শনিবার, ১০ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

সমুদ্রের রণতরী

তানভীর আহমেদ

সমুদ্রের রণতরী

সমুদ্র সুরক্ষায় বিশ্বের সামরিক শক্তিধর দেশগুলো নিজেদের উন্নয়ন করে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, চীন, জাপান, ইতালি ও ভারত গেল কয়েক দশকে সমুদ্রে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধিতে সচেষ্ট রয়েছে। প্রতিটি দেশই তাদের নৌ-বাহিনীতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত রণতরীর নাম লিখিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুদ্ধজাহাজে নানা ধরনের আধুনিকায়ন করা হয়েছে। প্রকৌশলীরা রণতরীর কাতারে এনেছেন ডেস্ট্রয়ার (ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে পারে এমন যুদ্ধজাহাজ)। বড় রণতরীর সঙ্গে যোগ দিয়েছে ক্রুজার। এ ছাড়া হালের বিমানবাহী রণতরী বলতে গেলে— সমুদ্রে রীতিমতো বিশাল সামরিক বাহিনী মোতায়েনই বলা যায়। এসব রণতরীতে কী নেই? যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার, ক্রুজ মিসাইল, লেজার রাডার থেকে শুরু করে শতাধিক সেনা, বিমান ও নৌ-বাহিনী অফিসার ও কয়েক হাজার যোদ্ধা অবস্থান করতে পারে। এই অতিকায় রণতরীকে সমুদ্রের দানব বললেও ভুল হবে না। এসব নিয়ে আজকের রকমারি—

 

 

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যুক্তরাষ্ট্রের রণতরী

রণতরীতে আধুনিকায়ন চলছে বিশ্বব্যাপী। সামরিক শক্তিধর দেশগুলো সমুদ্রে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে যুদ্ধজাহাজে বিভিন্ন ধরনের জাহাজের সংযোজন ঘটাচ্ছে। রণতরী হিসেবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে বিভিন্ন দেশের ডেস্ট্রোয়ারগুলো। সমুদ্রে রণতরীতে আধুনিক অস্ত্রের সমাহার ঘটিয়ে উন্নয়ন করা হচ্ছে ডেস্ট্রয়ারে। এখন বিশ্বের অন্যতম ভয়ঙ্কর ও ব্যয়বহুল বিমানবাহী ডেস্ট্রয়ার নির্মাণে এগিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউএসএস জুমাল্ট নামের এই ডেস্ট্রয়ারটি নির্মাণ করতে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হতে যাচ্ছে ৪.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটি লম্বায় ৬১০ ফুট ও এর ওজন হবে ১৫ হাজার টন। ২০১৬ সালে এটি সমুদ্রে পরীক্ষামূলক টহল দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নৌ-বাহিনী জুমাল্টকে আটলান্টিক মহাসাগরের সামুদ্রিক ঈগল বলে অহঙ্কার করে। বর্তমানে এটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় ও আক্রমণাত্মক রণতরী। এতে যোগ করা হয়েছে অত্যাধুনিক মিসাইল সিস্টেম। কম্পিউটারের নির্দেশনা মেনে এটি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে সক্ষম। এ ছাড়া রয়েছে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক লেজার গান ও রেইল গান। এ সময়ে সেরা রণতরীর কথা আসলে জুমাল্টকেই এগিয়ে রাখতে হবে। অবশ্য এখানেই থেমে নেই যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিমানবাহী রণতরী নির্মাণের পথে পা ফেলে তারা। রণতরীর নাম রাখা হয়েছে ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড। এর নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। এক লাখ টন ওজন ও এক হাজার ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যের রণতরীটি মার্কিন নৌ-বাহিনীর গর্ব হয়ে উঠবে। বলা হচ্ছে, রণতরীতে এক কোটি ফুট দৈর্ঘ্যের ইলেকট্রিক তার, ৪০ লাখ ফুট ফাইবার অপটিক তার রয়েছে। নেভি ক্রু, স্টাফসহ চার হাজার ৫৩৯ জন বহন করবে ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ড। ৭৫টির বেশি বিমান (এয়ারক্রাফট) উড্ডয়ন ও অবতরণ করবে রণতরীটি থেকে। ২০১৮ সালের শেষের দিকে এটির দেখা মিলতে পারে। ২০২০ সালে এটি কমিশন পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

 

সমুদ্রে রাশিয়ার ‘সিংহ’

রণতরীটির নাম এডমিরাল কুজেন্তোভ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই রাশিয়া সমুদ্রে নিজেদের দুর্ভেদ্য করে গড়ে তুলতে শুরু করে। বিশ্লেষকরা ধারণা করেন, পারমাণবিক মিসাইল ছুড়তে সক্ষম এমন রণতরী তো বটেই, সাবমেরিন নিয়ে সমুদ্রযুদ্ধে রাশিয়া সেরা। অতি সম্প্রতি আইএসকে হুমকিস্বরূপ সিরিয়ার মুখে রাশিয়া ভাসায় এডমিরাল কুজেন্তোভকে। এই দানব রণতরীতে সর্বাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের ভাণ্ডার রয়েছে। ৩০৫ মিটার দৈর্ঘ্যের এই রণতরী বিশ্বের দ্বিতীয় বিমানবাহী রণতরী। ৪২টি যুদ্ধবিমান ও ১৮টি হেলিকপ্টার নিয়ে এটি সমুদ্রে ছুটতে পারে ঘণ্টায় ৫৪ কিলোমিটার গতিতে। এর মোট ওজন ৬১ হাজার ৩৯০ টন। এই রণতরীতে ১ হাজার ৬৯০ জন নেভি সদস্য কাজ করেন।

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দানব ইয়ামাতো

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সমুদ্রে নেমেছিল জাপানের রণতরী ইয়ামাতো। জাপানের এক প্রাচীন শহরের নামে নাম রাখা হয়েছিল এর। যুদ্ধে নামা বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই রণতরীকে বলা হতো সমুদ্রের দানব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সমুদ্র সাম্রাজ্যে একাই জাপানের গর্ব ছিল এটি।  ইয়ামাতোর সহযোগী রণতরী ছিল মুশাই। সমুদ্রে এই যুগলের সঙ্গে কেউই নাক গলাতে আসার সাহস রাখত না। ১৯৩৭ সালে এর নির্মাণের খবর পাওয়া যায়। তবে এটি বিশ্ববাসীর চোখে পড়ে ১৯৪০ সালে। সে বছর এটি সমুদ্রে ভাসলেও কমিশন লাভ করে ১৯৪১ সালে। ইয়ামাতো ছিল রীতিমতো অস্ত্রভাণ্ডার। ভয়ঙ্কর সব অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এই রণতরীর ওজন ছিল ৭২ হাজার ৮০০ টন। রণতরীর পিঠে বসানো ছিল ১৮.১ ইঞ্চির ৯টি (৪৫ ক্যালিবার টাইপ ৯৪) মেইন গান। রণতরীর বুকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বন্দুক বলা যায় এটিকে। কমিশন পাওয়ার পর জাপান এটিকে হুমকি হিসেবেই সমুদ্রে রাখে। যুক্তরাষ্ট্রও কখনো সমুদ্র সংঘাতে এর মুখোমুখি হয়নি। তাই বেশ কয়েক যুদ্ধে গোলা ছুড়তে হয়নি। কিন্তু ১৯৪৪ সালে এটি আমেরিকান রণতরীর দিকে বন্দুক তাক করেছিল। সে বছর জুনের আগ পর্যন্ত আমেরিকান জোট ইয়ামাতোর হুমকিতে জবাব দেয়নি। অবশ্য সে বছর অক্টোবরেই হিসাব পাল্টে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ফিলিপাইন নিয়ে টানাপড়েন সংঘাতে জাপান ইয়ামাতোকে মুখোমুখি দাঁড় করায়। ‘ব্যাটেল অব লেয়াট গালফ’ খ্যাত সেই সমুদ্র যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র-অস্ট্রেলিয়া যৌথভাবে ইয়ামাতোর মোকাবিলা করে। কার্যত অস্ত্রশস্ত্রে যুক্তরাষ্ট্র-অস্ট্রেলিয়া যৌথ বাহিনী বেশ বড় বহর নিয়ে হাজির হলে একা খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি ইয়ামাতো। ইয়ামাতোর সহযোগী রণতরীগুলোও তেমন পেরে না ওঠায় এটি ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জ্বালানি সংকটে পড়ে অনেকটাই অকেজো হয়ে পড়ে এটি। ফিরে আসার কথা থাকলে কুশু সমুদ্র অঞ্চলে এটি মার্কিন নেভি ট্রুপ, সাবমেরিনের দ্বারা আবার আক্রান্ত হয়। এবার যুদ্ধ করা ছাড়া আর পথ পায়নি ইয়ামাতো। সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এটি যুদ্ধ চালিয়ে যায়। ৭ এপ্রিল ১৯৪৫ সালে এটি ধ্বংস হয়ে যায়। ইয়ামাতোর দৈর্ঘ্য ছিল ৮৬২ ফুট ১০ ইঞ্চি। ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার গতিতে এটি ছুটতে পারত। রণতরীতে ২ হাজার ৫০০ সৈনিক কাজ করত। সাতটি যুদ্ধজাহাজ ও দুটি বিমান উড্ডয়ন রানওয়ে ছিল এতে।

 

চীনের প্রথম বিমানবাহী রণতরী

প্রায় দশ বছর ধরে সংস্কারের পর চীন সমুদ্রে ভাসিয়েছে তাদের প্রথম বিমানবাহী রণতরী। ইউক্রেন থেকে কেনা এই বিমানবাহী রণতরী বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ রণতরী। সমুদ্রে চীনের আধিপত্য বিস্তারে এই রণতরী রীতিমতো সামরিক বিশ্লেষকদের হিসাব-নিকাশ পাল্টে দেয়। ১৯৯৮ সালে চীনা একটি ব্যবসায়ী কোম্পানি ভাসমান ক্যাসিনো হিসেবে ব্যবহার করার কথা বলে বিমানবাহী রণতরীটি ২ কোটি ডলারে ইউক্রেনের কাছ থেকে কিনে নেয়। ২০০২ সালে চীনের সমুদ্রবন্দর দালিয়ানে পৌঁছায় ভারিয়াগ। চীনের ভাষ্যমতে, রণতরীটি কেবল গবেষণা ও প্রশিক্ষণকাজে ব্যবহার করা হবে। রণতরীটির দৈর্ঘ্য ৩০২ মিটার, ওজন প্রায় ৬৭ হাজার টন, ৫০টি বিমান ধারণাক্ষমতা সম্পন্ন, ঘণ্টায় গতি ৩০ নটিক্যাল মাইল।

 

ভারতের হাতে দুটি রণতরী

ভারতের হাতে রয়েছে বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ রণতরী ‘বিক্রাদিত্য’। ২০১৩ সালে এটি কমিশন লাভ করে। ভারতের হাতে এখন দুটি বিমানবাহী রণতরী রয়েছে। রণতরী ‘বিক্রাদিত্য’ কিনতে ২.৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করতে হয়েছিল ভারতকে। রাশিয়ার এই রণতরীতে উল্লেখযোগ্য সংস্কার করে ভারত। বিমান উড্ডয়নে সহায়ক ১৪ ডিগ্রি ৩০ মিটার দীর্ঘ স্কি-জাম্প সংযোজন করেছে ভারত। একসঙ্গে ৩৬টি যুদ্ধবিমান দাঁড়াতে পারে এই রণতরীতে। ৪৪ হাজার ৫০০ টন ওজনের এই রণতরীতে ১১০ জন নেভি অফিসার কর্মরত থাকেন। নৌসেনা রয়েছেন ১ হাজার ৫০০ জন। ২৮৪ মিটার দৈর্ঘের এই রণতরীটি প্রায় ২২তলা দালানের সমান উঁচু। ঘণ্টায় ৫৬ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে সক্ষম এই রণতরী। সমুদ্রে ভারতের প্রধান যুদ্ধাস্ত্র এটি।

 

দক্ষিণ কোরিয়ার হাতে ‘গ্রেট ক্লাস’!

ভয়ঙ্কর ডেস্ট্রয়ার সেজাং দ্যা গ্রেট ক্লাস রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে। যুদ্ধজাহাজের কথা হলে এটিকে এগিয়ে রাখতে হয়। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে এটি সমুদ্রে নেমে দক্ষিণ কোরিয়াকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর নেভি ফোর্স হিসেবে পরিচিত করিয়ে দেয়। প্রায় ১১ হাজার টনের এই ডেস্ট্রয়ারটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডেস্ট্রয়ার হিসেবে দাবি করছেন অনেকে। সমুদ্র থেকে ক্রুজ মিসাইল ছোড়ার জন্য এটি বিশেষভাবে নির্মিত। এতে ‘অন-বোর্ড রাডার’ রয়েছে বলেও দাবি করা হয়। ডেস্ট্রয়ারটি থেকে ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরত্বে থাকা লক্ষ্যে আঘাত হানার জন্য শক্তিশালী ও নির্ভুল ক্রুজ মিসাইল সিস্টেম রয়েছে। এতে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারও রয়েছে।

এ ধরনের রণতরী নির্মাণে খরচ করতে হচ্ছে ৯৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ৬টি তৈরির পরিকল্পনা হাতে নিয়ে ৩টি তৈরি করে সমুদ্রে নামিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া।

 

কার কত বিমানবাহী রণতরী

 

সমুদ্রে  সেরা ৫ দেশ

যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রয়েছে ২৮৮টি রণতরী, ৬২ ডেস্ট্রয়ার, ৭২টি সাবমেরিন। ৩ লাখ ২৩ হাজার সমুদ্র সৈনিক, রিজার্ভ ফোর্সে আরও ১ লাখ সৈন্য— তারাই সেরা। খুব সম্প্রতি সমুদ্রে রণতরীর উন্নয়নে চীন চমক দেখিয়েছে। সর্বাধুনিক রণতরী, ডেস্ট্রয়ার ও সাবমেরিন যোগ করে তারা বিশ্বের দ্বিতীয় নেভি ফোর্সে নাম লিখিয়েছে।

তালিকায় তিন নম্বরে রয়েছে রাশিয়া। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত রাশিয়া ৭৯টি রণতরী বিশ্বের যে কোনো সমুদ্রের ঝটিকা দখল নিতে যথেষ্ট। ১৩ টি ডেস্ট্রয়ার ৫২টি সাবমেরিন যোগ দিলে সমুদ্রে রাশিয়াকে টেক্কা দেওয়ার সাহস কেউই করবে না।

ইংল্যান্ডকে বলা হয়— সমুদ্রের ফায়ার পাওয়ার। সমুদ্রে ৩৩ হাজারের বেশি পার্সোনাল নিয়োজিত রাখে তারা। ৪৫টি গাইডেড মিসাইল নিয়ে তাদের রণতরীগুলো সমুদ্রের আতঙ্ক বলা যায়।

বিশ্বের পঞ্চম শক্তিধর নেভি  ফোর্স রয়েছে জাপানের। জাপানের রয়েছে মেরিন সেলফ ডিফেন্স ফোর্স। তাদের হাতে রয়েছে ১১৪টি রণতরী। প্রতিটি কোরে রয়েছে ডেস্ট্রয়ার। এ ছাড়া শিপ টু শিপ— সাবমেরিনের হিসেবে জাপান বিশ্বসেরা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর