শুক্রবার, ২৬ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা
সাইদা খানম

কান্নাভরা মন নিয়ে মানিকদার শয্যার পাশে এসে দাঁড়ালাম

কান্নাভরা মন নিয়ে মানিকদার শয্যার পাশে এসে দাঁড়ালাম

সাইদা খানম বাংলাদেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রশিল্পী। ১৯৫৬ সালে জার্মানিতে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড কোলন, ১৯৬০ সালে ‘অল পাকিস্তান ফটো প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান, ইউনেস্কো অ্যাওয়ার্ড, ১৯৮০ তে সাইপ্রাসে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ ফটো প্রতিযোগিতায় সার্টিফিকেট, বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সম্মানসূচক ফেলোশিফ লাভ করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন—শেখ মেহেদী হাসান

 

আপনার জন্ম পাবনায়। আপনি কী পারিবারিক উৎসাহে আলোকচিত্র চর্চায় যুক্ত হয়েছিলেন?

আমার জন্ম পাবনায় কিন্তু পৈতৃক বাড়ি ফরিদপুরে। আমার বাবা মৌলভি আবদুস সামাদ খান শিক্ষা বিভাগে কাজ করতেন। আমার ছবি তোলার শুরু ১৯৪৯ সালে, মাত্র ১২ বছর বয়সে। শৈশবে দেখা ইছামতি নদী, পাবনার মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাকে ক্যামেরায় ছবি তোলার বিষয়ে আগ্রহী করে তোলে। প্রথম দিকে নিজের ক্যামেরা ছিল না। সামাজিক পরিবেশও ছিল মেয়েদের ছবি তোলার অন্তরায়। পর্দার কড়াকড়ি বা অবরোধ প্রথার অনুশাসনের মধ্যে ক্যামেরায় ছবি তোলা ছিল বিপজ্জনক। কখনো লুকিয়ে চুপিসারে বাড়ি থেকে বের হয়ে সখের ছবি তুলেছি। বাবা মাত্র দুটি বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন। বিবাহ আসরে ও স্টেডিয়ামে গিয়ে ছবি তোলা নিয়ে। বাবার প্রথম নির্দেশটি পালন করতে পারলেও দ্বিতীয়টি মানতে পারেনি। দুই ভাই, চার বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। বড় বোন মহসিনা আলী ছিলেন আর্ট কলেজের প্রথম মহিলা আর্টিস্ট।

 

আপনার তোলা আলোকচিত্র প্রথম ছাপা হয়েছিল বিখ্যাত  ‘বেগম’ পত্রিকায়।

‘বেগম’ পত্রিকায় আলোকচিত্র সাংবাদিক হিসেবে আমি কাজ শুরু করি ১৯৫৬ সালে। তখন আমি শিক্ষার্থী। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ও ১৯৭২ সালে লাইব্রেরি সায়েন্সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করি। এরপর তো ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কাজ করেছি। প্রেস ফটোগ্রাফার হিসেবেও কাজ করেছি দীর্ঘদিন। দুটি জাপানি পত্রিকাসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমার তোলা আলোকচিত্র মুদ্রিত হয়েছে। ১৯৭৩ সালে কলকাতায় ‘অল ইন্ডিয়া ফটো জার্নালিজম কনফারেন্সে’ বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেছিলাম। এরপর নানা সময় দিল্লি, কলকাতা, নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছি।

 

আপনি বহু খ্যাতিমান মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছেন।

আমি প্রায় ৩ হাজার মানুষের ছবি তুলেছি। তার মধ্যে দেশ-বিদেশের রাজনীতিবিদ, শিল্প ও সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের বহু বরেণ্য স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বের ছবি। তাদের সান্নিধ্য পেয়ে ধন্য হয়েছি। কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, ইন্দিরা গান্ধী, রানী এলিজাবেথ, মাদার তেরেসা, মার্শাল টিটো, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, বেগম সুফিয়া কামাল, মৈত্রেয়ী দেবী, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, আশাপূর্ণা দেবী, অড্রে হেপবার্ন, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া চাঁদের দেশে প্রথম যারা পা রেখেছিলেন সেই নিল আর্মস্ট্রং, অ্যাড্রিন অলড্রিনস, মাইকেল কলিন্সসহ অনেকের ছবি তুলেছি।

আপনি তো নায়ক উত্তম কুমারের ছবি তুলেছেন।

ষাটের দশকের কথা। কলকাতায় যাওয়া তখন বেশ কড়াকড়ি। তবু বছরে একবার যেতাম। পাক সার্কাসে দূরসম্পর্কের মামার (আবুল মালেক) বাড়িতে থাকতাম। ডাক্তারি চেকআপের পর যে কয়দিন থাকতাম, বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দিতাম টালিগঞ্জের সিনেমা স্টুডিওতে। কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে ঘুরি চিত্রালীর প্রতিনিধি হিসেবে। সাক্ষাৎকার ও ছবি তুলতে গিয়ে বুঝেছিলাম, আকাশে সুনির্দিষ্ট তারকা খুঁজে পাওয়া সহজ। কিন্তু এই কলকাতা মহানগরের চিত্রতারকাদের খুঁজে পাওয়া সত্যি কঠিন। কখন কোন স্টুডিওতে কার শুটিং, জানা সম্ভব হতো না যদি শ্রীযুক্ত নির্মল কুমার ঘোষের সহযোগিতা না পেতাম। তিনি খ্যাতনামা সমালোচক। চিত্রজগতে তার যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা। তিনি কাউকে সাহায্য করেন না, আমি বিদেশিনী বলেই করেছিলেন। সেদিন ‘শিউলীবাড়ী’র শুটিং ছিল। ফ্লোরের ভিতরে ঢুকে দূর থেকে উত্তম কুমারকে দেখে বিস্মিত হই। হালকা কাঠের চেয়ারে বসে আছেন। রুপালি পর্দায় যে রকম চেহারা দেখি, অবিকল তাই। অত্যন্ত সরল-সহজ, অমায়িক ব্যবহার। ওই দিন উত্তম কুমারের যে ছবিগুলো তুলি, তা চিত্রালী ও বেগমে ছাপা হয়েছিল।

 

সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে তিনবার আলোকচিত্র প্রদর্শনী করেছেন। তার সঙ্গে পরিচয় হলো কী করে?

বাংলাদেশ তখন স্বাধীন বাংলাদেশ নামে পরিচিত হয়নি। চিত্রালীর প্রতিনিধি হয়ে মানিকদার সাক্ষাৎকার নিতে যাই। উৎসাহ আমারই ছিল বেশি। চিত্রালীর সম্পাদক মরহুম পারভেজ সাহেবের কাছে যখন সত্যজিৎ রায়ের নাম উচ্চারণ করেছিলাম তিনি আমাকে তেমন উৎসাহিত করেননি। কারণটা কলকাতায় এসে অনুভব করলাম। শুনলাম, মানিকদা অহংকারী ও দাম্ভিক মানুষ। বেশি কথা বলেন না, ফটোও তুলতে দেন না। ১৯৬২ সালে হেমন্তের আবছা সন্ধ্যার মুখোমুখি, ধীরে ধীরে উঠে এলাম মানিকদার (সত্যজিৎ রায়) লেক টেম্পল রোডের বাসার দোতলায়। দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়ালাম। এক পাল্লা খোলা। ভিতরের দিকে তাকিয়ে মনে হলো সাদা শাল গায়ে জড়িয়ে যে মানুষটি লিখে চলেছেন তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারব না। ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতেই মানিকদা আমার উপস্থিতি টের পেলেন। বললেন ‘কে?’ দরজা ঠেলে ভিতরে এসে সালাম জানিয়ে বললাম, আমি চিত্রালী পত্রিকার প্রতিনিধি। ‘বসুন’ বলেই লেখার মধ্যে ডুবে গেলেন। কয়েক মিনিট পরে মুখ তুলে আমাকে স্থির দৃষ্টিতে দেখলেন। আমি যে নার্ভাস বোধ করছি, এটা সহজেই বুঝতে পারলেন। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে, নম্রভাবে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন— ‘আমার সম্পর্কে কি জানতে চান?’ লেখার ফাঁকে ফাঁকে আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন। সেই সন্ধ্যায় আমি মানিকদার বেশ কিছুটা সময় নষ্ট করি। কিন্তু সে জন্য কোনো বিরক্তি প্রকাশ করলেন না। তার সম্পর্কে যা শুনেছিলাম সব মিথ্যা হয়ে যায়। চলে আসার আগে যখন ছবি তোলার অনুমতি চাইলাম, আপত্তি করলেন না। খুশি হয়ে বললেন—‘এই লাইনে আমাদের দেশের মেয়েরা একেবারেই আসে না।’ ৩০ বছর ধরে মানিকদার কর্মের ও পারিবারিক জীবনের ছবি তুলি। আমাকে তারা পারিবারিক বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। মানিকদা অস্কার পুরস্কারে সম্মানিত হওয়ার দুদিন পর আমি কলকাতায় গিয়েছিলাম। আশা ছিল, অস্কারসহ মানিকদার ছবি তুলব, কিন্তু সম্ভব হলো না। মানিকদা তখন বেলভ্যু হাসপাতালে। অবস্থা খুবই খারাপ। নিকটতম আত্মীয় ছাড়া কাউকে ডাক্তাররা দেখতে দেন না। অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর মঙ্কুদিকে বলি, আমি কি একবার মানিকদাকে দেখতে পারি না? মঙ্কুদি রাজি হলেন। পথে গাড়িতে মঙ্কুদি আমাকে বললেন, ‘মানিক তার বিশেষ বন্ধুকে চিনতে পারেনি, তোমাকে যদি না চেনে দুঃখ পেয় না।’ ইনটেনসিভ কেয়ারের ভিতরে দেখতে পেলাম মানিকদার বেড। বিভিন্ন যন্ত্র দিয়ে ঘেরা। মঙ্কুদি ভিতরে গেলেন। অল্প একটু পরেই ডাকলেন। কান্নাভরা মন নিয়ে মানিকদার শয্যার পাশে এসে দাঁড়ালাম। মঙ্কুদি বললেন, ‘দেখ বাদল এসেছে।’ আশ্চর্য! মানিকদা আমাকে চিনতে পারলেন। অন্য সময়ে ঘরে ঢুকতেই যেমন হেসে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘ভালো আছ তো?’

 

কবি কাজী নজরুল ইসলামের দেখা ও ছবি তোলার অভিজ্ঞতা জানতে চাই?

কথাসাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সঙ্গে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামকে দেখতে গিয়েছিলাম। কলকাতার পাইকপাড়ায় ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে বড় ছেলের সঙ্গে থাকতেন। কবির স্ত্রী প্রমীলা দেবী তখন বেঁচে। ঘরের মধ্যে ঢুকতেই মনটা কান্নায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে, কবির যৌবনের বাঁশের বাঁশি হাতের ছবিটা। বিছানার ওপর জানালার এক পাশে কবি বসে আছেন। অদূরে আরেকটি বিছানায় অর্ধশায়িত অবস্থায় প্রমীলা দেবী। পাশে একটা ঝুড়িতে তরকারি, ছুরি আর গামলা। শুয়ে শুয়ে তিনি সংসারের কাজকর্ম করেন, যেটুকু পারেন। প্রমীলা দেবীর বিছানার পাশে মোড়াতে বসি। ছোটখাটো প্রশ্নের পর ছবি তুলি।

 

মাদার তেরেসার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?

মুক্তিযুদ্ধের সময় অবাঞ্ছিত শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণের প্রশ্নে মাদার তেরেসা ঢাকায় এসেছিলেন। পত্রিকায় মাদারের আগমন সংবাদ দেখে সকালে ক্যামেরা নিয়ে ছুটে যাই পুরান ঢাকায় খ্রিস্টানদের আশ্রয়কেন্দ্রে। গিয়ে দেখি তেজগাঁওয়ের ‘বটলিহোম’-এ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গাড়ি দাঁড়িয়ে। সালাম করে তার দোয়া নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার যাওয়ার আয়োজন দেখি। গাড়ি ছাড়ার আগের মুহূর্তে আমাকে গাড়িতে উঠতে বলেন। বিস্মিত হই, সেই সঙ্গে আনন্দিত। আশ্রমে পৌঁছে মাদার তেরেসার সত্যিকার রূপটা দেখতে পেলাম। অসহায় শিশুদের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেন অশ্রুসিক্ত চোখে। বিকলাঙ্গ বালককে আদর করেন। খাটে শোয়া শিশুদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটান। মাদার তেরেসাকে কোনো প্রশ্ন করি না। তার বেদনাহত মনের আবেগটা ক্যামেরায় ধরে রাখি। বিকালে রমনা গির্জায় যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন, মনে হলো তার প্রার্থনারত হাত দিয়ে যেন দেশবাসীর প্রতি আশীর্বাদ ঝরে পড়ছে। দ্বিতীয়বার তিনি যখন এসেছিলেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী। অনুষ্ঠানের শেষে তিনি ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মিলিত হন। প্রচুর ছবি তুলি। প্রটোকলের বাধানিষেধ অতিক্রম করে শেষবার তিনি আসেন চট্টগ্রামে প্রচণ্ড ঝড়ের পরে। মাদার তেরেসার মৃত্যুর পর তার মানবতার আদর্শকে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য সব ছবি দিয়ে একক প্রদর্শনী করি ‘অনন্যা’ পত্রিকার সৌজন্যে। প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ মহিলা সমিতির তৎকালীন চেয়ারম্যান, সাহিত্যিক ও সমাজসেবী ড. নীলিমা ইব্রাহিম।

 

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ছবি তোলার স্মৃতি জানতে চাই।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ মায়ের কাছে ওয়াদা করেছিলেন, গ্রামের মসজিদের উন্নয়ন, পানির কষ্ট দূর করে দেওয়ার জন্য পুকুর কেটে দেওয়া ও ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল করার। এই কাজ সমাপনের জন্য তিনি ঢাকায় এসেছিলেন দু-তিনবার। অল্প দিন থাকতেন। সরকারের অতিথি হয়ে উঠতেন বর্ধমান হাউসে। আজ যা বাংলা একাডেমি। ‘বেগম’ পত্রিকার জন্য তার সাক্ষাৎকার ও জীবনী লেখার জন্য সকালের দিকে যেতাম। ঘরের মধ্যে আলাউদ্দিন খাঁকে ঘিরে থাকতেন সংগীতশিল্পী, সাহিত্যিক ও জ্ঞানীগুণী মানুষ। আমি ফরাসের এক পাশে বসে তাদের কথাবার্তা থেকে কিছু কিছু লিখতাম। কেন জানি না প্রথম থেকেই তিনি আমাকে স্নেহের চোখে দেখতেন। সরোদ শেখার জন্য আমাকে মাইহারে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সৌভাগ্য গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি, তার প্রধান কারণ স্বাস্থ্য। সাধনা করার মতো শক্তি আমার ছিল না। তিনি পারিবারিক অনেক গল্প করতেন। বিশেষ করে তার স্ত্রী মদিনা বিবির সম্পর্কে।

একদিন আবেগবশত আলাউদ্দিন খাঁকে আমাদের বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে ফেলি। সবাই অবাক ও বিস্মিত। সাধারণত তিনি কারও বাড়ি যান না। সম্মেলন, রাজদরবার, অনুষ্ঠান ছিল তার গন্তব্য। সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি আমার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ আসা উপলক্ষে আমার কবি খালা (মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা) অনেক রকম খাবার তৈরি করেছিলেন। কিন্তু সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি আর বৃষ্টি। আমরা তখন জয়নাগ রোডে দোতলা বাসায় থাকতাম। পথঘাট সব হয়ে গেল নদীর মতো। যানবাহন কিছুই চলে না। আলাউদ্দিন খাঁকে আনতে পারলাম না। ফোন নেই। পরিস্থিতির কথা জানাতেও পারলাম না।

পরদিন সকালে গেলাম বর্ধমান হাউসে। সঙ্গে সুন্দর করে বক্সের মধ্যে কিছু খাবার। আলাউদ্দিন খাঁকে যিনি দেখাশোনা করতেন, আমাকে দেখামাত্র বললেন—‘চলে যান, আপনার ওপর ভীষণ রেগে আছেন। আপনাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে শুধু পায়চারি করেছেন।’ আলাউদ্দিন খাঁ রাগী মানুষ জানতাম। কিন্তু সে রাগ যে এত প্রচণ্ড ভাবতে পারিনি। আমাকে তিনি চলে যেতে বললেন, খাবারের বাক্স টেবিলের ওপর রাখতেই নিয়ে যেতে বললেন—নইলে ছুড়ে ফেলে দেবেন। পথ যে নদী হয়ে গিয়েছিল বলতে পারলাম না। চোখের পানি সঙ্গে করে বেরিয়ে আসার সময় মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি, আর কখনো কোনো বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তির কাছে যাব না ছবি তুলতে কিংবা সাক্ষাৎকার নিতে। বছরখানেক পরের কথা। সন্ধ্যার দিকে সবান্ধবে কলকাতার গড়েরমাঠে ঘুরছিলাম। চোখে পড়ল বিশাল প্যান্ডেল। বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন হচ্ছে। কাছে গিয়ে শুনলাম—ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সরোদ বাজাবেন রাতে। সঙ্গে সঙ্গে মনের ভিতর থেকে প্রতিজ্ঞা উড়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম, দেখা করে সেদিনের ঘটনার জন্য মাফ চেয়ে নেব। ভিতরে গিয়ে গ্রিন রুমে স্লিপ পাঠানোর অল্পক্ষণ পরেই বেরিয়ে এলেন। সালাম করতেই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘সেদিনের সেই ঘটনার পর ভাবতাম, আবার কবে আপনার সঙ্গে দেখা হবে।’ আমার চোখে পানি এসে যায় কঠোর মানুষটার কোমল অনুভূতির স্পর্শ পেয়ে। তিনি যে বিশ্ববিখ্যাত সরোদবাদক ও জাদুকরী সুর স্রষ্টা-এ কথা ভুলে যাই। পরে তিনি আমাকে তিনটি চিঠি লিখেছিলেন। কয়েক বছর পরে আলাউদ্দিন খাঁ যখন বেশ অসুস্থ তার সঙ্গে শেষ দেখা হয় কলকাতায় রাসবিহারি এভিনিউতে ওস্তাদ আলী আকবরের বাসায়। বিছানায় শুয়ে ছিলেন। আমাকে দেখে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন।

 

আলোকচিত্র চর্চার ক্ষেত্রে মেয়েদের কম উপস্থিতির কারণ কী?

প্রথমত, ছবি তোলার পারদর্শিতার জন্য দরকার প্রচুর অর্থ। ব্যয়বহুল বলে এই ক্ষেত্রে কম মেয়ে এগিয়ে আসেন। দ্বিতীয়ত, ছবি তোলার কাজে সময়-অসময় নেই, দরকার অসীম ধৈর্য। এর জন্য দরকার পারিবারিক সহযোগিতা। মেয়েদের সৃজনশীল কাজে এখনো পারিবারিক সহযোগিতা খুব বেশি দেখা যায় না। এই কাজে মেয়েদের খুব বেশি উৎসাহিত করা হয় না। তৃতীয়ত, এই কাজ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের সমাজ ও পরিবার মেয়েদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে খুব সহায়ক নয়। প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করার প্রচণ্ড মানসিক জোর প্রয়োজন হয়। এসব কারণে কমসংখ্যক মেয়ে আলোকচিত্র পেশায় এগিয়ে আসেন।

 

আপনি তো ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পরোক্ষভাবে কাজ করেছিলেন।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে আমি পরোক্ষভাবে কাজ করেছি। পাকিস্তান শাসনামলে ছাত্র গণআন্দোলনেও যুক্ত ছিলাম।  মুক্তিযুদ্ধের পর হাসপাতালে নার্স সংকট দেখা দিলে হলিফ্যামিলি হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবী নার্সিংয়ের কাজ করেছি।

 

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবেও আপনি ভূমিকা রেখেছেন।

আমি বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, বাংলা একাডেমি ও ইউএনএবির আজীবন সদস্য। এক সময় বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের সাধারণ সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করেছি। ‘ধুলোমুঠি’ (১৯৬৪) ও ‘আমার চোখে সত্যজিৎ রায়’ (২০০৪) নামে দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে।

 

আপনাকে ধন্যবাদ।

সর্বশেষ খবর