শুক্রবার, ১৬ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা
কামাল লোহানী

সংস্কৃতির সেবক হিসেবে আজীবন কাজ করে যাব

সংস্কৃতির সেবক হিসেবে আজীবন কাজ করে যাব

বাংলাদেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা কামাল লোহানী (জন্ম : ২৬ জুন ১৯৩৪)। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা সম্পাদক, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক, উদীচীর সভাপতি, ছায়ানট ও ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক এবং বিভিন্ন পত্রিকায় গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন—শেখ মেহেদী হাসান

 

আপনার জন্ম ও বেড়ে ওঠা কোথায়?

আমার জন্ম সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার খান সনতলা গ্রামে, ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন। ছেলেবেলায় মা মারা যাওয়ায় বাবা আমাকে গ্রামে না রেখে পাঠিয়ে দেন নিঃসন্তান ফুফুর কাছে কলকাতায়। কলকাতার শিশু বিদ্যাপীঠে আমার পড়াশোনা শুরু। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের এক বিভীষিকাময় দুর্যোগ। তার মধ্যেই আমার বেড়ে ওঠা। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে পাবনায় চলে আসি। সেখানে ভর্তি হই পাবনা জিলা স্কুলে। ছোট চাচার (তাসাদ্দুক লোহানী) বাসায় থাকতাম। তিনি পাবনা জিলা স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৫২ সালের ১০ মার্চ ছিল ম্যাট্রিক পরীক্ষা। তার আগে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলি চলল। বেশ কয়েকজন ছাত্র মারা গেল। খবর গ্রামে পৌঁছার পর পাবনা টাউনহলে সমাবেশ ও মিছিল হলো। আমার চাচা কঠোর নজরদারিতে রাখতেন। কারও সঙ্গে পরিচয়, খুব যোগাযোগ তেমন ছিল না। ফজলে হাসান আবেদ, কুতুবুদ্দিন, আবদুস সামাদ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল আমার ক্লাসমেট ছিল। কিন্তু ওরা তখন কোথায় কী করছে জানতাম না। চাচার চোখ ফাঁকি দিয়ে টাউনহলে গেলাম। মিছিলে যোগ দিলাম। ওই শুরু হলো আমার রাজনৈতিক জীবন।

 

তাহলে কৈশোরেই আপনি রাজনীতির পাঠ নিয়েছেন।

পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হওয়ার পরই জীবন পাল্টে গেল। মিয়া আবদুল মতিন নামে আমার এক বন্ধু কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিল। আমরা কয়েকজন মিলে কলেজে পাইওনিয়ার্স ফ্রন্ট করলাম। কলেজ ইউনিয়নের নির্বাচনে বামপন্থি মতাদর্শে বিশ্বাসী পাইওনিয়ার্স ফ্রন্টের হয়ে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে প্যানেল দিলাম। থার্ড ইয়ারের বজলুর রহমানকে ভিপি, আলাউদ্দিন আহমেদকে জিএস ক্যান্ডিডেট করা হলো। সেক্রেটারিয়েটে দাঁড়ালাম রণেশ মৈত্র, আবদুল মতিন, এইচ টি ইমাম এবং আমি। সবাই একসঙ্গে পড়তাম। নির্বাচনে আমরা জয়ী হলাম। ১৯৫২ সালের শেষ দিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ঘোষিত হলো। ১৯৫৩ সালে কনফারেন্স হলো। সেখানে পাইওনিয়ার্স ফ্রন্টের সবাই জয়েন করল। কনফারেন্স ঘুরে এসে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন পাবনা শাখা গঠন করা হলো। প্রেসিডেন্ট কে হয়েছিল এ মুহূর্তে মনে নেই। তবে জেনারেল সেক্রেটারি লাল মিয়া। আমি ভাইস প্রেসিডেন্ট। এইচ টি ইমাম অফিস সেক্রেটারি। রাজনৈতিক সংগ্রাম ছাড়াও তখন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছিলাম। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, গ্রন্থনা এবং আবৃত্তি করতাম।

 

শুনেছি নুরুল আমিনকে প্রতিরোধ করেছিলেন?

১৯৫৩ সালে জানলাম নুরুল আমিন, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সরদার আবদুর রব নিশতার, পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম লীগের সেন্ট্রাল নেতা আবদুল কাইয়ুম খান পাবনায় আসবেন এবং মুসলিম লীগের প্রাদেশিক কাউন্সিল পাবনার জিন্নাহ পার্কে (এখন স্টেডিয়াম) হবে। তাদের বাধা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম।

 

আপনাদের নামে তো মামলা হয়েছিল।

এডওয়ার্ড কলেজের আরবি বিভাগের অধ্যাপক আবদুল হামিদসহ আমাদের ৬৯ জনের নামে মামলা দেওয়া হলো। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা টাউনহল ময়দানে প্রতিবাদ সভা ও একুশে উদযাপন করলাম। প্রচুর মানুষের ভিড়ে রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমরা সহপাঠী-বন্ধু আমানুল্লাহর মেসে ছিলাম। ভোরে বাড়ি ফেরার জন্য ইছামতি নদী পেরিয়ে তীরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থার লোক ধরে ফেলল।

 

আপনাকে কারাগারে পাঠিয়ে দিল?

প্রথমে থানায় নিয়ে গেল। সাত দিন জেলে থাকার পর জামিন পেলাম। ১৯৫৪ সালের মার্চে পূর্ববাংলায় অনুষ্ঠিত হয় প্রাদেশিক নির্বাচন। আমরা প্রগতিশীল ছাত্ররাই যুক্তফ্রন্টের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণ করি। ১৯৫৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাবনা টাউনহলে মহান শহীদ দিবস উপলক্ষে গণজমায়েত এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। ওই বছর ২৯ মে ৯২-(ক) ধারার মাধ্যমে পূর্ববাংলায় ‘গভর্নরি শাসন’ চালু করে। মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা পূর্ববাংলায় গভর্নর হয়ে আসে এবং ব্যাপক ধরপাকড়ের নির্দেশ দেন। আবারও গ্রেফতার হলাম। দেড় বছর জেল খেটে ১৯৫৫ সালের আগস্টে ছাড়া পেলাম। আমাকে ও রণেশ মৈত্রকে রাজশাহীর এক পার্কে সংবর্ধনা দেওয়া হলো। ফিরে এলাম পাবনায়। কিন্তু আমার অভিভাবকদের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে মতবিরোধ হলো। তাদের বক্তব্য লেখাপড়া শেষে রাজনীতি কর, আপত্তি নেই। কিন্তু তখন আমার বিপ্লবের স্বপ্ন। তাই ছোট চাচার কাছ থেকে মাত্র ১৫ টাকা চেয়ে নিয়ে অনিশ্চিতের পথে ঢাকা অভিমুখে পা বাড়ালাম।

 

ঢাকায় এসে কোথায় উঠলেন। কী করলেন?

ঢাকায় এসে রাতে এক হোটেলে থাকলাম, যেখানে কাত হয়ে শুলে দুই আনা, চিত হলে চার আনা। ঘুম হলো না, সমানে ছারপোকা কামড়াচ্ছে। পরদিন বাবুবাজার রংপট্টিতে পার্টি অফিসে গেলাম। কিন্তু একজন কমরেড, নেতৃস্থানীয় নেতা বললেন, পুরান পাগলে ভাত পায় না, নতুন পাগলের আমদানি। ঠিক করলাম, পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ রাখব না নিজের পায়ে দাঁড়াব। পরে নবাবগঞ্জে এক বন্ধুর বাড়িতে উঠলাম। সে ইত্তেফাকে বিজ্ঞাপনে কাজ করত। বন্ধুর মাধ্যমে বিজ্ঞাপন, সার্কুলেশনের কাজ শিখলাম। নবাবগঞ্জ থেকে হেঁটে কোর্ট হাউস স্ট্রিটে আসতাম। এর মধ্যে আজিমপুর কলোনিতে চাচাতো বোন হোসনা বানু খানমের বাসায় উঠলাম। তিনি ইডেন কলেজে চাকরি করতেন। তার দুই ভাই ফতেহ লোহানী, ফজলে লোহানী। ফতেহ লোহানী আমার চেয়ে ছয় বছরের বড়, ফজলে লোহানী তিন-চার। ফজলে লোহানী দৈনিক মিল্লাতে নিয়ে গেলেন। সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর জিজ্ঞেস করলেন, ‘অভিজ্ঞতা কী?’ বললাম, পশ্চিমবঙ্গের ‘সত্যযুগ’ পত্রিকায় খবর পাঠাতাম। জেলখানায় কৃষক-শ্রমিক-কমরেডদের সন্ধ্যার পর ইংরেজি পত্রিকা অনুবাদ করে শোনাতাম। বার্তা সম্পাদক নুরুল ইসলাম পাটোয়ারীর কাছে পাঠালেন। তারপর ৭৫ টাকা বেতনে পত্রিকায় চাকরি হলো।

 

সাংবাদিকতা শুরু হয়ে গেল।

১৯৫৫ সালের আগস্টে আমার সাংবাদিকতা জীবনের সূচনা। অন্যদিকে ন্যাপে যোগ দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে গেলাম। ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে দেশ বিপন্ন হলে আত্মগোপন করতে বাধ্য হলাম। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গর্জে উঠল। আমার নামে জারি হলো হুলিয়া। ১৩ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে দৈনিক ‘আজাদ’ থেকে ঘরে ফেরার পথে গ্রেফতার হলাম। ওই সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ২৬ নম্ব্বর সেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, আবুল মনসুর আহমেদ, হায়দার আকবর খান রনো, অধ্যাপক রফিকুল ইসলামসহ অনেকেই একসঙ্গে ছিলাম। সাড়ে তিন মাস পরে আমরা মুক্তি পাই। বন্ধু তোয়াব খান তখন সংবাদের নিউজ এডিটর। মে মাসে ছাড়া পাওয়ার পর তাকে গিয়ে বললাম চাকরি দেন, না হলে তো আবার গ্রেফতার হব। এরপর পূর্বদেশ, দৈনিক পাকিস্তান। তার আগেই ইউনিয়নে যুক্ত হয়েছি।

 

ওই সময় তো নৃত্যচর্চায় মনোযোগ দিয়েছিলেন।

১৯৫৬ সালে আমি জি এম মান্নানের নাচ দেখার পর একটি বড় সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম দৈনিক মিল্লাতের জন্য। সেই থেকে তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ। নাচের আমি কিছুই জানি না। ছেলেবেলায় বুলবুল চৌধুরীর নাচ দেখেছিলাম। জি এ মান্নান একদিন বললেন—ওই খানে দাঁড়াও। দাঁড়ালাম। বললেন, পায়জামা হাঁটু পর্যন্ত গোটাও। গোটালাম। বললেন, তোমাকে দিয়ে হবে। বললাম, কী করে নাচব? আমি তো নাচ জানি না। বললেন, নাচের ব্যাপারটা আমি দেখব। এভাবে নাচের শুরু। এরপর রবীন্দ্র-জন্ম শতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথের শ্যামা নৃত্যনাট্যের বজ্রসেনও হয়েছি। মন্দিরা নন্দী হয়েছিল শ্যামা। পশ্চিম পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে গিয়েছি নাচে অংশ নিতে।

 

ছায়ানটের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হলেন?

রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের পর ওয়াহিদ ভাইয়েরা (ওয়াহিদুল হক) পিকনিকে গিয়ে ঠিক করলেন একটি সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করবেন। অনেকেই সেই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হলেন। বেগম সুফিয়া কামাল হলেন সভাপতি, ফরিদা হাসান হলেন সাধারণ সম্পাদক। আমি ১৯৬২ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ছায়ানটের বিভিন্ন কাজে যুক্তছিলাম। ১৯৬২-৬৬ এই সময়ে বসন্ত উৎসব, শারদ উৎসব, বর্ষামঙ্গল করেছি। ছায়ানট সংগীত বিদ্যানিকেতনের ব্যাপারেও আমার ভূমিকা ছিল। এটি তো এখন বিশাল আকার ধারণ করেছে।

 

এরপরই তো ক্রান্তির জন্ম?

ততদিনে মার্কসবাদী রাজনীতিতে মস্কো-পিকিং ভাগ হয়ে গেছে। ওই সময় পুরানা পল্টন এলাকায় প্রগতিশীল একটি সংগঠনের নাম ছিল ক্রান্তি। ওই নামটি নিয়েই আমরা কাজ করতে শুরু করলাম। আমাদের সঙ্গে ছিলেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, লুত্ফর রহমান, আবদুল লতিফ, আলতাফ মাহমুদ, খান আতাউর রহমান। আমি ছিলাম সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৬৭ সালের ২১, ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করলাম। ক্রান্তির সদস্যরা পরিষ্কারভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্য সংগীতের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক লড়াই।

 

মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকের জীবন কেমন ছিল?

১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলাম। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর যতদিন আমি পূর্ববাংলায় ছিলাম, ততদিন সামরিক শাসকচক্রের নানা দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। তখন খ্যাতিমান সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘স্বরাজ’ পত্রিকায় কয়েকটি অগ্নিগর্ভ প্রতিবেদন লিখি। অবশেষে এপ্রিলের শেষে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিই। এ ছাড়া সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠনগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংঘবদ্ধ করে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পীগোষ্ঠী’ গঠন করি। কিন্তু অবস্থার অবনতিতে অবশেষে কুমিল্লার চান্দিনা হয়ে নৌকাযোগে ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা গিয়ে উপস্থিত হই। আগরতলা থেকে কলকাতা যাই। যাত্রাসঙ্গী প্রখ্যাত ফুটবলার প্রতাপ শঙ্কর হাজরাদের আত্মীয়র আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে গিয়ে উঠি। তখন আমার সাংবাদিক বন্ধু মোহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরী ‘জয়বাংলা’ পত্রিকায় নিয়ে যান। সেখানে কাজ করতে গিয়ে দেখা হয় আমিনুল হক বাদশার সঙ্গে। সে আমাকে নিয়ে যায় বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডে। সেখানে তখন আয়োজন চলছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। ৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার উদ্বোধন হলো। বালীগঞ্জের এই বাড়িটিতে মন্ত্রীরা (অর্থাৎ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীরা) বাস করতেন। তারা বেতারের জন্য বাড়িটি ছেড়ে দিলেন। আমরা কাজ শুরু করলাম।

 

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজের অভিজ্ঞতা বলবেন কী?

আশফাকুর রহমান খান, টি এইচ শিকদার, তাহের সুলতান কেউই প্রকৌশলী ছিলেন না, তবু কোনো ভারতীয়র সাহায্য না নিয়েই চালু হয়েছিল এই কেন্দ্রটি। চট্টগ্রামে যারা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তখনো তারা কেউ পৌঁছাননি। সৈয়দ হাসান ইমাম ‘সালেহ আহমদ’ নামে সংবাদ পাঠ শুরু করেন। আমি স্বাধীন বাংলা বেতারের বার্তা সম্পাদক। তখন সংবাদ পাঠ, কথিকা লেখা ও প্রচার, ঘোষণা, স্লোগান দেওয়া ইত্যাদিতে কণ্ঠ দিতাম। ২৫ মে বিদ্রোহী কবির জন্মদিনে বেতারের অধিবেশন শুরু হলো। যেহেতু নিউজের দায়িত্বে ছিলাম, ইংরেজি-বাংলা নিউজ লিখতে হতো। প্রথম বাংলা নিউজটি পাঠ করলেন সালেহ আহমেদ (সৈয়দ হাসান ইমাম)। ইংরেজিটি আবু নঈম (আমি) নামে আমি। নিউজ ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অংশ নিয়ে ‘বজ্রকণ্ঠ’ পাঠ হতো, স্লোগান, গান, কথিকা থাকত। কল্যাণ মিত্রের লেখা ধারাবাহিক নাটক ছিল ‘জল্লাদের দরবার’। এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তিনি বিক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলতেন, নানা অঞ্চলের ভাষা ব্যবহার করতেন। লিখতেনও খুব সুন্দর। এটি স্বাধীন বাংলা বেতারের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল। জুলাই-আগস্টে বেতারের শিল্পী-কলাকুশলী, যন্ত্রীরা সিদ্ধান্ত নিল পদমর্যাদা, বেতনের হারের দাবি করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেবে। এ নিয়ে আমাদের সঙ্গে তাদের বিরোধ হলো। রাজনীতি-সচেতন আমরা দু-একজন জানতাম, মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া মানে কাজ করব, থাকব, খাব; এখানে বেতনের ব্যাপার নেই, অফিসিয়াল মর্যাদার কিছু নেই। আমরা সবাই এক। এজন্য তিন দিন কর্মবিরতিও পালন হলো। যেহেতু সমর্থন করলাম না, ফলে তিন দিন পরে বেতার চালু হলো। এই তিন দিন কিন্তু সংবাদ, কোরআন তেলাওয়াত, বজ্রকণ্ঠ, গান সব প্রচার হয়েছে। পরে অবশ্য বেতন কাঠামো ঠিক হয়েছিল। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা ক্লান্তিবোধ করলে মাঝেমধ্যে কলকাতা আসতেন। তাদের কাছ থেকে খবর সংগ্রহ করতাম।

 

স্বাধীনতার ঘোষণার খবরটি সম্ভবত আপনি পাঠ করেছিলেন।

অরোরা-নিয়াজির মধ্যে আলোচনা হতে হতে ১৬ তারিখ বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান আর্মি সারেন্ডার করল। আমরা হইহই করে উঠলাম। নিউজটি কীভাবে যাবে আলোচনায় বসলাম। ৪টা ৩০ মিনিটে কোনো অধিবেশন নেই, স্পেশাল অধিবেশন তৈরি করে স্পেশাল নিউজ বুলেটিন প্রচারিত হলো। নিউজ এডিটর হিসেবে বুলেটিনটি তৈরি করলাম। রুটিন অনুসারে সংবাদ পাঠক বাবুল আক্তারের পড়ার কথা ছিল। কিন্তু সৈয়দ হাসান ইমাম এসে বললেন, ‘যেহেতু প্রথম বাংলা বুলেটিনটি পড়েছি, শেষটিও আমি পড়ব।’ বললাম, দেখেন, রুটিন অনুযায়ী বাবুলের পড়ার কথা। ওকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে না। রাগ করে তিনি চলে গেলেন। কিন্তু যখন বাবুলকে পড়তে দেওয়া হলো, সে আবেগে পড়তে পারছে না। সংবাদ পাঠকরা তো নরমাল ভয়েসে পড়ে। এটি সে ভয়েসে পড়লে হবে না। মনে ক্রোধ থাকতে হবে, সেটি প্রকাশ করতে হবে। সবাই বললেন, লোহানী ভাই, আপনি পড়েন, বাবুলও বলল। আগে থেকে ধারাবিবরণীর অভ্যাস ছিল। নিউজটি পড়ে, রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিলাম। বিশ্ববাসী আমারই কণ্ঠে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়বার্তা জানতে পারল।

 

স্বাধীনতার পর আপনাকে তো বেতারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার ঢাকা চলে আসবে। এজন্য আমি চলে এলাম ঢাকায়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঢাকা আগমনের ধারাবিবরণী দিয়েছিলাম আমি। ২৫ ডিসেম্বর আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা বেতারের। দায়িত্ব নেওয়ার পর বিধ্বস্ত বেতারকে পুনর্গঠনের জন্য নানা কাজ করেছি। ১৯৭৩ সালে ২০ জানুয়ারি পুনরায় সাংবাদিকতায় ফিরে যাই। দৈনিক জনপদে যোগ দেই। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হই।

 

পরে একাধিক পত্রিকায় দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৭৪ সালে জনপদ ছেড়ে বঙ্গবার্তা; বাংলার বাণীর বার্তা সম্পাদক; ১৯৭৭ সালে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত দৈনিক বার্তার নির্বাহী সম্পাদক এবং ১৯৭৮ সালে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি। ১৯৮১ সালে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধ হলে দৈনিক বার্তা ছেড়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের ডেপথনিউজ বাংলাদেশের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিই। কমাস পরেই পিআইবির সহযোগী সম্পাদক পদ লাভ করি। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থা গঠন করি। এক সময় নিয়মিত চাকরি থেকে অবসর নিয়ে নিয়মিত কলাম লিখি। আমার বাংলা নামে শিল্প-সংস্কৃতি গবেষণা ও অনুশীলন চক্র গঠন করি। সংস্কৃতির একজন সেবক হিসেবে আজীবন কাজ করে যাব।

 

আপনি দুই মেয়াদে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন। পিআইবিতে দায়িত্ব পালন করেছেন। কেমন ছিল সে অভিজ্ঞতা?

১৯৯১ সালে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি। ষোল মাসের মাথায় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় আমার পূর্ব কর্মস্থল পিআইবিতে ফিরে যাই। কিন্তু পিআইবির মহাপরিচালক আমাকে জোরপূর্বক অবসরে পাঠিয়ে দেয়। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে মহাজোটের বিজয়ের পর দুই বছরের জন্য আবার শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করি। শিল্পকলা একাডেমিকে গতিশীল রাখতে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছি।

 

অবসর সময় কীভাবে কাটে?

আমার অবসর বলে কিছু নেই। গান শোনা, কবিতা পড়া, লেখালেখিসহ বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত থাকি। বয়স হয়েছে শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না তারপরও কাজ করি।

সর্বশেষ খবর