শিরোনাম
বুধবার, ৯ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
কিংবদন্তি মাও সে তুং

চাষি পরিবার থেকে বিপ্লবের মহানায়ক

আবদুল কাদের

চাষি পরিবার থেকে বিপ্লবের মহানায়ক

তিনি মিলিটারি লিডার। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠাতা এবং এক বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতা। অনুন্নত ও দারিদ্র্যপীড়িত চীনকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। জীবদ্দশায় পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের যেমন আদর্শে পরিণত হন, তেমনি নানা মহলের তীব্র সমালোচনারও সম্মুখীন হন।

 

মাও সে তুং, এক বিপ্লবীর নাম। তিনি ছিলেন মিলিটারি লিডার। চীনের বিপ্লবী রাষ্ট্রনায়ক। চীনের শত কোটি মানুষের প্রাণ। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠাতা। ১৮৯৩ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল। চীনের ইতিহাসকে বদলে দেওয়া এই মহানায়ক আজও অমর হয়ে আছেন চীনদেশে। মৃত্যুর ৪০ বছর পার হলেও তার সাম্যবাদী সমাজতন্ত্র এখনো দিব্যমান। ছাত্রজীবন থেকেই মাও রাজরীতিতে জড়িত ছিলেন। ২৪ বছর বয়সে রাজধানী পিকিংয়ে মার্কস তত্ত্বের মাধ্যমে কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া মাও নিজ প্রচেষ্টায় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যানের শীর্ষ পদে পৌঁছান। পরবর্তীতে সফলভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের রাষ্ট্রনায়কও হন তিনি। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে চীন কিং রাজতন্ত্রের দুঃশাসনে বুঁদ ছিল। জনসাধারণ রাজতন্ত্রে অতিষ্ঠ হয়ে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। সেই আন্দোলনের অন্যতম নেতা সান ইয়াত সেনের সঙ্গে যোগ দেন মাও সে তুং। গণআন্দোলন সফল হয়। চীন মুক্তি পায় কিং রাজতন্ত্রের দুঃশাসন থেকে। এরপর গঠিত হয় কউমিঙটাঙ (জাতীয়তাবাদী) দল। ১৯১৮ সালে মাও বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী লাইব্রেরিয়ানের চাকরি নেন। সে সময় বামপন্থি এক বুদ্ধিজীবীর চিন্তাধারা এবং সভ্যতার বিস্ময়কর তত্ত্ব মাকর্সবাদে মনোনিবেশ করেন। তখনই বুঝতে পারেন মায়ের ‘বুদ্ধবাদ’ ও বাবার ‘কনফুসীয়বাদ’ কোনো কাজের নয়। তখন থেকে মাও বামপন্থি রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯১৯ সালে আধুনিক চীনের লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলন হয়। সেখানে মাও লেখনীর মাধ্যমে আন্দোলনে সবার নজর কাড়েন। ১৯২০ সালের দিকে মার্কসবাদী হিসেবে চীনা রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ করেন। একই বছর চীনের চাংশায় ফিরে আসেন মাও। হুনান প্রদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কার করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। এরপর ১৯২১ সালে সাংহাই চলে আসেন। তখন চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তৈরির গোপন বৈঠকে যোগ দেন। এরপর হুনান প্রদেশে ফিরে কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক শাখা খোলেন। এখানে শ্রমিকদের কীভাবে ধর্মঘট করতে হয়, তা শেখান। ১৯২৩ সালে কমিউনিস্টরা জাতীয়তাবাদী কউমিঙটাঙ দলের সঙ্গে জোট গঠন করে। এসময় মাও কউমিঙটাঙ দলের সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য হন। ১৯২৫ সালে জন্মস্থান শাওশানে কৃষক সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯২৭ সালের দিকে কৃষক আন্দোলন নিয়ে তার লেখনীতে কৃষকদের বিপ্লব ঘটান। ওই বছরই জাতীয়তাবাদী কউমিঙটাঙ দলের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। কউমিঙটাঙ দলের নেতা চিয়াং কাই সেক কট্টরপন্থি হওয়ায় প্রবল কমিউনিস্টবিরোধী দমননীতি অনুসরণ করেন। এবার মাও হুনান প্রদেশের কৃষকদের নিয়ে সৈন্য বাহিনী গঠন করেন। এই বাহিনী সশস্ত্র আন্দোলনে পরাজিত হয়। চীনের দক্ষিণের পার্বত্য এলাকা জিয়াংজি প্রদেশে চলে যান মাও। এরপর অসংখ্য তরুণ মাওয়ের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। মাও তাদের সশস্ত্র সংগঠিত করেন। আর নাম দেন রেড আর্মি। রেড আর্মি অভিনব গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষিত দল। ১৯৩৪ সালে চিয়াং কাই শেক চীনের জিয়াংজি প্রদেশ ঘিরে ফেলে। অপ্রতিরোধ্য গতিবেগে সে বেড়াজাল ছিন্ন করে রেড আর্মিকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন মাও। এরপর তিনি শুরু করেন এক দীর্ঘ পদযাত্রা। যা ইতিহাসে লংমার্চ হিসেবে পরিচিত। ১৯৩৭ সালে চীন-জাপান যুদ্ধ শুরু হলে পরস্পরবিরোধী জাতীয়তাবাদী নেতা চিয়াং কাই শেকের ন্যাশনাল পার্টি এবং মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি একত্রিত হয়ে আগ্রাসী জাপানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে ১৯৪৫ সালে জাপান পরাজিত হয়। তারপর শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। এ গৃহযুদ্ধে জয়ী কমিউনিস্ট পার্টি মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে চীনের বিশাল ভূখণ্ডে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৪৯ সালে বিজয়ী কমিউনিস্ট মুক্তিফৌজের অগ্রগামী অংশ ক্যান্টনে প্রবেশ করলে চিয়াং কাই শেক সদলবলে চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে পালিয়ে ফরমোজা দ্বীপে আশ্রয় নেন। স্বৈরশাসক কাই শেককে পরাস্ত করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন মাও। ১৯৪৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মাও স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। তিনি এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এ পদে বহাল থাকেন। মাও চীনে শিল্প ও কৃষিতে বিপ্লব সাধন এবং সমাজতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটান।

 

মিলিয়ন ডলারে চিঠি

মাও সে তুংয়ের একটি চিঠি লন্ডনে নিলামে ৯ লাখ ১৮ হাজার মার্কিন ডলার (ছয় লাখ পাঁচ হাজার পাউন্ড) নিলামে বিক্রি হয়। ১৯৩৭ সালে চিঠিটি লিখেছিলেন মাও। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও লেবার পার্টির নেতা ক্লেমেন্ট অ্যাটলিকে চিঠিটি লিখেছিলেন। চিঠির মাধ্যমে চীনে জাপানি বাহিনীর আগ্রাসন ঠেকাতে ব্রিটেনের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছিল। চিঠিতে রয়েছে মাওয়ের বিরল সাক্ষর। ধারণা ছিল, চিঠিটি এক থেকে দেড় লাখ পাউন্ডে বিক্রি হবে।

 

 

নানজিকুনের আদর্শ

মাও শুধু চীনের প্রতিষ্ঠাতাই নন, একজন সাম্য প্রতিষ্ঠার নায়কও। তার যোগ্য নেতৃত্বে চীন অল্প সময়ে আধুনিক সমাজে পরিণত হয়। এ কারণেই মরে গিয়েও মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন চেয়ারম্যান মাও। মাও চীনের আকাশে তারা হয়েছেন আজ ৫০ বছর হয়েছে। তবুও তিনি দেশের অগণিত মানুষের মনে এখনো বিরাজ করে চলেছেন। তার উদাহরণ হলো চীনের হেনান প্রদেশের নানজিকুন গ্রাম। নানজিকুনের ভূপতি মানা হয় তাকে। গ্রামটির সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পুরোটা সময় দীপ্যমান থাকেন মাও সে তুং। রোদ-বৃষ্টি যাই থাকুক না কেন, প্রতিদিন সকাল সোয়া ৬টায় চীনের সাবেক এ নেতার স্তবগান বাজে এ গ্রামে। আর সেই স্তবগান মানুষের কর্ণে পৌঁছানোর জন্য রাস্তার প্রতিটি মোড়ে মোড়ে লাগানো আছে স্পিকার। মাওয়ের মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরি শাসকেরা রাষ্ট্রের মালিকানাধীনে নেওয়া এখানকার জমি গত শতকের আশির দশকে কৃষকদের কাছে ফিরিয়ে দেন। তবে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই কৃষকরা জমিগুলো গ্রাম কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নিজেদের অংশীদারিত্ব বজায় রাখেন। তারা যৌথভাবে এসব জমির মালিক। এসব জমিতে চলে আবাদ। প্রয়োজনে জমির ওপর নির্মাণ করা হয় কল-কারখানা। আর এতেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাটাও হয়ে যায় এখানকার মানুষের। এখানে চলে ‘দশে মিলে করি কাজ’ এই স্লোগান। ফলে একদিকে যেমন উন্নয়ন হচ্ছে তেমনি দ্বন্দ্ব-দুর্ভিক্ষেও কৃষকরা থাকছেন একই ছাতার নিচে। সমষ্টিগতভাবে এ গ্রামের সবারই অবস্থার উন্নতি হয়েছে। একসময় এখানে ছিল বস্তি আর বেড়ার ঘর। সেই জায়গায়ই আজ গড়ে উঠেছে বিশাল দালান। আর গ্রামের মাঝখানে সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে মহানায়ক মাও সে তুং, লেনিন ও স্ট্যালিনের বড় ভাস্কর্য। চারদিকে ঝুলছে লাল ব্যানার। এমন ঐক্যতার দেশে বিশ্বের অসংখ্য ধনাঢ্য ব্যক্তি বিনিয়োগও করছেন নির্দ্বিধায়। গড়ে উঠেছে নানা কারখানা। রয়েছে পত্রিকা অফিস। বিনোদনের জন্য রয়েছে বেতারকেন্দ্র ও টেলিভিশন। অদ্ভুত হলেও সত্য এখানকার মানুষের ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। আছে কিছু বিদ্যুত্চালিত স্কুটার আর তিন চাকার গাড়ি। কৃষিনির্ভর হলেও উচ্চ শিক্ষায় পিছিয়ে নেই এ গ্রাম। এখানকার মানুষের মূল বেতন মাত্র ৩২-৩৫ ডলারের কোঠায়। খাদ্যপণ্য, শিক্ষাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বিনামূল্যে পাওয়া যায় এখানে। মাও সে তুং-এর চিন্তাধারাকে বুকে ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে এ গ্রামের বাসিন্দারা।

 

অন্যরকম

 

এক কিংবদন্তি

‘শত পুষ্প বিকশিত হোক’। বিখ্যাত এক মানুষের উক্তি। তিনি কিংবদন্তি মাও সে তুং। জন্ম ১৮৯৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর। চীনের হুনান প্রদেশের শাং তাং জেলার শাওশানে গ্রামেই তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। মাও অতি সাধারণ কৃষক পরিবারের সন্তান। বাবা মাও ইচং ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী কৃষক। ছিলেন কনফুসিয়ানও। দরিদ্র কৃষক হলেও কয়েক বছর সেনাবাহিনীতে চাকরি করে জমিজমা কিনে অবস্থার উন্নতি ঘটান। পাশাপাশি কাঁচামালের ব্যবসা করে রীতিমতো মধ্যবিত্ত হয়ে ওঠেন। মা ওয়েন কিমে দয়ালু এবং বৌদ্ধ ধর্মভক্তি একজন। একসময় তাদের পরিবার গ্রামের ধনী পরিবার হয়ে ওঠে। তারা অন্যদের চেয়ে বিলাসী জীবনযাপন করতেন। মাও স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। মাও ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং পরিশ্রমী। ১৩ বছর বয়সে স্কুলের নিয়ম পালনে অস্বীকৃতি জানালে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর কেটে যায় আরও ২ বছর। ১৬ বছর বয়সে আবারও স্কুলে ভর্তি হন মাও। তার স্কুল থেকে বাড়ির দূরত্ব ছিল ২৭ কিলোমিটার। একসময় মাও শিক্ষকদের প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন।

 

ছিলেন কবি

চীনের বেশিরভাগ মানুষই গণহত্যাকে সাধারণভাবে নেননি। কিন্তু মাওয়ের কবিতা ও লেখার শৈলীতে মুগ্ধ হয়েছেন। এমনকি পশ্চিমা পণ্ডিতরাও তার কবিতায় মুগ্ধ। অনেকেই তার কবিতা পশ্চিমা ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। তাদের মতে, ‘চেয়ারম্যান মাওয়ের কবিতাগুলো হিটলারের ছবির মতো খারাপ নয়, চার্চিলের মতো ভালো নয়।’ মাও শাস্ত্রীয় সাহিত্য পছন্দ করতেন। তিনি কেবলমাত্র শাস্ত্রীয় শৈলীর মাধ্যমেই তার কাব্য রচনা করতেন। ছেলেবেলা থেকেই তার কবিতার লেখার চর্চা। একসময় সেই চর্চাই চেয়ারম্যান মাওকে করে তোলে সাংস্কৃতিক গুণসম্পন্ন কবি। ছেলেবেলা থেকেই এই শিল্পচর্চা থাকলেও ১৯৫৭ সালের আগে তার কোনো কবিতার বই প্রকাশিত হয়নি। গত ৫০ বছরে তার কবিতা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এমনকি তার কবিতা স্কুলের পাঠ্যবইয়েও সংযোজন করা হয়।

 

সাঁতার পছন্দ করতেন

মাও শারীরিক শিক্ষা এবং ব্যায়ামকে খুব গুরুত্ব দিতেন। তিনি সাঁতার কাটতে খুব পছন্দ করতেন। এটাকে তার শখই বলা চলে। তার একটি অনন্য উদাহরণ হলো ‘ক্রস ইয়াংটিজ প্রতিযোগিতা’। আরও পাঁচ হাজার সাঁতারু ছিলেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী-প্রতিযোগী। তখন মাও ছিলেন ৭২ বছর বয়সী বৃদ্ধ। হুনানের কাছাকাছি ইয়াংজটি নদীতে প্রতিযোগিতা হয়েছিল। সেখানে চেয়ারম্যান মাও এক ঘণ্টায় ১৬ কিলোমিটার (১০ মাইল) সাঁতরে পার হয়েছিলেন। প্রতিযোগিতাটি সে সময় ব্যাপকভাবে প্রচার পেয়েছিল। যদিও চাইনিজ প্রেসের দাবি, মাও ৬৫ মিনিটে ১৫ কিলোমিটার (৯ মাইল) অতিক্রম করেছেন। অর্থাৎ মাও প্রতি সেকেন্ডে ৩.৮ মিটার গতিতে সাঁতার কেটেছিলেন।

 

কখনো দাঁত মাজতেন না!

চেয়ারম্যান মাও দাঁতের স্বাস্থ্যে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি কখনো দাঁত মাজতেন না। এর পরিবর্তে তিনি প্রতিদিন সকালে গরম এক কাপ কড়া লিকারের চা খেতেন। তার ভাষায় এটাই সেরা। মাও তার ব্যক্তিগত ডেন্টিস্টকে বলতেন, ‘আমি চায়ের মাধ্যমে আমার দাঁত পরিষ্কার রাখি। বাঘ কি কখনো দাঁত মাজে! তাই বলে কি বাঘের দাঁত পরিষ্কার নয়? মাওয়ের ঘনিষ্ঠরা মাওকে জোর করে ব্রাশ করানোর চেষ্টা করতেন। যদিও এর মাধ্যমে কেবল দুই-একদিন ব্রাশ করানো যেত। তবে, প্রতিদিন সকাল বেলার চা-ই ছিল মাওয়ের দাঁতের স্বাস্থ্যের দাওয়া।

 

মনের দিক থেকেও  ছিলেন তরুণ...

চেয়ারম্যান মাও ছিলেন স্বপ্নবিলাসী। স্বপ্ন সাজাতে তিনি পছন্দ করতেন। তারুণ্যকে নিজের মধ্যে লালন করেন। তিনি মেয়েদের সঙ্গে একান্ত সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। জীবনে চারবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পরও মাও ছিলেন অন্য সবার চেয়ে আলাদা। মাও প্রথম বিয়ের পিঁড়িতে বসেন ১৯০৮ সালে। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। যদিও অল্প বয়সে বিয়ে করতে চাননি। চেয়ারম্যান মাও সব সময় নিজেকে তরুণ মনে করতেন। তার বয়স যখন ৬৯ বছর, তখন চেন নামের ১৪ বছর বয়সী এক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করেন। নানা কারণে মাওয়ের স্ত্রী চেনকে মোটেও সহ্য করতে পারতেন না। মাও বুড়ো বয়সেও মেয়েদের সঙ্গে নির্দ্বিধায় সময় কাটাতে পারবেন বলে বিশ্বাস করতেন। প্রতিদিনই অনেক কৃষক মেয়ে মাওয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসত।

 

দ্বিতীয় সর্বাধিক প্রকাশিত দ্য লিটল রেড বুক

চীনা বিপ্লবের নায়ক মাও সে তুংয়ের বিভিন্ন উক্তি সংবলিত বই দ্য লিটল রেড বুক; বাইবেলের পর সর্বাধিক প্রকাশিত বই। বইটির প্রচ্ছদ করা হয়েছে লাল এবং এতটাই ছোট যে, পকেটে রাখা যায়। ১৯৬৪ সালে প্রথম পিপলস লিবারেশন আর্মি বইটি প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছিল। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় বইটি একটি পবিত্র গ্রন্থ হয়ে ওঠে। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত যে বইটিকে ধ্বংস বা নষ্ট করতে চাইবে তাকেই চীনা সরকার লম্বা সময়ের জন্য হাজতে প্রেরণ করবে। সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে দেশটির সৈনিক, বড় বড় আমলা এমনকি অশিক্ষিত কৃষকও বইটি পড়তে বাধ্য হয়েছিল।

বইটি আরেকটি রেকর্ড ধরে রেখেছে। বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রীত বইগুলোর মধ্যে একটি। সরকারিভাবে ৯০০ মিলিয়ন কপি ছাপানোর পর এই বইটি ১৯৬৬-১৯৭১ সালের মধ্যে প্রায় সব প্রাপ্তবয়স্ক চীনা পুরুষকে কিনতে বাধ্য করা হয়েছিল। শুধু চীনেই নয়, ১৯৬৬ সালে বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশে বইটির সংস্করণ বিতরণ করা হয়েছে। এমনকি পৃথিবীর মোট ১২টির বেশি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়।

 

 

ভিন্নরকম

 

অধিক নারী দেশের বোঝা!

১৯৭৩ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি চলছিল। চেয়ারম্যান মাও তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে বসে ছিলেন। সভায় গুরুতর বিষয়ে আলোচনা চললেও মাওয়ের মনে ছিল অন্য কিছু। অধিক নারী দেশের বোঝা মনে করতেন মাও। মাও সভায় বলেন, ‘চীন গরিব দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপনে চীনের কিইবা দেওয়ার আছে। সুতরাং চীন তাদের জনসংখ্যার মধ্যে ১ কোটি নারীকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে উপহার দিতে পারে।’ এমন প্রস্তাবে জনরোষ বাড়বে, তাই কোনো সংবাদ মাধ্যমে তা আসেনি।

 

 

 

স্ট্যাম্প জমানো ছিল অপরাধ

মাও স্ট্যাম্প পছন্দ করতেন না। আর স্ট্যাম্প সংগ্রহ করাও না। মাওয়ের শাসনামলে স্ট্যাম্প সংগ্রহ করা ছিল অপরাধ। তিনি স্ট্যাম্প সংগ্রহ করাকে কেবল চিত্তবিনোদন বলেই মনে করতেন। এতে কেবল সময়ই নষ্ট হয় বলে চেয়ারম্যান মাও স্ট্যাম্প সংগ্রহ বন্ধ করে দেন। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর থেকেই চীনে এই আইন চালু ছিল। আর এই আইন বলবৎ ছিল তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। সে সময় এই অদ্ভুত শখটি ভুলেও জনসম্মুখে আনতেন না কেউ। তবে, বর্তমানে সেই বিপ্লব সময়কার স্ট্যাম্পগুলো পৃথিবীর মূলবান স্ট্যাম্পগুলোর অন্যতম।

 

 

মহাপ্রাচীর ভাঙার সিদ্ধান্ত  

তখনো চীনের মহাপ্রাচীর ঐতিহাসিক স্থানের তকমা পায়নি। সময়টা ছিল ১৯৭০ সাল। চেয়ারম্যান মাও এবং তার সরকার মহাপ্রাচীর ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন। তারা মনে করতেন এর পেছনে অযথাই অর্থ ব্যয় হচ্ছে। এটি শুধুই একটি বসার স্থান, এর পেছনে এত সরকারি অর্থ ব্যয় করার কোনো মানেই হয় না। তাই চীনের মহাপ্রাচীর থেকে নির্মাণ উপকরণ খুলে নিয়ে নতুন নির্মাণকাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। যদিও মাও এবং তার সরকার সফল হননি। পরবর্তীতে গ্রেট ওয়াল ঐতিহাসিক স্থানের মর্যাদা পায় এবং এলাকাটি সুরক্ষিত ঘোষণা করা হয়।

 

 

 

শিক্ষক পেটানোয় উৎসাহ!

১৯৬৬ সালের ঘটনা। সমাজতান্ত্রিক সমাজে মাও সে তুং মতাদর্শের বাইরে কোনো শিক্ষক কথা বললে শিক্ষার্থীরা তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলত। কমপক্ষে ৯১টি বিদ্যালয় এমন ঘটনার সাক্ষী। শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে টেনেহিঁচড়ে বিদ্যালয়ের বাইরে এনে পেটাত। তারা শিক্ষকের গায়ে কালি ছুড়ে, লাল রং দিয়ে ক্রস এঁকে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। গরম পানি দিয়ে শরীর ঝলসে দিত যতক্ষণ না শিক্ষক মারা যেত। চেয়ারম্যান মাও ছাত্রদের কাজে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ না করার নির্দেশ দেন। এমন ঘটনায় জড়িত ১৮ শিক্ষার্থী লজ্জায় আত্মহত্যা করেন।

সর্বশেষ খবর