বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

পাহাড়ে উৎসবের স্বাদ

ফাতেমা জান্নাত মুমু

পাহাড়ে উৎসবের স্বাদ

বছর ঘুরে বৈসাবি এলেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীরা গানের সুর আর নাচের তালে তালে মিশে যায়। বাতাসে ভেসে আসছে গানের সুর আর নূপুরের ছন্দ। চারদিকে বইয়ে যায় উৎসবের আমেজ। সব মিলে বৈসাবির রঙে রঙিন পাহাড় মেতে ওঠে। পার্বত্যাঞ্চলে ১০ ভাষাভাষী ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বিজু-সাংগ্রাই-বৈসাবি-বিষু অর্থাৎ বৈসাবির আমেজে রাঙামাটি হয়ে ওঠে উৎসবের নগরী।

 

বৈসাবি 

চৈত্র মাসের শুরুতেই একটি পাখি এসে বিজু বলে ডাক দিয়ে যায়। চাকমা সম্প্রদায় এ পাখিকে বিজু পেক্কো (বিজু পাখি) বলে। এই পাখির সুমধুর কলতান বিজু বা চৈত্রসংক্রান্তি উৎসবের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে। এমনটাই পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ধারণা। চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাইং, ত্রিপুরারা বৈসুক, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু ও অহমিয়ারা বিহু নামে পালন করে থাকে এই উৎসব। অর্থাৎ সব মিলিয়ে এর নাম রাখা হয় বৈসাবি। চাকমা রীতি অনুযায়ী ১২ এপ্রিল অর্থাৎ চৈত্র মাসের ২৯ তারিখ গঙ্গ্যাদেবীর উদ্দেশে নদীতে ফুল ভাসিয়ে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে সূচনা করা হবে ফুলবিজুর উৎসব। পরদিন ১৩ এপ্রিল মূলবিজু এবং ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ ও গোজ্যেপোজ্যা দিন উদযাপিত হবে। এ ছাড়া ১৫ এপ্রিল উদযাপন করা হবে মারমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী জলকেলি উৎসব।

 

বৈসু

পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে ত্রিপুরা সম্প্রদায় বছরের শেষ দিনের অনুষ্ঠানকে বৈসু উৎসব হিসেবে আখ্যায়িত করেন। উল্লেখ্য, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বিজুকে তিন পর্বে ভাগ করে উৎসব পালন করে থাকে। এগুলো হলো— হারি বিজু, বিষুমা বিজু ও বিসিকাতাল বিজু। বৈসু দিনে তারা পাজন, সেমাই, পিঠাসহ বিভিন্ন মুখরোচক খাবারের আয়োজন করে। পরিবারে বা গ্রামের বয়স্ক নারী-পুরুষকে স্নান করিয়ে এদের গলায় পাহাড়ি কাঁচা ফুলের মালা পরিয়ে নতুন কাপড় দান করে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এভাবে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসু উৎসব বছরের শেষ দিনে মহাসমারোহে উদযাপন করে। শিশুকিশোরের দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফুল বিতরণ করে।

সাংগ্রাই

সাংগ্রাই, এটি মারমা ভাষা। মারমা সম্প্রদায় বছরের শেষ দিনে নানা অনুষ্ঠান পালন করে। যার কারণে এ দিনটিকে সাংগ্রাই নামে অভিহিত করা হয়েছে। নতুন বছরের প্রথম দিনে সাংগ্রাই পালন করে থাকে মারমা সম্প্রদায়। সিমাই, পাজন, পিঠা এবং নানা মুখরোচক খাবারের আয়োজন করে মারমা সম্প্রদায়। একে অপরের বাড়িতে যায়, কুশল বিনিময় করে এবং আনন্দ উৎসবে মেতে থাকে। মারমা সম্প্রদায়ের এ দিনের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে ‘জলোৎসব’। জলকেলি দৃশ্য বেশ উপভোগ্য বলে প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে উৎসবস্থলে। মারমা ভাষায় এটিকে বলা হয় ‘রিলংপোয়ে’। জলখেলার জন্য এরা আগে থেকে প্যান্ডেল তৈরি করে। ওই প্যান্ডেলে মারমা যুবক-যুবতীরা একে অন্যের প্রতি জল ছিটিয়ে মেরে কাবু করার প্রতিযোগিতায় শামিল হয়। বয়স্করা এদিনে বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে ধর্মীয় রীতিনীতি মোতাবেক ধর্ম অনুশীলনে রত থাকে। শিশুকিশোররা

জল ছিটিয়ে আনন্দ-উল্লাস পালন করার পাশাপাশি দড়ি টানাটানি, হা-ডু-ডু ইত্যাদি খেলায় মেতে ওঠে।

 

বিজু

বিজু হলো চাকমা ভাষা। চাকমা সম্প্রদায় বিজু উৎসবকে তিনভাগে ভাগ করে পালন করে থাকে। বছরের শেষ অর্থাৎ চৈত্র মাসের ২৯ তারিখে ‘ফুল বিজু’, ৩০ তারিখে ‘মূল বিজু’ এবং নববর্ষের প্রথম দিনকে ‘গজ্যাপজ্যা বিজু’ নামে রকমারি উৎসব পালন করে। ফুল বিজুর দিন ভোর রাতে ঘুম থেকে উঠে স্নান করে নানা রকম ফুলের সন্ধানে শিশুকিশোরের দল পাহাড়ি অরণ্যে বিচরণ শুরু করে দেয়। ফুল সংগ্রহ শেষে এরা বাড়িতে ফিরে এসে ফুলগুলোকে চারভাগে ভাগ করে একভাগ দিয়ে নিজের মনের মতো করে ঘর-বাড়ি সাজায়। মূল বিজু হচ্ছে বিজুর প্রথম দিন। ফুল বিজুর দিনে মূল বিজুর প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। এদিনে ঘরের পাহাড়ি নারীরা খুবই ব্যস্ত থাকে। বিভিন্ন কাঁচা সবজি তরকারির সংমিশ্রণে পাচন তৈরি করা হয়। পাচন ছাড়াও নানা ধরনের পিঠা, পায়েস, মাছ-মাংসের আয়োজনও থাকে। বছরের ঐতিহ্য হিসেবে থাকে বিভিন্ন ধানের খই, নাড়ু, সেমাইয়ের পাশাপাশি পাহাড়ি মদও পরিবেশন করা হয় আগত মেহমানদের। আবার-বৃদ্ধ-বণিতাসহ সবাই পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায় এবং নানা আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি-ঘরের দরজায়, উঠানে, গো-শালায় প্রদীপ জ্বালিয়ে সবার মঙ্গল কামনা করা হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর