বৃহস্পতিবার, ৬ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

শ্রীলঙ্কার রক্তাক্ত ইতিহাস

সাইফ ইমন

শ্রীলঙ্কার রক্তাক্ত ইতিহাস

১৯৮৩ সালের ২৩ জুলাই শ্রীলঙ্কার তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীরা উত্তরাঞ্চলে ১৩ জন সৈন্যকে হত্যার মাধ্যমে শুরু করে দেশটির রক্তাক্ত ইতিহাস। দীর্ঘ ২৬ বছর চলে এই গৃহযুদ্ধ। যার অবসান ঘটে ২০০৯ সালে। এই দীর্ঘ সময়জুড়ে হওয়া গৃহযুদ্ধ শুধু শ্রীলঙ্কাতেই নয়, এর প্রভাব পড়েছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। একসময় সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন বিশ্বনেতারাও।  বিদ্রোহী তামিল টাইগার নেতা প্রভাকরণের মৃত্যু যবনিকা টানে এই গৃহযুদ্ধের—

 

তামিল টাইগার নেতা প্রভাকরণের মৃত্যু

শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর বিশেষ কমান্ডো সেনারা লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান প্রভাকরণকে হত্যা করে বলে দেশটির সেনাসূত্রগুলো এ দাবি করে। আরও বলা হয়, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানোর চেষ্টার সময় তাকে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর সময় ৫৪ বছর বয়সী এই দুর্ধর্ষ গেরিলা নেতা অঙ্গীকার করেছিলেন তিনি কখনই জীবিত অবস্থায় ধরা পড়বেন না। সেনাবাহিনীর একটি সূত্র উল্লেখ করে, আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স নিশ্চিত করে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে পালিয়ে যাওয়ার সময় প্রভাকরণকে হত্যা করা হয়। শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এর আগেই প্রথমবারের মতো প্রভাকরণের ছেলে এবং অন্য শীর্ষ নেতাদের নিহত হওয়ার খবর ও ছবি প্রকাশ করে। এর একদিন আগেই শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনী পুরো উপকূলীয় এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়।  এলটিটিইকে পরাজিত করার ঘোষণা করেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে।

 

লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম

১৯৭৩ মতান্তরে ১৯৭৪ সালে প্রভাকরণ ‘তামিল নিউ টাইগার্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম অবস্থায় এ সংগঠনটি তামিলদের প্রান্তিক নানা অবস্থার প্রতিবাদকারী একটি সংগঠনের মতো কাজ করলেও এক বছর পর এটি লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম বা এলটিটিই নামে প্রতিষ্ঠা পায়। এর পরই সংগঠনটির বিরুদ্ধে জাফনার মেয়রকে হত্যার অভিযোগ ওঠে। তারপরই টাইগাররা ১০ হাজারেরও বেশি সদস্যের দুর্ধর্ষ বিশাল বাহিনীতে পরিণত হয়। স্থানীয়ভাবে ব্যাপক জনপ্রিয় প্রভাকরণের সঙ্গে পুরুষদের পাশাপাশি বহু নারী ও শিশুও যোগ দেয়। বিশাল একটা অংশের নেতৃত্বের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের জন্য একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন প্রভাকরণ।  ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলমের নিজস্ব স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তামিল টাইগার নামেই পরিচিতি পায় সংগঠনটি।

 

দীর্ঘ ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধ

১৯৮৩ সালের জুলাই মাসকে শ্রীলঙ্কানরা বলে ‘ব্ল্যাক জুলাই’ বা ‘কালো জুলাই’। এ মাসেরই ২৩ তারিখ তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দেশটির উত্তরাঞ্চলে ১৩ জন সৈন্যকে হত্যা করে। এটাই ছিল তামিল টাইগারদের প্রথম আক্রমণ। আর এর মাধ্যমেই শ্রীলঙ্কার রক্তাক্ত ইতিহাসের শুরু। প্রতিশোধ হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি সম্প্রদায়ের উত্তেজিত জনতা পাল্টা হামলা চালায়। যার ফলে নিহত হয় তামিল সম্প্রদায়ের প্রায় তিন হাজারেরও বেশি মানুষ। এর পর এই গৃহযুদ্ধ চলে দীর্ঘ ২৬ বছর। নিহত হয়েছে প্রায় এক লাখ মানুষ।  দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় হাজার হাজার তামিল। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একটি স্বাধীন তামিল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম (এলটিটিই) ওই ঘটনাকে যুদ্ধ শুরু বলে অভিহিত করে।

 

ভারতের হস্তক্ষেপ

তামিল টাইগারদের অস্ত্র সরবরাহ করত বলে অনেকে দাবি করলেও ১৯৮৭ সালে শান্তি স্থাপনে শ্রীলঙ্কায় সেনা পাঠায় ভারত। কিন্তু অস্ত্র সমর্পণে অস্বীকৃতি জানায় টাইগাররা। শুরু হয় ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ। এ যুদ্ধে নিহত হয় এক হাজার ভারতীয় সেনা। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে ভারত সরকার সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। শ্রীলঙ্কা ২০১৩ সালে দেশটির ২৬ বছর স্থায়ী গৃহযুদ্ধের জন্য ভারতের সাবেক সরকারকে দায়ী করেছে। শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষা সচিব গোটাভায়া রাজাপাকসে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের কাছে এ বক্তব্য দেন।  শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের শেষ ১০০ দিনে সরকারি বাহিনী সেনা অভিযান চালানোর সময় যুদ্ধাপরাধ করেছে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে— জাতিসংঘে ভারতের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি হারদীপ সিং পুরি এমন বিবৃতি দিয়েছিলেন।  

 

তৃতীয় ইলম যুদ্ধ

১৯৯৫ সালে নৌবাহিনীর জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে বিদ্রোহীরা শুরু করে ‘তৃতীয় ইলম যুদ্ধ’। তবে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর কাছে জাফনার নিয়ন্ত্রণ হারায় তামিল টাইগাররা। তখন থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলজুড়ে চলতে থাকে গৃহযুদ্ধ। ১৯৯৬ সালে কলম্বোয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আত্মঘাতী বোমা হামলা থেকে শুরু করে অসংখ্য মেয়র, পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে এলটিটিই বাহিনী। আর এভাবেই দেশের উত্তরাঞ্চলে তামিল বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত একটি স্বতন্ত্র অঞ্চল পরিচালনা শুরু করেন প্রভাকরণ। তৎকালীন

কলম্বোয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আত্মঘাতী হামলায় নিহত হয় প্রায় ১০০ জন। টাইগারদের হামলায় আরও আহত হন প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা। অবশেষে ২০০২-এ নরওয়ের মধ্যস্থতায় সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে ঐতিহাসিক যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষর হয়।

২০০৪-২০০৫ সালে টাইগারদের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার কর্নেল করুনা আমান প্রায় ছয় হাজার যোদ্ধা নিয়ে এলটিটিই থেকে বেরিয়ে যান। সন্দেহভাজন টাইগারদের হামলায় নিহত হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লক্ষণ কাদির গামার। সে সময় কট্টর এলটিটিই বিরোধী মাহিন্দা রাজাপক্ষে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০০৬ সালের এপ্রিল থেকে আবারও শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ।

এতে বিশ্বনেতারা অক্টোবরে জেনেভায় নতুন করে আলোচনার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।  কিন্তু ব্যর্থ হয় সে উদ্যোগ।

তামিল টাইগারদের পরাজয়

২০০৭ সালে পূর্বাঞ্চলে তামিল টাইগারদের শক্ত ঘাঁটি দখল করে নেয় শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনী। এর পরের বছরের শুরুতেই যুদ্ধবিরতি অকার্যকর ঘোষণা করে সরকার এবং বড় ধরনের যুদ্ধাভিযান শুরু করে শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনী। চলমান সে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে টাইগারদের ঘোষিত রাজধানী কিলোনাচ্চি দখল করে নেয় তারা। সামরিক বাহিনীর আগ্রাসী আক্রমণে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পরে তামিল টাইগাররা। তাদের আত্মসমর্পণের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয় শ্রীলঙ্কা সরকার এপ্রিলের ২০ তারিখ। এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় এক লাখ ১৫ হাজার সাধারণ মানুষ যুদ্ধাঞ্চল থেকে পালিয়ে আসে। মে মাসের ১৬ তারিখ প্রথমবারের মতো সমগ্র উপকূলসীমার নিয়ন্ত্রণ নেয় সেনাবাহিনী। সে সময় জর্ডান সফররত প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে দাবি করেন, এলটিটিই পরাজিত হয়েছে। তখন বেসামরিক নাগরিকের বেশ ধরে প্রচুর তামিল টাইগার সৈন্য নৌকা করে পালানোর সময় নিহত হয়।  এ ছাড়া আরও অনেকে আত্মঘাতী হামলার মাধ্যমে প্রাণ বিসর্জন দেয়। সেই যুদ্ধ এলাকার সব বেসামরিক নাগরিককে মুক্ত করার ঘোষণা দেয় সেনাবাহিনী।

 

রাজীব গান্ধীর মৃত্যু

১৯৯১ সালে সন্দেহভাজন এলটিটিইর আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। দুই বছর পরে আরেকটি আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসা। দুটি হামলার জন্যই এলটিটিইকে দায়ী করা হয়। ১৯৯১ সালে চেন্নাইয়ের কাছে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে হত্যার জন্য প্রভাকরণকে দায়ী করা হয়। বলা হয়, আশির দশকের মাঝামাঝিতে শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের প্রতিশোধ নিতে রাজীব গান্ধীকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রভাকরণ। এর পরই ভারতের আদালত প্রভাকরণের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। সেই সঙ্গে সন্ত্রাসবাদ, খুন ও সংঘটিত নানা অপরাধের অভিযোগে ইন্টারপোলের ‘ওয়ান্টেড’ তালিকায় নাম ওঠে প্রভাকরণের। এতে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন প্রভাকরণ।  এর পরই ১৯৯৩ সালে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসাকে হত্যা করা হয়। 

 

নায়ক নাকি ভিলেন

প্রভাকরণকে ‘সূর্যদেবতা’ বলে ডাকত তার সমর্থকরা। অবশ্য তার বিরোধীরা তাকে অত্যন্ত নির্দয় বলেও অভিহিত করত। ইতিহাস বলছে, দেশের এবং দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক নেতাদের হত্যার পেছনের কারিগর তিনি। একদিকে বীর যোদ্ধা হিসেবে খ্যাতি, অন্যদিকে ভয়ঙ্কর ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে তার কুখ্যাতি। ইতিহাসের পাতায় এভাবেই লেখা হয়েছে প্রভাকরণের নাম। ভারতের আদালত থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল প্রভাকরণের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। তবে ইন্টারপোলের নথি থেকে জানা যায়, প্রভাকরণ এমন এক ব্যক্তি যিনি যে কোনো মুহূর্তে ছদ্মবেশ ধারণ করতে সক্ষম ছিলেন এবং আধুনিক সমরাস্ত্র ও বিস্ফোরক ব্যবহারে অত্যন্ত  পারদর্শী ছিলেন। ১৯৫৪ সালের ২৬ নভেম্বর জাফনা উপদ্বীপের উত্তরে অবস্থিত উপকূলীয় শহর ভেলভেত্তিয়াথুরাইতে জন্মগ্রহণ করেন প্রভাকরণ। মা-বাবার চার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে ছোট।  আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ও নেপোলিয়ানসহ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের দুই প্রবাদ পুরুষ সুভাষ চন্দ্র বসু এবং ভগত সিং দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন প্রভাকরণ।

জনসংখ্যা ও শিক্ষার হার

২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যা প্রায় ২১ কোটি ২০ লাখ তিন হাজার। উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে শ্রীলঙ্কা সর্বোচ্চ সাক্ষর জনসংখ্যার একটি দেশ। যার সাক্ষরতার হার শতকরা ৯২ শতাংশ। যার মধ্যে ৮৩% মানুষ মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত। শ্রীলঙ্কায় শিশুদের ৯ বছর মেয়াদি বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. সি. ডব্লিউ. ডব্লিউ কান্নানগারা শিক্ষা ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন। ১৯৪৫ সালে তার প্রণীত অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা শ্রীলঙ্কার সাক্ষরতায় বিরাট অবদান রাখে। সাবেক এই শিক্ষামন্ত্রী শ্রীলঙ্কার প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে একটি করে মাধ্যমিক মহাবিদ্যালয় স্থাপন করেন। এর আগে ১৯৪২ সালে বিশেষ শিক্ষা কমিটি একটি যোগ্য ও মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য প্রস্তাব করে। বিদ্যালয়গুলোতে গ্রেড ওয়ান থেকে থার্টিন পর্যন্ত পাঠদান ব্যবস্থা করা হয়। ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা যথাক্রমে ১১ এবং ১৩ গ্রেডে অনুষ্ঠিত হয়। শ্রীলঙ্কার শিক্ষা ব্যবস্থায় বেশির ভাগ বিদ্যালয়ই ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার অনুকরণে গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে পর্যাপ্ত সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের পাশাপাশি অনেক আন্তর্জাতিক মানের বিদ্যালয়ও গড়ে উঠেছে। শ্রীলঙ্কায় প্রায় ১৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তার মধ্যে কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়, পেরাদেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কেলানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, জয়াবর্ধনপুরা বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম।

 

সামরিক বাহিনী

স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে শ্রীলঙ্কা সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত। বিশ্ব পরিমণ্ডলে শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর তালিকায় সেরার তকমা না পেলেও গোটা বিশ্বে একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী হিসেবেই পরিচিত। শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে কোনো ধরনের সামরিক শাসন জারি না হলেও দেশটিতে সক্রিয় সেনার সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার। যার বদৌলতে দেশটি যে কোনো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম। পাশাপাশি দেশটির সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরও দুটি আধাসামরিক বাহিনী আছে। একটি  স্পেশাল টাস্কফোর্স এবং অন্যটি সিভিল ডিফেন্স ফোর্স। শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে প্রতিটি বাহিনীই দেশপ্রেম ও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকেই সামরিক বাহিনীর প্রধান কাজ ছিল অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাবলয় বজায় রাখা।  যার সিংহভাগই আছে এলটিটিইর সঙ্গে দীর্ঘ ২৬ বছরের যুদ্ধ। প্রভাকরণের মৃত্যুর মাধ্যমে এ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

শ্রীলঙ্কাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে খুব একটা দেখা না গেলেও ১৯৭৭ সাল থেকে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছে।  দেশটি জাতিসংঘের সঙ্গে যুক্তের পাশাপাশি কমনওয়েলথ, সার্ক, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন তহবিল, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক এবং কলম্বো পরিকল্পনার সদস্য দেশ হিসেবে বিশ্ব পরিমণ্ডলে বেশ প্রশংসিত হয়ে আসছে।

 

অর্থনীতি

প্রাচীনকাল থেকেই শ্রীলঙ্কা বাণিজ্যিক রাষ্ট্র হিসেবে বণিকদের কাছে পরিচিতি পেয়ে আসছে। মধ্যপ্রাচ্য, পারস্য, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার বহু বণিক এখানে বাণিজ্য করতে আসতেন। সেই থেকেই দেশটি অর্থনীতিতে বেশ সমুজ্জ্বল। শ্রীলঙ্কা বিশ্বের বুকে চিনামন, রাবার, সিলন চা রপ্তানির জন্য ব্যাপক বিখ্যাত। যদিও উপনিবেশরা চা, রাবার, জুম, নীলের চাষ শুরু করেছিলেন। ব্রিটিশদের শাসনামল থেকেই দেশটি আধুনিক বন্দরের সুবিধা পেয়ে আসছে। আর সেই আধুনিক সমুদ্রবন্দর স্থাপন করে দিয়েছিল ইংরেজরা। শ্রীলঙ্কার আবাদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দেশের দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক অসমতাকে বৃদ্ধি করছে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিকতা সরকারের অর্থনীতিকে মারাত্মক প্রভাবিত করেছে। সে সময় উপনিবেশিক চাষাবাদ ভেঙে পৃথক করা হয়েছে এবং শিল্প-কলকারখানাকে জাতীয়করণ করা হয়। এখানকার জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে নিম্ন উৎপাদন হার ও কম বৈদেশিক বিনিয়োগের চাহিদা ও প্রবৃদ্ধি দিন দিন বাড়তে থাকে। ১৯৭৭ সালের পর শ্রীলঙ্কার রাজ্য সরকার বেসরকারিকরণকে উৎসাহিত করে নানা পদক্ষেপ নেয়। চা, কফি, চিনি, রাবার এবং অন্যান্য কৃষি পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি সমহারে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই সরকারিভাবে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, বস্ত্রশিল্প, টেলিযোগাযোগ এবং শিল্পভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালে কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানি কমে দাঁড়ায় ২০% (যেখানে ১৯৭০ সালে ছিল ৯৩%) অপরদিকে বস্ত্র ও গার্মেন্ট ক্ষেত্রে বেড়ে দাঁড়ায় ৬৩%। ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে জিডিপি ছিল ৫.৫% যা ১৯৯৭-২০০০ সালে দাঁড়ায় ৫.৩%।  ২০০৩ সালে কলম্বো স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বের সর্বোচ্চ উৎপাদনশীল হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করে এবং দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়ের দেশের তকমা অর্জন করে শ্রীলঙ্কা।

 

যুদ্ধ-পরবর্তী অবস্থা

২০০৯ সালে দীর্ঘ ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। উত্তরের তামিলরা ১৮ মে দিনটিকে নীরব গুমোট আবহাওয়ায় মৃত্যু দিবস হিসেবেই পালন করে। আর কলম্বোতে দিনটিকে বিবেচনা করা হয় বিজয় দিবস হিসেবে। সামরিক বাহিনী-সংশ্লিষ্ট অনেক অনুষ্ঠানও হয়ে থাকে দিনটিতে। সেটা ছিল লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম বা এলটিটিইর শেষ দুর্গ। নন্দিকাদল খাড়ি আর বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে থাকা উত্তর-পূর্ব শ্রীলঙ্কার মুল্লিওয়াইক্কিল নামে ছোট্ট ভূখণ্ডটি ছিল লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম বা এলটিটিইর শেষ দুর্গ। দারিদ্র্যপীড়িত এ অঞ্চলের মানুষগুলো মাছ ধরে জীবিকানির্বাহ করে। অথচ এলাকাটি যুদ্ধ শেষের আট বছর পরও বিধ্বস্তই রয়ে গেছে। এখনো সেখানকার মানুষ বোমায় বিধ্বস্ত বাড়িগুলোতে বসবাস করছে। ভয়াবহ ওই গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত যেসব এলাকা রয়েছে এটি তার একটি।

সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের আমলে তামিলদের দুর্দশার কাহিনী প্রকাশ্যে আসতে পারত না। সে সময় তাদের অবস্থা ছিল ভয়াবহ শোচনীয়। তবে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনার আমলে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। তামিলদের শোচনীয় অবস্থার কথা গণমাধ্যমে উঠে আসছে।

তবে নর্দার্ন প্রভিন্সের মুখ্যমন্ত্রী সি ভি বিগনেশ্বরন এবার শোক দিবস পালনের একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। যা আদালতের নির্দেশে সম্ভব হয়নি। এই মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছিলেন, যুদ্ধাপরাধীরা শাস্তি পাক বা না পাক, আন্তর্জাতিক তদন্ত হলে সত্যিকারের কাহিনী বের হয়ে আসবে। কথিত ‘বিশ্বাসযোগ্য’ ভাষ্যের ভিত্তিতে জাতিসংঘ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৬-২০০৯ সালের গৃহযুদ্ধে" প্রায় ৪০ হাজার বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, শ্রীলঙ্কার উচিত ছিল যুদ্ধের পরপরই উভয় পক্ষের আস্থা সৃষ্টির লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিশেষ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের বিখ্যাত উক্তি ‘আর কোনো সংখ্যালঘু থাকবে না’ মন্তব্য করেছিলেন। এর রেশ ধরে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেত সহজেই। রাজাপক্ষে যদিও বিশাল বিশাল প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন।  কিন্তু এসব প্রকল্প সিংহলি ও তামিলদের মধ্যকার ব্যবধান কমাতে খুব বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।

সর্বশেষ খবর