বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

সুন্দরবনের অভিশাপ জলদস্যু অধ্যায়ের সমাপ্তি

বেনজীর আহমেদ, বিপিএম (বার), অতিরিক্ত আইজিপি

সুন্দরবনের অভিশাপ জলদস্যু অধ্যায়ের সমাপ্তি

‘সুন্দরবন’ আমাদের গর্ব, আমাদের জীবিকা, আমাদের ঐতিহ্য। এটি শুধু আমাদের নয়, সমগ্র পৃথিবীর ঐতিহ্য। ২২ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে ইউনেস্কো কর্তৃক সুন্দরবনকে ৫২২তম বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর পর্যটক তথা সারা বিশ্বেই সুন্দরবনের কদর বহুলাংশে বেড়ে গেছে। সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, যার আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিমি। সুন্দরবন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য যেমন বিখ্যাত, তেমনি এখানে রয়েছে হাজারো প্রাকৃতিক সম্পদ। সুন্দরবনে প্রতিদিন হাজারো দেশি-বিদেশি পর্যটক যান এর সৌন্দর্য দেখতে। আর সুন্দরবন সংলগ্ন লাখ লাখ পেশাজীবী যান জীবিকার সন্ধানে। তা ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলের লোকালয়গুলোকে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকেও রক্ষা করে চলেছে সুন্দরবন। উপকূলীয় তথা সুন্দরবন সংলগ্ন মানুষগুলোর রুটি-রুজির জন্য নির্ভর করে থাকতে হয় এই সুন্দরবন ও সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা অসংখ্য নদী ও খালবিলের ওপর। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আর আমাদের গর্ব রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ আরও অসংখ্য বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্যও এই সুন্দরবন। কিন্তু আশির দশকে সুন্দরবনে নেমে আসে এক অভিশাপ, শুরু হয় এক কলঙ্কিত অধ্যায়; তার নাম ‘জলদস্যু’। সেই আশির দশক থেকে কয়েক মাস আগ পর্যন্ত এই জলদস্যুদের চাঁদাবাজি, অপহরণ আর অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল উপকূলীয় ও সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার মানুষ। এই অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্য লাখ লাখ মানুষ প্রার্থনা করেছে সৃষ্টিকর্তার কাছে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, কবে মিলবে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি।

সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করে উপকূলীয় ও সুন্দরবন সংলগ্ন অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ। এদের কেউ জেলে, কেউ বাওয়ালি, কেউ মৌয়ালি। অতি দরিদ্র ও ভূমিহীনরাই সাধারণত এই ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত। প্রতিনিয়ত বাঘ, কুমির ও সাপ আর হাজারো বিপদের মুখে এই দরিদ্র মানুষগুলো যান শুধু পরিবারের সদস্যদের মুখে বেঁচে থাকার মতো আহার তুলে দেওয়ার জন্য। যারা সুন্দরবনে এসব পেশাজীবীর জীবিকা নির্বাহের বিষয়টি নিজের চোখে দেখেননি তারা কল্পনাও করতে পারবেন না সেখানে জীবিকা অর্জন কতটা কঠিন, কষ্টকর আর বিপজ্জনক। একটি ছোট নৌকায় শুকনো খাবার আর পানি নিয়ে জেলেরা ৭ দিনের জন্য চলে যান মাছ অথবা কাঁকড়া ধরতে। জঙ্গলে বাঘ থাকে বলে সেখানে টয়লেটের জন্য মাটিতে নামা বিপজ্জনক, তাই ইচ্ছে করেই জেলেরা অল্প পরিমাণে শুকনো খাবার (মুড়ি, চিঁড়া, বিস্কুট) খায় যেন টয়লেটে কম যেতে হয়। কখনো কখনো স্বামী-স্ত্রী একত্রে নৌকা নিয়ে সুন্দরবনে যায় রোজগার বাড়াতে। এমনো দেখা যায়, ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকেও তারা নৌকার মাঝখানে বসিয়ে নিয়ে জঙ্গলে চলে যায়, বাড়িতে কারও কাছে রেখে যাওয়ার মতো কেউ নেই বলে। এই মাসুম বাচ্চাগুলো ঝড়-বৃষ্টি আর কনকনে শীতের মধ্যে বড় হতে থাকে হাজারো বিপদ মাথায় নিয়ে। আর বাবা-মা মাছ ধরার পাশাপাশি পালা করে বাচ্চাকে পাহারা দেন, কখন না আবার বাচ্চা পানিতে পড়ে যায়। একে তো পেটে খাবার নেই, তার সঙ্গে হাড়ভাঙা পরিশ্রম, বাড়তি হিসেবে জোটে নির্ঘুম রাত আর জলের কুমির, ডাঙার বাঘ তো আছেই। সুন্দরবননির্ভর পেশাজীবীদের মতো এত কষ্টকর আর চ্যালেঞ্জিং পেশা হয়তো খুব কমই পাওয়া যাবে। এত বিপদ মাথায় নিয়ে আর রক্ত পানি করা পরিশ্রম করেও যা জোটে তাও খুবই সামান্য। যা দিয়ে হয়তো কোনো মতে পরিবারের বৃদ্ধ, শিশুসহ সবার বেঁচে থাকার জন্য আহার জোটে।

সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল পেশাজীবীদের এত বিপদের চেয়েও আরও ভয়ঙ্কর এক বিপদ রয়েছে যার নাম ‘জলদস্যু’। আশির দশকে অস্ত্র নিয়ে সর্বপ্রথম সুন্দরবনে জলদস্যুতা শুরু করে ‘গনি বাহিনী’। সুন্দরবনে যাওয়া বিভিন্ন পেশাজীবী যেমন জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালিদের কাছ থেকে অস্ত্রের মুখে চাঁদা আদায় করা আর চাঁদা না পেলে মাছ, মধু লুট করে নিয়ে যেত তারা। পরবর্তীতে সারা সুন্দরবনজুড়ে আরও অনেক জলদস্যু বাহিনী এলাকা ভাগ করে নিয়ে দস্যুতা শুরু করে। আর চাঁদা আদায়ের জন্য তারা ব্যবহার শুরু করে ‘টোকেন’ ব্যবস্থা। জলদস্যু দলগুলো তাদের দখল করা এলাকায় আসা পেশাজীবীদের সবার টোকেন চেক করে দেখে। কারও কাছে টোকেন না পাওয়া গেলে তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় জলদস্যুরা। হাড়ভাঙা পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থ দিয়ে তাই সুন্দরবনে যাওয়ার আগে প্রত্যেক জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালিকে সংগ্রহ করতে হয় জলদস্যুদের টোকেন। একেকটি টোকেনের মূল্য ৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। সুন্দরবন সংলগ্ন ও উপকূলীয় লোকালয়গুলোতে ভদ্রবেশে লুকিয়ে থাকা জলদস্যুদের এজেন্টরাই এই টোকেনগুলো সুন্দরবনের পেশাজীবীদের কাছে বিক্রি করে। বিনিময়ে টোকেন বিক্রির একটি অংশ তারা পায়।

জলদস্যুদের বিচরণ সুন্দরবন জুড়ে। পাথরঘাটা থেকে শ্যামনগর কোথাও স্বস্তি নেই এই মানুষরূপী জলদস্যুদের অত্যাচার। ইলিশ ধরার মৌসুমে জলদস্যুরা তাদের দ্রুতগামী ট্রলারগুলো নিয়ে হায়েনার মতো ছুটে যায় সাগরেও। সেখানে মাছ ধরার ট্রলারগুলো থেকে লুট করে নেয় মাছ আর জাল। কোনো ট্রলারে যদি টোকেন না পাওয়া যায় তবে ওই ট্রলারের জেলেদের অপহরণ করে নিয়ে যায় জলদস্যুরা। পরে তাদের মোটা অঙ্কের টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনে তাদের পরিবার অথবা মালিক। পারিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম অতি আপনজনকে জলদস্যুর কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনতে অনেক সময় শেষ সম্বলটুকুও বিক্রি করে দিতে হয় পরিবারগুলোকে। মুক্তিপণ গড়ে এক লাখ থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত হয়। হতদরিদ্র পেশাজীবীদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের আয়ের বিনিময়ে টোকেনের টাকা আর ভিটেমাটি বিক্রির মুক্তিপণের টাকায় জলদস্যুরা যাপন করে বিলাসী জীবন।

কী নেই জলদস্যুদের ট্রলারে! বিদেশি জুস, ফলমূল, দামি বডিলোশন, চুলের মেহেদি, বিভিন্ন ধরনের খাবার। ট্রলারে রয়েছে শুষ্ক ও তাজা খাবার সংরক্ষণের স্টোর। বেশির ভাগ ডাকাতের ট্রলারই স্টিল অথবা লোহার পুরু পাত দিয়ে বুলেট প্রুফ করা। আমোদ-প্রমোদেরও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয় নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর, মদ, গান-বাজনা, নেশাদ্রব্য তো আছেই। এ ছাড়াও বানিয়াশান্তা পতিতাপল্লী ও বিভিন্ন লোকালয় থেকে টাকার বিনিময়ে মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হয় ডাকাত দলের প্রমোদের জন্য। দরিদ্র মানুষের ঘাম ঝরানো হাড়ভাঙা পরিশ্রমের টাকা লুণ্ঠন করে এভাবেই দুহাতে খরচ করে হায়েনার দল। আর বাজার সদাই থেকে শুরু করে মেয়ে মানুষ সরবরাহের দায়িত্ব পালন করে লোকালয়ে থাকা কিছু ভদ্রবেশী ব্যক্তি, যার বিনিময়ে ডাকাত দলের লুণ্ঠিত অবৈধ রোজগারের একটা বড় অংশ পেয়ে যায় তারা।

জলদস্যুরা সুন্দরবননির্ভর পেশাজীবীদের অত্যাচারের পাশাপাশি মারাত্মক ক্ষতি করছে সুন্দরবনেরও। আমাদের গর্ব রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে গুলি করে হত্যা করে সেই বাঘের চামড়া ও হাড় কালোবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। নিজেরা খাওয়ার জন্য ও মাংস বিক্রি করার জন্য অবাধে শিকার করছে হরিণ। হরিণের চামড়াও বিক্রি করে দিচ্ছে অবৈধভাবে। তা ছাড়া নিজেরা থাকা ও রান্না করার জন্য সুন্দরবনের গাছ কেটে নষ্ট করছে। দিন দিন রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ জলদস্যু কর্তৃক অবাধে বাঘ হত্যা করা। র‌্যাব এ যাবৎ জলদস্যু কর্তৃক হত্যা করা বাঘ ও হরিণের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চামড়া উদ্ধার করেছে। উদ্ধার করা বাঘ ও হরিণের চামড়াগুলো জলদস্যু কর্তৃক শিকারের পরবর্তীতে অবৈধ চোরাকারবারিদের হাতে গেছে। অবাধে বাঘ ও হরিণ শিকার এবং গাছ ও জঙ্গল কেটে ফেলার কারণে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়ছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে খাদ্য শৃঙ্খলা।

আশির দশক থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সুন্দরবনে অনেক জলদস্যু দল দস্যুতা করে আসছে। এদের মধ্যে উল্লেযোগ্য বাহিনীগুলো হচ্ছে ‘শীর্ষ বাহিনী’, ‘ফেরাউন বেল্লাল’, ‘কাসেম বাহিনী’, ‘মাস্টার বাহিনী’, ‘রাজু বাহিনী’, ‘আলিম বাহিনী’ প্রভৃতি। বড় জলদস্যু বাহিনীগুলোর মাসিক আয় গড়ে ৫০ লাখ থেকে ৬০ লাখ টাকা। আর ছোট বাহিনীগুলোর ৫০ হাজার টাকা থেকে ৩ লাখ টাকা। বড় বাহিনীগুলোর প্রায় সব অস্ত্রই বিদেশি। এরা আমেরিকা, তুরস্ক ও ভারতে তৈরি অস্ত্র বেশি ব্যবহার করে। নাইন শুটার, এইট শুটার, সিং শুটার, ডাবল ব্যারেল, সিঙ্গেল ব্যারেল, এ কে.২২ অস্ত্রগুলোই বেশি ব্যবহার হয়। আর ছোট দলগুলো দেশীয় বন্দুক, এলজি, ওয়ান শুটার প্রভৃতি অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে।

আশির দশক থেকে শুরু করে ২০১৫ সাল পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শতাধিক জলদস্যু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে শীর্ষ বাহিনীর প্রধান শীর্ষ, ফেরাউন বেল্লাল বাহিনীর প্রধান বেল্লাল, কাসেম বাহিনীর প্রধান কাসেম প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ ক্ষেত্রে র‌্যাবই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্মতিতে র‌্যাবের ক্রমাগত অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পড়া জলদস্যুরা ২০১৬ সাল থেকে র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করা শুরু করে। ২০১৬ সাল থেকে অদ্যাবধি র‌্যাবের কাছে বিপুল অস্ত্র গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করে ১০টি জলদস্যু বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান আর দস্যুদলগুলোর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে প্রায় সমাপ্তির পথে সুন্দরবনের অভিশাপ জলদস্যু অধ্যায়ের। গোয়েন্দা তথ্য মতে, আর দু-তিনটি বাহিনী এখনো সুন্দরবনে দস্যুতা চালিয়ে যাচ্ছে। শিগগিরই হয়তো এগুলোও আত্মসমর্পণ অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মধ্য দিয়ে নির্মূল হয়ে যাবে। অভিশাপমুক্ত হচ্ছে আমাদের গর্ব, আমাদের ঐতিহ্য সুন্দরবন। নিরাপত্তা, শান্তি আর আস্থা ফিরে আসছে উপকূলীয় ও সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ের দরিদ্র অসহায় মানুষগুলোর মাঝে। নিরাপদ হচ্ছে আমাদের গর্ব রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর চিত্রা হরিণ। আগামীতে হয়তো বাঘ আর হরিণের পরিসংখ্যানে আমরা এর সুফল দেখতে পাব।

আত্মসমর্পণ করা জলদস্যুদের পুনর্বাসনের বিষয়েও র‌্যাব সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পেশাগত দায়িত্বের বাইরে সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে আত্মসমর্পণ করা জলদস্যুদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে নগদ অর্থ সহায়তা, তাদের পরিবারকে সহায়তা এবং তাদের স্বাবলম্বী করার জন্য সার্বিকভাবে সহায়তা করছে র‌্যাব। তারা যেন আবার দস্যুতা পেশায় ফিরে না যায় তার জন্য তাদের মোটিভেশন দেওয়া এবং নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থাও করছে র‌্যাব। আত্মসমর্পণকৃত জলদস্যুদের অনেকেই ইতিমধ্যে জামিন পেয়ে র‌্যাবের সহায়তায় বিভিন্ন সামাজিক পেশায় কাজ করতে শুরু করেছে। কেউ দোকান দিয়েছে, কেউবা রিকশাভ্যান কিনে চালাচ্ছে। অনেক জলদস্যু নিজেও এখন জেলে হিসেবে মাছ ধরতে যাচ্ছে সুন্দরবনে। র‌্যাবের সহায়তায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারা জলদস্যুরা সবাই র‌্যাবের প্রতি কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞ তাদের পরিবারের সদস্যরাও।

সুন্দরবনকে জলদস্যু মুক্ত করার এ বিরল সাফল্যের ফলে উক্ত এলাকার জলদস্যু, জেলে, সুন্দরবননির্ভর পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষের জীবন ধারায় অভাবনীয় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। নিম্নে তাদের কিছু স্বগোক্তি উল্লেখ করা হলো—

আত্মসমর্পণকারী জলদস্যু মো. সোহাগ গাজী (মাস্টার বাহিনী) বলেন, ‘স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিভিন্ন অপকর্মে বাধা প্রদান করায় তারা আমার নামে ৮-৯টি মিথ্যা মামলা দেয়। মামলার বিভিন্ন খরচের কারণে আমি আর্থিকভাবে অনেক সংকটে পড়ি এই সংকট এড়াতে এবং অধিক আয়ের আশায় ২০০৯ সালে প্রথমে রাজু বাহিনীতে যোগ দেই। সেখানে এক বছর কাজ করার পরে এ ধরনের কাজ ভালো লাগে না এবং র‌্যাবের ভয়ে ও পরিবার থেকে দূরে থাকার বিরহে বাড়ি ফিরে আসি। আবার ২০১৪ সালের দিকে নোয়া বাহিনীতে যোগ দিই। প্রায় ৬ বছর এ পেশায় থাকার পর জলদস্যু জীবন আর ভালো লাগে না। নিজের স্ত্রী সন্তানদের সঙ্গে দেখা হয় না, জঙ্গলে জঙ্গলে পালিয়ে জীবনযাপন করতে হয়, সাধারণ মানুষের মাঝে প্রাণ খুলে চলা যায় না এবং র‌্যাবের ভয় ইত্যাদি কারণে আমি আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেই এবং দলের সবাইকে আত্মসমর্পণের ব্যাপারে বুঝিয়ে অনুপ্রাণিত করি। আত্মসমর্পণ করে বর্তমানে আর্থিকভাবে মোটামুটি সচ্ছল আছি। নিয়মিত নামাজ আদায় করি। নিজের স্ত্রী সন্তানদের সঙ্গে সুখে জীবনযাপন করছি। আগে অনেক টাকা ছিল কিন্তু মনে শান্তি ছিল না বর্তমানে শান্তি রয়েছে। আত্মসমর্পণের পর র‌্যাব আমাদের নগদ ২০ হাজার টাকা ও দুটি কম্বল প্রদান করেছে। সরকার আমাদের মধ্যে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের বিদেশে প্রেরণের জন্য আশ্বাস প্রদান করেছে। আগে মনে হতো র‌্যাব মানেই আতঙ্ক। কিন্তু আত্মসমর্পণের পর বুঝতে পেরেছি, র‌্যাব মানুষকে সুন্দর জীবনে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে। আমার এই সুন্দর জীবন ও মুক্ত চলাচলের পুরোটাই র‌্যাবের অবদান।’

আত্মসমর্পণকারী জলদস্যু মো. বারেক তালুকদার (শান্ত বাহিনীর প্রধান) বলেন, ‘আমি কৃষি কাজ, জোনের কাজ, মাটি কাটার কাজ করে জীবন চালাতাম। আমার বাড়ির পাশে একটি মাছের ঘের থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী কিছু অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে। দলীয় শত্রুতার জের ধরে এ অস্ত্রের মামলায় আসামি হিসেবে আমাকে জড়িয়ে দেয়। মামলা চালানোর জন্য আমার স্ত্রী অনেক লোকের কাছ থেকে টাকা ধার করে এবং ঘর বিক্রি করে। পাওনাদারেরা বাড়িতে এসে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা বলে এবং আমার স্ত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের খারাপ ব্যবহার করত। কোনো দিক না পেয়ে স্বল্প সময়ে অধিক টাকা রোজগারের লোভে জলদস্যু ছোরাব বাহিনীতে যোগ দেই। বাহিনীপ্রধান ছোরাব ও প্রধান সহযোগী র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার পরে আমি বাহিনীর প্রধান হই। পালিয়ে বাঁচার জীবন ভালো লাগত না, নিজের স্ত্রী সন্তানদের সঙ্গে দেখা হতো না, সাধারণ মানুষের মাঝে নির্ভয়ে হাঁটতে না পারা, সব সময় আতঙ্কে থাকা ইত্যাদি কারণে আমি আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। আত্মসমর্পণের পর স্বাভাবিক জীবনযাপন অনেক ভালো লাগছে, অনেক ভালো ও সুখে আছি। র‌্যাব নগদ ২০ হাজার টাকা ও দুটি কম্বল প্রদান করেছে, যে কোনো সমস্যা র‌্যাবকে অবহিত করার সঙ্গে সঙ্গে র‌্যাব সাহায্য করে। র‌্যাব সন্ত্রাসীদের ভুল থেকে সরে আসার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। অপরাধী জীবন থেকে ফিরে এসে যে আবার স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারব এটা কখনো ভাবিনি। মনে হতো হয়তো আমার লাশের কবরও হবে না কিন্তু শুধু র‌্যাবের কারণেই আমি আজ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পেরেছি। র‌্যাবের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।’

আত্মসমর্পণকারী জলদস্যু মজনুর হাতে অপহৃত মো. লিটন বিশ্বাস বলেন, ‘সুন্দরবনের পাশেই আমাদের বসতবাড়ি এবং এখানে বংশ পরম্পরায় আমরা মাছ-কাঁকড়া ধরে জীবিকা চালাই। শুনেছি মজনু আমাদের মতোই সু্ন্দরবনের ভিতরে নদী ও খালে মাছ ধরত। সেখান থেকেই জলদস্যুদের দলে যোগ দেয়। পরবর্তীতে নিজেই বাহিনী গঠন করে। সে প্রায় ১০/১২ বছর জলদস্যু ছিল। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে আমি ও আমার ছেলে একদিন সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরতে গেলে মজনু বাহিনীর হাতে নৌকা ও কাঁকড়াসহ অপহৃত হই। আমাদের অনেক মারধর করে। আমি বাড়ি ফিরে টাকা পাঠিয়ে আমার ছেলেকে মুক্ত করি। এভাবে সে অনেক জেলেকে আটক করে মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন করত এবং টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিত। আত্মসমর্পণের পর সে জেলে আছে বলে শুনেছি। খুলনার কয়রা ও সাতক্ষীরা জেলার দক্ষিণ অংশে সুন্দরবনে মজনু বাহিনীর উৎপাত ছিল। ওই এলাকায় মাছ ধরতে গেলে তাদের নিয়মিত চাঁদা দিতে হতো। চাঁদা না দিলে নেমে আসত বিপদ। আমরা সবসময় আতঙ্কে থাকতাম। ভয়ে থাকতাম, কখন মজনুর লোকজন আমাদের ধরে নিয়ে যায় এবং মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন করে। আমার মতো অনেক দরিদ্র জেলে এতদিন তাদের ভয়ে শান্তিতে কাঁকড়া-মাছ ধরতে পারত না। মজনু আত্মসমর্পণ করেছে এবং জেলখানা থেকে ছাড়া পেলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে বলে আশা করি। আত্মসমর্পণ করায় আমরা জেলেরা সবাই খুশি। সুন্দরবনে কাঁকড়া-মাছ ধরতে আমাদের আর কোনো অসুবিধা নেই। মজনু বাহিনী র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করবে তা বিশ্বাস করিনি। জলদস্যুদের আত্মসমর্পণের কারণে আমরা সুন্দরবনে নির্বিঘ্নে মাছ ও কাঁকড়া ধরতে পারছি। তাই র‌্যাবকে আমরা ধন্যবাদ জানাই।’

আত্মসমর্পণকারী জলদস্যু জাহাঙ্গীরের প্রতিবেশী কামাল শিকারি বলেন, ‘জাহাঙ্গীর আমার ভাতিজা ও প্রতিবেশী। জাহাঙ্গীরের বাড়ি বাগেরহাট জেলার রামপাল থানাধীন শ্রীফলতলায়। জলদস্যুতায় যাওয়ার আগে সে সুন্দরবনের ভিতরে কাঁকড়া ও মাছ ধরত। মাছ ধরতে গিয়ে সুন্দরবনের জলদস্যুদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। লোভে পড়ে এক পর্যায়ে জলদস্যুদের সঙ্গে তার সখ্য হয়। সে প্রথমে রাজু বাহিনীর ও পরে ইলিয়াস বাহিনীর সদস্য হিসেবে কাজ করে। পরবর্তীতে এ বাহিনী ভেঙে গেলে সে নিজেই লোক সংগ্রহ করে বাহিনী গঠন করে তার দলনেতা বনে যায়। জাহাঙ্গীর প্রায় ৮/১০ বছর ধরে জলদস্যুতায় লিপ্ত ছিল। জেলেদের ধরে নিয়ে আটক রাখত। আমার ভাতিজা জলদস্যু থাকাকালে লজ্জায় কাউকে মুখ দেখাতে পারতাম না। এলাকার লোকজন আমাদের নানা কথা শোনাত। র‌্যাব, ডিবি প্রায়ই খুঁজতে আসত এবং এলাকায় নতুন কাউকে দেখলে আমরা ভয় পেতাম। আমি সবসময় আতঙ্কে থাকতাম কখন যে জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর খবর পাই। তাকে ভাতিজা হিসেবে পরিচয় দিতে সঙ্কোচবোধ করতাম। সে র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণের পর বর্তমানে জেলে রয়েছে। শুনেছি সে তার অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য অনুতপ্ত। জাহাঙ্গীর আত্মমর্পণের পর তার স্ত্রী ও পরিবার শ্রীফলতলায় নিজ বাড়িতে বসবাস করে। আমার ভাতিজা খারাপ পথ থেকে ভালো পথে ফিরে এসেছে। এটাই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আমার ভাতিজা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণ করে সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে পেরেছে এজন্য র‌্যাবের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সরকার তাদের আর্থিক সাহায্য দিয়েছে। অন্য জলদস্যুরাও যদি এ পথ ছেড়ে ভালো পথে আসে সেই দোয়া করি।’

আত্মসমর্পণ পরবর্তী জলদস্যুদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। আত্মসমর্পণকারী জলদস্যুদের কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে এ উদ্যোগের সফল পরিসমাপ্তি ঘটবে। এ লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ জলদস্যুদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়াকে আরও বেগবান করবে। এজন্য বেসরকারি পর্যায়ে জলদস্যুদের পুনর্বাসনে আগ্রহী ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান করপোরেট সোস্যাল রেসপন্সিবিলিটির আওতায় এগিয়ে আসতে পারেন। জলদস্যুতার পরিসমাপ্তির মাধ্যমে সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলে যে স্বস্তির পরিস্থিতি বিরাজমান রয়েছে তা দীর্ঘস্থায়ী করতে সবাইকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।

২০১৫-২০১৬ সাল সুন্দরবননির্ভর পেশাজীবীদের জন্য ক্রমবর্ধমান স্বস্তির সময়। বহু বছরের অত্যাচার আর শোষণ থেকে মুক্তির বছর। বহুদিনের দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পাচ্ছে অসহায়, দরিদ্র মানুষগুলো। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের টাকা এখন আর দিতে হচ্ছে না জলদস্যুদের টোকেনের জন্য। ছোট শিশুটিকেও হয়তো আর যেতে হবে না ওই কষ্টকর অনিশ্চিত জঙ্গলে। তার পিতার ঘাম ঝরানো রোজগারে যদি হায়েনা জলদস্যু কামড় না বসায় তাহলে হয়তো শিগগিরই সে স্কুলে যাওয়া শুরু করবে। জলদস্যু অধ্যায়ের সমাপ্তির অপেক্ষায় দিন গুনছে উপকূলীয় অঞ্চলের সব মানুষ। হয়তো খুব শিগগির সমগ্র সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত ঘোষণা করা যাবে। আমাদের বিলুপ্ত প্রায় প্রাণিকূল ও বনজসম্পদ রক্ষা পাবে। পর্যটন শিল্পের প্রসারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ভাগ্য আরও সুপ্রসন্ন হবে। সে দিনের অপেক্ষায় উপকূলীয় অঞ্চলের প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি পরিবার, প্রতীক্ষায় সেই ছোট্ট শিশুটিও। সমগ্র জাতির সঙ্গে র‌্যাব ফোর্সেস এর প্রতিটি সদস্যও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

     —লেখক : র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-এর মহাপরিচালক

সর্বশেষ খবর