বুধবার, ২৯ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

মাহাথিরের ছবির শহর পুত্রাজায়া

মাহাথিরের ছবির শহর পুত্রাজায়া

মালয়েশিয়ায় ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন। ১৯৫৭ সালের ৩১ আগস্ট দেশটি ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৬৩ সালে উত্তর বোর্নিও, সারাওয়াক ও সিঙ্গাপুর নিয়ে গঠিত হয় মালায়া ইউনাইটেড। সেখান থেকেই দেশটির নামকরণ করা হয় মালয়েশিয়া। মাত্র দুই বছর পরই ১৯৬৫ সালে সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া ফেডারেশন থেকে বহিষ্কার হয়ে আলাদা হয়। স্বাধীন মালয়েশিয়া তার নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে যাত্রা শুরু করে। উঁচু-নিচু পাহাড়ঘেরা অসমতল এবং নানা ধর্ম-জাতি ও গোত্রের সমন্বয়ে দেশটি শুরুতে ছিল অত্যন্ত অনুন্নত। পশ্চাৎপদ ও জাতি হিসেবে ছিল খুবই অলস প্রকৃতির। তবে দেশটির মেয়েরা অত্যন্ত পরিশ্রমী। আশির দশকে দেশটির হাল ধরেন মালয়েশিয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা ড. মাহাথির মোহাম্মদ। সেই থেকেই ধীরে ধীরে মালয়েশিয়া হয়ে ওঠে বিশ্বের রোল মডেল। বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম একটি আধুনিক শহর। এর পেছনের কারিগর ড. মাহাথির মোহাম্মদ। সম্প্রতি মালয়েশিয়া ঘুরে এসে দেশটির নানা বৈচিত্র্যের গল্প জানাচ্ছেন— মাহমুদ আজহার

ছবি তুলেছেন— জয়ীতা রায়

 

 

ছিমছাম ছবির মতো সাজানো গোছানো শহর মালয়েশিয়ার পুত্রাজায়া। কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর থেকে নেমে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরের পথ। যানজটমুক্ত পরিকল্পিত ও সাজানো গোছানো শহর পুত্রাজায়া। পৃথিবীর অন্যতম প্রধান আধুনিক ও শৈল্পিক-স্থাপত্য শিল্পের পরিপাটি নগরী। শহরটি তথ্যপ্রযুক্তির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এ শহরটি। ৪৯ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই শহরটি রাজধানী কুয়ালালামপুর থেকে দূরত্ব প্রায় ৩৬ কিলোমিটার। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের সঙ্গেই লেকবেষ্টিত দৃষ্টিনন্দিত পুত্রা মসজিদ দৃষ্টি কাড়ে পর্যটকদের। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকের দেখা মেলে ঝিলপাড়ে। লন্ডনের টেমস নদীর ব্রিজের আদলে গড়ে তোলা হয়েছে পুত্রায় এ দুটি ব্রিজ। সেখানে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এ শহরটির স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ। তিনি দেশটির চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী মেয়াদে থাকা অবস্থায় এই শহরটি গড়ে তোলেন। তার প্রস্তাবেই কুয়ালালামপুর থেকে বেশকিছু সরকারি দফতর পুত্রাজায়ায় স্থানান্তর করা হয়। গড়ে তোলা হয় বিশাল এলাকাজুড়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। বাসভবনের সামনে বিশাল উন্মুক্ত স্থান। চারপাশে পর্যটকদের গাড়ি রাখার স্থান।

জানা যায়, কুয়ালালামপুর শহরটি অতিরিক্ত জনবহুল হওয়ায় ১৯৯৯ সালে প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রাজায়াতে স্থানান্তরিত করেন মালয়েশিয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা ড. মাহাথির মোহাম্মদ। অবশ্য বর্তমানে এখানেও জনসংখ্যার আধিক্য দেখা দিয়েছে। ১৯১৮ সালে ব্রিটিশরা স্থানটি উন্মুক্ত করে। তখন এয়ার ‘হিতাম’ নামকরণ করা হলেও এর আদি নাম ‘প্রাং বেসার’। মূল ভূখণ্ডটি ৮০০ একরের হলেও পরবর্তী সময়ে এর পরিধি কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হয়। এখন পরিধি ৮ হাজার একর বা ৩২ বর্গকিলোমিটার। শহরটির প্রায় ৪০ শতাংশ প্রাকৃতিক। পুরো নগরকে কেন্দ্র করে রয়েছে সবুজ বনানী। বোটানিক্যাল গার্ডেনের অপরূপ ল্যান্ডস্কেপ এই শহরকে করে তুলেছে অনন্য এবং আরও দৃষ্টিনন্দন। এর সঙ্গে বাড়তি যোগ হয়েছে বিভিন্ন ধরনের জলাশয় এবং পানির ধারা। বিশেষ করে, পুত্রাজায়া লেক পুরো নগরের আকর্ষণের বিশ্রাম-বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র। শহরজুড়ে বিস্তৃত এই লেক। শহর  কেন্দ্রে কোলোস্যাল শোকেস বিল্ডিং পুত্রাজায়ার সব থেকে আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান। এখানে ধর্মীয় স্থাপনাগুলোতে প্রবেশে কিছু বিধিনিষেধ মানতে হয়। বিশেষ করে, পোশাকের ক্ষেত্রে। উদাহরণ হিসেবে পের্দানা পুত্রা, সেরি পের্দানা এবং পুত্রা মসজিদের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এখানে টি-শার্ট, হাফ প্যান্ট, পাদুকা অথবা যে  কোনো অশালীন পোশাক পড়ে অবস্থান নিষেধ।

১৯৯৫ সালের আগস্টে নির্মাণকাজ শুরু হয় পুত্রাজায়ার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এটা ছিল মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বড় বাজেট প্রকল্প। এটার বিশেষত্ব হচ্ছে, পুরো প্রকল্পের পরিকল্পনা, নকশা ও নির্মাণকাজ মালয়েশিয়ার নিজস্ব। বিশেষ দিক হচ্ছে, ৩৮ ভাগ জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে সবুজায়নে। প্রকল্পের কাজ শেষ দিকে থাকা অবস্থায় ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর দফতর ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ পুত্রাজায়ায় স্থানান্তরিত হয়। আর পরিকল্পিত, পরিবেশবান্ধব, বাগানসদৃশ পরিপাটি শহরের নাম দেওয়া হয় পুত্রাজায়া। ভবনের স্থাপত্যশৈলী, নকশা, চার পাশের গ্রিন স্পেস, মন মাতানো সাজসজ্জা যে কাউকে আকর্ষণ করবে। পুত্রাজায়া লেকের সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। লেকের ওই পাড়ে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর আবাসিক কার্যালয়। তার পাশেই উপপ্রধানমন্ত্রীর আবাসিক কার্যালয়। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দফতরগুলোর মধ্যে রয়েছে, অর্থ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পর্যটন ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। রয়েছে পারডানা লিডারশিপ ফাউন্ডেশন, বিচারালয়, হেরিটেজ স্কয়ার, লৌহ নির্মিত টুংকু জয়নাল আবেদীন মসজিদ, পুত্রাজায়া ল্যান্ডমার্ক, ওয়েটল্যান্ড পার্ক। মিলেনিয়াম মনুমেন্ট, ন্যাশনাল হিরোজ স্কয়ার ও স্বাধীনতা চত্বরও পুত্রাজায়ায়। পুত্রাজায়ায় আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টার (পিআইসিসি), লৌহ মসজিদ (স্টিল মস্ক), পুত্রাজায়া ব্রিজ, পুত্রাজায়া বোটানিকেল গার্ডেন, ইমিগ্রেশন অফিসও রয়েছে। 

পুত্রাজায়া আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের একটু সামনে লেকের ওপর ব্রিজ। এখানে কেউ এসে দাঁড়ালে তার সব দুঃখ-কষ্ট ঘুচবে। প্রিশান্তি উপচে পড়বে। লেকের পানিতে ভাসমান পুত্রা মসজিদ, পেছনে দৃষ্টিনন্দন পুত্রাজায়া সম্মেলন কেন্দ্র, সামনে সরলরেখাকৃতি পার্কসদৃশ সড়ক আর ডানে সমুদ্রসদৃশ লেকের অবশিষ্ট অংশ এবং তার তীরে দৃষ্টিনন্দন বিভিন্ন স্থাপনা। পরিপাটি সৌন্দর্যের এই লীলাভূমিতে পর্যটকদের ভিড় বছরজুড়েই লেগে থাকে।

খেলাধুলা প্রেমীদের জন্য পুত্রাজায়ার আকর্ষণের স্থান ‘তামান অ্যাকুস্ট্রিয়ান পুত্রাজায়া’। পুত্রাজায়ার জনপ্রিয় বিনোদনের স্থান এটি। এখানে আধুনিক রেস্টুরেন্ট, সুইমিংপুল,  টেনিস কোট, মাল্টিপারপাস হলসহ রয়েছে নানা ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থাও। রাতেও রয়েছে আকর্ষণীয় সব বিনোদন আয়োজন। সেরিওয়ওয়াসানা ব্রিজ হতে পারে আকর্ষণের  কেন্দ্রবিন্দু। সেতুটির নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি রেখে পুরো  সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ মিলবে রাতভর। এ ছাড়াও পুত্রাজায়া লেক এড়িয়ে মসজিদ চত্বরে অবস্থিত এসকেলেটর বেয়ে নিচে নেমে ফুডকোটেও বেশকিছু সময় কাটানো যায় একান্তে।  কেনাকাটার জন্য আলামান্দা পুত্রাজায়ার সবথেকে প্রসিদ্ধ স্থান। এখানে বিভিন্ন ধরনের উপকরণের পাশাপাশি মিলবে ফুলের বিপুল সমারোহ।

পের্দানা পুত্রা : প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এটি। ভবনটি নির্দিষ্ট সময়ে অভ্যাগতদের জন্যও উন্মুক্ত রাখা হয়। সাধারণত সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২:৩০ মিনিট এবং দুপুর ২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত সপ্তাহের সোম থেকে শুক্রবার চাইলেই যে কেউ প্রবেশ করতে পারবেন। তবে এখানে যে কোনো পরিচয়পত্র প্রদর্শন করে তবেই প্রবেশের অনুমতি পাওয়া যায়। বিদেশিদের জন্য পাসপোর্টই পরিচয়পত্র।

পুত্রা মসজিদ : মসজিদটি মনোরম গোলাপি বর্ণের। এখানে একসঙ্গে ১৫০০০ লোক একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন। এর প্রধান মিনারটি দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ মিনার। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত মসজিদটি সবার জন্য উন্মুক্ত। প্রার্থনার সময় মুসলমান বাদে অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রবেশের ক্ষেত্রে নিরুৎসা্হিত করা হয়। জানা গেছে, এই মসজিদটির অর্থায়ন করেছেন ওসামা বিন লাদেন।

পুত্রাজায়া ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার : পুত্রাজায়া বুলেভার্ডের শেষপ্রান্তে এই স্থাপনা। ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিসের সম্মেলনের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল এটি। ভবনটিতে মালয় ঐতিহ্যের ছাপ রয়েছে, যা সব দর্শনাথীর নজর কাড়ে।

ক্রুজ তাসিক পুত্রাজায়া : প্রমোদ নৌবিহারের ব্যবস্থা রয়েছে। পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী ৪-৬ আসন বিশিষ্ট গন্ডলা ধাঁচের পেরাহু নৌযানে ঘুরে দেখা যায় পুত্রাজায়া। ৭৬ আসন বিশিষ্ট শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রমোদতরীও রয়েছে এখানে। যানটি বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে যাত্রাবিরতি দিয়ে পুরো পুত্রাজায়া ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। ছুটির দিন হলে বাড়তি কিছু খরচ হবে। নৈশভোজের সুযোগ মিলবে নৌযানেই। এজন্য অবশ্যই বুকিং দিতে হবে আগে থেকে।

সেরি পের্দানা : মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর প্রশাসনিক ভবন সেরি পের্দানা। বরাবরই পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু স্থানটি। সর্বসাধারণের অবাধ যাতায়াত বন্ধ। তবে জাতীয় দিবসগুলোতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।

উইসমা পুত্রা : স্থাপনাটি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন। সেরি পের্দানায় বিধি নিষেধ আরোপের পর দর্শনার্থীরা ভিড় জমান এখানে।

স্তানা মেলাওয়াতি এবং ইস্তানা দারুল এহসান : স্থান দুটি পর্যায়ক্রমে  দেশটির রাজা এবং সেলাংগোর প্রদেশের সুলতানের বাসভবন। পর্যটকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আছে। তবে বিশেষ দিবসে প্রবেশ করা যায়।

ডিপ্লোমেটিক এনক্লেভ : প্রবাসী দূতাবাসের জন্য বরাদ্দকৃত স্থান এটি। এই স্থান পরিদর্শন করেই অনেক পর্যটক হাতের সময়টুকু ব্যয় করেন।

পের্দানা লিডারশিপ ফাউন্ডেশন : সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রাত্যহিক কাজের জন্য বরাদ্দকৃত স্থান এটি। বর্তমানে এটি ড. মাহাথির মুহাম্মাদের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হয়।

তামান পুত্রা পের্দানা : খুবই নীরব পাহাড়ের চূড়ায় বসে পুত্রা পের্দানা ভবনটি উপভোগ করা যায়। অর্থাৎ প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে কৃত্রিম ভবনের এক অসাধারণ মেলবন্ধন।

মিলেনিয়াম মনুমেন্ট : স্থানটি মালয়েশিয়ার ইতিহাসের স্মারক হয়ে রয়েছে। ভাস্কর্যটি কিছু থামের সাহায্যে ফুলের আকৃতি পেয়েছে।

পুত্রাজায়া বুলেভার্ড : ১০০ মিটার চওড়া এবং ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘের এই রাজকীয় পথটি মূলত বিশেষ জাতীয় দিবসের প্যারেডের জন্য। বাকি সময় স্থানটি থাকে উন্মুক্ত। আরও আছে  বোটানিক্যাল গার্ডেন। খোলা থাকে সকাল ১০টা  থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। ছুটির দিনে খোলা থাকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত।

 

 

২৭২ সিঁড়ি অতিক্রম করে

বাতু গুহায়...মালয়েশিয়ার সেলাঙ্গোরে বাতু কেভসের (গুহা) অবস্থান। রাজধানী কুয়ালালামপুর দূরত্ব প্রায় ১৩ কিলোমিটার। কথিত আছে, গুহাটি ৪ কোটি বছরের পুরনো। গুহায় প্রধান মন্দিরটি ১১৬ বছরের প্রাচীন বলেও কেউ কেউ ধারণা করেন। গুহার সামনে হিন্দু দেবতা মুরগানের বিশাল আকারের একটি মূর্তি। ২৭২টি সিঁড়ি অতিক্রম করে মূল গুহা পর্যন্ত পৌঁছানো যায়। প্রতি দিন হাজার হাজার পর্যটক এবং তীর্থযাত্রী এই পর্যটনকেন্দ্রে ভিড় করেন। গুহার ওপরে উঠতে ঘাম ঝরে পর্যটকদের। ৪০০ ফুট উচ্চতায় উঠে এ গুহা থেকে সেলফি বা নিজের ছবি তুলতেও ভুল করেন না কেউ। গুহার ভিতরে ছোট দুটি দোকান রয়েছে। সেখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মূর্তিসহ নানা সামগ্রী পাওয়া যায়। বাতুকেভের ডানপাশে ১৪০-ফুট-উচ্চতায় প্রভু মুরগানের একটি মূর্তি রয়েছে। মূর্তিটি ২০০৬ সালের ২৯ জানুয়ারি স্থাপিত হয়। প্রায় ১৫৫০ ঘন মিটার কংক্রিট, ৩০০ লিটার সোনালি রং এবং ২৫০ টন ইস্পাত দণ্ড এই বিরাট মূর্তিটি নির্মাণ করতে ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বাতু কেভ খোলা থাকে। মূর্তির সামনেই বেশ খোলা স্থান। আশপাশে রয়েছে কয়েকটি ইন্ডিয়ান খাবার হোটেল। গোম্বাক স্টার হোটেল, বাতু কেভস বিজনেস হোটেল,  হোটেল সাহারা ইন, তমন শ্রী বাতু কেভস এবং  হোমস্টে বোগেনভিলিয়া। বাতু কেভস ওরফে শ্রী শুব্রানিয়ার মন্দির হল প্রভু মুরগানের প্রতি উৎসর্গকৃত হিন্দু মঠ। গুহাগুলো সুঙ্গাই বাতু বা বাতু নদের নামানুসারে নামকরণ করা হয় বলে স্থানীয়রা জানান। ২০০৯ সালে মালয়েশিয়া সরকার গুহা ভবনটির উন্নয়নে ৩.৬ মিলিয়ন আরএম ব্যয় করে।

 

 

আকাশচুম্বী কেএল টাওয়ারে সেলফি চাই

কুয়ালালামপুর যাবেন, আকাশচুম্বী কেএল টাওয়ারকে নিয়ে নিজের  সেলফি তুলবেন না—তা কি হয়? প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক এখানে এসে সেলফি তুলছেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জমজমাট কেএল টাওয়ার। কেউ কেউ ‘পেট্রোনাইজ টুইন টাওয়ার’ বলেও ডাকেন। ‘সেলফি জোন’ বলেও পর্যটকদের মন্তব্য। এখানে পাওয়া যায় সেলফি স্ট্রিক ও ক্যামেরা। কেএল টাওয়ার নিয়ে নিজের মোবাইলে ছবি তোলার সময় চারদিকে ঘিরে ধরে কিছু তরুণ। তাদের হাতে ক্যামেরা ও সেলফি স্ট্রিক। কেএল টাওয়ারের দুই পাশের ফোয়ারাও পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে। মালয়েশিয়ার মেনারা কুয়ালালামপুর, জালান পি রামলির  পেছনে ২ জালান পানচাকে কেএল টাওয়ারের (কুয়ালালামপুর টাওয়ার) অবস্থান।

এটা কুয়ালালামপুরের মসজিদ ইন্ডিয়া, কোতারায়া ও বুকিট বিনতাং এলাকার কাছেই। কে এল টাওয়ার বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা টেলিকম টাওয়ারের মধ্যে অন্যতম। এই আকাশচুম্বী টাওয়ারটির ওপর একটি বাল্বের অবলম্বিত অবস্থান, মালয়েশিয়ার ঘূর্ণায়মান খেলনার প্রতিকৃতির অনুরূপ। কেএল টাওয়ারে একটি ঘূর্ণায়মান রেস্তোরাঁ ও একটি পর্যবেক্ষণ  ডেক আছে। ওপর থেকে পুরো মালয়েশিয়া দেখা যায়। কেএল টাওয়ার বিশ্বের ছয় নম্বর অবস্থানে। কেএল টাওয়ারের চূড়ায় উঠতে হয় লিফটে করে। চূড়ায় যেতে খরচ হবে ৩০ রিঙ্গিত। ১৯৯১ সালে শুরু হয় কেএল টাওয়ারের নির্মাণকাজ। ১ মার্চ ১৯৯৫ সালে নির্মাণকাজ শেষে এই টাওয়ারটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। টাওয়ারটি নির্মাণ হয়েছে মালয়েশিয়া সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে। আনুষ্ঠানিকভাবে নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেছিলেন মালয়েশিয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ। কেএল টাওয়ার নির্মাণ করতে খরচ হয়েছে ২৭০ মিলিয়ন রিঙ্গিত। কেএল টাওয়ারকে মালয়েশিয়ার টেলিযোগাযোগ টাওয়ারও বলা হয়। নিচ থেকে মাথা উঁচু করে কেএল টাওয়ারের চূড়ায় তাকালে মনে হয় এত উপরে গেলে ভয় লাগবে কিন্তু না। চূড়ায় যাওয়ার পরেই আপনি বুঝতে পারবেন কেএল টাওয়ার ভ্রমণ কতটা আনন্দদায়ক। প্রতিটা মুহূর্ত আপনার ভালো কাটবে। বিভিন্ন  দেশ থেকে প্রতিদিন আগত হাজার হাজার পর্যটককে প্রতিদিন কেএল টাওয়ার ভ্রমণ করতে দেখা যায়।

জানা যায়, মিনারা কুয়ালালামপুর এস ডি এন বি এইচ ডি নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে কেএল টাওয়ার নির্মাণকাজ করেন। কেএল টাওয়ারের চূড়ায় আছে খাবার হোটেল। খাবার হোটেলের যেই আসনেই আপনি বসেন না কেন  দেখতে পাবেন পুরো কুয়ালালামপুর শহর। খাবার হোটেলগুলো ঘূর্ণায়মান। উচ্চতার দিক থেকে কেএল টাওয়ার প্রায়  পেট্রোনাস টাওয়ারের সমান।

টাওয়ারে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য মাথাপিছু ৪৯:০০ আর এম (মালয়েশীয় রিঙ্গিত) এবং শিশুদের জন্য মাথাপিছু ২৯:০০ আর এম মূল্য ধার্য রয়েছে। উন্মুক্ত ডেকটিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য মাথাপিছু ৯৯:০০ আর এম মূল্য ধার্য রয়েছে। সম্মিলিত টিকিটও উপলব্ধ রয়েছে। মালয়েশিয়াকে দেখতে বেশ কিছু  টেলিস্কোপ (দূরবীক্ষণ যন্ত্র) স্থাপন করা হয়েছে কেএল টাওয়ারে। সন্ধ্যার পর কেএল টাওয়ারের অন্যরূপ দেখা যায়। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কেএল টাওয়ার উন্মুক্ত থাকে।

 

গ্যান্টিং হাইল্যান্ডে মেঘের সঙ্গে মিতালি

মালয়েশিয়ায় যাবেন, গ্যান্টিং হাইল্যান্ডে উঠবেন না—যেন আপনার ভ্রমনটাই অতৃপ্তি রয়ে যাবে। পর্যটকেরা এখানে মেঘের সঙ্গে মিতালি করেন। সমতল ভূমি থেকে প্রায় তিন হাজার ৮০০ ফুট উপরে গ্যান্টিং হাইল্যান্ড। কুয়ালালামপুর থেকে বাসযোগে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় গ্যান্টিংয়ে। তবে ওই উচ্চতায় বাস উঠে না। বাস টার্মিনাল থেকে আরও এক হাজার ৮০০ ফুট যেতে হয় ক্যাবল কারে। পাহাড়ের ওপর দিয়ে ক্যাবল কারে দুলে দুলে রোমাঞ্চকর এক যাত্রা। এই ক্যাবল কারে চড়ে হাজারো পর্যটক প্রতিদিন ভিড় জমান গ্যান্টিংয়ে। তবে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়েও উঠা যায় হাইল্যান্ডে। অনেকেই ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যান। হাইল্যান্ডে বিশাল আকৃতির ১৪তলা ভবনে রয়েছে ৫ হাজার গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। চারটি পাঁচ তারকা হোটেল, অত্যাধুনিক মানের  রেস্টুরেন্ট, ডিসকো বার, ম্যাসাজ সেন্টার, থিম পার্ক, গেম জোন, শপিং মলসহ বিনোদনের সব ব্যবস্থা রয়েছে গ্যান্টিং হাইল্যান্ডে।

 

পামঅয়েলের দেশ

পামঅয়েলের দেশ মালয়েশিয়া। মাহাথির মোহাম্মদের দেশের তরল সোনা নামে খ্যাত, একটি উদ্ভিদ ফসলের নাম পামঅয়েল। এই পামঅয়েল গাছ বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের মাধ্যমে ১৯৭০ সালের মধ্যে মালয়েশিয়া পৃথিবীর প্রধান পামঅয়েল উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়। দেশটির অর্থনৈতিক আয়ের বড় অংশই পামঅয়েল থেকে।

মালয়েশিয়ায় উৎপন্ন পামঅয়েল বাংলাদেশও আমদানি করে। এ ছাড়া চীন, পাকিস্তান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশই কমবেশি মালয়েশিয়ান পামঅয়েল আমদানি করে। প্রতি মাসে অন্তত ১ দশমিক ১২ মিলিয়ন টন পামঅয়েল উৎপন্ন হয় মালয়েশিয়ায়। পুরো দেশজুড়েই পাম বাগান। উঁচু-নিচু মালয়েশিয়ায় পামগাছেও সৌন্দর্য বাড়িয়েছে।

 

ক্যাবল কারে  না উঠলে ভ্র মণই বৃথা

গ্যান্টিং হাইল্যান্ডে স্কাইওয়ে কেবল কারে উঠবেন, না তা কি হয়?  ৩ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার উপরে গ্যান্টিং হাইল্যান্ড। বাসে করে পাহাড় বেয়ে উঠতে হবে গ্যান্টিংয়ের বেসক্যাম্পে। সেখান  থেকে স্কাইওয়ে কেবল কারে উড্ডয়ন। ইলেকট্রিক দড়ি বেয়ে উঠতে হবে। সময় লাগে মাত্র ১২ মিনিট। স্কাইওয়ে নামের এই কেবল কারের ল্যান্ডিং প্ল্যাটফর্মে সবাই লাইন করে দাঁড়াচ্ছে। একপাশ দিয়ে লাইন ধরে নেমে আসছে কেবল কারের যাত্রীরা। সারিবেঁধে মানুষ উঠছে। ৮.৫০ রিঙ্গিতে স্কাইওয়ে ক্যাবল কার ভ্রমণসহ বাসে আসা যাওয়া (১ রিঙ্গিত ১৮.৫০ পয়সার সমান)। দিনরাত ২৪ ঘণ্টায় ওঠানামা করা যায় ক্যাবল কারে। গ্যান্টিং হাইল্যান্ডের কাছাকাছি উঁচু দালানের চূড়ায় ৬০০০ লেখা। এর মানে ছয় হাজার ফুট উচ্চতা। আর এ  দালানসহ আরেকটি দালান মিলে হলো রিসোর্ট হোটেল অ্যান্ড গ্যান্টিং হোটেল। এ দুটির পাশে আরও দুটি দালান। নিচের দিকে তাকালে ভয় পান অনেকেই। হার্টে সমস্যা রোগীদের ক্যাবল কারে ওঠা খুবই ঝুঁকিপূণ। ক্যাবল কারে ওঠার পথে দুটি স্টেশন রয়েছে। কেউ চাইলে ওইসব স্টেশনে নেমে কিছু নৈসর্গিক প্রকৃতি উপভোগ করতে পারেন। নিচের দালান কোঠা আর গাছালিতে ভরপুর এ পাহাড়টি। নিচে তাকিয়ে দেখা বান্দরবানের মতো সবুজ অরণ্যের অপূর্ব তৈলচিত্র।

 

লাল টুকটুকে স্ট্রবেরি গার্ডেন

গ্যান্টিং হাইল্যান্ডের পাদদেশে বিশাল এলাকাজুড়ে একটি স্ট্রবেরি গার্ডেন। বাগানে প্রবেশমূল্য ৮.৫০ রিঙ্গিত। তবে পর্যটকদের গাইডদের জন্য ফ্রি প্রবেশ। দৈনিক হাজার হাজার পর্যটক এই বাগানে ঘুরতে আসেন। গাছ থেকে তুলে স্ট্রবেরি খান অনেকেই। স্ট্রবেরির মধুসহ অন্তত বেশ কয়েক প্রকার সুস্বাদু খাবারও বিক্রি করতে দেখা যায় বাগানে। ওই গার্ডেনে বাংলাদেশি অনেক শ্রমিক দেখা যায়। কুমিল্লার রফিকুল ইসলাম নামে এক স্ট্রবেরি বাগান শ্রমিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, কয়েক বছর ধরেই তিনি এই বাগানে কাজ করছেন। ভালো মাইনেও পাচ্ছেন।

সর্বশেষ খবর