শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২২ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রাণে বেঁচে ফেরা অভিযাত্রী

পৃথিবীতে দুঃসাহসী মানুষের অভাব নেই। নতুনকে জানার জন্য তারা পাড়ি দেন সমুদ্র, জয় করেন পাহাড়। এ ছাড়া নানা দুর্যোগেও তাদের লড়াই করতে হয়। অনেকেই শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকে জয় করে প্রাণে বেঁচে ফেরেন। প্রাণে বেঁচে ফেরা অভিযাত্রীরা মোকাবিলা করেন সবচেয়ে কঠিন বিপদ ও চ্যালেঞ্জ। মৃত্যুকে জয় করা এই অভিযাত্রীদের প্রাণে বেঁচে ফেরার গল্প আমাদের অনুপ্রাণিত করে। স্বপ্ন দেখায় সব বাধা টপকে নতুনভাবে জীবন সাজানোর। লিখেছেন— তানিয়া তুষ্টি

 

নাকশা বিবি

২০০৫ সালে পাকিস্তানে আঘাত হানে ভয়াবহ ভূমিকম্প। আর এই ভূমিকম্পের আঘাতে দুমড়ে-মুচড়ে ধসে পড়ে বাড়ি-ঘরসহ নানা স্থাপনা। আর এই ভূমিকম্পের কবল থেকে রেহাই পায়নি ভূ-স্বর্গখ্যাত কাশ্মীরও। কিন্তু কে জানত ভূমিকম্পের এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর আরও বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল সবার জন্য! ভূমিকম্পে অনেকের সন্ধান পাওয়া গেলেও ৪০ বছরের এক নারীর কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। ঘটনার দুই মাস পেরিয়ে গেলে ওই মহিলার বেঁচে থাকার কথা কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। কিন্তু সবার কল্পনাকে ভুল প্রমাণ করে বাস্তবেই জীবিত ফিরলেন নকশা বিবি। ঘটনার ৬০ দিন পর্যন্ত ধ্বংসস্তূপের নিচে একটি রান্নাঘরে আটকে ছিলেন তিনি। ঘরটিতে জায়গা এতই স্বল্প যে, নড়াচড়ার কোনো উপায়ই ছিল না। এরপরও ওই নারী বেঁচে ছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন প্রতিকূল পরিবেশ দীর্ঘদিন কাটানোর পর বেঁচে আসাদের তালিকায় সবার উপরে তাই তার নাম। যে রান্নাঘরটিতে নাকশা বিবি আটকে পড়েছিলেন সেখানে নড়াচড়ার মতো উপায় না থাকলেও বাইরে থেকে সামান্য অক্সিজেন সরবরাহ হচ্ছিল। সবচেয়ে বড় বিষয় ভূমিকম্পে নাকশা বিবি কোনো আঘাত পাননি। আর ভাগ্য আরও ভালো ছিল এ জন্য যে, আটকেপড়া ঘরটি ছিল একটি রান্নাঘর। বাইরে থেকে ঢোকা সামান্য অক্সিজেনের সহযোগিতায় কাটল কয়েক ঘণ্টা। ক্ষুধা লাগতেই ঘরে রাখা খাবারের খানিকটা খেলেন। এরপর খানিকটা পানি। অনেক চিৎকার-চেঁচামেচির পরও কেউ আসেনি তাকে উদ্ধার করতে। একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়েন। একেকটি দিনকে একেকটি মাস মনে হতো। একসময় পচে যাওয়া খাবার খেতে লাগলেন। পানিও আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসছিল। তবু মনের ভিতর আশা নিয়ে ছিলেন। অবশেষে আবর্জনার জঞ্জাল সরাতে গিয়ে নাকশা বিবিকে উদ্ধার করা হয়।

 

১৭ মাস সমুদ্রে রবার্টসন পরিবার

৩৮ দিনের জন্য গেলেও যাত্রাকাল দাঁড়ায় ১৭ মাসে। রবার্টসনের পরিবার এর মধ্যে সাগরে হারিয়ে ছিল অনেকদিন। রবার্ট ছিলেন একজন ব্রিটিশ ডেইরি চাষি। তিনি চেয়েছিলেন তার পরিবারকে একটি নৌভ্রমণে নিয়ে যেতে। ঘটনাটি ১০৭১ সালের ২৭ জানুয়ারির। রবার্টসন তার বউ ও চার সন্তানকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। এই যাত্রার আগে রবার্টসন কিছু প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা রেখেছিলেন কারণ তিনি একজন ব্রিটিশ নেভির নাবিক ছিলেন। ভ্রমণের সময় তারা বন্দর থেকে বন্দরে নোঙর ফেলে। কিন্তু ১৯৭২ সালের ১৫ জুন গালাপাগোজ দ্ব্বীপে এসে তার পরিবার একদল ঘাতক তিমির হাতে পড়ে। তিমির দলের আক্রমণে রবার্টসনের নৌকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মৃত্যু অবধারিত হলেও প্রাণে বেঁচে যায় সে যাত্রায়। শেষমেশ প্রত্যেকে লাইফবোটে ভাসতে থাকে। এরপর সঙ্গী হয় ছোট ডিঙ্গি নৌকা। এই সময় তাদের হাতে থাকে মাত্র ছয় দিনের খাবার। তারপর তারা বৃষ্টির পানি খেয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকে। সমুদ্র থেকে কচ্ছপ শিকার করেও খায়। তারপর ১৬ দিন তাদের লাইফজ্যাকেট আর ব্যবহারের উপযুক্ত ছিল না। তাই তাদের অনভিজ্ঞ পরিবারকে ডিঙ্গিতে করেই ভাসতে হয়। এটা ছিল মাত্র ১০ ফুটের একটি নৌকা। যেখানে তাদের পুরো পরিবার ধারণ করা ছিল খুবই অসম্ভব একটি ব্যাপার। তবুও রবার্টসন পরিবার ভাসতে থাকে। এরপর ২৩ জুলাই ১৯৭২ সালে তারা আবিষ্কার করে একটি জাপানি জেলেনৌকা। তখন তাদের মুক্তি মেলে।

 

২৭ দিন ধ্বংস্তূপে ইভানস

একনাগাড়ে ২৭ দিন ধ্বংসস্তূপের ভিতর আটকে পড়েও জীবিত উদ্ধার হন ইভানস মোনসিগনাক। তিনি একজন আফ্রিকান, ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি হাইতিতে ভয়াবহ ভূমিকম্প দেশটিকে এলোমেলো করে দেয়। রিখটার স্কেলে সাত মাত্রার সেই ভূমিকম্পে পোর্ট অব প্রিন্স শহরটি মাটির সঙ্গে মিশে যায়। ভূমিকম্পের ১১ দিনের মাথায় উদ্ধারকাজ বন্ধ করে দেয় দেশটির সরকার। এর আগেই ৫ দিনের মাথায় উদ্ধারকাজ বন্ধ করে দেয় জাতিসংঘ। কিন্তু কে জানত এমন মৃত্যুগহ্বরের মাঝখান থেকেও কেউ একজন মাথা তুলে দাঁড়াবেন। অবিশ্বাস্য সেই ঘটনাটিই ঘটেছে ইভানস মোনসিগনাকের বেলায়। হাইতি ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপের নিচে ২৭ দিন পর্যন্ত আটকে ছিলেন ইভানস। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা এ রকম অবরুদ্ধ অবস্থায় দীর্ঘ সময় ধরে জীবিত থাকার ক্ষেত্রে এটি বর্তমানে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। দুই সন্তানের বাবা ইভানসের এই জীবিত থাকা বিশ্বজুড়ে আলোচনার ঝড় বইয়ে দেয়।

 

পার্ক সিউইং হিউন

১৯৯৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে একদিন হঠাৎ করেই ধসে পড়ে একটি বহুতল শপিং কমপ্লেক্স। এই ঘটনায় প্রায় ৬০০ মানুষ নিহত হন। আহত হন আরও অনেকে। আর সেই সঙ্গে অসংখ্য মানুষ চাপা পড়েন ভবনের ধংসস্তূপের নিচে। এই ধ্বংসস্তূপে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে চাপা পড়েন পার্ক সিউইং হিউন নামের এক কোরিয়ান নারী। সাধারণত চার-পাঁচ দিন পর্যন্ত জীবিত প্রাণের সন্ধানে উদ্ধারকাজ চালানো হয়। কিন্তু ভাগ্যের জোরে, আর অদম্য প্রাণশক্তি ঠিকই পাল্টে বাঁচিয়ে রাখে কাউকে না কাউকে। ঠিক এমনটিই ঘটে পার্ক সিউইং হিউনের সঙ্গে। ভবনটি ধসে পড়ার ১৬ দিন পর ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয় তাকে। ভাগ্যবান এই নারী কেবল বৃষ্টির পানি পান করে এতগুলো দিন বেঁচে ছিলেন। একটা সময় বাঁচার আশা ছেড়ে দিলেও শেষ পর্যন্ত বাঁচার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আর এতেই তৈরি হলো ইতিহাস।

 

রেশমা বেগম

বাংলাদেশের সাভারে ধসেপড়া রানা প্লাজা থেকে প্রায় আড়াই হাজার মানুষকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন এখনো। এত সব দুশ্চিন্তা আর দুঃসংবাদকে পেছনে ফেলে সবাইকে অবাক করে দিয়ে রানা প্লাজা ধসের ১৭ দিনের মাথায় জীবিত উদ্ধার হন রেশমা। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা এরকম অবরুদ্ধ অবস্থায় দীর্ঘ সময় ধরে জীবিত থাকার ক্ষেত্রে রেশমার এই বেঁচে থাকা বর্তমানে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। তার চেয়ে বেশি সময় আটকে থাকার অভিজ্ঞতা কেবল দুজন মানুষেরই রয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকেপড়া রেশমার প্রাণ বাঁচিয়েছে পানি। ধংসস্তূপের নিচে ৪১৬ ঘণ্টা আটকে ছিলেন রেশমা। সঙ্গে থাকা যৎসামান্য শুকনা খাবার ফুরিয়ে যায় অনেক আগেই। উদ্ধারকর্মীরা ওপর থেকে নানা সময়ে বোতলজাত পানি বিভিন্ন সময় ফুটো দিয়ে ভিতরে পাঠাতেন। সেখান থেকে পানি খেয়েই বেঁচেছিলেন তিনি।

সর্বশেষ খবর