বৃহস্পতিবার, ১৮ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

সাপের খামারে কোটি টাকার হাতছানি

প্রতিনিয়ত সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে বাংলাদেশে। নতুন নতুন আবিষ্কার আর ভালো উদ্যোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এ দেশ। উন্নত দেশগুলোকে অনুসরণ করে সম্প্রতি বাংলাদেশের কয়েকটি স্থানে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় কিছু বিষাক্ত সাপের খামার। মূলত সাপ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, বিষ সংগ্রহ, রপ্তানি এবং প্রতিষেধক তৈরির উদ্দেশ্যেই গড়ে উঠেছে এসব খামার। কিছু সাহসী ব্যতিক্রমী উদ্যোক্তার প্রচেষ্টায় আজ উজ্জ্বল সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। কিন্তু সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় থমকে আছে সম্ভাবনাময় এই শিল্প। দেশের দুই প্রান্তে গড়ে ওঠা দুটি বৃহত্ খামারের সম্ভাবনার কথা নিয়ে লিখেছেন— নাহিদুর রহমান হিমেল; প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন আমাদের পটুয়াখালী প্রতিনিধি—সঞ্জয় কুমার দাস

সাপের খামারে কোটি টাকার হাতছানি

‘রাজবাড়ী স্নেক ফার্ম’-এ সংরক্ষিত অজগর (বামে), পটুয়াখালীর ‘বাংলাদেশ স্নেক ভেনম’ ফার্মে সংরক্ষিত কিছু বিষধর গোখড়া সাপ (মাঝে) এবং সাপ রাখার প্লাস্টিকের বাক্স (ডানে)

খামার গড়ে ওঠার গল্প

  মানুষের কাছে মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম সাপ। জল ও স্থল উভয় স্থানেই বিভিন্ন প্রজাতির সাপ বসবাস করলেও স্থলেই এদের বেশি দেখা যায়। হাত-পা বিহীন এই লম্বা সরীসৃপের প্রতি মানুষের যেন কৌতূহলের শেষ নেই। কোথাও সাপ দেখা গেলে মানুষজন লাঠিসোটা নিয়ে ছুটে যায় পিটিয়ে মারতে। সাপের সঙ্গে যেন মানুষের চিরকালের শত্রুতা। বিষধরদের জন্য বিখ্যাত হলেও বেশির ভাগ প্রজাতির সাপই নির্বিষ। কৌতূহলী এই প্রাণীটিকে লালন-পালনে পেশা হিসেবে নিতে চেয়েছেন এ দেশের কিছু সাহসী উদ্যোক্তা। ডিসকভারি বা ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে বিষাক্ত সাপ সংগ্রহ, পালন ও বিষ সংগ্রহের ওপর নানা তথ্যচিত্র দেখেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন তারা।

তেমনি একজন আবদুর রাজ্জাক বিশ্বাস। দেশের সর্ব দক্ষিণে উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালী সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে নন্দিপাড়া গ্রামে গড়ে তুলেছেন সাপের খামার। প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ না থাকলেও সৌদি প্রবাসী আবদুর রাজ্জাক বিশ্বাস তার নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছেন খামারটি। ‘বাংলাদেশ স্নেক ভেনম’ নামের একটি সাইনবোর্ড নিয়ে পাকা ঘরে চলছে আবদুর রাজ্জাকের সাপ লালন-পালন। সেখানে বিভিন্ন সাইজের নানান প্রজাতির সাপগুলো রয়েছে বাক্সবন্দী। আবার বেশকিছু সাপ রয়েছে হাউস সিস্টেমে ভিন্ন ভিন্ন কক্ষের মেঝেতে।

সাপের খামারি আবদুর রাজ্জাক জানান, সৌদি আরবে থাকাকালীন বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান কিভাবে করা যায় এমন চিন্তা ঘুরপাক খায় তার মনে। এরই মধ্যে ইন্টারনেটে সাপের খামারের বিষয়টি নজরে আসে তার। ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি সাপের খামারির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার চোখে জ্বলে ওঠে সাপের বিষ থেকে বিপুল পরিমাণ আয়ের সম্ভাবনার স্বপ্ন। সেই উদ্যোক্তার কথা শুনে খামার প্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত হন তিনি।

এরপর ২০০০ সালে ছুটি নিয়ে দেশে আসেন রাজ্জাক। শুরু করেন সাপের খামার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবতা নিয়ে নানা কৌশল। এরই মধ্যে তার গ্রামেরই একটি পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে একটি গোখরা সাপ ধরেন। সেই সাপ থেকে ২৪টি ডিমও পান তিনি। ডিমগুলো প্রক্রিয়াজাত করে বাচ্চা ফোটান। একটি সাপ সঙ্গে ২৪টি বাচ্চা দিয়ে শুরু করেন তার খামার। সঠিক লালন-পালন আর পরিচর্যা করতে না পারায় শুরুর দিকে কিছু বাচ্চা মারা যায়।

বর্তমানে তার খামারে পাঁচ প্রজাতির (কোবরা নাজা নাজা, কমন ক্রেইট, কিং কোবরা, রাসেল ভাইপার ও পাইথন) প্রায় আড়াই শতাধিক সাপ রয়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা, সাপের খাবার সংগ্রহ ও সন্ধান মিললে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সাপ ধরে নিয়ে আসার কাজে রাজ্জাকের রয়েছে সাতজন শ্রমিক। রাজ্জাক জানান, তার খামারে সাপগুলো বেড়ে উঠছে উপযুক্ত পরিবেশে। সাপের খাওয়ানোর কাজটি বেশির ভাগ সময়ে তিনি নিজের হাতে করে থাকেন। তিনি বলেন, আমি সাপের খাবার রাতে দেই। কারণ সাপ অন্ধকারে ভালো খায়। এদিকে সাপ দেখতে প্রতিদিন তার বাড়িতে কৌতূহলী মানুষ ভিড় জমান। তারা দেখেন সাপ নিয়ে রাজ্জাকের খেলা। তার মুখেই মানুষ শোনেন সাপের অজানা তথ্য ও অপার সম্ভাবনার গল্প।

অন্যদিকে পটুয়াখালীর পাশাপাশি বেশ কিছুদিন আগে কয়েকজন তরুণের সাহসী উদ্যোগে রাজবাড়ীতে গড়ে ওঠে বিষধর সাপের খামার। এ জেলার কালুখালী উপজেলার মৃগী ইউনিয়নের কাঁসাদহ গ্রামে কয়েক প্রজাতির বিষধর সাপ নিয়ে গড়ে ওঠে এ খামার। প্রথমে এলাকাবাসীর নানা কটূক্তি শুনলেও এখন নানা রকম বাহবা পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এলাকাবাসীও। পরীক্ষামূলকভাবে ৮৩ শতাংশ জমির ওপর গড়ে ওঠা ‘রাজবাড়ী স্নেক ফার্ম’ নামের এ খামারে শুরুতে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ২০০টি বিষাক্ত সাপ ছিল। কয়েকবার গোখরা সাপের ডিম থেকে কয়েকশ’ বাচ্চাও পাওয়া গেছে।

খামারের প্রধান উদ্যোক্তা মো. রবিউল ইসলাম রঞ্জু বলেন, চাচাতো ভাই ডাক্তার, তাই সাপ নিয়ে তার কিছু পরামর্শ আমাকে এ খামার করতে উৎসাহ জোগায়। এরপর ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ও ডিসকভারি চ্যানেলে সাপের অনুষ্ঠানগুলো নিয়মিত দেখতে থাকি। সেই সঙ্গে ইন্টারনেটে তথ্য সংগ্রহ শুরু করি। এরপর রাজবাড়ী সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক নুরুজ্জামান স্যার ও তার ছাত্র তন্ময় সরকারসহ আমার কয়েক বন্ধুর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করেই এ খামার প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেই। পরে পটুয়াখালীর সাপের খামারি আবদুর রাজ্জাক এবং রাজশাহীর বোরহান বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা আমাকে দিক-নির্দেশনা দেন।

সরেজমিন খামারে গিয়ে দেখা যায়, প্রাপ্তবয়স্ক বিষাক্ত সাপগুলোকে আলাদাভাবে একটি ঘরের ভিতরে খণ্ড খণ্ড হাউসে রাখা হয়েছে। বর্তমানে এ খামারে স্থান পেয়েছে পাঁচ প্রজাতির প্রায় অর্ধ শতাধিক সাপ।

এগুলোর মধ্যে রয়েছে, ইন্ডিয়ান র‌্যাট স্নেক বা দাঁরাজ, ইন্ডিয়ান কোবরা নাজা নাজা, রাসেল ভাইপার, পাইথন বা অজগর এবং স্যান্ডবোয়া বা বালুবোড়া। এসব সাপের অধিকাংশই সংগ্রহ করা হয়েছে আশপাশের স্থানীয় বিভিন্ন বাসাবাড়ি বা জঙ্গল থেকে। এলাকায় এমন সাপের খামার থাকায় আনন্দিত এলাকাবাসী। এখন কোথাও সাপের দেখা পেলেই খবর দেন এখানে। সাপ রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচর্যার জন্য এখানে রয়েছেন চারজন কর্মচারী। বিষাক্ত প্রাপ্তবয়স্ক সাপগুলোকে সপ্তাহে একদিন খাওয়ানো হয় বয়লারের বাচ্চা (একদিন বয়সের), ব্যাঙ, ইঁদুর বা পোকামাকড়। আর বাচ্চা সাপগুলোকে খাওয়ানো হয় কেঁচো ও আলোর ফাঁদের মাধ্যমে সংগ্রহ করা বিভিন্ন পোকামাকড়।

রঞ্জুর নিজস্ব অর্থায়নেই চলছে এ খামার। ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রতিষ্ঠিত এই খামারে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। বর্তমানে তিনজন কর্মচারী রয়েছে এবং মাসিক খরচ প্রায় ১০-১২ হাজার টাকা। এ ছাড়া সাপের খামারের পাশাপাশি কেঁচোর চাষ করে আদর্শ জৈব সার উৎপাদনের একটি খামারও তৈরি করেছেন রঞ্জু।

 

দুই খামারির যত স্বপ্ন ও প্রতিকূলতা

দেশে বেশ কয়েকটি সাপের খামার গড়ে উঠলেও রয়েছে নানা প্রতিকূলতা। খামার শুরুর পর সরকারের পক্ষ থেকে সাপের বিষ রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা শুনেই অনুপ্রাণিত হন পটুয়াখালীর আবদুর রাজ্জাক। কিন্তু সরকারি অনুমোদন না পাওয়ায় বিষ উৎপাদন ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যেতে পারছেন না রাজ্জাক। নিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি এলাকায় কিছু বেকার যুবককে সঙ্গে নিয়ে শুরু করেন এই খামার। তবে দীর্ঘ ১৭ বছরেও বিষ রপ্তানির জন্য সরকারি অনুমোদন না পাওয়ায় হতাশ এই উদ্যোক্তা। তিনি জানান, বিষ রপ্তানির অনুমোদন পেলে জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখা সম্ভব। আর স্বল্প পুঁজিতে সাপের খামার করে দ্রুত লাভবান হওয়া সম্ভব। এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে সংসদে সরকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী তা ইতিবাচকভাবে নেন এবং সাপ লালন-পালন, সাপের বিষ সংগ্রহ এবং সাপুড়েদের বিকল্প কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। রাজ্জাক বলেন, ২০০৮ সালে বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে একটি গেজেট প্রকাশ করে। সরকারের উদ্যোগের পরেই মূলত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খামার প্রতিষ্ঠার দিকে পুরোপুরি নজর দেই। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন পরিচালক মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান সরকার স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগকে কাজে লাগাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে ‘ছাড়পত্রের’ জন্য সেটি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু এক অজানা কারণে থমকে আছে অনুমোদনের বিষয়টি। এদিকে খামারের উদ্দেশ্য ও স্বপ্ন নিয়ে রাজবাড়ী স্নেক ফার্মের উদ্যোক্তা রবিউল ইসলাম রঞ্জু বলেন, সরকারের সহযোগিতা ও নিবন্ধন পেলে খামারে সংগৃহীত বিষ দিয়ে এন্টিভেনাম উৎপাদন সম্ভব হবে এবং বাণিজ্যিকভাবে বিষ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অজন করা সম্ভব হবে। খামার ও বিষ রপ্তানির অনুমোদন নিয়ে শুরু থেকেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন রঞ্জুু। সমবায় অধিদফতরের মাধ্যমে তিনি খামারের অনুমোদন পেয়েছেন। তবে এখন প্রয়োজন বিষ রপ্তানির অনুমোদন। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে এ ব্যাপারে রঞ্জু বলেন, এখন শুধু সাপের বিষ সংরক্ষণ ও তা রপ্তানির সুযোগ চাই। সরকার এদিকে দৃষ্টি দিলে সমুদ্র বিজয় থেকেও বড় বিজয় ঘটবে বাংলাদেশে। এটিকে যদি শিল্প হিসেবে গড়ে তোলা যায় তবে তা পোশাক শিল্প থেকেও বড় ক্ষেত্র তৈরি করবে। তিনি বলেন, সাপের বিষের মাধ্যমে ওষুধ শিল্পে গবেষণার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। এটাকে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এটি একসময় বাংলাদেশের ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’ হবে। এ খাতের সম্ভাবনা নিয়ে রঞ্জু বলেন, কোবরা নাজা নাজ সাপের এক গ্রাম বিষের দাম ৩৫০ ডলার (সময়ভেদে)। সঠিক পরিচর্যায় এক মাসে একটি সাপ থেকে দুবার বিষ সংগ্রহ করা যাবে যা প্রায় এক গ্রাম বিষের সমান। সরকারি অনুমোদন পেলে বাণিজ্যিকভাবে খামার করার স্বপ্ন দেখছেন রঞ্জু। তিনি বলেন, বিষ রপ্তানির অনুমোদন পেলে আমরা এক হাজার সাপ দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে খামার চালু করব। এতে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা আসবে তেমনি সরকারের ট্যাক্সও বাড়বে। সেই সঙ্গে বেকারত্ব দূর হবে। এমনকি বেদে পল্লীর সাপুড়েদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, শুধু অনুমোদন দিলেই চলবে না। সরকারের এদিকে নজরদারিও বাড়াতে হবে। খামারের সাপের তালিকা রাখতে হবে। সাপ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বাচ্চার সংখ্যা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তা না হলে খামারের নাম করে অসাধু চক্র অবাধে সাপ বা সাপের চামড়া, মাংস ও বিষ বিদেশে পাচার করতে পারে। এদিকে এমন বিষাক্ত সাপের খামার রক্ষণাবেক্ষণে যেকোনো সময় ঘটতে পারে প্রাণনাশের মতো দুর্ঘটনা। পটুয়াখালী সদর হাসপাতালে এন্টিভেনম থাকলেও রাজবাড়ীতে নেই। তাই শিগগিরই সদর হাসপাতালে এন্টিভেনম রাখার দাবি জানিয়েছেন রঞ্জু বিশ্বাস। রাজবাড়ী জেলা সিভিল সার্জন ডা. রহিম বক্স বলেন, সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরে বিষয়টি জানিয়ে নতুন প্রতিষেধক চেয়েছি। আপাতত কোনো ঘটনা ঘটলে আমরা ফরিদপুরে রেফার করছি।

 

ঘোড়ার রক্ত থেকে সাপের এন্টিভেনম

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, সাপের বিষ থেকেই সাপের এন্টিভেনম তৈরি হয়। ঠিক কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতোই ব্যাপারটা। পৃথিবীতে খুব অল্পসংখ্যক প্রাণী নিজের শরীরে সাপের বিষ প্রতিরোধের ওষুধ তৈরি করতে পারে। যেমন : গাধা, ভেড়া, উট ও ঘোড়া। বেশি রক্ত এবং অনেকদিন বেঁচে থাকা আর বারবার ব্যবহার করা যায় বলে বর্তমানে বাণিজ্যিক ভাবে এন্টিভেনম উৎপাদনের জন্য ঘোড়ার ব্যবহার সর্বাধিক।

এন্টিভেনম তৈরির জন্য প্রথমে সাপের বিষ সংগ্রহ করা হয়। এরপর প্রথমে সুস্থ-সবল ঘোড়া নির্বাচন করে কয়েক ধাপে সাপের বিষ ইনজেকশনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট মাত্রায় ধমনিতে প্রবেশ করানো হয়। এভাবে বেশ কয়েক মাস পর সেই ঘোড়ার রক্তে শক্তিশালী এন্টিবডি তৈরি হয়ে যায়।

এরপর সেই ঘোড়া থেকে রক্ত সংগ্রহ করে তা থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় রক্তকণিকাগুলো পৃথক করে রক্তের এন্টিবডি আলাদা করা হয়। আলাদাকৃত এই এন্টিবডিই সাপের বিষের একমাত্র ওষুধ ‘এন্টিভেনম’। এরপর এটির শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বাজারজাত করা হয়। ঘোড়া বেশ স্বাস্থ্যবান এবং

 অনেক রক্ত থাকে বলে বেশি পরিমাণে রক্ত নিলেও ঘোড়ার তেমন ক্ষতি হয় না।

 

পরামর্শ

সাপের দংশনে যা করবেন

বিষাক্ত সাপে কাটা রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নির্ভর করে সাপ আক্রান্ত স্থানে কতটুকু বিষ ঢেলেছে, তার ওপর। আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সাহস দেওয়া। প্রয়োজনীয় সাহস দিতে না পারলে, রোগী হার্ট অ্যাটাকে মারা যেতে পারে। আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। রোগীকে শান্ত রাখতে হবে। রোগীর হার্টবিট স্বাভাবিক রাখতে হবে, হার্টবিট বাড়লে রক্তের সঙ্গে বিষ দ্রুত মিশে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আক্রান্ত স্থান হার্ট লেভেলের নিচে রাখতে হবে। সাপের দংশনের স্থানে কোনো কাটাছেঁড়া যাবে না। সাপের দংশিত ক্ষতস্থান পরিষ্কার পানি বা এন্টিসেপটিক দিয়ে পরিষ্কার করা যেতে পারে। সম্ভব হলে আক্রান্ত স্থানের আশপাশে হালকা চাপ দিয়ে ক্ষতস্থান দিয়ে কিছু রক্ত বের করা যেতে পারে। আর মুখ লাগিয়ে রক্ত চোষা উচিত নয়। আক্রান্ত স্থানের এক থেকে দেড় ইঞ্চি উপর থেকে ৬/৭ ইঞ্চি উপর পর্যন্ত চিকন লাঠি দিয়ে ডোড়া বেঁধে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তবে খুব বেশি শক্ত করে বাঁধা যাবে না। এমনভাবে বাঁধতে হবে, যেন আক্রান্ত অঙ্গ ও কাপড়ের মাঝে কষ্ট করে একটি আঙ্গুল ঢোকানো যায়। হাসপাতালে নেওয়ার সময় রোগীকে বসানো অবস্থায় নেওয়া এবং রোগীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে যাওয়া ভালো। সাধারণত নির্বিষ সাপের দংশিত স্থানে সামান্য ব্যথা, ফুলে যাওয়া বা সামান্য ক্ষতের সৃষ্টি হয়ে থাকে। তবে এসব লক্ষণ থাকলেও ঝুঁকি নেওয়া ঠিক নয়।

পরামর্শ দিয়েছেন—

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

 

যত ভ্রান্ত ধারণা

♦  গাছের বাকল, শিকড় বা তাবিজ দিয়ে সাপের বিষ নামানো যায় না

♦  সাপ আঘাতকারীকে চিনে রেখে প্রতিশোধ নিতে পারে না

♦  সাপ বধির। তাই সাপুড়ের বীণে সাপ মাথা দুলিয়ে নাচে না

 

অনেকের ধারণা সাপকে কিছুটা আঘাত করে চলে গেলে সাপ তাকে চিনে রাখে এবং রাতে সাপ ওই আঘাতকারীর বাড়িতে গিয়ে দংশন করে। এটি পুরোটাই একটি ভ্রান্ত ধারণা। সাপের স্মৃতিশক্তি অনেক কম। এদের পক্ষে আঘাতকারীকে চিনে রাখা বা প্রতিহিংসা পরায়ণ হওয়া অসম্ভব।

এ ছাড়া সাপ কখনো দুধ-কলা খায় না। দুধ-কলা হজম করার এনজাইম এদের নেই। সাপ মাংসাশী প্রাণী। এরা ইঁদুর, ব্যাঙ, পোকা-মাকড় খায়। এ ছাড়া সাপ ‘গরুর বাঁট ধরে দুধ চুষে খায়’ এমন গল্প শোনা গেলেও এর কোনো ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি। কারণ চেরা জিভ দিয়ে চেটে বা চুষে দুধ খাওয়া যায় না।

সাপ বধির প্রাণী। দৃষ্টিশক্তিও অতি ক্ষীণ। তাই সাপুড়ের বীণ বাজানোর শব্দ ওদের শোনা সম্ভব নয়। যেহেতু ওরা খুব ক্ষীণ দেখে তাই কোনো সঞ্চারণশীল বস্তুকে বোঝার জন্য মাথা দোলায়। বীণ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাজানো হয় বলেই সাপও মাথা দোলায়। অনেকে বলে, রাতে শিস দিতে নেই, শিস ধ্বনি শুনে সাপ আসে। আসলে এটিও একটি ভ্রান্ত ধারণা। বধির সাপ শিসধ্বনি শুনতে পায় না। সাপ চলাফেরার প্রয়োজনে বার বার জিহ্বা বের করে তা আসলে শোনার জন্য নয়। এটিকে ঘ্রাণ নেওয়া বলা যেতে পারে। এর মাধ্যমে সাপ বুঝে যায় সামনে খাদ্য নাকি অখাদ্য, নাকি কোনো বিপদ আছে। সাপের মাথায় মণি বলে যা কিছু সাপুড়ে দেখায় বা বলে আসলে তা পুরোটাই ভ্রান্ত। সাপের মাথায় এ জাতীয় কোনো পাথুরে পদার্থ আদৌ তৈরি হয় না। সাপুড়েরা মানুষকে বিভ্রান্ত করতে নানা চটকদার কথা বলে থাকেন। অনেকের ধারণা দাঁরাশ সাপ লেজ দিয়ে আঘাত করে এবং এই আঘাত যেখানে লাগে সেখানে পচন ধরে। এটিও ভ্রান্ত।

আমাদের দেশের সবার ধারণা সাপ পিচ্ছিল। কিন্তু সাপ পিচ্ছিল তো নয়ই বরং খসখসে। সাপের গা থেকে কোনো প্রকার পিচ্ছিল পদার্থ নিঃসৃত হয় না। গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত কথা, ‘সাপের পা দেখলে রাজা হওয়া যায়’। আসলে সাপের কোনো পা নেই।

তাই সাপের পা দেখে রাজা হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। সাপের ওঝা বা কবিরাজ যে চিকিৎসা করে তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত।  কোনো গাছ-গাছাড়া দিয়ে বিষাক্ত সাপের বিষ নামানো সম্ভব নয়। সাপের ওঝার চিকিৎসায় সেই রোগীই ভালো হয় যাকে এমন সাপে দংশন করেছে যার বিষ নেই বা মারণ মাত্রার বিষ শরীরে প্রবেশ করেনি। অধিকাংশ সাপ মরণ মাত্রার বিষ ঢালতে পারে না, কারণ সাপ শিকার ধরার জন্য ছোবল দিলেই বিষ বেরিয়ে আসে। আর বিষথলিতে বিষভর্তি হতে ৮ থেকে ১০ দিন সময় লাগে।

সুতরাং বিষধর সাপের দংশন মানেই মৃত্যু নয়। কালনাগিনীর নাম শুনেই অনেকের গা শিউরে উঠতে চান! অনেকে বিশ্বাস করেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, পুরো পৃথিবীতে সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ কালনাগিনী। শুধু কি বিষাক্ত, কালনাগিনী হচ্ছে সাপদের রাণী; আর ভয়ঙ্কর রকম জেদি আর প্রতিহিংসাপরায়ণ। আসলে এসবই ভ্রান্ত ধারণা। কালনাগিনী একটি নির্বিষ সাপ।

 

সাপের বিষ ও এন্টিভেনম

সাপের জিহ্বার নিচে কিংবা চোয়ালের দুপাশে একজোড়া রূপান্তরিত প্যারোটিড গ্রন্থি থাকে যাদের কাজ হলো বিষ উত্পন্ন ও সংরক্ষণ করা। এই বিষ মূলত এক ধরনের রূপান্তরিত লালা। এই গ্রন্থি থেকে অতি সূক্ষ্মনালি তাদের বিষ দাঁতে প্রবেশ করে। বিষধর সাপের দাঁত অনেকটা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জের মতো, যা দিয়ে তারা বিষ ঢেলে দেয়। বিষ প্রয়োগ করার পুরো প্রক্রিয়ায় সময় লাগে মাত্র কয়েক সেকেন্ড। সাপের বিষে ২০টির বেশি এনজাইম পাওয়া গেছে এখন পর্যন্ত। সাপের বিষ কয়েকভাবে মানবদেহকে আক্রান্ত করতে পারে। এর মধ্যে প্রধানত তিনটি বিষয় উল্লেখ্য। যেমন—‘হেমোটক্সিন্স’ রক্তের লোহিত কণিকাকে বিভক্ত করে অথবা রক্তের জমাট বাঁধার ক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলে। নিউরোটক্সিন্স নার্ভকে আক্রান্ত করে, যার ভয়াবহ পরিণতি হলো যেসব পেশির সংকোচন প্রসারণে আমরা খাবার গিলতে পারি বা নিঃশ্বাস নিতে পারি—সেগুলো অকেজো হওয়া। কার্ডিওটক্সিন্স হৃত্যন্ত্রকে সরাসরি আক্রমণ করে এবং রক্ত চলাচল বন্ধ করে দিতে পারে। বিষাক্ত সাপে দংশন করলে শরীরে এন্টিভেনম প্রয়োগ করতে হয়। ১৮৯৪ সালে সাপের বিষের এন্টিভেনম আবিষ্কার করেন ফ্রান্সের ব্যাকটেরিয়া বিজ্ঞানী আলবার্ট ক্যালমেট। পরবর্তীতে লুই পাস্তুর সেটার উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। সাপের এন্টিভেনম দুপ্রকারের। এগুলো হলো— গড়হড়াধষবহঃ ধহঃর-াবহড়স এবং চড়ষুাধষবহঃ ধহঃর-াবহড়স। কোনো নিদিষ্ট প্রজাতির বিষধর সাপের প্রতিষেধক হিসেবে প্রথমটি ব্যবহৃত হয়। আর দুই বা তার চেয়ে বেশি প্রজাতির বিষধর সাপের প্রতিষেধক হিসেবে দ্বিতীয়টি ব্যবহার করা হয়। তবে স্বল্প বিষধর এবং নির্বিষ সাপের ক্ষেত্রে প্রতিষেধকের প্রয়োজন হয় না।

 

সোনার চেয়ে দামি সাপের বিষ!

সাপের এন্টিভেনম ছাড়াও বিষ থেকে আরও অনেক রোগের ওষুধ তৈরি হয়। তাই উন্নত দেশে এর চাহিদা ব্যাপক। এক গবেষণায় জানা গেছে, সাপের বিষ থেকে তৈরি ওষুধে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম। তাই সাপের বিষ থেকে হার্টের ওষুধ বানানোর গবেষণা চলছে। এ ছাড়া সাপের বিষের অপব্যবহারও দিন দিন বাড়ছে। ইদানীং মাদকেও মেশানো হচ্ছে সাপের বিষ! তাই দিন দিন বাড়ছে সাপের বিষের চাহিদা। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার সাপের বিষ পাচার হচ্ছে দেশের বাইরেও। এ মুহূর্তে এক লিটার সাপের বিষের বাজার দাম প্রায় তিন কোটি টাকা। সোনার সালে তুলনা করলে বলা যায় এটি সোনার চেয়েও অনেক দামি। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে এক গ্রাম সোনার দাম ৪০.৬২ মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশে প্রায় ৩ হাজার তিন হাজার ৩৩০ টাকা, যেখানে ব্যান্ডেড ক্রেইট সাপের এক গ্রাম বিষের দাম ৩৮০ ডলার যা বাংলাদেশে প্রায় ৩১ হাজার টাকা। এ ছাড়া কোবরা সাপের এক গ্রাম শুষ্ক বিষ প্রজাতি ভেদে ২৩৫ ডলার থেকে শুরু করে ৪৬৭ ডলার পর্যন্ত দাম রয়েছে। প্রতি বছরই দেশে শত শত কোটি টাকার বিষ উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সর্বশেষ গত ৮ মার্চ রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার এক বাড়িতে অভিযান চালিয়ে কোবরা সাপের ১২ পাউন্ড বিষ উদ্ধার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। যার মূল্য আনুমানিক প্রায় ১২ কোটি টাকা।

 

দেশের যত বিষধর সাপ

বন-জঙ্গলে, গ্রামাঞ্চলে ফসলের ক্ষেতে কিংবা বসতবাড়ির আশপাশে গোখরা সাপ বেশি দেখা যায়

 

পৃথিবীতে নানা ধরনের বিষধর সাপ আছে। কিছু কিছু সাপ আছে যাদের বিষে শরীরের মাংসে পচন ধরে। আবার কিছু সাপের বিষে এমন তীব্রতা যে, দংশনের সঙ্গে সঙ্গে শরীর অবশ হয়ে হৃৎপিণ্ড বিকল হয়ে যায়। বিষগ্রন্থির উপস্থিতির ওপর নির্ভর করে সাপ সাধারণত বিষধর ও নির্বিষ হয়ে থাকে। বিষধর সাপের শরীরে বিষ উৎপাদনকারী গ্রন্থি এবং বিষদাঁত থাকে। আমাদের দেশে কয়েক প্রজাতির বিষধর সাপ দেখা গেলেও নির্বিষ সাপের সংখ্যাই বেশি। বন-জঙ্গলে, গ্রামাঞ্চলে, ফসলের খেতে কিংবা বসতবাড়ির আশপাশে যে বিষধর সাপ দেখা যায় তার নাম গোখরা বা কোবরা। এর কয়েকটি  প্রজাতি রয়েছে। এর মধ্যে রাজ গোখরা বা কিং কোবরা সবচেয়ে বিষধর এবং বড় সাপ (৩.৫ মিটার থেকে ৫.৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়)। এটি দেশের সবত্র তেমন দেখা যায় না। কোবরা সাপের বিষে পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান পটাশিয়াম সায়ানাইডের পরিমাণ বেশি আছে। উজ্জ্বল সবুজ রঙের সবুজবোড়া সাপও বিষধর সাপের তালিকায় অন্যতম। আমাদের দেশে তিন প্রজাতির সবুজবোড়া থাকলেও বেশি দেখা যায় সাদাঠোঁট সবুজবোড়া বা হোয়াইট লিপড ট্রি ভাইপার। গোলাকার হলুদ চোখ এবং সারা শরীরে উজ্জ্বল সবুজ ও হলুদ রঙের মিশ্রণে ছোট এ সাপটি দিনের বেলায় গাছের শাখায় লুকিয়ে থাকে এবং সাধারণত রাতে শিকার করে থাকে। কমন ক্রেইট বা শাঁখামুঠি সাপ এক প্রকার বিষধর সাপ। এরা এমনি শান্ত তবে ক্ষিপ্ত গতির। এদের খাদ্য অন্য ছোট সাপ। শঙ্খিনী বা ডোরা কাল কেউটে বা ব্যান্ডেড ক্রেইট মারাত্মক বিষধর সাপ। এটি কেউটে সাপের ভিতরে সবচেয়ে দীর্ঘ এবং এটির সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য হতে পারে ২.১ মি বা প্রায় সাত ফুট। এরা সমতল ভূমির উন্মুক্ত স্থানে বাস করে। তবে পাহাড়ি জলস্রোতেও এদের দেখা যায়। এদের প্রিয় খাবার অন্য বিষধর সাপ। রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া অন্যতম একটি বিষধর সাপ। তবে এটি এখন মহাবিপন্ন। অন্য যেকোনো বিষাক্ত সাপের চেয়ে এ সাপই মানুষের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। এটি কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকে এবং হঠাৎ প্রচণ্ড বেগে শিকারকে ছোবল মারে। এরা সাধারণত সাড়ে তিন ফুট থেকে পাঁচ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। এ ছাড়া দেশে কিছু সামুদ্রিক সাপও আছে যা মারাত্মক বিষধর। এগুলো হাইড্রফিডি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। যেমন হলুদমুখো কেউটে বা ব্যান্ডেড সি ক্রেইট, বড়শিনাক বা হুক নোজড সি স্নেক, স্ট্রিপড সি স্নেক, ক্যান্টরের সরু মাথা সাপ ইত্যাদি।

 

নির্বিষ সাপ চেনার উপায়

বিষদাঁত ও বিষ উৎপাদক অঙ্গ বা বিষগ্রন্থিহীন সাপকেই নির্বিষ সাপ বলা হয়। বাংলাদেশে প্রায় ৯৪ প্রজাতির সাপের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশই নির্বিষ। তাই সাপে দংশন করলেই আতঙ্কিত হবেন না। নির্বিষ সাপে আক্রান্ত স্থানে সামান্য ব্যথা থাকে এবং লাল হয়ে যায়। ক্ষীণ বিষধর সাপের বিষথলিতে এত কম বিষ থাকে যে, পুরোটা কারও শরীরে ঢেলে দিলেও রোগী মারা যায় না। অধিকাংশ নির্বিষ সাপের মজবুত পিছনমুখী দাঁত রয়েছে, যা দ্বারা শিকারকে শক্তভাবে ধরে রাখতে এবং চেপে মারতে পারে। কোনো কোনো সাপ শিকারের নড়াচড়ার শক্তি না হারানো পর্যন্ত সেটা শক্তভাবে ধরে রাখে।

 

দেশের কিছু নির্বিষ বা ক্ষীণ বিষধর সাপ

 

♦  কালনাগিনী সাপকে অনেকে বিষধর সাপ মনে করেন। আসলে কালনাগিনী সাপে বিষ নেই

 

দাঁড়াশ সাপ আক্রমণাত্মক বলে অনেকেই একে ভয়ঙ্কর ও বিষাক্ত বলে মনে করে। তবে এ সাপে বিষ নেই।

 

বাংলাদেশে একই সাপ এলাকা ভেদে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। দেশের কিছু নির্বিষ সাপের মধ্যে অজগর একটি। অজগর গোত্রের তিনটি প্রজাতি বাংলাদেশে আছে। এরা খাবারের জন্য ঘাপটি মেরে বসে থাকে।

শিকার কাছে এলে কামড়ে পেঁচিয়ে ধরে চাপ দিয়ে শ্বাস বন্ধ করে মেরে ফেলে আস্ত গিলে খায়। ঘরগিন্ন্নি সাপও নির্বিষ। এর তিনটি প্রজাতি আছে এর মধ্যে দুটি বিরল। বাংলাদেশে বেশি পাওয়া যায় হলুদাভ ঘরগিন্নি সাপ। কালোমাথা সাপও নির্বিষ। এটি দুধরনের যথা ক্যান্টরের কালোমাথা সাপ ও ডুমেরিলের কালোমাথা সাপ। ঢোড়া সাপ দেশের প্রতিটি অঞ্চলেই দেখতে পাওয়া যায়। তবে এর ক্ষীণবিষ রয়েছে। এরা পানিতে থাকতে পছন্দ করে। এদের প্রিয় খাবার মাছ।

মেটে সাপ বা বাইট্টা সাপও ঢোড়া সাপের মতো সাধারণ ও সহজলভ্য সাপ। এরাও পানিতে থাকতে পছন্দ করে। এদের মাথা অপেক্ষাকৃত সরু।

দাঁড়াশ বা দাঁড়াজ সাপও বাংলাদেশে অহরহ দেখা যায়। ইংরেজিতে একে ইন্ডিয়ান র‌্যাট স্নেক বলে। এদের প্রধান খাবার ইঁদুর। এদের ব্যবহার খুবই আক্রমণাত্মক ও মারমুখী। দাঁড়াশ সাপের এই ব্যবহারের জন্য মানুষ

একে ভয়ঙ্কর ও বিষাক্ত বলে মনে করে। এরা খুব দ্রুত গতিতে চলাফেরা করতে পারে।

কালনাগিনী একটি নির্বিষ সাপ। গাছের ওপর থাকতে ভালোবাসে। এমনকি এক গাছের উঁচু অংশ থেকে আরেক গাছের নীচু অংশে লাফ দিতে পারে। এদের ফ্লাইং ট্রি স্নেকও বলা হয়। লাউডগা সাপ কয়েক প্রজাতির রয়েছে। যেমন পাতি লাউডগা সাপ, ছোট-নাক লাউডগা সাপ ইত্যাদি। এটি সুতানালি সাপ নামেও পরিচিত। এটি সরু, চিকন, লম্বা, মাথার অগ্রভাগ সুচালো এবং একদম সবুজ সাপ।

বালুবোড়া নিরীহ ও শ্লথগতির সাপ। ডিম থেকে নয় এরা সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে। একত্রে ৮-১০টি বাচ্চা দেয়। অজগরের মতো এরাও ওঁৎ পেতে শিকার করে। ইঁদুর এদের প্রধান খাদ্য বলে এরা কৃষকের বন্ধু বলে পরিচিত। বালুবোড়াকে অনেক সময় শিশু অজগরও বলা হয়। দুধরাজ সাপও নির্বিষ। এর নাম দুধরাজ হলেও এই সাপ দুধ খায় না।

সর্বশেষ খবর