শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধারাবাহিক উপন্যাস

অটোমান সূর্য সুলতালন সুলেমান পর্ব ৩১

রণক ইকরাম

অটোমান সূর্য সুলতালন সুলেমান পর্ব ৩১

মুসলিম শাসকদের মধ্যে যেমন শীর্ষে তেমনি পৃথিবীর ইতিহাসেও অন্যতম সেরা শাসক তিনি। সুলতান সুলেমান খান। অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান। সুলতান সুলেমানকে নিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে আলোচিত-সমালোচিত টিভি সিরিয়াল মুহতাশিম ইউজিয়েল। আমাদের এ উপন্যাসের ভিত্তি সেই টিভি সিরিজ বা উপন্যাস নয়। মূলত ইতিহাসের নানা বইপত্র ঘেঁটে সুলতান সুলেমানের আমলটি তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতিহাসাশ্রয়ী এ উপন্যাসের মূল ভিত্তি অটোমানদের ইতিহাস। বাকিটুকু লেখকের কল্পনা। উপন্যাসের শুরুর দিকে যুবরাজ সুলেমানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন পাঠক। সিংহাসনে তখন সুলেমানের বাবা সুলতান প্রথম সেলিম। সুলতান সেলিমের সর্বশেষ বিজয়, অসুস্থতা ইত্যাদি পথপরিক্রমায় অটোমান সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন সুলেমান খান। এর মধ্যেই হেরেম সংস্কৃতি, প্রাসাদ, প্রশাসনসহ নানা দিক উঠে এসেছে। সুলেমান খানের ক্ষমতা গ্রহণের পর নতুন সূর্যোদয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করে অটোমান সাম্রাজ্য। সে যাত্রায় পীরে মেহমুদ পাশাকে স্বপদে বহাল রেখে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন সুলতান। সবার প্রত্যাশার বাইরে পারগালি ইব্রাহিমকে বানিয়েছেন নিজের খাসকামরা প্রধান। সুলেমান রোডস অভিযানে সাফল্যের পর ফিরে এসেছেন। হুররেম খাতুন সন্তানসম্ভবা। পদ হারাতে চলেছেন পীরে পাশা। রকমারির প্রতি শনিবারের এ বিশেষ আয়োজনে আজ ছাপা হলো ৩১তম পর্ব।

একটা একটা করে অতীতের খাতায় নাম লিখিয়েছে সুলতান সুলেমান আর অটোমান প্রাসাদের অনেকগুলো দিন। খুব বেশি পালাবদল হয়নি দিনগুলোতে। কেবল পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সুলতানের কাছের বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষী পারগালি ইব্রাহিমের হাতে উঠেছে সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদের সিলমোহর। পারগালি ইব্রাহিম এখন আর বহিরাগত ভাগ্যবান সেই বাজপাখি রক্ষক নেই। সৌভাগ্যের মুকুটে নতুন পালক জুড়ে দিয়ে তিনি এখন পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী অটোমান সাম্রাজ্যের মাননীয় উজির।

শুধু কি তাই? সবাইকে অবাক করে দিয়ে এই পারগালির হাতেই তুলে দেওয়া হয়েছে অটোমান সাম্রাজ্যের রাজকন্যা সুলতানের সবচেয়ে প্রিয় বোন হেতিজাকে। অটোমান ইতিহাসের অন্যতম সেরা জাঁকজমকপূর্ণভাবে আয়োজন করা হয় তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানের। রাজ্য আর রাজকন্যা নিয়ে পারগালি ইব্রাহিম এখন অটোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তির নাম। অভিজাতদের কাছে তিনি ঈর্ষার কারণ। সাধারণের কাছে এক অপার বিস্ময়। অন্যদিকে সুলেমানের কাছে আস্থা-বিশ্বস্ততার অপর নাম। প্রধান উজিরের প্রতি সুলতানের নির্ভরতা বেড়েছে কয়েকগুণ। আর ইব্রাহিমও নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে সুলতানের প্রতি নিজের বিশ্বস্ততার প্রমাণ রেখে চলেছেন।

এর বাইরে হুররেম সুলতানও নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। এর মধ্যেই আরও দুবার মা হয়েছেন তিনি। একবার অবশ্য মৃত সন্তান প্রসব করেছেন। এরপরও অন্তঃপুর আর বাইরের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন তিনি। সুলতানের আগ্রহ-প্রশ্রয় আর প্রাধান্য হুররেম খাতুনকে সুলতানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন অনেকেই। নৈতিক বিরোধিতার কারণে পারগালি ইব্রাহিমের সঙ্গে আগের মতো সেই সুসম্পর্ক নেই হুররেমের। বিশেষ করে শাহজাদা মুস্তফার প্রতি ইব্রাহিমের দুর্বলতা হুররেমের সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ। ইব্রাহিমের সঙ্গে তাই প্রায়ই হুররেমের ঠাণ্ডা লড়াই চলে। নিজের পরিকল্পনামতো সব কাজ এগিয়ে নিতে প্রায়ই সুলতানের কান ভারি করেন রুশ সুন্দরী হুররেম।

হুররেম যত প্রাধান্য পাচ্ছেন ততই গৌণ হয়ে উঠেছেন মাহিদেভরান। তার সব স্বপ্ন আর ভাবনা এখন কেবল মুস্তফাকে নিয়েই। বালিদ সুলতান আয়েশা প্রায়ই অসুস্থ থাকছেন। সুলতানার আগের সেই ঝাঁঝটা এখন আর নেই। এখন তিনি অনেকটাই ঠাণ্ডা। এসবের মধ্যে সুলতান সুলেমান আগের মতোই কখনো কবি, কখনো রক্ষক আবার কখনো পাগল প্রেমিক। তবে বৈশ্বিক রাজনীতিতে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠেছেন তিনি। এতসব পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়েও পাল্টায় না হেরেমের অন্তঃপুরের নারীদের জীবন। তাই হেরেমের নারীদের একঘেয়েমি থেকে মুক্ত করতে অটোমানদের প্রমোদভ্রমণ আয়োজনের নিয়ম ছিল।

 

অনেক বছর পর সেরকমই এক প্রমোদভ্রমণের আয়োজন করা হয়েছে। হালকা হিমেল হাওয়ার পরশের সঙ্গে চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল একটা দিন। মাথার ওপর গাঢ় নীল আকাশ। ফুটেছে সূর্যমুখী ফুল। এমন প্রমোদভ্রমণের জন্য একেবারে আদর্শ বলা চলে। দূরে বসফরাস নদীর তীরে স্রোতের তালে দুলছে নৌকা। নৌকার ওপর থেকে শখের বশে মাছ ধরার চেষ্টা করছে একদল খোজা। এমন উপলক্ষ ছাড়া নিজের মতো সময় কাটানোর সুযোগ এরা খুব কমই পায়।

গাছের ছায়ায় দামি পার্সিয়ান কাপড়ে তৈরি কার্পেট বিছানো হয়েছে। হেরেমের মেয়েরা সেখানে বসে গল্পগুজব করছে। সামনেই ফল এবং শরবতের সমারোহ। একটু দূরে তাঁবু টানানো মঞ্চে বাঁশি এবং তানপুরা বাজাচ্ছে বাদকের দল।

 

বালিদ সুলতান আয়েশা, হেতিজা, মাহিদেভরান, মুস্তফা, সারা খাতুন আর মনজিলারাও আরেক পাশে বসা। এর একটু দূরে বসা হুররেম খাতুন। সঙ্গে ইসাবেলা আর আদরের সন্তানদ্বয়। দামি পাথর খচিত একটা আয়নায় নিজের চেহারা দেখছে হুররেম। কিছুদিন আগেই এই আয়নাটা তাকে উপহার দিয়েছিলেন সুলতান। মাঝে মাঝেই এদিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন মাহিদেভরান। সুলতানের সঙ্গে সম্পর্কটা স্বাভাবিক রূপ পেলেও তিনি ভালো মতোই জানেন তার প্রতি সুলতানের আর কোনো আকর্ষণ নেই। অটোমান সাম্রাজ্যের ব্যস্ততার দিনগুলোর বাইরে যেটুকু আবসর, এর পুরোটাই যেন হুররেমের জন্য। এমনকি মেহমেদকে সহ্য করতে পারেন না মাহিদেভরান। রাজরক্তের লড়াই বুঝি একেই বলে। অবুঝ শিশুকেও শত্রু বানিয়ে দেয় মুহূর্তেই। অথচ মাহিদেভরান এমন ছিলেন না কখনোই। যত লড়াই-ই থাকুক না কেন, একটা জায়গায় মাহিদেভরান আর হুররেমের দারুণ মিল। দুজনেই সুলতানের সান্নিধ্য পেতে চান। দুজনেই সুলতানের ভাগ কাউকে দিতে চান না। এমনকি এই মুহূর্তেও আর সবার মতো তারা দুজনেই সুলতানের আগমনের অপেক্ষায় আছেন। প্রমোদভ্রমণে গোটা বহর আরও আগে পৌঁছে গেলেও স্বয়ং সুলতান এখনো এসে পৌঁছাননি। ভেনেসীয় বণিকদের সঙ্গে কর-সংক্রান্ত একটা জরুরি সভা শেষ করে এখানে আসার কথা তার। সবাই সুলতানের আগমন পথের দিকে অনিঃশেষ তাকিয়ে।

 

হঠাৎই রোদের আলো ঝাপসা করে চিক চিক বালির দেখা মিলল। ঘোড়া ছুটিয়ে সঙ্গীদলসহ আসছেন সুলতান। কারও আদেশ-নির্দেশ ছাড়াই তাকে সম্ভাষণ জানাতে এগিয়ে আসে সাধারণ প্রহরী আর দাসেরা। তাকে দেখে অনেকেই ফিসফাঁস শুরু করে ‘উপহার! পুরস্কারে পুরস্কার আসে!’

 

সেই পৌরুষ, সেই নিখুঁত সোনালি সাজপোশাক, সেই সঙ্গে সচকিত আচার-আচরণ ক্ষমতার বিশালত্ব ও ব্যক্তিত্বকে আড়াল করে ঘোড়া থেকে নামলেন সুলেমান। মন ভরে অভিবাদন গ্রহণ করলেন তার ওপর নির্ভরশীল প্রিয় মানুষের। নেমেই মায়ের দিকে এগিয়ে গেলেন সুলতান। সবাইকে এড়িয়ে সবার আগে মায়ের সঙ্গে দেখা করাটাকেই বড় করে দেখলেন সুলতান।

 

হেরেমের মেয়েদের আড্ডা জমে উঠেছে। আড্ডার বিষয় বস্তুও খুব মজার। হুররেম আর মাহিদেভরান।

‘দেখবি সুলতান ঠিকই ফিরবেন মাহিদেভরানের কাছে।’

‘বলেছে তোকে। এখনো তুই এই তর্ক কী করে করিস?’

‘কেন? এখনো তো মাহিদেভরানই সুলতানা।’

‘কিন্তু হুররেম খাতুন কম কিসে? শাহজাদার মা হয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা সুলতান তাকেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন।’

‘কিন্তু বড় শাহজাদা মুস্তফা কিন্তু উত্তরাধিকারী হিসেবে দারুণভাবে বেড়ে উঠছেন।’

আলেতন আর সিরহনের কথার মাঝখানে মেলিসা নামের কালোচুলের এক মেয়ে আঙ্গুর মুখে পুরে বলল,

‘হুররেম সম্পর্কে অনেক গুজব আছে। সে নাকি ডাইনি?  মন্ত্রতন্ত্র জানে? এই তন্ত্রমন্ত্রের প্রভাবেই নাকি সে সুলতানকে মাহিদেভরানের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে।’

এবার আর কোনো প্রতিবাদ করে না আলেতন।

সুযোগ পেয়ে আরও কথা যোগ করে সিরহন।

‘ইদানীং নাকি প্রাসাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় আর রাজনীতি নিয়েও নাক গলানো শুরু করেছে।’

‘কীভাবে?’

‘সুলতান নিজেই নাকি তার সঙ্গে কথা বলেন।’

‘আমরা এসব আলাপ করে আর কী করব। আদার ব্যাপারির জাহাজের খবর নিয়ে কী লাভ?’

‘কিন্তু মাহিদেভরানের জন্য খারাপ লাগছে। সুলতান তাকে অবহেলা করে ঠিক করছেন না।’

‘অনেকে বলেন, ডাইনিকে বিয়ে করার কারণে সুলতানকে নাকি আল্লাহ শাস্তি দিচ্ছেন। এ কারণেই হুররেমের শেষ সন্তানটা মারা গেছে।’

‘কিন্তু হুররেমের এখনো দুটো সন্তান আছে। আর সামনেই সে আরেকবার মা হতে যাচ্ছে।’

‘এটাও মন্দ বলোনি। আসলেই হুররেম দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।’

‘তবে যেটাই ঘটুক না কেন, মুস্তফাই ভবিষ্যৎ সুলতান।’

‘কিন্তু শুনলাম হুররেম খাতুন নাকি মুস্তফাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছে।’

গলার স্বর নিচু হয়ে আসে আলেতনের। শুনে চোখ কপালে ওঠে সিরহনের।

‘কী সাংঘাতিক! কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব?’

‘আরে নাহ! অত সহজ না। সুলতান মুস্তফাকে অনেক ভালোবাসেন। আর তা ছাড়া এরকম একটা কাণ্ড করে নিশ্চয়ই ছাড় পাবেন না হুররেম!’

 

হেরেমের সাধারণ মেয়েগুলোর অবসরের আলাপ হলেও এই কথাগুলো দারুণ তাত্পর্যপূর্ণ। সত্যিকার অর্থেই গত পাঁচ বছরে পাল্টে গেছে সুলতানের জীবনধারা। আস্তে আস্তে সুলতানের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছেন হুররেম। কখনো ইচ্ছায় কখনো অনিচ্ছায় হুররেমের সঙ্গেই নানা বিষয় নিয়ে আলাপ করেন। মাহিদেভরান এসবের কিছুই বুঝত না। কিন্তু হুররেম খাতুন দারুণ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সুলতানের কথার জবাব দেন। আলোচনা জমজমাট হয়ে ওঠে। নিজের মায়ের পর এমন বুদ্ধিমতী নারী সুলতান তার জীবনে আর কাউকে দেখেনি। হেরেম থেকে শুরু করে রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিষয় এমনকি যুদ্ধ বিষয়েও হুররেমের জ্ঞান রীতিমতো অবাক করার মতো। এসব বিষয় সুলতানকে আস্তে আস্তে হুররেমের প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভরশীল করে তোলে। হুররেমকে যত দেখছেন ততই বিস্মিত হচ্ছেন সুলতান। একজন মানুষের মধ্যে এতগুণ থাকে কীভাবে? নাচ, গান, অভিনয় সবই পারে। এমনকি রাজনীতি বিষয়েও রাখে সম্যক জ্ঞান। আরেকটা কথা কেবল সুলতান জানেন। বিষয়টা ব্যক্তিগত। বিছানায় হুররেমের তুলনা কেবল হুররেমই। প্রতি রাতেই নতুন নতুন বিস্ময় নিয়ে হাজির হয় সে। কাম-কলার পুরোটা যেন তার রপ্ত করা। সুলতানের মাঝে মাঝে মনে হয় হুররেমের সঙ্গে পরিচয় না হলে বোধ হয় বিছানার অনেক তৃপ্তিই অচেনা থেকে যেত সুলতানের। একটা পুঁচকে রাশিয়ান মেয়ে এভাবে অটোমান সুলতানকে জয় করে নেবেন কখনো ভাবেননি সুলতান।

গান-বাজনা, ভূড়িভোজ আর আনন্দ আয়োজনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো অটোমানদের দুই দিনব্যাপী প্রমোদভ্রমণের। কিন্তু এর মধ্যেই একাধিক ঘটনা সুলতানকে আকুল করে তুলল। প্রথমত,  হেতিজার শরীর খারাপ। তাই পারগালি ইব্রাহিমকে ছুটি দিয়েছেন। ফলে সুলতানের কাছাকাছি পরামর্শ করার মতো আর কেউ নেই। সাধারণ কারও সঙ্গে কথা বলতে সুলতানের ভালো লাগে না। বাকি থাকে হুররেম। মাঝে মাঝেই তার সঙ্গে কথা বলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন সুলেমান। এবারও তাই হুররেমের সঙ্গে কথা বলাটাই সুবিধাজনক মনে হলো তার কাছে।

‘একটু ঝামেলা হয়ে গেছে বেগম?’

‘কী হয়েছে আমার সুলতানের?

‘শরীর খারাপ?

‘না।’

‘তাহলে?’

‘বিষয়টা রাজনৈতিক। কী করব বুঝতে পারছি না।’

‘আপনার আপত্তি না থাকলে আমায় বলতে পারেন।’

‘হাঙ্গেরির ফ্রেডারিক আবার লম্ফঝম্প শুরু করেছে। উল্টা পাল্টা কথাও বলছে। সে নাকি আমাদের বিরুদ্ধে সৈন্য তৈরি করছে। কিন্তু সে তো জানে না জাপোলিয়া ইতিমধ্যেই লোক পাঠিয়ে ইব্রাহিমের সঙ্গে কথা সেরে রেখেছে।’

‘তাহলে তো কোনো সমস্যাই নেই। আপনি এত বড় সম্রাট। এসব খুচরো ব্যাপারে আপনার মাথা ঘামালে চলবে কেন? ইব্রাহিম পাশার ওপরই ছেড়ে দিন। দেখবেন তিনি সব সামলে নেবেন।’

বছর দুয়েক আগে সুলতান ইব্রাহিমের নেতৃত্বে হাঙ্গেরির রাজাকে অপসারণ করতে সৈন্য দল পাঠিয়েছিলেন সুলতান। নিজে না গেলেও সেই অভিযান সফল হয়েছিল। রাজাকে অপসারণও করা হয়। কিন্তু সমস্যা পুরোপুরি দূর হয়নি।  হাঙ্গেরি, তুরস্ক থেকে অনেক দূরে হওয়ায় সুলতান সেখান থেকে তার সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। হাঙ্গেরি সুলতানের দখলে থাকলেও সেখানে কোনো প্রশাসক নিয়োগ করেননি তিনি। এখন ফ্রেডারিক এবং হ্যাপসবার্গ পরিবারের জাপোলিয়া হাঙ্গেরি আবার দখলের চেষ্টা করছে।

সুলেমানকে চিন্তিত দেখাল।

‘আপনি কী ভাবছেন জাহাপনা?’

‘ভাবছি আগে কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। ফ্রেডারিককে নাকি জাপোলিয়াকে? হাঙ্গেরির এখনকার রাজা সুলতান সুলেমান। আমার অনুমতি ছাড়া তারা ওই জায়গা দখলের চেষ্টা করে। এত বড় সাহস? আমি আবার সেনা পাঠাব।’

‘কিন্তু হুজুর...

নরম গলায় বাধা দিল হুররেম।

‘তাহলে তো প্রতি বছরই আমাদের সৈন্য পাঠাতে হবে জায়গাটা দখলে রাখার জন্য।’

সুলেমানের চিন্তা আর মাথা দুই-ই ঘুরে গেল। হুররেম সত্যি কথাই বলেছে। এভাবে তিনি ভেবে দেখেননি।

‘তাহলে এখন কী করা যেতে পারে খাতুন?’ জানতে চাইলেন সুলতান।

‘আমার পরামর্শ হলো জাপোলিয়াকে হাঙ্গেরি শাসনের ভার দিন। তবে কিছু শর্ত সাপেক্ষে। যেভাবেই হোক তাকে অবশ্যই আপনার অধীনে রাখতে হবে। আপনি নিজে মুকুট জাতীয় একটা কিছু পরিয়ে দিতে পারেন। তাতে সে নিজেকে রাজা ভাবতে শুরু করবে। আপনি চাইবেন তার আনুগত্য। ফলে জাপোলিয়াই সেখানকার অটোমান বাহিনীর দূত হিসেবে কাজ করবে।’

‘কিন্তু জাপোলিয়া কি ফ্রেডারিকের সেনাবাহিনীকে ঠেকাতে পারবে? তার তো এত ক্ষমতা নেই।’

‘না পারুক। সমস্যা নেই। ব্যাপারটা আরেকভাবে দেখুন। এটা হচ্ছে অনেকটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো। আপনি জাপোলিয়াকে শাসনভার দিলে সেটা ফ্রেডারিকের পছন্দ হবে না। সে আক্রমণ করবে জাপোলিয়াকে। জাপোলিয়াও ঠেকাতে পারবে না। পতন ঘটবে তার। এই যুদ্ধের কথা আমাদের কানে এলে তখন আমরা হাঙ্গেরি আক্রমণ করব। আর ফ্রেডারিকের সৈন্যবাহিনীকে পরাজিত করব। ফ্রেডারিকের বাহিনী তখন ক্লান্ত থাকবে। আর জাপোলিয়া হিসেবের বাইরে। ফলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা সম্ভব হবে আমাদের।’

এবার সুলতানের কপালের রেখা আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠল। চোখ তুলে বসফরাসের দিকে তাকালেন। চিন্তা করলেন কিছুক্ষণ।

তারপর বললেন, ‘জাপোলিয়াই ঠিক আছে।’

‘জাহাপনা। বেয়াদপি নেবেন না। আমি আমার ভাবনাটুকু বলেছি। আপনি আমার চেয়ে অনেক ভালো জানেন এবং বুঝেন আপনাকে পরামর্শ দেওয়ার মতো ধৃষ্টতা আমার নেই।’

জবাবে আর কোনো উত্তর দিলেন না সুলতান। কেবল মৃদু হাসলেন। হুররেম জানেন এই হাসির মধ্যে সুলতানের সন্তুষ্টিই লুকিয়ে আছে। যেটি অর্জনের জন্য হুররেমকে দিনের পর দিন নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে।

 

মায়ের নির্দেশে মাহিদেভরানের সঙ্গে খাবার খেতে এসেছেন সুলতান। খাওয়া শেষ হলে শীতল গোলাপজল পান করে একটা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন সুলতান। এতক্ষণে খুব একটা কথা হয়নি সুলতান আর মাহিদেভরানের।

সুযোগ বুঝে এবার মুখ খুললেন মাহিদেভরান।

‘সুলতানের কী আমার প্রতি রাগ এখনো কমেনি?’

‘কিসের রাগ?’

সুলতান অবাক হলেন যেন!

‘তাহলে সব এমন কেন?’

‘কেমন?’

‘এই যে আমি আপনাকে একদমই কাছে পাই না। আপনি কেমন যেন দূরে দূরে থাকেন।’

‘নাহ! তা হবে কেন। এই খানিক ব্যস্ত থাকতে হয়। এত বড় সাম্রাজ্য কত রকম কাজ সামলাতে হয়।’

‘ভুল হলে ক্ষমা করবেন। তবু সাহস করে বলছি আপনি কতদিন আমাকে বিছানায় চান না। যখনই আপনি এখানে আসেন, আসেন শুধু মুস্তফাকে দেখতে। আমার কোনো খোঁজ তো আপনি রাখেন না!’

সুলতান কোনো উত্তর দিলেন না। মাহিদেভরানের জন্য একটু খারাপ লাগছে তার। কিন্তু এখানে এলেই হুররেমের কথা মনে পড়ে। ঠিক তখনই মাহিদেভরানকে সবদিক থেকে পেছনে ফেলে জিতে যান হুররেম।

 

► পরবর্তী পর্ব আগামী শনিবার

সর্বশেষ খবর