘উহু। আরও প্রমাণ আছে।’

‘কী প্রমাণ?’

‘ও খাস কামরা প্রধানের দায়িত্ব নিতে চায়নি।’

‘তাহলে?’

‘আমিই ওকে জোর করেছি। এমনকি প্রধান উজিরের পদের কথা বলার পরও অগ্রাহ্য করতে চেয়েছে।’

‘কীভাবে?’

‘আপনার মতোই অন্যান্য পাশা এবং সভাসদদের কথা বলেছে। বলেছে ও ভিনদেশী। এত বড় দায়িত্ব নেওয়া ঠিক হবে না।’

‘চতুর।’

‘না। বুদ্ধিমান। দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে।’

‘তোমার সঙ্গে যুক্তির লড়াইয়ে যাব না।’

‘কিন্তু আম্মা আমি কিন্তু যুক্তির বাইরে বিছুই ভাবছি না।’

‘হয়তো বা।’

‘জী না। এটাই সত্য। আমি অনেক ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন আপনার অভিমতই বিবেচ্য।’

‘কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত কী তুমি মানবে?’

‘কেন নয়?’

‘আচ্ছা যাও। আমিই তোমার সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন আয়েশা।

‘তুমি সুলতান। তোমার সব সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেই আমার সমর্থন আছে।’

হাসলেন সুলেমান। মাকে এত সহজে মানাতে পারবেন ভাবেননি। টুক করে মায়ের হাতটা টেনে নিয়ে চুমু খেলেন। অটোমানরা এ ধরনের অভিবাদনের কাজটা খুব আনন্দ নিয়ে করে থাকে।

‘প্রধান উজিরের সঙ্গে হেতিজার বিয়ে হলে নিশ্চয়ই আপনার আপত্তি থাকবে না?’

এবার আয়েশা নিজেই হেসে দিলেন।

‘আর কেউ জানে?’

‘না। ইব্রাহিমের সঙ্গে আলাপ হয়েছে।’

‘কবে ঘোষণা দিতে চাও?’

‘এখনই না। শুধু আপনাকে জানিয়ে রাখলাম। যেন আপনি আমায় ভুল না বোঝেন।’

‘ঠিক আছে। বুঝতে পারছি- তোমার মাথায় কিছু একটা খেলা করছে।’

‘খুব বেশি কিছু না আম্মা। আগামীর অভিযান আর রাজ্য পরিচালনায় ইব্রাহিমের সঙ্গটা বেশ জরুরি।’

‘হুম। দেখো কতদূর কী হয়।’

‘আপনি শুধু দোয়া করবেন।’

‘অবশ্যই।’

 

সময়ের পিঠে চেপেই সময়কে বশে এনেছেন সুলতান সুলেমান। বদলে দিয়েছেন রাজ্যপট। তুর্কি প্রথাকে করেছেন আধুনিক। সুলেমান যেদিকে গেছেন, নিয়ম নীতি আইন গেছে সেদিকেই। ব্যক্তিত্বে, শৌর্য-বীর্যে অটোমান সিংহাসনকে করেছেন আলোকিত। প্রাসাদের বাইরে সব সময়ই ঘোড়ার পিঠে সওয়ার থাকেন। ভীষণরকম ঘোড়াপ্রিয় সুলেমান অনেক সময় কাটিয়েছেন পার্বত্যের ঘোড়ার খামারগুলোতে। অনেকটা নারীসুলভ ভঙ্গিতে কোমলভাবে নিজের ঘোড়ায় জিন চাপাতেন সুলেমান। বাদামওয়ালা হাত দুখানি বাদামি আর পেশিবহুল। দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। প্রিয় ঘোড়ার পিঠে চড়েই মুখোমুখি হন সাধারণ জনতার। এমনকি যখন পুরনো সেরাই থেকে তার বাগানের প্রকাণ্ড ফটক ধরে বেরিয়ে আসেন তখনো ঘোড়ার পিঠেই সওয়ার থাকেন। এক্ষেত্রে হাঁটেন না। কিংবা অন্য বাহন- চেয়ার ব্যবহার করেন না। এটা সুলেমানীয় প্রথা। শুধু প্রাসাদ কেন, সুলেমান আপন খেয়ালে যেখানে খুশি সেখানেই যেতে পারেন। দানিউব থেকে নীল নদের শেষ প্রান্ত। পুরোটাই তার ঘোড়ার খুরের নিচে। দীর্ঘদেহী এবং আনমনা, দৃশ্যত স্থীর বিজয়ী একজন। পলকা এক পরত গোঁফ ছাড়া মুখের পুরোটাই কামিয়ে রাখেন। আর হেলানো মাথার চারপাশে জড়ানো শিথিল কাপড়ের বন্ধনে তারুণ্যের ঝিলিক উঠে। নিখুঁত মানানসই ধূসর-কালো কিংবা সোনালি রাজপোশাকের সঙ্গে সচকিত আচার আচরণ যে কোনো আতঙ্কবোধকে আড়াল করে। এসব গুণের বদৌলতেই সাধারণ প্রজাদের মনের মধ্যে গেঁথে গেছেন সুলেমান। তার ওপর নির্ভরশীল হাজার হাজার প্রজাসাধারণের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সুবন্দোবস্ত করাসহ নানা কাজের চাপেও খেই হারান না। কেবল রাজ্যের ব্যস্ততা, এত দায়, যুদ্ধবিগ্রহ প্রায়ই তাকে একা করে দেয়। মুক্ত বিহঙ্গের মতো আকাশের বুকে ধেই ধেই ওড়ার স্বপ্নটা বুকের বাম পাশে জমাই থেকে যায়। তখন জোর করে অবসর নামান। নিজের ঘরে একলা একলা কাগজের বুকে স্বপ্ন লিখেন।

     ‘নীলনদ থেকে দানিউব হয়ে উড়ে আসে

     ঝলঝলে মোমবাতি রঙের পায়রা

     ডানার ভিতর সুবাস লুকানো সন্ধ্যাযাত্রায়

     মেঘ সরিয়ে প্রতিদিন আঁকে নতুন আকাশ

     গ্রীষ্মের ধুলো ঝাপসা কুয়াশা হয়

     বাগানের স্মৃতি ফুলেদের রঙ মলিন হয়

     জীবন বদলায়, বদলায় কাম-প্রেম-মোহ-দ্রোহ

     শুধু বদলায় না বুকের ভেতর চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাস!’

 

     অপেক্ষার পালা শেষ হলো। শান্ত নিবিড় মধ্যরাতে হারেমের একপ্রান্তে হুল্লোড় পড়ে গেল। ঘুম ভেঙে গেল তোপকাপি প্রাসের। প্রসব বেদনায় কাতর হুররেমের চিৎকারে প্রকম্পিত হলো পুরো প্রাসাদ। ব্যস্ততায় হালিমের নেসার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হুররেমের চিৎকার আর থামে না। বিরক্ত হালিমের নেসা হুররেমের দাঁতের ফাঁকে একটা হাতির দাঁতে তৈরি কাঠি গুঁজে দিলেন। মিনিট চারেকের চেষ্টায় নীরবতা নামল। যথাসময়ে একটা বাচ্চার জন্ম দিলেন হুররেম খাতুন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় নাড়ি পেঁচিয়ে জীবনসংশয় দেখা দিয়েছিল শিশুটির। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো বিপদ ছাড়াই ভূমিষ্ঠ হলো। আজান পড়ল। এরপর বাচ্চাকে লিনেনের কাপড়ে মুড়িয়ে তুলে দেওয়া হলো মনজিলা খাতুনের হাতে।

অটোমান রীতি অনুযায়ী মনজিলা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব তদারক করছিলেন। তার হাতে বাচ্চাকে তুলে দেওয়ার পর বাচ্চাটিকে মার্বেলের ঝর্ণায় গোসল করানো হলো। এরপর শিশুর মুখে দেওয়া হলো মধু। মুখের ভাষা যেন সুমিষ্ট হয় তার। চোখে হাল্কা করে লাগিয়ে দেওয়া হলো সুরমা। কপালে ছোঁয়ানো হলো পবিত্র কোরআন শরীফ। এ রীতি যখন চলছিল হুররেম তখন পাশে দঁড়ানো হেকিম হালিমের নেসাকে খামচে ধরলেন।

‘বলো আমাকে। কী হয়েছে আমার? ছেলে না মেয়ে?’

‘ছেলে, খাতুন আপনার একটি ফুটফুটে ছেলে হয়েছে।’

উত্তর শুনে পরম নিশ্চিন্তে জ্ঞান হারালেন হুররেম।

 

     নতুন শাহজাদা আসার খবর চাউর হয়ে গেছে প্রাসাদে। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত মিষ্টি আর শরবত বিতরণ করা হয়েছে। হারেমের ভিতর মোহর বিলিয়েছেন মনজিলা। সকাল বেলায় বালিদ সুলতান, হেতিজা, সুলেমান, মাহিদেভরান ও মুস্তফা দল বেঁধে এলো শাহজাদাকে দেখতে। সবাইকে খুশি মনে হলো। কেবল একজন ছাড়া। তিনি মাহিদেভরান। ঈর্ষাকাতর মুখখানি একেবারে ছোট হয়ে গেছে তার। নেহায়েত অটোমান সাম্রাজ্যের নিয়ম। নইলে এখানে তাকে কেউ আনতেই পারত না।

সুলতান যখন নতুন শাহজাদাকে কোলে তুলে নিলেন তখন মাহিদেভরানের চোখ গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা অশ্রু। দ্রুত  রুমাল দিয়ে অশ্রু ঢাকার চেষ্টা করলেন তিনি।

সুলতান ছেলেকে কোলে নিয়েই মায়ের দিকে এগিয়ে এলো।

‘দেখুন আম্মা। ওর চোখগুলো দেখুন। একেবারে দাদার মতো হয়েছে।’

‘হ্যা তাইতো দেখছি। আমার শাহজাদা।’

হাসছেন আয়েশা। মাহিদেভরান আর হুররেমকে নিয়ে যে সংকটের সংশয় মনের ভিতর বারবার উঁকি দিচ্ছে, সেটাকে ঢেকে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি।

‘ওর নাম দিলাম মেহমেদ।’

বলেই ছোট্ট শাহজাদার কপালে একটা চুমু খেলেন সুলেমান। তখনই একটা কাণ্ড করে বসলো শাহজাদা মুস্তফা। বাবার কাফতান ধরে টানতে লাগলো।

‘কী হয়েছে মুস্তফা?’

‘তুমি ওকে আদর করছো কেন?’

‘ও তোমার ভাই শাহজাদা।’

ততক্ষণে দাদীর কোলে ঠাঁই নিয়েছে নতুন শাহজাদা। মুস্তফাকে কোলো তুলে নিলেন সুলেমান।

‘ভাইকে তুমিও আদর করবে। দেখো কতো সুন্দর দেখতে হয়েছে।’

‘না আমার ভাই লাগবে না।’

হাত নেড়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলো মুস্তফা।

‘এভাবে বলে না মুস্তফা। তুমি ওর বড় ভাই। তুমি শাহজাদা। তোমাকে এমন হলে চলবে না।’

‘না। না। আমি বলেছি আমার কোনো ভাই লাগবে না।’

‘মুস্তফা..’

সুলতানের কণ্ঠ ভারী হয়ে এলো।

বিষয়টা নজর এড়ালো না হেতিজা সুলতানের। এগিয়ে এসে ভাস্তেকে কোলে তুলে নিলেন তিনি। কিন্তু হেতিজার কোলেও থাকতে চাইলো না সে। মন ভীষণ খারাপ। নেমেই মাকে জাঁপটে ধরলো। মাহিদেভরানও মুস্তফাকে বুকে জড়িয়ে দুঃখ ভুলতে চাইলেন। হেতিজা হুররেমের কাছে গিয়ে বসলেন। শরীরের খোঁজ নিলেন। নতুন বাবুটাকেও অনেকক্ষণ আদর করলেন। বললেন একটু সুস্থ হলেই গল্প জমবে তাদের।

 

     কাশিম পাশার ডাক পড়েছে। সুলতানের চেহারার দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলেন কাশিম পাশা। সুলতানের মায়া ভরা মুখটাতে যেন রাজ্যের মেঘ ভিড় করে আছে। কী কঠিন দৃঢ়তার ছাপ পড়েছে সেখানে! লক্ষণটা একদম ভালো ঠেকছে না। কিন্তু করার নেই কিছুই।

‘পাশা..’

‘জি জাঁহাপনা।’

‘আমার মনে হয় আপনার বয়স হয়েছে। এখন আপনার বিশ্রামে যাওয়া উচিত।’

‘বয়স আর কোথায় হলো! হুজুর বেয়াদপি নেবেন না। এ দেহে যতদিন প্রাণ আছে, ততদিন আপনার সেবা করে যেতে চাই।’

‘কথাটা ঠিক বলেননি। কম দিনতো আর সেবা করলেন না। এবার সত্যি বিশ্রাম দরকার।’

‘কিন্তু পীরে পাশাতো আমার চাইতেও বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করছেন।’

‘তার ব্যাপারটা ভিন্ন। তিনি বাবার সময় থেকে আছেন। তাছাড়া

তার ব্যাপারেও যে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না- সেটা কিন্তু আপনাকে বলা হয়নি। আমি শুধু আপনার কথাই বলেছি।’

সুলতানের চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে। আর কিছুই করার নেই স্পষ্ট টের পাচ্ছেন কাশিম পাশা। এরপরও কাঁচুমাচু করছেন তিনি।

‘কোনো কথা বলবেন না পাশা। আপনার অবসরের সব ব্যবস্থাই করা হয়েছে। খাজাঞ্চিখানা থেকে আপনার জন্য দুই লক্ষ অ্যাস্পার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নিয়ম করে মাসিক ভাতা পাবেন। আর অবসরপ্রাপ্ত রাজসদস্য হিসেবে অন্য সুবিধারও ব্যতিক্রম হবে না।’

বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন কাশিম পাশা। যেন পায়ের তলার মাটি সব আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। এ মুহূর্তটির জন্য তৈরি ছিলেন না মোটেই।

‘হুজুর কী কোনো কারণে রেগে আছেন আমার ওপর? আমি কী কোনো ভুল করেছি?’

‘একদমই না।’

‘ভুল হলে ক্ষমা করবেন।’

বলেই সুলতানের পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ার উপক্রম হলো পাশার। সুলতান সরে দাঁড়ালেন। রেগে গেছেন তিনি।

‘এসব কী করছেন? আমিতো বলেছি এটাই আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। আপনি এখন আসতে পারেন। পীরে পাশার কাছে সিলমোহর বুঝিয়ে দেবেন।’

কিংকর্তব্যবিমূঢ় কাশিম পাশা কুর্নিশ করে কক্ষ থেকে বিদায় নিলেন।

‘আপনার কথা অটোমান সাম্রাজ্য কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মনে রাখবে পাশা।’

সুলতানের সেই কথা কাশিম পাশার কানে পৌঁছালো ঠিকই কিন্তু দুজনেই জানেন এটা কেবলই কথার কথা। সুলতানের ঘর থেকে বেরোতেই পারগালি ইব্রাহিমের সঙ্গে চোখাচোখি হলো কাশিম পাশার। দুজনের দৃষ্টিতেই রাজ্যের শীতলতা। কয়েক সেকেন্ডের জন্য একে অন্যের দিকে নির্বাক তাকিয়ে রইলেন কেবল। কোনো কথা নেই। পারগালিকে যখন খাসকামরা প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখন প্রকাশ্যেই এর বিরোধিতা করেছিলেন কাশিম পাশা। মনের ভেতর উজিরে আজম হওয়ার খায়েশ ছিল তার একদিনতো ইব্রাহিমকে বলেই ফেলেছেন ‘উজিরে আজম হওয়ার পর দেখব কীভাবে একজন ভিনদেশীর হাতে সিলমোহর থাকে।’ পারগালি সেদিন বলেছিলেন, তিনি সুলতানের গোলাম। আর তাই মনিবের নির্দেশ পালনই তার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। এর বাইরে তার আর কোনো দায়িত্ব নেই।  সুলতানের গোলামীর কথা বলে কাশিম পাশার অবজ্ঞা এড়িয়ে গিয়েছিলেন পারগালি।

কিন্তু আজ? আজ উল্টো কাশিম পাশাই সিলমোহর হারালেন। অন্যদিকে ইব্রাহিমের উজিরে আজম হওয়া এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। আর হেতিজার ব্যাপারটাতো আছেই। ইব্রাহিমকে বেশ গর্বিত মনে হলো। মনে মনে ভাবছে- এতো কেবল শুরু পাশা। চমকের আরও অনেক কিছুই যে বাকি রয়ে গেছে!

ইব্রাহিম স্বপ্নবিলাসী নয়। এরপরও গত কয়েকদিনের সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছে ওর কাছে। বিশ্বাস হতে চাইছে না কিছুই। সত্যি, ভাগ্য মানুষকে কোথা থেকে কোথায় টেনে নিয়ে যায়!

পরবর্তী পর্ব আগামী শনিবার

সর্বশেষ খবর