বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

হারিয়ে যাওয়া বিস্ময়কর সভ্যতা

তানভীর আহমেদ

হারিয়ে যাওয়া বিস্ময়কর সভ্যতা

নাবাতিয়ান

নাবাতিয়ান সভ্যতা। এই সভ্যতা বেশি আলোচনায় এসেছে গবেষকদের বিশেষ বিশ্লেষণ ও গবেষণার কারণে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার এই সভ্যতা মানবজাতির সভ্যতার বিকাশে বিশেষভাবে আলোচিত হয়ে আসছে। নাবাতিয়ান সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বর্তমান জর্ডান ও আশপাশের অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় বলে ধারণা করা হয়। এই শহরের গঠন বেশ রহস্যময়। পুরো শহরটাই যেন রহস্যে ঢাকা। বিস্ময়কর এ সভ্যতার শহরগুলোর মতো এর নির্মাতারাও রহস্যই থেকে গেছেন। তাদের নগর পরিকল্পনা বিশেষত্ব বহন করে। শহরের বেশির ভাগ স্থাপনাই পাথরে খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে। অতিকায়  স্থাপনাগুলো অবিশ্বাস্যের চোখে দেখতে হয় স্থাপনাগুলোর স্থাপত্যশৈলী কতটা নান্দনিক ও রুচি বহন করে। পাথরের খোদাইকৃত শহরগুলো দেখে এখনো পর্যটকরা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যান। নাবাতিয়ান সভ্যতার স্থাপনাগুলোর নির্মাণশৈলীতে প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকরা বৈজ্ঞানিক যুক্তি দাঁড় করাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এত আগে পাহাড় কেটে কেমন করে এসব অতিকায় পাথুরে স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে তা সত্যিকার অর্থেই এক বিস্ময়। তবে নাবাতিয়ান সভ্যতার শৈল্পিক গঠনই একমাত্র বিস্ময় নয়। এ সভ্যতার কোনো লিখিত ইতিহাস না থাকাটাও ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিস্ময়ের জন্ম দেয়। অপরূপ গঠনের নাবাতিয়ান সভ্যতা ১০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে রোমান সম্রাট ট্র্যাজান কর্তৃক বিজিত হয়। এরপর ধীরে ধীরে গ্রিক-রোমান সংস্কৃতিতে হারিয়ে যায় এ সভ্যতার কীর্তিমানদের সব বীরত্বগাথা। নাবাতিয়ান সভ্যতা ধীরে ধীরে আরও পূর্ণ হয়েছে আধুনিকতায়। গ্রিক ও রোমানদের আগমনে এই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে। শিল্প ও সংস্কৃতিতে অনেকটাই এগিয়ে যায় নাবাতিয়ান সভ্যতা। ইতিহাসবেত্তাদের মতে, নাবাতিয়ান সভ্যতার এই অগ্রগতি খুব বেশি দিন ছিল না। প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায়ই নাকাল হয়েছে শহরটি। ফসল ফলানোর জন্যও নগরীটি খুব আদর্শ ছিল না।

এসব কারণে পরবর্তীতে এই শহর ছেড়ে কোলাহল দূরে সরে যেতে শুরু করেছিল বলে ধারণা করা হয়।

 

সিন্ধু

দ্য ইন্ডাস ভ্যালি। যতগুলো সভ্যতার কথা ইতিহাসবেত্তাদের বিস্মিত করে তার মধ্যে দ্য ইন্ডাস ভ্যালি অন্যতম। এখনো এই সভ্যতার যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে ততটুকু দেখে চোখ কপালে উঠে যায়। এর প্রধান কারণ অপূর্ব সব স্থাপত্যকর্ম। মানুষের হাতে গড়ে ওঠা সবচেয়ে নান্দনিক সভ্যতার নিদর্শন বহন করে দ্য ইন্ডাস ভ্যালি। বর্তমান আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত এ সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ অব্দের দিকে এ এলাকার অন্তত সাড়ে ১২ লাখ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত ছিল। এই সভ্যতায় শিল্প ও অলঙ্কার ব্যবসার বেশ প্রসার ঘটে। এর পাশাপাশি ইন্ডাস ভ্যালির লোকেরা পরিকল্পিত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও চালু করেছিল। যার নমুনা পাওয়া যায়। নৃতাত্ত্বিকদের খুঁজে পাওয়া নমুনায়। এ ছাড়া নগরের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রবর্তক ইন্ডাস ভ্যালি সভ্যতার লোকেরা বৃহৎ পরিসরে ব্যবসা-বাণিজ্যের উপযোগী ওজন পরিমাপ পদ্ধতি চালু করেন বলে একমত হয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এই সভ্যতার কেন্দ্রের ইতিহাস বিখ্যাত মহেঞ্জোদারো সভ্যতা অবস্থিত। ঐতিহাসিকদের কাছে এটি পৃথিবীর প্রথমদিককার অন্যতম শহুরে সভ্যতা হিসেবে বিবেচিত।  যোগাযোগের জন্য নিজস্ব লিখন পদ্ধতির উদ্ভাবন করে ইন্ডাস ভ্যালি সভ্যতার লোকেরা নিজেদের বিস্তৃত ইতিহাস লিখে যায়। যদিও তাদের ভাষারীতি সম্পর্কে এখনো অজ্ঞ বিশেষজ্ঞরা। সে কারণে তাদের লিখিত লিপির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। স্থাপনায় খোদাই কর্ম ও ধাতুবিদ্যার অনেকটা তাই এখনো অজানা।

 

খেমার

খেমার সভ্যতা। ইতিহাসের পাতায় এখনো সমুজ্জ্বল এই সভ্যতা। সর্বকালের অন্যতম রহস্যাবৃত সাম্রাজ্য হিসেবেও একে বিবেচনা করা হয়। খেমার সাম্রাজ্য ‘অ্যাঙ্কর’ সভ্যতা নামেও পরিচিত। এই সভ্যতার স্থাপত্যশৈলী প্রশংসিত। এই সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় প্রাসাদে গোলন্দাজদের জন্য ইস্পাত নির্মিত টাওয়ার এবং খোদাইকৃত অসাধারণ শিল্পকর্মের ইমারতগুলো শিল্পায়ন পূর্ববর্তী বিশ্বের এক শক্তিশালী সাম্রাজ্যের স্মৃতিচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে। খেমার সভ্যতার গোড়াপত্তন কোথা থেকে এসেছে এ নিয়ে বহু তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। তবে বেশির ভাগ বিশ্লেষকরা একমত হয়েছেন কম্বোডিয়ার প্রাচীন রাজারা খেমার সভ্যতা নির্মাণ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দের দিকে এ সভ্যতা ভিয়েতনাম থাইল্যান্ড এবং লাওসে বিস্তৃতি লাভ করে। খেমার সভ্যতার কেন্দ্র ছিল ‘অ্যাঙ্কর’ নামের একটি শহর। ‘অ্যাঙ্কর’ সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ ‘শহর’। শুধু স্থাপত্যশৈলীর জন্যই এই সভ্যতা অমরত্ব লাভ করেছে। এই সভ্যতার অন্যতম দিক হলো শুরুর দিকের যোগাযোগ তৈরিকারী সভ্যতাগুলোরও এটি একটি। স্থল যোগাযোগ ব্যবস্থার মূল সমস্যা বিভিন্ন খাল ও নদীর ওপর সেতু নির্মাণও ছিল যুগান্তকারী খেমার সভ্যতার অন্যতম কীর্তি।

খেমার রাজা সপ্তম জয়াভারনামের সময় রাজ্যের মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় কিছু হাসপাতাল নির্মাণ করেন। বাইরের শত্রুর আক্রমণ থেকে রাজ্য রক্ষায় খেমার রাজারা পাথর দিয়ে এমন কিছু সীমানা দেয়াল তৈরি করেন যা ডিঙিয়ে শত্রুর পক্ষে খেমার রাজ্যে প্রবেশ করা ছিল প্রায় অসম্ভব। অনেকেই বলে থাকেন খেমার সভ্যতার লোকেরা ধর্মভীরু ছিল। এদের বেশির ভাগই বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাস্কৃতিক উৎসব পালন করত।

প্রতি বছরই খেমার সাম্রাজ্যে কুস্তি প্রতিযোগিতার পাশাপাশি সামাজিক উৎসবের তালিকায় ছিল গানের আসর ও সরকারি, ধর্মীয় বিশেষ দিবস উপলক্ষে আতশবাজি পোড়ানো। শহরের কেন্দ্রে একটি মন্দির নির্মাণ করেছিল তারা। পুরো সভ্যতাটি হারিয়ে যায় কালের গহ্বরে। কীভাবে এই সভ্যতা মানুষের আড়ালে চলে যায় এ নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে।

সর্বশেষ খবর