শনিবার, ১ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধারাবাহিক উপন্যাস

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব ৩২

রণক ইকরাম

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব ৩২

মুসলিম শাসকদের মধ্যে যেমন শীর্ষে, তেমনি পৃথিবীর ইতিহাসেও অন্যতম সেরা শাসক তিনি। সুলতান সুলেমান খান। অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান। সুলতান সুলেমানকে নিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে আলোচিত-সমালোচিত টিভি সিরিয়াল মুহতাশিম ইউজিয়েল। আমাদের এ উপন্যাসের ভিত্তি সেই টিভি সিরিজ বা উপন্যাস নয়। মূলত ইতিহাসের নানা বইপত্র ঘেঁটে সুলতান সুলেমানের আমলটি তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতিহাসাশ্রয়ী এ উপন্যাসের মূল ভিত্তি অটোমানদের ইতিহাস। বাকিটুকু লেখকের কল্পনা। উপন্যাসের শুরুর দিকে যুবরাজ সুলেমানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন পাঠক। সিংহাসনে তখন সুলেমানের বাবা সুলতান প্রথম সেলিম। সুলতান সেলিমের সর্বশেষ বিজয়, অসুস্থতা ইত্যাদি পথপরিক্রমায় অটোমান সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন সুলেমান খান। এর মধ্যেই হেরেম সংস্কৃতি, প্রাসাদ, প্রশাসনসহ নানা দিক উঠে এসেছে। সুলেমান খানের ক্ষমতা গ্রহণের পর নতুন সূর্যোদয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করে অটোমান সাম্রাজ্য। সে যাত্রায় পীরে মেহমুদ পাশাকে স্বপদে বহাল রেখে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন সুলতান। সবার প্রত্যাশার বাইরে পারগালি ইব্রাহিমকে বানিয়েছেন নিজের খাসকামরা প্রধান। সুলেমান রোডস অভিযানে সাফল্যের পর ফিরে এসেছেন। হুররেম খাতুন সন্তানসম্ভবা। পদ হারাতে চলেছেন পীরে পাশা। রকমারির প্রতি শনিবারের এ বিশেষ আয়োজনে আজ ছাপা হলো ৩২তম পর্ব।

 

[পূর্ব প্রকাশের পর]

 

ইসাবেলাকে শাস্তি হিসেবে পুরনো মহলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন হুররেম। বছর দু-এক সেখানেই ছিলেন। আজ তাকে পুনরায় মূল প্রাসাদে ডেকে এনেছেন হুররেম। ইসাবেলার চেহারায় পুরনো সেই জৌলুস আর নেই। শরীর অনেকটাই ভেঙে গেছে। চোখের নিচে হালকা কালির রেখা।

হুররেম খাতুন এসেই ঠোঁট বাঁকা করে হাসলেন।

‘কেমন আছ ইসাবেলা?’

‘জি ভালো।’

‘তেজ কমেছে?’

ইসাবেলা কোনো উত্তর দিলেন না। হুররেম আবার হাসলেন।

‘এখনো রাগ?’

‘জি না।’

এবার মুখ খুললেন ইসাবেলা।

‘আমি চাই তুমি আবার আমার সঙ্গে থাক। তবে যদি এমন প্যাঁচা মুখ করে রাখ, তাহলে সুলতানার সঙ্গে থাকতে পারবে না। আবার ফিরে যেতে হবে পুরনো প্রাসাদে। ভেবে দেখ।’

এবার সত্যি সত্যি চিন্তায় পড়ে গেলেন ইসাবেলা। হুররেম খাতুনকে বিশ্বাস করা দায়। এত কাছের হয়েও সামান্য অপরাধে ক্ষমতার দম্ভে তাকে শাস্তি দিয়েছেন হুররেম। দুই দুইটি বছর কেটেছে নিদারুণ কষ্টে। আবার সেই হুররেমই এখন তাকে বলছেন একসঙ্গে থাকার জন্য। বিষয়টি ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না তিনি। তবে কিছুক্ষণ ভাবার পর মনে হলো পুরনো প্রাসাদে ফিরে যাওয়ার চেয়ে বরং এখানে হুররেমের সঙ্গে থাকাটাই ভালো!

কয়েক মিনিটের মধ্যে নিজেকে সামলে নিলেন ইসাবেলা। ছুটে গিয়ে হুররেমের পায়ে পড়লেন।

হুররেম ক্ষমা করে দিলেন পুরনো বান্ধবীকে। যদিও হুররেমকে একদমই বিশ্বাস করেন না ইসাবেলা, তবু আপাতত এটাই ভালো থাকার সবচেয়ে ভালো মাধ্যম।

 

            সুলতানের জন্য সঙ্গী বাছাই করছেন উজিরে আজম ইব্রাহিম পাশা। অবশ্য উজির হওয়ার পর থেকে খাসকামরা প্রধানের দায়িত্বটা তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। ইব্রাহিমের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন মানসেং খান। কিন্তু এখনো নানান সময়ে সুলতানের একান্ত ব্যক্তিগত কাজে পারগালি ইব্রাহিমকেই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। এই যেমন আজ সুলতানের চেহারার দিকে তাকিয়েই ইব্রাহিম বুঝতে পেরেছিলেন সুলতানের মেজাজ খারাপ। কয়েকটা প্রশ্ন করার পরও সুলতান ঠিকঠাক জবাব দিচ্ছিলেন না। পারগালির মনে তখন দুষ্টুমি খেলা করছিল। সুলতানকে ব্যক্তিগত জলসার ইঙ্গিত দিতেই সুলতানের দুই চোখ চকচক করে উঠল। আর সে কারণেই স্বয়ং ইব্রাহিম পাশা এসেছেন সুলতানের সঙ্গী বাছাই করতে।

হেরেমের নতুন মেয়েগুলোর মধ্য থেকে বাছাই করা ৯-১০ জন মেয়েকে আনা হয়েছে উজিরের সামনে। মানসেং খানই প্রাথমিক বাছাইটা সেরেছেন। তবে এই মেয়েগুলোর দিকে তাকানোর পর প্রথমেই সোনালি চুলের একটা মেয়ের দিকে নজর গেল পারগালির। ধবধবে ফরসা মেয়েটি সম্ভবত রাশান। এই মেয়েটির সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হচ্ছে তার শরীর যতটা লিকলিকে, অবয়ব ততটাই আকর্ষণীয়। মানে হচ্ছে সে চিকন-চাকন হলেও মেয়েলি উপকরণগুলো তার শরীরে দারুণ ভরাট। ইব্রাহিম পাশা যখন মেয়েটাকে সামনে ডাকলেন, তখন মেয়েটার ভারী বুক রীতিমতো দুলে উঠল। এলোমেলো সোনালি চুল আর গোলাপি ঠোঁট। মেয়েটাকে অপরূপ লাগছিল। মেয়েটার নাম এলিসা।

‘সুন্দর নাম।’

একবার কেবল ছোট্ট করে প্রশংসা করলেন ইব্রাহিম পাশা। এরপর তাকেই নির্বাচন করলেন সুলতানের শয্যাসঙ্গী হিসেবে। নিয়মানুযায়ী তাকে গোসল করানোর পর তৈরি করে সুলতানের কামরায় পাঠানো হবে। দ্রুত সেসব সম্পন্ন করার আদেশ দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন পারগালি।

 

            শিরস্ত্রাণ পরা দুজন সৈন্য এলিসাকে হেরেমের মধ্য দিয়ে লোহার দরজা পেরিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলল। এলিসার মনে অদ্ভুত একটা অনুভূতি। খানিকটা ভয় আবার অনেকটা রোমাঞ্চ। সে ঠিক বুঝতে পারছে না, তার ভাগ্যে কী ঘটতে চলেছে। হেরেমের মেয়েগুলো সব সুলতানের শয্যাসঙ্গী হওয়ার স্বপ্ন দেখে। অনেকে আবার সুলতানের সন্তানের মা হওয়ার চিন্তায় বিভোর থাকে। কিন্তু এলিসা এমনটা কখনো ভাবেনি। নিজের বন্দীজীবন আর নিয়তির কথা ভেবে কেবল মন খারাপই থাকে তার। বারো মাস মন খারাপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছুই ঘটেনি এখানে। তবে আজকের ঘটনাটা বিরল। যখন ওকে গোসল করিয়ে সাজানো হচ্ছিল, তখনই টের পেয়েছে আজকের ঘটনাটা বিরল এবং আসলেই বিশেষ কিছু। হেরেমের মেয়েগুলো ওর দিকে ঈর্ষা ভরে তাকাচ্ছিল। সবার মধ্যে মৃদু গুঞ্জন। এখানে আসার পর এই প্রথম নিজেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মনে হয়েছে এলিসার। আপাতত প্রাপ্তি এটুকুই। এরপর কী ঘটে কে জানে!

 

            পাথুরে করিডরগুলো বেশ প্রশস্ত। ঘুটঘুটে অন্ধকার তাড়িয়ে মশালগুলো তীব্র আলোয়া আলোকিত। হাঁটতে হাঁটতে ওরা মুক্তা এবং কচ্ছপের খোল খচিত দরজার সামনে পৌঁছে গেল। এলিসা তখন দারুণ উত্তেজিত। বুক ঢিপঢিপ করছে তার। বিস্মিত দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে সে। প্রাসাদের এপাশটায় আর কখনই আসেনি সে। পুরো দেয়ালে টাইলসের কাজ। ময়ূর এবং কমলারাঙা ফুল-ফল আঁকা সেসব টাইলসের গায়ে। গম্বুজাকৃতির সিলিং অনেক উঁচুতে। সিলিং থেকে ঝুলছে নীলকান্তমণি এবং রুবিখচিত ধূপাধার। পিরামিড আকৃতির একটা ফায়ারপ্লেস আছে পাশেই। দেয়াল থেকে ঝুলছে তেলের কুপি।

ঘরের কোণের দিকে একটা উঁচু মতোন জিনিস উঠে গেছে। এটাই বিছানা। এটার নিচে চারটা থাম দেওয়া। বিছানায় বিছানো হয়েছে সবুজ এবং সোনালি রঙের সুতা দিয়ে কাজ করা চাদর। বালিশের কভারের রং সিঁদুরে লাল। প্রত্যেকটা মুক্তা খচিত। ঘরের চারকোণে চারটা প্লাটিনামের মোমদানিতে জ্বলছে মোম।

সুলতানের অনুমতি মিলতেই ইশারায় এলিসাকে ভিতরে ঢুকতে বলল রক্ষী দুজন।

 

কাঁপা কাঁপা পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল সে। বিছানায় শুয়ে আছেন সুলতান। পরনে তার হালকা সবুজরঙা কাফতান। মাথায় সাদা সিল্কের পাগড়ি বাঁধা। পাগড়িতে একটা বড় পাথর বসানো। সুলতানের এক হাত তার মাথার নিচে রাখা। একটু বিমর্ষ, একটু ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। এলিসা ভিতরে ঢুকতেই দরজার সামনে থাকা সুলতানের প্রহরীরা দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল। শব্দ শুনে একবার কেবল ঝট করে পেছন ফিরে তাকাল এলিসা। ততক্ষণে সুলতান এদিকে ফিরে তাকিয়েছেন। সুলতান এলিসার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। একবার কেবল সুলতানের দিকে চোখ তুলল এলিসা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আবার সেটা নামিয়ে ফেলল সে। বুকের কাঁপুনিটা এখন কয়েক হাজার গুণ বেড়ে গেছে। এক দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে এলিসা। ওকে বলা হয়েছিল সুলতানের কাফতান এবং হাত ধরে চুমু খাওয়ার কথা। কিন্তু সুলতান তো শুয়ে আছেন। বসে থাকলে অথবা দাঁড়িয়ে থাকলে না হয় এমন কিছু একটা করা যেত। কিন্তু সুলতান কেবল তাকিয়েই আছেন।

কিছু বলছেন না।

আবার কিছু করছেনও না।

এলিসা বুঝতে পারছে না ওর কী করা উচিত। হুট করে কী যেন হলো এলিসার। ছুটে গেল সুলতানের বিছানার কাছে। এরপর চট করে বসে পড়ল সুলতানের পায়ের কাছে। এরপর হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।

এবার উঠে বসলেন সুলতান। মেয়েটার কাণ্ড দেখে দারুণ অবাক হয়েছেন তিনি।

‘কী ব্যাপার কাঁদছো কেন তুমি?’

‘এলিসা চমকে উঠল। মেয়েটার মাথায় সুলতানের হাত।

‘ভয়ে।’

‘ভয় কীসের?’

‘সুলতানের।’

‘আমি কি এত খারাপ যে আমাকে ভয় পেতে হবে। ওঠে বসো। কী নাম তোমার?’

‘এলিসা।’

সুলতান অনেকটা টেনেই নিজের পাশে বসালেন এলিসাকে।

‘এবার বল কী হয়েছে?’

‘আমি দেখতে খুব বাজে। অনেক কিছু বুঝি না। এখানকার রীতিনীতিও আমার খুব বেশি আয়ত্বে নেই। এরপরও আমাকে কেন এখানে পাঠানো হলো আমি ঠিক জানি না। আমি ভীষণ লজ্জিত আমার সুলতান।’

এলিসার কথা শুনে মৃদু হাসলেন সুলতান।

‘উহু। তোমার ধারণা একদমই ভুল। তুমি বেশ সুন্দর এবং মিষ্টি একটা মেয়ে।’

সুলতান, এলিসাকে দাঁড় করালেন। এলিসার চোখে চোখ সুলতানের। নিজের পাগড়িটা খুলে টেবিলে রাখলেন সুলেমান। এলিসার কাঁধে হাত রেখে তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন সুলতান।

‘আমার খুব ভয় করছে। আমি এটা কখনই চাইনি সুলতান। আমাকে ক্ষমা করুন।’

মৃদু স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল এলিসা। আরেকবার ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান খান।

‘তুমি কি জান তোমার সঙ্গে এই জায়গাটা বদল করার জন্য  হেরেমের যে কোনো মেয়ে একপায়ে খাড়া?’

‘জানি সুলতান। এবং এও জানি সেখানকার সবাই আমার থেকেও বেশি সুন্দরী।’

এলিসার মুখে কথা ফুটেছে। সুলতান বুঝতে পারলেন মেয়েটার মধ্যে দম আছে। ঠিক যেন হুররেমের মতো। সেই গোলাপি ঠোঁট, সেই সাদা চামড়া সোনালি চুল। দিন পুরনো গল্পটা হুট করে দোলা দিয়ে গেল সুলেমানের মনে। কিন্তু সেসব মনে করে এখনকার সময়টুকু নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। হুট করেই নিজেকে বদলাতে চাইলেন সুলতান।

‘এসব বাদ দাও। এসো।’

বলেই এলিসার দুটো হাত নিজের হাতের মধ্যে পুরে নিলেন সুলতান। এক হাতে এলিসার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললেন,

‘আমার ধারণা তুমি অন্যদের থেকে আলাদা। একটু কেমন যেন!’

সুলতানের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল এলিসা। সুলতান তাকে বুকের মাঝে টেনে নিলেন। অনেকটা সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে। এলিসাও সুলতানকে জাপটে ধরলেন।

এলিসার শরীর থেকে একটু মিষ্টি সৌরভ এসে নাকে লাগে সুলতানের। শিহরণে চোখ দুটো মুদে আসে। এলিসাও দুই হাতে আরও দৃঢ়ভাবে জাপটে ধরে সুলতানকে।

‘এখন আমার কী করা উচিত সুলতান?’

‘কোনো কথা নয়। কেবল সময়টাকে উপভোগের চেষ্টা করো।’

এলিসার মুখটা দুই হাতে ধরে চুমু খেলেন সুলেমান। সুলতানের দুই হাত সচল হয়ে ওঠে। এলিসার গোঙানি বাড়ে। ওদিকে লাজুক রাত বুড়ো হয়। নিস্তব্ধতা নামে রাতের বুকের প্রতিটি ইটের দেয়ালে।

 

            ইসাবেলার সঙ্গে নতুন করে সখ্যতা গড়ে তুলেছেন হুররেম। হুররেমের নির্দেশে ইসাবেলা হেরেমে আলাদা কক্ষ পেয়েছেন। নতুন জামাকাপড় আরও কত উপহার। এসবের পেছনের কারণটা তিনি বুঝতে পারেন না। কিন্তু আপাতত এসব গ্রহণ করে উপভোগ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

একদিনের মাথায় ভরদুপুরে ইসাবেলাকে ডেকে পাঠালেন হুররেম। হুড়মুড় করে সেদিকে ছুটে এলেন ইসাবেলা। ইসাবেলা ঘরে ঢোকার আগেই পুরো ঘরটি ফাঁকা করে নিলেন হুররেম।

‘তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে ইসাবেলা।’

‘বলুন সুলতানা।’

‘এখন এই ঘরে কেউ নেই। তুমি আমাকে আলেকজান্দ্রা বা হুররেম বলতে পার।’

‘সমস্যা নেই।’

‘কথাটা একেবারে ব্যক্তিগত।’

‘আচ্ছা।’

‘আমি জানি তুমি ভেষজ দিয়ে একটা কঠিন বিষ বানাতে পার।’

‘ওটা ভুলে গেছি।’

হুররেমের পাতা কোনো ফাঁদে পা দিতে রাজি নন ইসাবেলা।

‘কিন্তু আমি জানি তুমি এত সহজে কোনো কিছু ভুলো না। আমার সঙ্গে মিথ্যা বলছ?’

একটু ধাক্কা খেলেন ইসাবেলা। আসলেই হুররেমের সঙ্গে মিথ্যা কথা বলে হজম করা যায় না।

‘তোমাকে আমার জন্য কাজটা করে দিতে হবে ইসাবেলা।’

 বিরক্ত হলেও ইসাবেলা বুঝতে পারছেন হুররেমকে এড়িয়ে চলা সম্ভব না।

‘কী কাজ?’

‘কঠিন করে বিষ বানাতে হবে।’

‘আমি পারব না।’

‘ভেবে দেখ, না করলে কিন্তু ফেঁসে যাবে।’

‘করলে যে বেঁচে যাব সেটাই বা কে জানে?’

‘খুব কথা শিখেছ!’

‘না। সত্যিটা বোঝার চেষ্টা করছি।’

‘তোমাকে কাজটা করে দিতেই হবে। নইলে তোমারই বিপদ।’

‘বিষ দিয়ে তুমি কী করবে?’

‘সেটা জেনে তোমার কাজ নেই।’

‘আচ্ছা আমার জিনিসপত্র লাগবে।’

‘কোনো সমস্যা নেই। সেসবের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’

‘আচ্ছা তৈরি করে দেব।’

‘এই তো আমার বান্ধবীর মতো কথা বলেছ তুমি!’

হুররেমের ঠোঁটে শয়তানি হাসি। তাকে দারুণ ভয় পান ইসাবেলা। কখন যে কী করে ফেলে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই একে এড়িয়ে চলা কঠিন নয়, রীতিমতো অসম্ভব।

 

            প্রাসাদের রান্নাঘর আগুনের মতো গরম হয়ে আছে। বিভিন্ন রকমের মসলার গন্ধে ভারী হয়ে আছে জায়গাটা। রান্নার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সময় কাটছে রাঁধুনি আর দাস-দাসীদের। এ কারণেই হাতে করে কতগুলো ফল নিয়ে আসা মোটা কালো মেয়েটাকে কেউ খেয়াল করল না। বাঁ দিকের এক কোনায় শাহজাদার জন্য বানানো স্যুপ পরিবেশনের জন্য তৈরি করা হচ্ছে। সে দায়িত্বে থাকা দাসীটি একটু অন্যদিকে ফিরতেই কালো মহিলা স্যুপের বাটিতে কী যেন মিশিয়ে দ্রুত সেখান থেকে কেটে পড়লেন। শাহজাদা মুস্তফা তার যুদ্ধবিদ্যাসংক্রান্ত শরীরচর্চার পর স্যুপ খান। গত ৮-১০ বছর ধরে এটাই নিয়ম। সুলতান সুলেমানের পুত্র শাহজাদা মুস্তফা এখন আর ছোট্ট নেই। তার বয়স এখন চৌদ্দ ছুঁই ছুঁই। এ বয়সেই রাজরক্তের উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজের যোগ্যতার ছাপ রাখতে শুরু করেছেন কিশোর মুস্তফা। ঘোড়া চালনা এবং তরবারি চালনায় মুস্তফার দক্ষতার গল্প প্রাসাদ ছাপিয়ে সাম্রাজ্যেও আলোচিত হয় এখন। অনেক সৈন্য ঈর্ষার চোখে তাকিয়ে থাকে শাহজাদার তরবারি চালনার অসামান্য দক্ষতা দেখে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো মুস্তফা পড়াশোনাতেও দুর্দান্ত। কোরআন শরিফ খতমের সঙ্গে সঙ্গে সে পার্সিয়ান এবং গণিতেও দক্ষতা অর্জন করেছে। সুলতান সুলেমান মাঝে মাঝে গর্ব করে বলেন, এমন গুণী শাহজাদা অটোমান রাজবংশে আর কখনই আসেনি। হুররেম মাঝে মাঝে মুস্তফা সম্পর্কে দু-একটা উল্টা-পাল্টা বলার চেষ্টা করলেও সুলেমান সেগুলো একদমই কানে তুলতে চান না। কারণ তিনি তার পুত্রকে অনেক বেশি ভালোবাসেন। মাহিদেভরানের সঙ্গে তার সম্পর্কটা শীতল হতে পারে, কিন্তু বিষয় যখন শাহজাদা মুস্তফা তখন তিল পরিমাণ ছাড় দিতে রাজি নন সুলেমান। আর সেটা টের পেয়েই ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছেন হুররেম। এভাবে যেহেতু সম্ভব হচ্ছে না, সেহেতু মুস্তফাকে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করেছেন তিনি। কে জানে শাহজাদা মুস্তফার কপালে কী আছে।

 

            যুদ্ধচর্চা শেষ করে মাঠ থেকে ফিরছিল মুস্তফা। করিডরে বাবার সঙ্গে দেখা। বাবাকে কুর্নিশ করতেই ছেলের কুশল জিজ্ঞেস করলেন সুলতান সুলেমান। মুস্তফার ডান চোখের চারপাশে কালশিটে পড়ে গিয়ে চোখটা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। সেটা দেখে আঁতকে উঠলেন সুলেমান।

‘কী হয়েছে ওখানে? আবার আঘাত পেয়েছ নাকি? তোমাকে না বলেছি আরও দেখেশুনে চলার জন্য।’

‘জাঁহাপনা, ওকে একটু বুঝিয়ে বলুন। ও যেন এসব চোট থেকে একটু দূরে থাকে। বর্শার হাতলে লেগে কী অবস্থা হয়েছে চোখটার। আমার কথা একদমই শুনতে চায় না। ওর কিছু হয়ে গেলে আমি কী নিয়ে বাঁচব?’

মুস্তফার হয়ে জবাব দিলেন মাহিদেভরান।

অবশ্য মায়ের মতো এতটা আবেগাপ্লুত হলেন না সুলতান। তবে ছেলেকে সাবধান করলেন ঠিকই।

‘মুস্তফা। একটু সাবধান হতে হবে। তোমার চেষ্টা আর কসরত নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আরও সতর্ক হতে হবে। তুমি ভবিষ্যৎ সুলতান। যুদ্ধ কৌশল যেমন শিখতে হবে, তেমনি নিজেকে সাবধানেও রাখতে হবে।’

‘ওকে নিয়ে আর পারছি না। পারলে গোটা দিনটাই ঘোড়ার পিঠে পিঠে কাটিয়ে দেয়।’

আরেকবার অনুযোগ করলেন মাহিদেভরান সুলতান।

নিজের পুত্রের দিকে তাকালেন সুলতান। অনেক বড় হয়ে গেছে মুস্তফা। দাড়ি উঠতে শুরু করেছে ওর। চোখে-মুখে দুরন্তপনার ছাপ স্পষ্ট। চোখ দুটো যেন শিকারি ঈগলের মতো। নিজের কথা মনে পড়ল সুলেমানের। কৈশোরে তিনিও এমন দুরন্তই ছিলেন। তবে বাবার সঙ্গে এমন সখ্যতা ছিল না তার। সুলেমান এই বয়সে সব সময় তার পিতা সেলিম খানের ভয়ে কুঁকড়ে থাকতেন। কিন্তু মুস্তফাকে তিনি সেভাবে বড় করেননি। মুস্তফার সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেক সহজ এবং স্বাভাবিক। সুলেমান বিশ্বাস করেন এটা মুস্তফাকে মানসিকভাবে আরও দৃঢ় এবং সম্পর্কের গুরুত্ব অনুধাবন করাতে দারুণ কার্যকর হবে।

---পরবর্তী পর্ব আগামী শনিবার

সর্বশেষ খবর