শুক্রবার, ২৬ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

অসাম্প্র্রদায়িক ও কালোত্তীর্ণ নজরুল

তুহিন ওয়াদুদ

অসাম্প্র্রদায়িক ও কালোত্তীর্ণ নজরুল

কাজী নজরুল ইসলামের মানস গঠনের কালে বঙ্গসমাজ ছিল অন্ধ চিন্তায় আচ্ছন্ন। সময় ছিল বিজ্ঞানমনস্কতার বিপরীত। প্রতিকূল ছিল রাজনৈতিক পরিমণ্ডল। সামাজিক-ধর্মীয় মূল্যবোধ ছিল আলোক বর্জিত। তখনো যুক্তিবাদের গোড়াপত্তনই ঠিকমতো হয়নি। তার ওপর ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ, ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডসহ অনেক ঘটনাই নজরুল ইসলাম মানস গঠনের কালে ঘটেছে।

কাজী নজরুল ইসলামকে বলা হয় রেনেসাঁসের কবি। রেনেসাঁসের অন্যতম দুটি অনুষঙ্গ; প্রচলিত রীতির বিরোধিতা করা এবং ঐতিহ্যে মিলন সাধন। একই সঙ্গে প্রচলিত রীতির অসারতা নির্দেশপূর্ব ঐতিহ্যগত ঐক্যসূত্র রচনা করার জন্য গভীরতর দৃষ্টি ছিল তার। ফলে তিনি লিখেছেন— ‘গাহি সাম্যের গান—/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,/ যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম ক্রিশ্চান।’ তিনি প্রচলিত প্রথার বিরোধিতা করে লিখেছেন—‘কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুথু ও—গায়ে?/ হয়তো তোমার স্তন্য দিয়েছে সীতা-সম সতী মায়ে।’ প্রচলিত সমাজে যৌনকর্মীদের সম্মানের যে অবনমন তার থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছেন। এমনকি যৌনকর্মীকে তিনি অবলীলায় ‘মা’ সম্বোধন করেছেন।

সততই তিনি ধর্মের বিভেদ দূরীকরণে সচেষ্ট ছিলেন। নজরুল দর্শনের অন্যতম দিকটি হচ্ছে ‘ধার্মিক’ পরিচয়ের চেয়ে ‘মানুষ’ পরিচয় বড়।  আল্লাহ এবং নারায়ণের মধ্যে কখনোই তলোয়ারের ‘ঠোকাঠুকি হবে না’ বলে তিনি মত দিয়েছেন। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন—তারা দুজনই এক। ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন— ‘এত মারামারির মধ্যে এইটুকু ভরসার কথা যে, আল্লা ওরফে নারায়ণ হিন্দুও নন, মুসলমানও নন। তার টিকিও নেই, দাড়িও নেই। একেবারে ‘ক্লিন’। টিকি-দাড়ির ওপর আমার এত আক্রোশ এই জন্য যে, এরা সর্বদা স্মরণ করিয়ে দেয় মানুষকে যে, তুই আলাদা আমি আলাদা। মানুষকে তার চিরন্তন রক্তের সম্পর্ক ভুলিয়ে দেয় এই বাইরের চিহ্নগুলো।’

কালের দাবি মিটিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম কালোত্তীর্ণ। কবি সম্পর্কে এ মূল্যায়ন একক মাত্রার নয়, বহুবিধ মাত্রার। কখনো তিনি স্বদেশবোধ বিবেচনায় শিখরে উত্তীর্ণ, কখনো তিনি নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে অগ্রভাগে, কখনো ধর্মের নামে অসার চিন্তা বিনির্মাণের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানে ছিল অনড়। স্বজাত্যবোধ-দেশাত্মবোধ-ধর্মবোধ-মানবতাবোধ-শ্রেণিবোধের এক মহাসম্মিলন ঘটেছে তার শিল্পবোধে। সত্য উচ্চারণে তিনি যে দৃঢ় সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যে তা বিরল। তার দর্শনের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে মুসলমানদের, হিন্দুদের, ব্রিটিশদের। নজরুল ইসলামের উদার মানবতা ধারণ করার মতো সমাজ তখনো সৃষ্টি হয়নি। হাজার বছরের অজ্ঞতা আর সংকীর্ণতার ঘেরাটোপে সমাজ ছিল বন্দী। ফলে শাস্ত্রবাদীরা সবাই তার দর্শনের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। নজরুলকে কোন মানদণ্ডে সামাজিকেরা মূল্যায়ন করেন তা ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় কবি নিজেই উপস্থাপন করেছেন। ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে উচ্চকিত কাজী নজরুল ইসলামকে ব্রিটিশরা যখন কারাবাস দিয়েছে, তখনো অটল ছিলেন তিনি। ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে যখন কথা বলার মতো মানুষ ছিল না, সে রকম সময়ে কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশদের শোষণ-নীতির বিরুদ্ধে শুধু লেখনী ধরেননি, কারাবাসী হয়েও নিজের ন্যায় উচ্চারণের পক্ষ ত্যাগ করেননি।

কথাশিল্প, মননশীল সৃষ্টি, কবিতা শিল্প, সংগীত, নাট্যশিল্প সর্বত্র কাজী নজরুল ইসলাম বিচরণ করেছেন। তার শিল্পের ভুবন ব্যবচ্ছেদ করলে অখণ্ড এক নজরুল আমাদের সামনে উপস্থিত হন। শিল্পের নির্যাস থেকে তার দর্শন আমরা সেচে নিতে পারি। ব্যক্তি নজরুলের চেয়েও অনেক শক্তিশালী হয়ে ওঠেন শিল্পী নজরুল। 

কবি চিন্তায় এবং কর্মে সমকালীন এবং পূর্বাপরদের চেয়ে ভিন্ন। তার এই ভিন্নতা দর্শনে এবং কর্মে। সমাজের যে বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তাশীল সমাজ দৃঢ় কথা বলতে ইতস্তত করেছে কবি সেসব ক্ষেত্রে ছিলেন নির্মেদ বলিষ্ঠ উচ্চারণ। সমাজ ছিল যুক্তিহীনতার আচ্ছাদনে পরিবৃত। সেখানে সত্য উচ্চারণে সমাজচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কবি সে সব কিছুর তোয়াক্কা করেননি। শিল্পের রূপ অক্ষুণ্ন রাখলে দাবির শক্তি কমে আসে। সে কারণে তিনি কবিতার আঙ্গিক বিচারের চেয়ে বিষয়ের প্রয়োজনীয়তার দিকে মনোনিবেশ করেছেন। ন্যায় উচ্চারণে দ্বিধা করেননি। ক্রমাগত শোষণ-পীড়ন দেখতে দেখতে কবির ক্ষোভের মাত্রা চরমে পৌঁছেছে। শিল্পকে তিনি সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। সচেতনভাবেই তিনি শিল্পের আঙ্গিক নিয়ে ভাবিত ছিলেন না। আমার কৈফিয়ৎ কবিতাটি বিশ্লেষণ করলে নজরুল সম্পর্কে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়।

অস্তি-নাস্তি নয় কবি নজরুলকে মনে হয় সংশয়বাদী ধারার মানুষ। তার গদ্যে-পদ্যে, সৃজনশীল-মননশীল সাহিত্যে অস্তিত্ববিষয়ক ধারণা লাভ করা যায়। কোনো ধর্মকেই হেয় জ্ঞান করেননি। প্রবন্ধ সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম হিন্দু-মুসলামানদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরস্পরের দূরত্ব সৃষ্টির সমালোচনা করেছেন। ধর্মতত্ত্বে দৃশ্যমান বিভিন্নতা থাকলেও স্রষ্টায় কোনো বিভিন্নতা নেই এটাই তার ধারণা। তিনি একই সঙ্গে হামদ-নাত-ইসলামী সংগীত লিখেছেন, আবার একই সঙ্গে তিনি শ্যামাসংগীতও লিখেছেন। তবে একটি গানে নজরুলের ধর্মবিষয়ক ধারণার মীমাংসা হয়ে যায়। তবে তার এ লেখার বাইরে যখন আমরা দেখি তার লেখা গান—‘খেলিছ এ বিশ্বলয়ে বিরাট শিশুর আনমনে।’ এ গানের মধ্যে কবি যে দর্শনের আলোকপাত করেছেন তাতে যেন তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন ধর্মবিষয়ক মানুষের চূড়ান্ত সমাধান স্রষ্টার কাছে। ব্যক্তির ভালো-মন্দের চেষ্টা গৌণ। কবি নজরুল ইসলাম মানুষকে দেখেছেন সামগ্রিকতার নিরিখে, ধর্মকে দেখেছেন স্থান-কাল নিরপেক্ষতার প্রেক্ষাপটে। ফলে যারা সমকালীন ভাবনার আলোকে এবং ক্ষুদ্র স্থানবিশেষে ধর্ম কিংবা মানুষকে দেখেন তাদের সঙ্গে নজরুলের বৈপরীত্য রচিত হয়েছে। ব্যক্তিক স্বার্থ-ব্যক্তিক ধর্ম নজরুল ইসলামের কাছে তাই সুদূর পরাহত।

কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে সর্বাধিক আলোচিত বিষয় তার বিদ্রোহী সত্তা।  বিদ্রোহী সত্তার চরমতম প্রকাশ তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। তার প্রকৃত রূপ যেন সেখানে ঝংকৃত হয়। চিন্তার সমতল ভূমি থেকে অনেক উচ্চে বেজে ওঠে তার ধ্বনি। আবেগে-আক্রোশে-ক্ষোভে-প্রতিবাদে জ্বলে ওঠা নজরুলের পঙিক্তবদ্ধ প্রকাশ, বিদ্রোহী কবিতা। কবি যদি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ছাড়া আর কোনো সাহিত্য রচনা নাও করতেন তবুও বাংলা সাহিত্য থেকে তাকে মুছে ফেলা সম্ভব হতো না। মূলত তার সৃজনশীল-মননশীল উভয় ধারায় যে আবেগের আতিশয্য তার অন্যতম কারণই হচ্ছে তার বিদ্রোহী মনোভঙ্গি। প্রবন্ধ-উপন্যাস-ছোটগল্প-সংগীত সর্বত্রই তার আবেগধর্মিতা বর্তমান। সাহিত্যে তার অসংযত আবেগ নিয়ে সমালোচনা আছে। কবি নজরুল ইসলামও জ্ঞাত ছিলেন তার শিল্পের অসংযত আবেগের ব্যবহার নিয়ে। আত্মপক্ষ সমর্থনে বিনয়-বিদ্রোহের সমান ব্যবহারে সমালোচকদের জবাব দিয়েছেন ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতার মাধ্যমে। তার লেখার প্রধানতম অভীষ্ট ছিল মানুষ-সমাজ। তিনি একটি বৃদ্ধিবৃত্তিক সমাজ চেয়েছিলেন। শোষণ-পীড়ন মুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা দেখতে চেয়েছিলেন। ধর্মান্ধতার শেকল ছিন্ন করা আবাসভূমি চেয়েছিলেন। কাজী নজরুলের শ্রেণিবৈষম্যপূর্ণ সমাজেরও বিরোধিতা করেছেন। নারী-পুরুষ, উচ্চ-নিম্ন, ধর্মে-ধর্মে সর্বত্রই তিনি সাম্য চেয়েছিলেন। সেই চাওয়ার মধ্যে আমরা যে তাকে পাই তিনি আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার কাঙ্ক্ষিত সমাজ আজও প্রতিষ্ঠা পায়নি। একদিন হয়তো নজরুল কাঙ্ক্ষিত সমাজ প্রতিষ্ঠা পাবে। যার নেপথ্য শক্তি হিসেবে তার লেখার ভূমিকা থাকবে অপরিসীম।

সর্বশেষ খবর