বৃহস্পতিবার, ১ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

চোখ ধাঁধানো রাজপ্রাসাদ

চোখ ধাঁধানো রাজপ্রাসাদ

পৃথিবীর বুকে দাপিয়ে বেড়ানো রাজাদের ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের অহঙ্কার একেকটি রাজপ্রাসাদ। এক সময় রাজপ্রাসাদ ছিল রাজাদের বাসস্থান, কখনোবা রাজকার্য পরিচালনার কেন্দ্র। প্রতিটি রাজপ্রাসাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কৌতূহল জাগানো নানা ইতিহাস। স্থাপত্যশৈলীতে অনন্য রাজপ্রাসাদগুলো শাসকদের অর্থ প্রাচুর্য ও দোর্দণ্ড প্রতাপের কথা মনে করিয়ে দেয়। আজও এসব প্রাসাদের সামনে দাঁড়ালে চমকে উঠতে হয়। নির্মাণশৈলী তো বটেই, এই রাজপ্রাসাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ইতিহাস মানুষকে বিস্মিত করে। পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা দৃষ্টিনন্দন রাজপ্রাসাদগুলো এখন পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। চমকপ্রদ তেমন কিছু রাজপ্রাসাদ নিয়ে লিখেছেন— সাইফ ইমন

 

 

বসনিক প্রাসাদ (স্লোভাকিয়া)

চমৎকার দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ বজনিক। যেন শিল্পীর আঁকা কোনো ছবি। স্লোভাকিয়ার বসনিক শহরে একটি পাহাড়ের উপর প্রাসাদটি নির্মাণ করা হয়। এক নজর দেখলেই মনে পড়বে প্রাসাদটি আপনার অপরিচিত নয়। কারণ টেলিভিশন স্ক্রিনে কিংবা থিয়েটারে এই রাজপ্রাসাদ আপনি অনেকবার দেখেছেন। অনেকগুলো বিখ্যাত সিনেমার শুটিং হয়েছে এই রাজপ্রাসাদে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত সিনেমা হলো ইতালিয়ান ফ্যান্টাসি মুভি ‘ফান্তাগিরো’। প্রথমদিকে এ দুর্গটি কাঠ দিয়ে তৈরি হয়েছিল। পাহাড়ের উপর বৃক্ষরাজি দিয়ে ঘেরা কাঠের প্রাসাদটিও ছিল অসাধারণ। পরবর্তীতে তেরো শতকে প্রাসাদটিকে আবার পাথর দিয়ে পুনর্নির্মাণ করা হয়। ১৯৭০ সালে এটাকে জাতীয় ও সাংস্কৃতিক স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করে স্লোভাকিয়া সরকার।

 

গ্র্যান্ড প্যালেস (থাইল্যান্ড)

থাইল্যান্ডের ব্যাংককে অবস্থিত আরও একটি পৃথিবীখ্যাত রাজপ্রাসাদ হলো গ্র্যান্ড প্যালেস। অনেকগুলো ভবন একসঙ্গে তৈরি হয়েছে এই রাজপ্রাসাদ। এই অনন্য গ্র্যান্ড প্যালেস ১৭৮২ সালে নির্মিত হয় এবং এটি ছিল সিয়াম (বর্তমানে থাইল্যান্ড) রাজ পরিবারের বাসস্থান। এখান থেকেই তৎকালীন রাজারা তাদের সব কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। এখানে রাজপরিবারগুলো অবস্থান করেছেন ১৯২৫ সাল পর্যন্ত। যদিও সদ্যপ্রয়াত রাজা ভুমিবল আদুলিয়াদজে চিত্রালদা প্রাসাদেই থাকতেন এবং এই প্রাসাদটি বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহার করতেন। গ্রান্ড প্যালেসটি অনেকগুলো বাগান, লন ও চত্বরের সমন্বয়ে অসাধারণ শৈল্পিক নৈপুণ্যে সমৃদ্ধ সৌন্দর্যের আশ্রয়। বিভিন্ন জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান এখানে আয়োজিত হয়। থাইল্যান্ডে আগত বিদেশি অতিথিদেরও তীর্থস্থান এই গ্র্যান্ড প্যালেস।

 

পিটারহফ (রাশিয়া)

রাশিয়ার সেইন্ট পিটার্সবার্গে এই অনিন্দ সুন্দর রাজপ্রাসাদটি অবস্থিত। এই পিটারহফ রাজপ্রাসাদ তৈরি করেন সম্রাট পিটার দ্য গ্রেট। সেইন্ট পিটার্সবার্গ নগরীও প্রতিষ্ঠা করেন এই সম্রাট। পিটারহফ রাজপ্রাসাদকে অনেকেই ফ্রান্সের ভার্সাই রাজপ্রাসাদের অনুকরণে তৈরি বলে মনে করেন। তাই একে রাশিয়ার ভার্সেই বলা হয়। সেইন্ট পিটার্সবার্গের সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় স্থাপনা হচ্ছে পিটারহফ। অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, সম্রাট পিটার দ্য গ্রেট ফ্রান্সের ভার্সাই রাজপ্রাসাদ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েই প্রাসাদটি তৈরি করেন। রাজপ্রাসাদটির নাম ‘পার্টারহফ’ এর অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘পিটারের দরবার’। এ থেকেই বোঝা যায়, রাজপ্রাসাদটি ছিল সম্রাট পিটারের সব রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু। মনোমুগ্ধকর এই রাজপ্রাসাদ বিশাল এলাকাজুড়ে তৈরি করা হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন লাগোয়া ভবনগুলোর সঙ্গে রয়েছে অনেকগুলো বাগান, ঝরনা ও পুকুর। এ ছাড়াও শৈল্পিক চিত্রকল্পে পুরোটা পরিবেষ্টিত এই অসাধারণ রাজপ্রাসাদটি। আরও রয়েছে নানা রকম নানা আকৃতির রাজপরিবারের লোকজনদের সোনালি ভাস্কর্য।

 

এইলিয়ান ডোনান (স্কটল্যান্ড)

এইলিয়ান ডোনানকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রাজপ্রাসাদগুলোর একটি। ছবির মতো সুন্দর দেশ স্কটল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিম উপকূলের রাজপ্রাসাদ এইলিয়ান ডোনান। একটি দ্বীপের মধ্যে এ রাজপ্রাসাদটি তৈরি করা হয়েছে। দ্বীপের চারপাশের স্বচ্ছ পানির দিকে তাকালে একেবারে তলদেশ পর্যন্ত দেখা যায়। স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আর চমকপ্রদ দর্শনীয় জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম এই এইলিয়ান ডোনান।

১৭১৯ থেকে থেকে দেড়শো বছরেরও বেশি সময় রাজপ্রাসাদটি পরিত্যক্ত ছিল। জেকোবাইট বিদ্রোহে রাজপ্রাসাদটি অনেকটা ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে। ১৯১১ সালে আবার পুরনো অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়। এই প্রসাদে ঘুরতে চাইলে আপনাকে ৬.৫০ ডলার খরচ করে টিকিট কাটতে হবে। এইলিয়েন রাজপ্রাসাদের আরও একটি বিশেষত্ব হলো এটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ নেয়। চারপাশে পাহাড় বেষ্টিত রাজপ্রাসাদটি সূর্যের আলোতে একরকম দেখা যায়, ঝড়ের সময় আরেক রূপ আবার বরফ গলা শীতের সময় অন্যরূপে ধরা দেয় পর্যটকদের চোখে।

 

লে মন্ত সেইন্ট মিচেল (ফ্রান্স)

লে মন্ত সেইন্ট মিচেল ফ্রান্স অবস্থিত পৃথিবীখ্যাত আরও একটি রাজপ্রাসাদ। ফ্রান্সের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় ক্যুসোনান নদীর আধা মাইল দূরে অবস্থিত লে মন্ত সেইন্ট মিচেল। বিশপ আব্রানচেস এর চোখে পড়ে এই রাজপ্রাসাদ। পরবর্তীতে তারই অনুরোধে এটি প্রথম দিকে গির্জা হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। সময়টা তখন ৭০৯ সালের ১৬ অক্টোবর। এরপর নানা সময় নানা কাজে ব্যবহূত হয় এই লে মন্ত সেইন্ট মিচেল প্রাসাদ। যেমন ফরাসি বিপ্লবের সময় এটি জেলখানা হিসেবে ব্যবহূত হয়েছিল। নানা কারণে প্রাসাদটির বাহ্যিক অবয়ব নষ্ট হতে থাকলে ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে উদ্যোগ নেওয়া হয়। শুরু করা হয় প্রাসাদের এর সংস্কার কাজ। যার ফলে আজকের এই বর্তমান রূপ। প্রাসাদের চারপাশে লেক খনন করায় এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় বহুগুণে। মেঘমুক্ত নীল আকাশ যখন থাকে তখন এই প্রাসাদসংলগ্ন লেকের নীলাভ পানির মধ্যে প্রাসাদটিকে মনে হয় নীলপদ্ম। আবহাওয়া ভেদে এই লে মন্ত সেইন্ট মিচেল এর রূপ পরিবর্তিত হতে থাকে স্কটল্যান্ডের এইলিয়ান ডোনানের মতোই।

 

প্যালেস অব ভার্সাই  (ফ্রান্স)

সম্রাট ত্রয়োদশ লুই ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে এই ভার্সাই প্রাসাদ নির্মাণ শুরু করেন। ত্রয়োদশ লুইয়ের মৃত্যুর পর প্রায় ১৮ বছর এই প্যালেস অব্যবহূত ছিল। এরপর চতুর্দশ লুই প্রাসাদটিকে রাজপ্রাসাদে সম্প্রসারণ করেন। দুই হাজার কক্ষবিশিষ্ট তার কয়েকগুণ দরজা-জানালাবিশিষ্ট এ প্রাসাদটির সংগ্রহে আছে ছয় হাজার ১২৩টি পেইন্টিং ও দুই হাজার ১০২টি ভাস্কর্য। ফ্রান্সের অসীম ক্ষমতাধর রাজতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে ভার্সেই রাজপ্রাসাদ। অথচ ৪৫০ বছর আগে ভার্সাই মূলত প্যারিসের অদূরের একটি সাধারণ গ্রাম ছাড়া আর কিছু ছিল না। প্রথমে সম্রাট ত্রয়োদশ লুই এর চারপাশে চল্লিশ হেক্টর জমি ক্রয় করেন। ইতিহাস-খ্যাত বিখ্যাত স্থপতি ‘লুই লা ভাউ’ প্রাসাদটির ডিজাইন এবং নির্মাণকাজ তদারকি করেন।

 

নুশোয়ানসেই  (জার্মানি)

চিত্রের প্রাসাদটি দেখে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। অনেকে মনে করতে পারেন এ প্রাসাদটি ডিজনিল্যান্ডের বিখ্যাত স্লিপিং বিউটি প্রাসাদ এটি। আদতে তা নয়। এটি নুশোয়ানসেই রাজপ্রাসাদ—পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় দৃষ্টিনন্দন রাজপ্রাসাদের মধ্যে অন্যতম একটি। ডিজনিল্যান্ডের বিখ্যাত স্লিপিং বিউটি রাজপ্রাসাদটি তৈরির ক্ষেত্রে এর অনুকরণ করা হয়েছে। এই রাজপ্রাসাদটি জার্মানির বেভারিয়া অঞ্চলের শোয়াংগুতে অবস্থিত। ১৮৮৬ সালে রাজা লুডউইগের মৃত্যুর পর রাজপ্রাসাদটি পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত এখানে ৬১ মিলিয়ন পর্যটকের পা পড়েছে। বর্তমানে প্রতি বছর এক দশমিক তিন মিলিয়নেরও বেশি পর্যটকের সমাগম ঘটে এখানে।

উল্লেখ্য, গ্রীষ্মের ছুটিতে প্রতিদিনই ছয় হাজার লোকেরও বেশি পর্যটকে মুখরিত হয় এটি।

 

শ্যাতো দে ভিনসেন্স (ফ্রান্স)

শ্যাতো দে ভিনসেন্স প্রাসাদটি ফ্রান্সে ১৩৪০ সাল থেকে ১৪১০ সাল পর্যন্ত রাজ পরিবারের দুর্গ হিসেবে ব্যবহূত হতো। ফ্রান্সের প্যারিসের ভিনসেন্স শহরে এ প্রাসাদটি অবস্থিত। ১১৫০ সালে ভিনসেন্স শহরের জঙ্গলে গোপনে প্রাসাদটি তৈরি করা হয় ফ্রান্সের তৎকালীন রাজা লুইস সপ্তমের আদেশে। পরে ১৩০০ শতাব্দীতে লুইস নবম প্রাসাদটিকে আরও বর্ধিত করেন। প্রাসাদটির চতুর্দিকে একটি পরিখা খনন করে প্রাসাদটি তখন ঘিরে ফেলা হয়। রাজা সপ্তম লুই শিকার করার জন্য বের হলে এই প্রাসাদেই অবস্থান করতেন। ১২৭৪ সালে ফিলিপ তৃতীয় এবং ১২৮৪ সালে ফিলিপ চতুর্থ এই প্রাসাদে বিয়ে করেন। এরপর ১৪০০ শতাব্দীর আগে তিন জন রাজা এই প্রাসাদে মৃত্যুবরণ করে। এদের মধ্যে ১৩১৬ সালে রাজা লুইস দশম, ১৩২২ সালে ফিলিপ পঞ্চম এবং ১৩২৮ সালে রাজা চার্লস মৃত্যুবরণ করেন। আসল স্থাপনাটির বিশাল অংশই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। চতুর্দশ শতকে নির্মিত অংশগুলোর পুনঃস্থাপনা করে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। প্রাসাদটিতে প্রবেশের জন্য তিনটি বড় বড় প্রবেশ দ্বার রয়েছে।

 

গুয়েইতা (ইতালি)

রোকা দেলা গুয়েইতা সান মারিনো ইতালির সান মারিনোয় অবস্থিত। পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচুতে তিনটি টাওয়ার মিলে এই রাজপ্রাসাদ। বাকি দুটি টাওয়ারের নাম ডে লা ফ্র্যাটা এবং মন্তালে। এখান থেকে ইতালির সান মারিনোর পুরোটা একবারে দেখা যায়। যদিও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবর্তন এসেছে এই রাজপ্রাসাদের। এই টাওয়ার তিনটি মিলে গঠিত স্থাপনাটি ১১ শতকে নির্মিত হয়েছিল। তবে গুয়েইতা টাওয়ারটিই সবার আগে তৈরি হয়েছিল। তাই সবাই এই প্রাসাদকে গুয়েইতা বলেই জানে। এখানে একটি টাওয়ার ওয়াচ টাওয়ার ও একটি বেল টাওয়ার হিসেবে ব্যবহূত হতো। আরও আছে সেন্ট বারবারা চ্যাপেল এবং একটি দুর্গ—যেটি বন্দীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য ব্যবহূত হয়ে আসছিল। ২০০৮ সালে এ জায়গাটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর