শনিবার, ১ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

সত্যি হলো যত ভবিষ্যদ্বাণী

পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেছে এরকম কিছু মানুষ যারা ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। প্রত্যেকেই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সফল পাশাপাশি নিজেদের চোখেই দেখতে পেয়েছিলেন ভবিষ্যৎ। সে কথা তারা লিখে রেখে গেছেন অথবা বিভিন্ন সময়ে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন। ভয়াবহ আগুনে শহর পুড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাহাজ টাইটানিক ডুবে যাওয়া এমনকি চন্দ্রজয় থেকে বর্তমানের ইন্টারনেটের মাধ্যমে পুরো পৃথিবীর সংযোগ সবকিছুই ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। এ নিয়ে লিখেছেন সাইফ ইমন

 

 

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ভবিষ্যদ্বাণী

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, সংগীতজ্ঞ, চিত্রকর ইত্যাদি নানা গুণের অধিকারী। তবে তিনি বেশি বিখ্যাত তার কালজয়ী চিত্রকর্ম মোনালিসার কারণে। তিনি একটি ডায়রি সবসময় ব্যবহার করতেন। ১৪৮০ সাল থেকে ১৫১৯ সাল অব্দি অর্থাৎ তার মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তা ব্যবহার করে গেছেন। তিনি ছিলেন তার সময় থেকে এগিয়ে থাকা একজন। তিনি নানা রকম ভবিষ্যতের প্রযুক্তির ডিজাইন তৈরি করে দিয়ে গেছেন। যা তার সময় ভাবা ছিল একেবারেই কল্পনাতীত একটা ব্যাপার। যেমন তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে মানুষ একসময় কোনো রকম নড়াচড়া ছাড়াই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে সক্ষম হবে। সে সময় এটা চিন্তা করাই অসম্ভব ছিল। কিন্তু তিনি এখনকার ব্যবহূত আধুনিক যানবাহনের মডেল এঁকেছিলেন। যদিও তার চিত্রকর্মে বিশদ কোনো বর্ণনা ছিল না যেটি দেখে কেউ নতুন প্রযুক্তি তৈরি করে ফেলতে পারে। কিন্তু তিনিই প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তির। যেমন মানুষের প্যারাস্যুটের মাধ্যমে উড়াল দেওয়ার ধারণা তিনিই দেন। এ বিষয়ে তিনি একটি মডেলও তৈরি করেন। এরও ৩০০ বছর পরে মানুষ প্রথম প্যারাস্যুট জাম্প দেয়। সামরিক বাহিনীর ব্যবহূত ট্যাংক আবিষ্কারের ৪০০ বছর আগেই তিনি ট্যাংকের মডেল এঁকেছিলেন।

 

দ্য গ্রেট ফায়ার অব লন্ডন

ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন এমন একজন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা হলেন মাইক্যাল দে নস্ট্রাদামুস। নানা রকম ঐতিহাসিক ঘটনা তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। যা তার মৃত্যুর পর শত বছর যাবৎ হুবহু মিলে যাচ্ছে। এমনই একটি ঘটনা হচ্ছে দ্য গ্রেট ফায়ার অব লন্ডন। ১৬৬৬ সালে লন্ডন শহরে এক ভয়াবহ আগনের সূত্রপাত হয়। এর ফলে শহরের ৯০ শতাংশ বাড়িঘর ও স্থাপনা পুরে যায়। মাইক্যাল দে নস্ট্রাদামুস তার বইতে লিখে ছিলেন লন্ডন শহর ৬৬ সালে ভয়াবহ আগুনে জ্বলবে। বাস্তবেও ঠিক তাই হয়েছে। রাজা ২য় হেনরির মৃত্যু এবং এডলফ হিটলার পরিণতির কথাও তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। রাজা ২য় হেনরির মৃত্যুর কথা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লিখেন- যুবক সিংহ বৃদ্ধকে জয় করবে, যুদ্ধ ক্ষেত্রে একক যুদ্ধতে, সে তার চোখের একটি সুবর্ণ খাঁচাতে জ্বলবে: দুই দাঙ্গা এক, তারপর একটি নিষ্ঠুর মৃত্যুবরণ।

১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের কথাও তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। আবার ১/১১ টুইন টাওয়ার অ্যাটাকের কথাও তিনি বর্ণনা করে গেছেন। এ প্রসঙ্গে তার লেখা পঞ্চ এবং চল্লিশ ডিগ্রি আকাশ পুড়বে, নতুন শহরের বড় আকারের অগ্নি অগ্রসর হয়: এক মুহূর্তে একটি বড় আকারের শিখা ঝাঁপিয়ে ছড়িয়ে পড়বে,  যখন নর্মান দ্বারা প্রমাণ রাখতে চাইবে।

২০০১ সালে ১ সেপ্টেম্বর এরপর থেকে স্থানটি অনেকেই নর্মান এই পদ্য দিয়ে স্মরণ করে।

 

ওয়াই-ফাই

নিকোলা টেসলা ছিলেন একজন সার্বিয়ান-আমেরিকান উদ্ভাবক। জনশ্রুতি আছে তিনি ২০ শতকের উদ্ভাবন করেছেন। তিনি সবচেয়ে বেশি সুপরিচিত সর্বাধুনিক ইলেক্ট্রিক্যাল সাপ্লাই সিস্টেমের জন্য। অন্য একটি চমকপ্রদ বিষয় হলো তিনি বর্তমানে ব্যবহূত ওয়াই-ফাইয়ের ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। ১৯০১ সালেই তিনি বলেছিলেন ভবিষ্যতের পৃথিবীর এক তারবিহীন যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা। সেই সময় নিউইয়র্ক টাইমসে একটি নিকোলা টিসলার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। যেখানে তিনি বর্তমানে যে ওয়াই-ফাই ছাড়া আমাদের চলে না সেই ওয়াই-ফাই সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দিয়ে গেছেন। তাও আবার ১০০ বছর আগে। সেখানে তিনি ভবিষ্যৎ পৃথিবীর প্রযুক্তি কেমন হবে সে সম্পর্কে ধারণা দেন। যাতে বলা হয় ভবিষ্যতের পৃথিবী হবে এমন এক পৃথিবী যেখানে মানুষ তারবিহীন সংযোগ স্থাপন করে বার্তা আদান-প্রদান করতে পারবে। সেই সঙ্গে তিনি কল্পনা করেছিলেন এমন এক ডিভাইস যার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষ একে অপরের সঙ্গে কানেকটেড থাকবে। নিঃসন্দেহে তিনি মোবাইল ফোনের কথা বলেছিলেন। যেটি বাস্তবে রূপ নেয় ১৯৭৩ সালে আর ওয়াই-ফাই আসে ১৯৯১ সালে।

 

ইন্টারনেট

যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সাহিত্য ব্যক্তিত্ব মার্ক টোয়েন। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, প্রকাশক, সমাজবাদী, উদ্যোক্তা ও লেকচারার। এই পথিকৃত ব্যক্তিত্ব ১৮৯৮ সালে একটি ছোট গল্প লিখেছিলেন। আসলে গল্পটি ছিল এই সায়েন্স ফিকশান। এর নাম ছিল ‘ফ্রম দ্য লন্ডন টাইমস হস ১৯০৪’। সেই গল্পে বলা হয় একটি ইলেক্ট্রনিকস ডিভাইসের কথা যার কাল্পনিক নাম ছিল ইলেক্ট্রস্কোপ। এটি কানেক্টেড ছিল একটি টেলিফোনিক ডিভাইসের সঙ্গে যার মাধ্যমে পৃথিবীর ঘটে যাওয়া প্রতিদিনের ঘটনা সবার সামনে অটোমেটিক্যালি চলে আসত। কী অসাধারণ ব্যাপার তাই না! ১০০ বছর আগের একজন ১০০ বছর পরের পৃথিবীর কথা ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। আরও বিস্ময়কর হচ্ছে মার্ক টোয়েন তার মৃত্যুদিন নির্দিষ্টভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। যা হুবহু মিলে যায়। ঘটনা হলো ১৯০৯ সালে প্রকাশিত তার অটোবায়োগ্রাফিতে তিনি দাবি করেন তার জন্ম হয়েছিল ১৮৩৫ সালে হ্যালির ধূমকেতুর আগমনের মধ্য দিয়ে যা আবারও আসবে পরের বছর এবং তিনি বিদায় নিবেন।

 

চন্দ্র জয়

জনপ্রিয় কালজয়ী কথাসাহিত্যিক জুল ভার্নকে চিনেন না এমন মানুষ খুব কমই রয়েছেন পৃথিবীতে। ১৯ শতকের বিখ্যাত এই কল্পকাহিনীকার ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইস’ বইটি লিখে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হয়েছিলেন।  জেনে অবাক হবেন তার লেখা অন্য একটি ছোট কল্পকাহিনী বইও পরবর্তীতে সত্যি হয়ে যায়। সায়েন্স ফিকশান গল্পটির নাম ‘ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন’। গল্পটিতে মানুষের প্রথম চন্দ্র অভিযানের বিষয়ে অবতারণা করা হয়। সে সময় গল্পটি পড়ে মানুষ বিশ্বাসই করতে পারেনি যে মানুষ সত্যি কখনো চাঁদে পৌঁছতে পারবে। এরও প্রায় এক শতাব্দী পরে ১৯৬৯ সালে জুল ভার্নের কল্পনায় দেখা ভবিষ্যৎ বাস্তবে রূপ নেয়। মানুষের পা প্রথমবারের মতো পৃথিবীর বাইরে কোথাও গিয়ে পৌঁছে। চাঁদের বুক নামে পৃথিবীর প্রথম মানুষ নীল আর্মস্ট্রং। জুল ভার্নের বর্ির্ণত গল্পের অভিযানের সঙ্গে শুধু এখানেই বাস্তবের অ্যাপোলোর অভিযানের মিল নয়। আরও অনেক মিল রয়েছে। যেমন অ্যাপোলোর অভিযাত্রীর সংখ্যার সঙ্গে হুবহু মিলে যায় জুলভার্নের গল্পের অভিযাত্রীর সংখ্যা। দুটি রকেটই ফ্লোরিডা থেকে পৃথিবী ত্যাগ করে। আরও অদ্ভুত আর বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে জুল ভার্নের কল্পনার রকেটে অভিযাত্রীরা মহাশূন্যে নিজেদের ওজনহীন অনুভূতির মধ্য দিয়ে যায়। এই বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যায় বাস্তবের অ্যাপোলোর অভিযাত্রীদের অভিজ্ঞতা। অথচ জুল ভার্নের সময়কালীন বিজ্ঞানীরা তখনো জানতেন না পৃথিবী ও তার বাইরের গ্র্যাভিটির পার্থক্য।

 

টাইটানিক সংকট

১৮৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে একটি বই প্রকাশ পায়। বইটির নাম ‘ফুটিলিটি অর দ্য রিক অব দ্য টাইটান’। এর লেখক ছিলেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মরগান রবার্টসন। বইটিতে বলা হয় ‘এস এস টাইটান’ নামের একটি বিশালাকার জাহাজের কথা। যেটি নর্থ আটলান্টিক সাগরে একটি আইসবার্গের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে ডুবে যায়। এর ঠিক ১৪ বছর পরেই অর্থাৎ ১৯১২ সালে হুবহু একই রকম এবং পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম জাহাজডুবির ঘটনাটি ঘটে। বলছি টাইটানিকের কথা। ১৫০৩ জন যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় জাহাজটি। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে বইটিতে বর্ণিত টাইটান জাহাজের সঙ্গে বাস্তবের টাইটানিক জাহাজের প্রায় হুবহু মিল পাওয়া যায়। লেখকের কল্পনার টাইটানের আকার এবং গতি আর বাস্তবের টাইটানিকের আকার এবং গতি একই। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে দুটি জাহাজকেই কখনো ডুববে না বলে অবিহিত করা হয়েছিল। এমনকি দুটি জাহাজেই যাত্রীর সংখ্যার চেয়ে অনেক কমসংখ্যক লাইফ জ্যাকেট ও লাইফ বোট ছিল। শুনলে আরও অবাক হবেন যে বইটিতে লেখক বর্ণনা করেছেন যে টাইটান ডুবে যায় বছরের এপ্রিল মাসে। এর ১২ বছর পরের বাস্তবের টাইটানিকও ডুবে যায় এপ্রিল মাসেই। দুটি জাহাজেই অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী মৃত্যুবরণ করে। আবার জাহাজ দুটির নামও প্রায় একই টাইটান এবং টাইটানিক। এমন বিস্ময়করভাবে সব কিছু মিলে যাওয়ায় পৃথিবীর মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। অনেক আগেই লেখক তার কল্পনাশক্তির ফলে দেখতে পেয়েছিলেন অনাকাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ।

সর্বশেষ খবর