বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

উৎসবের চৈত্রসংক্রান্তি

তানভীর আহমেদ

উৎসবের  চৈত্রসংক্রান্তি

বাংলা সনের শেষ দিন আজ। একই সঙ্গে বিদায় নিচ্ছে ঋতুরাজ বসন্ত। গ্রীষ্মের দাবদাহ এখন প্রকৃতিতে। পয়লা বৈশাখ, বাংলা সনের প্রথম দিনটিকে আনন্দ-উৎসবে বরণ করে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে সবখানে। বাংলা সনের শেষ দিনটি চৈত্রসংক্রান্তি নামেই পরিচিত।

দিন শেষে সূর্যাস্ত, বিদায় নেবে আরও একটি সন। বাংলাদেশ তো বটেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কোটি বাঙালি ও বাংলাদেশি বাংলা পঞ্জিকার নতুন বছরের প্রথম সূর্যবরণ করতে প্রস্তুতি নিয়েছে। তারা মেতে উঠবে নতুন উদ্দীপনায়, বৈশাখ বন্দনায়।

বাংলা বছরের শেষ মাস চৈত্র। এ মাসের শেষ দিনটিকে ঘিরে আমাদের সাংস্কৃতিক আচার বহু বছর ধরে পালিত হচ্ছে। আমাদের লোকাচার অনুযায়ী এদিনে বিদায় উৎসব পালন করা হয়ে থাকে যা বাঙালি জীবনে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের মানুষের মাঝে সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির বন্ধনের কথা অজানা নেই কারও। বিশ্বের দরবারে তাই বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হয় অনন্য গৌরবে। এই ভূমিতেই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সহাবস্থানে বসবাস করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তাই পয়লা বৈশাখ বা চৈত্র সংক্রান্তির মতো উৎসব হয়ে ওঠে সার্বজনীন। একইভাবে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান পালনে একত্রিত হয় সবাই। বাঙালিরা এই দিনটিতে বেশ কিছু লোকাচারমূলক অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। যেমন— গজল, নীল পূজা বা চড়ক পূজা, চৈত্রসংক্রান্তির মেলা, শেষ প্রস্তুতি চলে হালখাতার। ঠিক একই সময় আদিবাসী সম্প্রদায় পালন করে বর্ষবিদায়, বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বৈসাবি। যে চৈত্র-সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে বাঙালির এত আয়োজন তার রয়েছে  সুগঠিত ইতিহাস। বাংলা সনের শেষ মাসের নামকরণ করা হয়েছে ‘চিত্রা’ নক্ষত্রের নামানুসারে। গ্রন্থ পুরাণে বর্ণিত আছে, ২৭টি নক্ষত্র আছে যা রাজা/প্রজাপতির দক্ষের সুন্দরীকন্যার নামানুসারে নামকরণ করা হয়।

প্রবাদতুল্য সুন্দরী এই কন্যাদের বিয়ে দেওয়ার চিন্তায় উৎকণ্ঠিত রাজা দক্ষ। যোগ্যপাত্র খুঁজে পেতে মরিয়া তিনি। তবে নিরাশ হতে হয়নি। এক সময় ঠিকই উপযুক্ত পাত্র পাওয়া গেল। একদিন মহাধুমধামে চন্দ্রদেবের সঙ্গে বিয়ে হলো দক্ষের ২৭ জন কন্যার। দক্ষের এক কন্যা চিত্রার নামানুসারে চিত্রানক্ষত্রা এবং চিত্রানক্ষত্র থেকে চৈত্র মাসের নামকরণ করা হয়। রাজা দক্ষের আরেক অনন্য সুন্দরী কন্যা বিশখার নামানুসারে ‘বিশখা’ নক্ষত্র এবং ‘বিশখা’ নক্ষত্রের নামানুসারে বৈশাখ মাসের নামকরণ করা হয়।

চৈত্র মাসের শেষ দিনটিতে পেছনের বছরের অসংখ্য সমাপ্ত আর অসমাপ্ত কাজের হিসাব-নিকাষ চুকিয়ে নেওয়া হয়। স্মরণে আসে বিগত দিনগুলোর অনন্য স্মৃতি। কিছু মলিন, বেদনাক্লেশ যেমন সেখানে জায়গা করে নিয়েছে তেমনি রয়েছে প্রাপ্তির যোগফল। মুখের হাসি দিয়ে সুখের মুহূর্তগুলোকেই গ্রহণ করি সবাই। প্রাপ্তিটুকু সম্বল করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় প্রেরণা নেই। চৈত্রসংক্রান্তিতে তাই বিভিন্ন লোকাচার-পার্বণে সড়াম্বরে বিদায় জানানো হয়। প্রাণ জাগে নতুনের উচ্ছ্বাসে। প্রাণে প্রাণে ছড়িয়ে পড়ে নতুন উদ্যম। মঙ্গল প্রত্যাশায় নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি চলে পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে। উৎসবের আকার বা পরিধির দিকে তাকালে দেখা যাবে, চৈত্রসংক্রান্তি বিশেষ লোকউৎসব। অসাম্প্রদায়িক বাঙালির কাছে এক বৃহত্তর লোকউৎসবে পরিণত হয়েছে দিনটি। এই উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ গাজন। গাজন একটি লোকউৎসব। চৈত্রসংক্রান্তি থেকে শুরু করে আষাঢ়ি পূর্ণিমা পর্যন্ত সংক্রান্তি কিংবা পূর্ণিমা তিথিতে এ উৎসব উদযাপিত হয়। এই দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পুণ্যজনক বলে মনে করা হয়। গ্রামে গ্রামে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা বসে। ক্রমশ এসব মেলার আয়োজন করে এলেও আবেদন কমেনি মোটেও। এসব মেলায় বাঁশ, বেত, প্লাস্টিক, মাটি ও ধাতুর তৈরি বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র ও খেলনা, বিভিন্ন রকমের ফল-ফলারি ও মিষ্টি ক্রয়-বিক্রয় হয়। বায়স্কোপ, সার্কাস, পুতুলনাচ, ঘুড়ি ওড়ানো ইত্যাদি চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা থাকে। বছরের শেষ দিনটিকে বিদায় জানানোর পাশাপাশি নতুনের আহ্বান প্রাণ থেকে প্রাণে ছড়িয়ে দেওয়া হয় চৈত্রসংক্রান্তিতে। এ তো বাংলায় প্রাণে প্রাণে নতুনেরই উৎসব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর