রবিবার, ১৯ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

সাইকেল চালিয়ে পৃথিবী দেখা

তানভীর আহমেদ

সাইকেল চালিয়ে পৃথিবী দেখা

পরিবেশ দূষণ, পর্যটন শিল্পের বিকাশ, এইডস প্রতিরোধ, মাদক নির্মূল, দুর্নীতি রোধসহ নানা সামাজিক বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরির জন্য দেশ থেকে দেশে সাইকেল চালিয়ে ছুটে চলেছেন এক বাংলাদেশি তরুণ। তার নাম আবুল হোসেন আসাদ। সাইকেল চালিয়ে পৃথিবী দেখার অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জ নিয়ে ইতিমধ্যে ৪২টি দেশ ঘুরে এসেছেন তিনি। দেখেছেন দেশে দেশে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। অদ্ভুত, মজার ও বিচিত্র সব ঘটনা-গল্প জমা হয়েছে তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে। গোপালগঞ্জের টগবগে যুবক ‘সাইক্লিস্ট আসাদ’ এসেছিলেন  বাংলাদেশ প্রতিদিন কার্যালয়ে, শুনিয়েছেন পৃথিবী দেখার নানা গল্প। সেসব নিয়েই আজকের রকমারি—

 

 

রোভার স্কাউটিং দিয়ে শুরু

পৃথিবী ঘুরে আসা সোজা কথা নয়। আকাশে উড়ে সে না হয় অনেকেই করেছে। কিন্তু সাইকেলে চড়ে পৃথিবী দেখার স্বপ্ন কজন দেখে? স্বপ্ন দেখা হাতেগোনা অল্প কয়েকজনের একজন আসাদ। সাইকেলে পা রেখে পৃথিবীর নানা দেশে ছুটে চলেছেন বাংলাদেশের এই তরুণ। তার শুরুটা কিন্তু সহজ ছিল না। ১৯৯৭ সালের ২৩ অক্টোবর। সিলেটের লাক্কাতুরায় নবম এশিয়া-প্যাসিফিক রোভারমুট ও সপ্তম বাংলাদেশ রোভারমুটে অংশগ্রহণ করতে রওনা হয় পাঁচ তরুণ। মেহেরপুর ডিগ্রি কলেজের সেই পাঁচজন রোভার স্কাউটস মানিকগঞ্জে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এ দুর্ঘটনা ছুঁয়ে যায় আসাদকে।  নিরাপদ সড়ক চাই এবং পথ যেন হয় শান্তির, মৃত্যুর নয়— এই বাণী ছড়িয়ে দিতে পথে নামলেন তিনি। সাধারণ মানুষের সচেতনতা তৈরিতে একজন রোভার স্কাউটস হিসেবে সাইকেলে বাংলাদেশ ভ্রমণের প্রতিজ্ঞা নিয়েই শুরু। সেই প্যাডেলে পা রাখলেন। বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগে ছুটলেন। বাংলাদেশের বুকজুড়ে ছোটাছুটির পর ঠিক করলেন— এবার না হয় গোটা পৃথিবীটাই ঘুরে আসি না কেন! তখনো তিনি ছাত্র। তবে পৃথিবীটা চক্কর দেওয়ার পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে দেশের বাইরে যাত্রা শুরু করেন। যথারীতি সাইকেলে করেই প্রথম ভ্রমণ করেন ভারতে। তারপর একে একে ৪২টি দেশে পা ফেলেছেন তিনি। সাইকেলে চড়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশের সীমান্ত পাড়ি দিতে বহু ঝক্কি সামলাতে হয়েছে। ইতিমধ্যে যেসব দেশে সাইকেল চালিয়ে ঘুরে এসেছেন সেগুলো হলো— ১. ভারত ২. ভুটান ৩. নেপাল ৪. পাকিস্থান ৫. শ্রীলঙ্কা ৬. মালদ্বীপ ৭. সিঙ্গাপুর ৮. মালয়েশিয়া ৯. থাইল্যান্ড ১০. কম্বোডিয়া ১১. ভিয়েতনাম ১২. লাওস ১৩. চায়না ১৪. ফিলিপাইন ১৫. ব্রুনেই দারুস সালাম ১৬. ইন্দোনেশিয়া ১৭. জাপান ১৮. সাউথ কোরিয়া ১৯. হংকং ২০. ম্যাকাও ২১. মিসর ২২. কাতার ২৩. সংযুক্ত আরব আমিরাত ২৪. ওমান ২৫. অস্ট্রেলিয়া   ২৬. গ্রিস ২৭. ইতালি ২৮. অস্ট্রিয়া ২৯. হাঙ্গেরি ৩০. চেক রিপাবলিক ৩১. পোল্যান্ড ৩২. লিথুয়ানিয়া ৩৩. লাটভিয়া ৩৪. জার্মানি ৩৫. নেদারল্যান্ডস ৩৬. বেলজিয়াম ৩৭. লুক্সেমবার্গ ৩৮. ফ্রান্স  ৩৯. স্পেন ৪০. পর্তুগাল ৪১.সুইজারল্যান্ড ৪২. লিস্টেনস্টাইন। সবশেষ ঘুরে এসেছেন ওমান। এতটা পথ সাইকেল চালিয়ে এসেও বলতে হয়— পৃথিবী দেখা সবে তো শুরু!

 

সাইক্লিস্ট আসাদ

বাংলাদেশি এই তরুণের পুরো নাম মুহাম্মদ আবুল হোসেন আসাদ। অবশ্য দেশে-বিদেশে তিনি পরিচিত ‘সাইক্লিস্ট আসাদ’ নামেই। সাইকেল চালিয়ে ইতিমধ্যে ৪২টি দেশ ঘুরে এসে আলোচিত হয়েছেন তিনি। তার বাবার নাম আবদুল আলী ফকির, মা রহিমা বেগম। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোলে এমএসসি করেছেন। তার জন্ম গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুরের বনগ্রামে। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। পথিক লিমিটেড নামের ট্যুরিজম অপারেটর প্রতিষ্ঠানের অংশীদার তিনি।

 

ছড়িয়েছেন সচেতনতার বাণী

বিশ্বজুড়ে মানুষের মাঝে পরিবেশ সংরক্ষণ, পর্যটন শিল্পের প্রসার, মাদক নির্মূল, দুর্নীতি রোধসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে সামাজিক সচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে দেশে দেশে সাইকেল চালিয়ে ঘুরছেন আসাদ। দেশে এবং দেশের বাইরে যেখানেই যান সেখানেই প্রচার করেন সমাজ সচেতনতামূলক বাণী। ‘স্থলমাইনমুক্ত পৃথিবী’, ‘দুর্নীতিমুক্ত স্বদেশ’, ‘মাদককে না বলো, জীবনের পথে এগিয়ে চলো’, ‘পরিবেশ বাঁচান, নিজে বাঁচুন’, ‘এইচআইভিমুক্ত বিশ্ব গড়ি’— এ ধরনের স্লোগান ছড়িয়ে দিতে সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে চলেছেন বাংলাদেশের এই তরুণ।

 

মুখোমুখি

যখন বিদেশে সাইক্লিং করি তখন স্থানীয় লোকজন ভাবে ভিনদেশি তরুণ সাইকেল চালাচ্ছে। টি-শার্টে লেখা ‘প্যাডেলিং ফর প্ল্যানেট’ তখন সবাই নিজে থেকেই কথা বলতে এসেছে। আমিও তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। কথা না বুঝলে আকার-ইঙ্গিতেই সেরে নিয়েছি মনের ভাব। সময়, পরিস্থিতি, আবহাওয়া সবকিছু মিলিয়েই ঠিক করতাম কোন দেশে কত দিন থাকব। সব দেশেই সমান আতিথেয়তা মেলেনি। কোনো কোনো দেশে গিয়ে তো ভীষণ বিপাকেই পড়তে হয়েছে। রাস্তা দিয়ে চলছি, বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ পাশ থেকে একটা মোটরবাইকের আরোহী হয়তো তার হেলমেটটি দিয়ে মাথায় ধুম করে একটা বাড়ি মেরে ঝড়ের বেগে হাওয়া! সাধারণ মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছি প্রত্যেকটি দেশে, তা ভোলার নয়। এই ভালোবাসার শক্তিতেই সাইকেলের প্যাডেল ঘোরাতে পেরেছি ক্লান্তিহীন। দুনিয়ার পথে পথে সমস্যা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রেরণার উৎস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শুধু ঘোরার জন্যই ঘোরাঘুুরি নয়, বাংলাদেশের পর্যটনকে বহির্বিশ্বে তুলে ধরাও আমার উদ্দেশ্য। ‘বাংলাদেশ দেখুন, বাংলাদেশ জানুন’ স্লোগান নিয়ে সাইকেলে ভ্রমণ করছি। সেই সঙ্গে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ রুটটি একটি আন্তর্জাতিক মানের সাইকেল প্রতিযোগিতার ভেন্যু করার প্রয়াস নিয়েছি। যাতে করে কক্সবাজারে পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও দেশের বাইরে উজ্জ্বল হয়।

 

 

দেশে দেশে মিডিয়ার চোখে

সাইকেলে চড়ে আসাদের বিশ্বভ্রমণ

 

চাকায় চাকায় চক্কর

যে ভাষা সবাই বুঝে

ঘটনাটি ভিয়েতনামে। প্রচণ্ড রোদে সাইকেল চালিয়ে এসে ক্ষুধায় মরছি। প্রত্যন্ত এক গ্রামে এসে মিলল খাবারের দোকান। দোকানে আস্ত মুরগি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আমি বার বার দোকানদারকে ইংরেজিতে বলছি, আমি এইটা কিনতে চাই। দোকানদার ইংরেজি বুঝে না। যত ভাবেই বুঝাই সে বুঝতেই পাচ্ছে না। এদিকে খিদায় মরি। শেষে ধৈর্য হারিয়ে এক হাতে ভিয়েতনামি মুদ্রা ডং আরেক হাতে আস্ত মুরগি নিয়ে কামড় বসিয়ে দিলাম। ইশারায় কাজ হলো। দোকানদার আমার এই কাণ্ড দেখে হেসেই খুন।

ভিনদেশির ভালোবাসা

সিঙ্গাপুর থেকে মালয়েশিয়া যাচ্ছি। হঠাৎ এক দিন খেয়াল করলাম প্রাইভেট কার থেকে এক লোক আমাকে থামতে ইশারা দিচ্ছে। আমি ভয়ে থামছি না। পাছে টাকা-পয়সা ছিনতাই না হয়ে যায়। শহরের কাছাকাছি আসতে থামলাম। ভিনদেশি লোকটি কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দিল। তাকিয়ে দেখি তার হাতে বেশ কিছু রিঙ্গিত। লোকটি বলল, তোমাকে আগেও দেখেছি। তুমি ভালো কাজ করছ। তাই তোমার জন্য কিছু রিঙ্গিত নিয়ে এলাম। আশা করি তোমার উপকার হবে। আমার ভয় কেটে উল্টো আনন্দ লাগল।

‘দাদা, বাংলায় বলুন’

ভ্রমণের এক পর্যায়ে ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়। ঘটনাটি দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায়। এই পত্রিকার নিউজ এডিটরের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছি। তিনি আমার কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বললেন, দাদা, ইংরেজিতে না বলে বাংলায় বলুন, ভালো লাগবে। আমি চমকে উঠলাম। স্যার, আপনি তাহলে বাঙালি! তিনি বললেন, বাঙালি তো বটেই, আমি বাংলাদেশের ছেলে। ছোটবেলায় বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে কত খেলে বেড়িয়েছি তার হিসেব নেই। এখনো আমার মন টানে বাংলাদেশের দিকে। বাংলাদেশে সময় পেলেই যাব।

কম্বোডিয়ার ভিসা হাজির

এক দিন সাইকেলসহ কম্বোডিয়ার মালয়েশীয় অ্যাম্বেসিতে গিয়েছি ভিসা নিতে। ওখানকার নিয়ম হলো, আগে ইন্টারভিউ দিতে হয়। যথারীতি ইন্টারভিউ দিচ্ছি। এমন সময় ইন্টারভিউ কক্ষে প্রবেশ করলেন দূতাবাসের এক কর্মকর্তা। ইন্টারভিউ অফিসারটি আমাদের দেখিয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে সেই কর্মকর্তাকে বললেন, স্যার বাংলাদেশি পাসপোর্টে ভিসা দেওয়াটা রিস্কি, এরা দুজন ওয়ার্ল্ড ট্যুরিস্ট। যেই মাত্র ইন্টারভিউ গ্রহণকারী অফিসারটি কর্মকর্তাকে বললেন, ওয়ার্ল্ড ট্যুরিস্ট। সঙ্গে সঙ্গে সেই কর্মকর্তা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আবুল হোসেন কে? আমি বললাম, স্যার, আমি। বলতেই তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, তোমরা অনুমতি দিলে তোমাদের স্যুভেনীয়র হিসেবে এই অ্যাম্বেসিতে মালয়েশিয়ার জাতীয় প্রতীকের সঙ্গে তোমাদের ছবি তুলব এবং আমি সেই ছবিতে থাকব। বলেই তিনি সাইকেল কোথায়? সাইকেল কোথায়? সাইকেল খোঁজ করে অ্যাম্বেসি সরগরম করলেন। গার্ডরা দৌড়ে দূতাবাসের গেটের বাইরে দাঁড় করানো আমাদের সাইকেলগুলো নিয়ে এলো একেবারে গেটের ভিতরে। আমরা ছবি তুললাম।

ওদিকে ইন্টারভিউ চুলোয় গেল। তিনি রাগত স্বরে ইন্টারভিউ গ্রহণকারী অফিসারকে বললেন, আপনি তার দেখভাল করেননি? ইন্টারভিউ গ্রহণকারী অফিসার তড়িঘড়ি করে কাগজপত্র ছাড়াই ভিসা ইস্যু করে দিলেন।

 

পথে পথে কত কাণ্ড

সাইকেলে চড়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশের সীমান্ত পেরোতে ভুগতে হয়েছে তাকে। অবশ্য পথে পথে মিলেছে নানা রঙের নানা ঢঙের মানুষ। দেশে দেশে ভিন্ন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, মজার সব ঘটনার বর্ণনা শুনুন আসাদের মুখে—

 

হাসতে মানা

কোরিয়া ইমিগ্রেশনে। ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে দাঁড়ালাম। মেয়েটি বলল, ‘ক্যামেরার দিকে  তাকাও।’ আমি ক্যামেরার দিকে তাকালাম। একটু হাসি দিলাম মেয়েটি বলল, ‘নো স্মাইল।’ আমি আবার একটু মুচকি হাসি দিলাম। এবার একটু বিরক্ত হলো বলেই মনে হলো। মেয়ে অফিসারটি বলল, ‘নো, নো স্মাইল’, বলেই ইমিগ্রেশন থেকে উঠে দাঁড়াল আর আমার ঠোঁট দুটো বন্ধ করে দিল।

 

লঙ্কাকাণ্ড একেই বলে

রাত প্রায় ৮টা বাজে। শ্রী সিংহরাজা মাহাথা এর পাশেই মহিউদ্দিন মসজিদ রোড। একটু ভিতরেই মসজিদ। কলম্বোবাসী মোজাম্মেল সাহেব সামনে পড়লেন। জিজ্ঞেস করলেন শ্রীলঙ্কায়  তোমরা কি কাজ করতে এসেছ? লোকজনের চাহনি এবং মুখের হাবভাব দেখেই বুঝতে পারি, যেন তাদের দেশে থাকতে এসেছি। তাদের বোঝা। এ জন্য আজ ল্যাপটপ সঙ্গে এনেছি আমাকে নিয়ে খবর, ভিডিও দেখাব বলে। বললাম, আপনি শ্রীলঙ্কান তামিল তো নিশ্চয়ই পড়তে জানেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি ল্যাপটপ চালু করে সিঙ্গাপুর থেকে প্রকাশিত তামিল মুরাসু পত্রিকাটি দেখালাম। ইতিমধ্যে একজন ইমাম অর্থাৎ ওস্তাদজি এসে দাঁড়ালেন তার পাশে।  ওস্তাদজি একটু দেখলেন। দেখেই বললেন, ‘এটম বোম, এটম বোম।’ তার ভয়ার্ত কথায় লোকজন চলে এসেছে এবং জটলা পাকাচ্ছে। সরু রাস্তায় গাড়ি থেমে যানজট লেগে গেছে। সবার মুখ শুকিয়ে গেছে। ওস্তাদজি এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। যেন পুলিশ খুঁজছেন। কিংবা অন্য কিছু খুঁজছেন। বুঝলাম মহাবিপদে পড়ে গেছি। গণধোলাই খেতে না হয় শেষমেশ কলম্বো এসে। ওদিকে লোকজন ভীষণ সন্দেহভরা চোখে তাকাচ্ছে। তার সামনে ল্যাপটপ ধরেই আছি, কাতর কণ্ঠে বললাম পড়ুন। তিনি  অস্থিরভাবে বললেন, ‘এটম বোম নিকাল লে।’ ওস্তাদজি লোকজনকে বোঝাচ্ছেন এরকম যেন— এক দেশ থেকে অন্য দেশে এটম বোম নিয়ে যাচ্ছি। আমি মিনতি করে বললাম, পুরোটা পড়ুন। তিনি কী পড়লেন কে জানে। হাঁ করে তাকিয়ে দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর, ‘কানিপাডি   কানিপাডি’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। সবারই  চোখ বড় বড়। এবার অন্য দৃশ্য। ওস্তাদজি আচমকা হাসিমুখ করে বললেন, ‘ভিডিও কোথায়? ভিডিও দেখাও।’  পেলাম একটা ভিডিও, টিভি নিউজ। ভিডিও দেখে সবাই বেশ খুশি যেন এই মেঘ এই রোদ্দুর। শ্রীলঙ্কার আকাশের মতোই বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি। আমার সাইকেল সহযাত্রী বলল, ‘গুরু, তাড়াতাড়ি চলেন, কেটে পড়ি। আবার না জানি কোন বিপদ। জটলা অনেক বেড়ে গেছে।

 

সাইকেলের লাইসেন্স

জাপানে এক রেল স্টেশনে গিয়ে পৌঁছেছি। রাত ১২টা বাজতে না বাজতেই দুম করে স্টেশনের সব গেট বন্ধ হয়ে গেল। আমি ভাবলাম রাতটা এখানেই কাটিয়ে দিই। সারাদিন সাইকেল চালিয়েছি, মুহূর্তে ঘুম চলে এলো। মধ্য রাতে ঘুম ভাঙল সাইকেল টানাটানিতে। এক জাপানি আমার সাইকেল ধরে টানছে। আমি অবাক। আমি নিজের সাইকেল টানছি আমার দিকে সে টানছে তার দিকে। এমন সময় স্টেশনে পুলিশ এগিয়ে এলো। জাপানি বলে বসল সাইকেলটি তার। আমিও সাইকেলের দাবিদার। পুলিশ বলল, তোমার সাইকেলের লাইসেন্স দেখাও। আমার আক্কেলগুড়ুম। সাইকেলের আবার লাইসেন্স হয় নাকি? বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বের অনেক সাইকেলের লাইসেন্স থাকে না। এই কথা জাপানি পুলিশ মানতে নারাজ। অবশেষে বাংলাদেশের যে দোকান থেকে সাইকেল কিনেছিলাম সেই রসিদ বের করে দেখালাম। পুলিশকে বুঝালাম এটাই বাংলাদেশের সাইকেলের রসিদ। তাতেই রক্ষা পেলাম।

 

মেয়েরাই বিয়ে করে

আমাদের দেশে সাধারণত ছেলেরা মেয়েদের বিয়ে করে। তবে ব্রুনাইতে উল্টো। ব্রুনাইতে বিয়ের পর মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে বসবাস করে না। বরং ছেলেকে মেয়ের বাড়িতে থাকার জন্য চলে আসতে হয়। অনেকটা ঘরজামাইয়ের মতো ব্যাপারটা। ব্রুনাইতে কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে হলে ৫ হাজার ডলার লাগে। সেখানে আতিথেয়তা নিয়েছিলাম মাসুদ ভাইয়ের কাছে। তিনি রসিকতা করে বললেন, চাইলে আপনি ও আপনার সঙ্গীর জন্য বিয়ের পাত্রী দেখতে পারি। তবে ৫ হাজার ডলার লাগবে।

 

 

এর নাম ভালোবাসা

অনেক ঝক্কি-ঝামেলার পর ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত পেরোলাম। পাকিস্তানে লাহোরের দিকে যাচ্ছি। মহাসড়কে এক পাকিস্তানি আমাকে সাইকেল থামানোর ইশারা করল। আমি থামলাম না। লোকটি নাছোড়বান্দা। সে আমার পিছু ছাড়ল না। অগত্যা থামতে হলো। লোকটি এসেই বলল, তুমি কি বাংলাদেশি? আমি বললাম, হ্যাঁ। লোকটি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, বাসায় চলো তোমাকে আপ্যায়ন করাব। আমি বললাম, কেন? আপনি কেন আমাকে দাওয়াত দিচ্ছেন? লোকটি বলল, আমার বাবা পাকিস্তান আর্মিতে ছিলেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালোবাসতেন। তার মতো মুজিব কোট পরতেন। যে কারণে আমার বাবাকে কোর্ট মার্শাল দেওয়া হয়। আমার বাবা তোমার দেশের নেতাকে ভালোবাসতেন। তুমি শেখ মুজিবের দেশের মানুষ সেজন্য আমিও তোমাকে ভালোবাসি।

সর্বশেষ খবর