বুধবার, ৫ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

সমুদ্রে ভাসে যে দেশ

সমুদ্রে ভাসে যে দেশ

পৃথিবীর অন্যতম নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত দেশ মালদ্বীপ। ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্র তার প্রকৃতি যেন সাজিয়েছে দুনিয়াজোড়া মানুষকে মুগ্ধ করতেই। ১১৯০টি প্রবাল দ্বীপের এই রাষ্ট্রের প্রধান আয়ের উৎসও তাই পর্যটন। প্রতি বছর বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে লাখ লাখ পর্যটক দেশটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসেন। এক ঋতুর এই দেশটির উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম মিলে  রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার ছোট ছোট দ্বীপ। সংস্কৃতি শব্দ ‘দ্বীপমালা’ শব্দ থেকেই মালদ্বীপ। আবার অনেকে দাবি করে মালে দিভেই রাজে এই কথা থেকে মালদ্বীপ শব্দটির উদ্ভব। যার অর্থ দ্বীপরাজ্য। অনেকে মালদ্বীপকে মহল দ্বীপ বলে। লিখেছেন— সাইফ ইমন

 

 

মালদ্বীপ দখলের সেই ঘটনা

শ্রীলঙ্কার কিছু তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী সৈন্য মালদ্বীপ দখলের পরিকল্পনা করেছিল। যার ফলে ১৯৮৮ সালে মালদ্বীপে একটি অভ্যুত্থান ঘটে। এতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে ৮০ জন সশস্ত্র সৈন্য। মাত্র অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে একটা দেশ দখল করে ফেলার নজির বিশ্বে আর একটাও নেই। তবে এর পেছনের মূল কারিগর ছিল স্থানীয় জনগণই। যার নেতৃত্বে ছিলেন আবদুল্লাহ লুথুফি। শ্রীলঙ্কার তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সাহায্যে আবদুল্লাহ লুথুফি এই অভিযান পরিচালনা করেন। পিপলস লিবারেশন অর্গানাইজেশন অব তামিল ইলেম নামের শ্রীলঙ্কার বিচ্ছিন্নতাবাদী সংঘটনটির যাত্রা শুরু হয় ১৯৮০ সালে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সংগঠনটির কূটনৈতিক কার্যক্রম ছিল ব্যাপক শক্তিশালী। মামুন আবদুল গাইয়ুম ছিলেন তৎকালীন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট। তার বিরুদ্ধে আবদুল্লাহ লুথুফি অভ্যুত্থান ঘটানোর উদ্দেশ্যে পিপলস লিবারেশন অর্গানাইজেশন অব তামিল ইলেমের সৈন্যদের ভাড়া করেন। বলা হয়ে থাকে এই কাজের জন্য দলটিকে ১ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছিল। তবে অনেকে দাবি করেন অর্থের পরিমাণ আরও আনেক বেশি। এমনকি এটা ১০ মিলিয়ন ডলারও হতে পারে। এর আগে ১৯৮০ এবং ১৯৮৩ সালেও দুটি অভ্যুত্থান হয়। তবে সেক্ষেত্রে অভ্যুত্থানকারীরা বিফল হলেও শ্রীলঙ্কার পিপলস লিবারেশন অর্গানাইজেশনের সৈন্যরা ঠিকই সফল হয়েছিল। পানিপথে সৈন্যদল স্পিডবোটে করে মালদ্বীপে প্রবেশ করে। তারা খুব সহজেই রাজধানীসহ বিভিন্ন সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, এয়ারপোর্ট, টেলিভিশন এবং রেডিও স্টেশনের দখল নিয়ে নেয়। কিন্তু তারা মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টকে অপহরণ করতে ব্যর্থ হয়। প্রেসিডেন্ট গাইয়ুম এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে থাকেন। এর মাঝে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ভারত সরকারের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গেই ১৬০০ সৈন্যের একটি দল আকাশপথে মালদ্বীপ পুনরুদ্ধারের জন্য পাঠান। ভারতীয় সৈন্যদল অপারেশন ক্যকটাস নামে একটি সফল অভিযান চালিয়ে অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেয়। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই ভারতীয় প্যারাট্রুপাররা দক্ষতার সঙ্গে দেশটিকে দখলমুক্ত করে প্রেসিডেন্ট গাইয়ুমকে উদ্ধার করে।

পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট গাইয়ুম ১১ নভেম্বর ২০০৮ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। দেশটিতে বর্তমানে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান। বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামেন। মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট সরকারপ্রধান হিসেবে ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের নিয়োগ দেন। প্রেসিডেন্ট নিজেই ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের প্রধান হিসেবে সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। প্রেসিডেন্ট পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তবে মুসলিম অধ্যুষিত দেশটিতে অমুসলিমদের কোনো ভোটাধিকার নেই। মালদ্বীপে ৫০ সদস্যের একটি মজলিসে শূরা রয়েছে। এই শূরা সদস্যরাও পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এই ৫০ সদস্যের মধ্যে আটজন প্রেসিডেন্ট মনোনীত করেন। এই একটি উপায়েই মহিলারা সংসদে প্রবেশের সুযোগ পান। দেশটিতে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে ২০০৫ সালে। সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুম দলটি প্রতিষ্ঠিত করেন। দলের নাম ‘দ্য মাল দ্বীপিয়ান পিপলস পার্টি’। একই বছর আরেকটি রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হয়। দলটির নাম ‘মাল দ্বীপিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’।

 

নিরাপদ পর্যটন

দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের গঠন প্রশ্নাতীতভাবেই পৃথিবীর বুকে বিস্ময়কর সুন্দরতম একটি স্থান। মালদ্বীপকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নিরাপদ পর্যটন কেন্দ্র। এখানকার রিসোর্ট, দ্বীপ সবই আকর্ষণ করবে যে কোনো পর্যটককে। বেশিরভাগ পর্যটক রাজধানী মালেতে যান। সেখান থেকে আশপাশের বিভিন্ন জায়গায় যান, বোটিং করেন, উল্লেখযোগ্য মসজিদ দেখেন, পাশের মার্কেট থেকে কেনাকাটা করে ফিরে আসেন। তবে এই দেশের আরও অনেক জায়গা রয়েছে যেগুলো পর্যটকদের জন্য যেমন পছন্দনীয় তেমন নিরাপদ। স্পেশাল রিসোর্ট, পুল, বোটিং স্পেস সবই পাবেন নিজের মতো করে। খুব সম্প্রতি নতুন লোকাল গেস্ট হাউসগুলো হানিমুন জুটির জন্য নিয়ে এসেছে ফ্লোটিং হাউস, অ্যাডভেঞ্চারসহ মনোমুগ্ধকর নানা আয়োজন। বালু বেষ্টিত এই দ্বীপরাষ্ট্রের মূল আকর্ষণ বাড়িয়েছে রিসোর্টগুলো। এগুলো দ্বীপের চেহারাই বদলে দিয়েছে। সুন্দর সাজানো-গোছানো পরিবেশ একই সঙ্গে প্রকৃতিপ্রেমীদের স্বর্গের অনুভূতি দিয়ে থাকে। দ্বীপ ঘিরে রাখা পরিষ্কার ঝকঝকে পানি ইশারা দিয়ে ডাকে বোটিংয়ের জন্য।

 

হাজার দ্বীপের মালদ্বীপ

মালদ্বীপ দেশটি অনেক দ্বীপের সমাহার। মালদ্বীপে মোট ১১৯০টি প্রবাল দ্বীপ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে মাত্র ২০০টি দ্বীপে মানুষের বসবাস রয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য মালদ্বীপের এই দ্বীপগুলোর প্রতিটিই সমুদ্রে জেগে রয়েছে। পর্যটক ইবনে বতুতা যখন মালদ্বীপ পৌঁছান তিনি একে বলেছেন— মহল দ্বীপ বা রাজপ্রাসাদের দ্বীপ।

সম্রাট অশোকের সময় থেকে শ্রীলঙ্কা থেকে মালদ্বীপে বৌদ্ধভিক্ষুদের যাতায়াত ও বসবাসের ইতিহাস রয়েছে। এরপর নানা চড়াই-উত্ড়াই পেড়িয়ে ১৯৬৫ সাল থেকে মালদ্বীপ ব্রিটিশ শাসনের ইতি টেনে স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। মালদ্বীপের আয়ের বড় অংশই সমুদ্র পরিবহন ও পর্যটন থেকে এসে থাকে।

 

জনসংখ্যা ও অর্থনীতি

মালদ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় তিন লাখ। শতকরা ১০০ ভাগ মুসলমান। ধিবেহি ভাষা বা মালদ্বীপীয় ভাষা মালদ্বীপের সরকারি ভাষা। এই দ্বীপগুলোর প্রায় সবাই ধিবেহি ভাষা ও বিভিন্ন উপভাষা ব্যবহার করে থাকে। প্রাচীনকাল থেকেই সমুদ্রই এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান আয়ের উৎস। সামুদ্রিক মাছ হচ্ছে দেশটির অর্থনীতির মূল ভিত্তি। তবে বর্তমানে দেশটি পর্যটন শিল্পেও অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে। মালদ্বীপের বড় শিল্প এখন পর্যটন। প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক আসে মালদ্বীপ দেশ উপভোগ করতে। দেশটির মোট আয়ের ২৮ শতাংশ এবং মোট বৈদেশিক আয়ের ৬০ শতাংশই আসে পর্যটন শিল্প থেকে। ১৯৮৯ সালে দেশটির সরকার প্রথমবারের মতো অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করে। শেষ এক বছর যাবৎ দেশটির প্রবৃদ্ধি ৭.৫ শতাংশের বেশি।

 

পানির নিচে ক্যাবিনেট মিটিং

দ্ব্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের সরকার ২০০৯ সালে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে পানির নিচে ক্যাবিনেট মিটিং করার মাধ্যমে। প্রশ্নাতীতভাবেই পৃথিবীজুড়ে এই মিটিং পত্রিকাগুলোর শিরোনামে পরিণত হয়। পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয় হওয়ায় এই অদ্ভুত মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়। ১৪ মন্ত্রিসভার মাত্র ৩ জন এই মিটিংয়ে অংশ নিতে পারেননি। যার মধ্যে দুইজন শারীরিকভাবে আনফিট ছিলেন আর অপরজন দেশের বাইরে ছিলেন। তাছাড়া মন্ত্রিসভার সবাই পানির নিচের অভূতপূর্ব সেই মিটিংয়ে অংশ নিয়েছিলেন। ইনস্ট্রাক্টরদের সহায়তায় মিটিংয়ে অংশগ্রহণকারী মন্ত্রীদের মিলিটারি এসকর্টরা সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

 

সমুদ্রে ভাসে বিমানবন্দর

সমুদ্রে ভাসে বিমানবন্দর! শুনতে অবাক হওয়ার মতো হলেও এটি সত্যি মালদ্বীপে। আস্ত একটা দ্বীপ নিয়েই গড়ে উঠেছে মালদ্বীপের একমাত্র বিমানবন্দর। এটি পৃথিবীর নয়নাভিরাম সুন্দর বিমানবন্দরগুলোর মধ্যেও অন্যতম। এই বিমানবন্দরের নাম ইব্রাহিম নাসির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এর চারপাশজুড়ে ভারত মহাসাগর। চলমান উড়োজাহাজ থেকে আপনি যখন এই বিমানবন্দরে ল্যান্ড করতে যাবেন তখন এর অপরূপ দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। মালদ্বীপের একমাত্র প্রধান প্রবেশদ্বারও এই বিমানবন্দর। অর্থাৎ আপনাকে এই বিমানবন্দর ব্যবহার করেই মালদ্বীপে প্রবেশ করতে হবে। সরকারি মালিকানাধীন আইল্যান্ড এভিয়েশন সার্ভিসেস চেন্নাই ও তিরুবনন্তপুরম, ভারত ও বাংলাদেশ এ আন্তর্জাতিক পরিবহন করে থাকে।

 

রাজার দ্বীপ ‘মালে’

মালদ্বীপের রাজধানী মালে। খুব ছোট এই দ্বীপটিকে বলা হয় কিংস আইল্যান্ড। বাংলা করলে যার মানে দাঁড়ায় রাজার দ্বীপ। ঘণ্টাখানেক সময় হাতে নিয়ে চাইলে পুরো মালে ঘুরে আসা সম্ভব। মালদ্বীপ পুরো দেশটিই দ্বীপের মালা। মালেও তাই। সমুদ্রে জেগে থাকা ছোট রাজধানী দ্বীপ পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। ৫.৮ বর্গকিলোমিটার দীর্ঘ এই দ্বীপে প্রায় ১ লাখ ৩৩ হাজার মানুষ বসবাস করে।  অবাক করা বিষয় হলো মালে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহর!

 

অ্যালকোহল নিষিদ্ধ

মুসলিম দেশ মালদ্বীপ। আর সে কারণেই এখানে অ্যালকোহল একেবারেই নিষিদ্ধ। স্থানীয়রা ইসলামিক রীতি অনুসারে এই নিয়ম মেনে চলে।

কিন্তু একেবারে ভড়কে যাওয়ার কিছু নেই। হোটেল ও রিসোর্টগুলোতে পর্যটকদের জন্য হরহামেশাই অ্যালকোহল মিলবে। তবে আপনি কখনোই চাইলেই পাবলিক প্লেসে মদপান করতে পারবেন না। এছাড়াও প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় অতিথিদের ফ্রি মদপানের ব্যবস্থা করে হোটেল কর্তৃপক্ষ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর