রবিবার, ২০ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

কিংফিশার ও বিজয় মালিয়ার গল্প

কিংফিশার ও বিজয় মালিয়ার গল্প

বিজয় মালিয়া। এক ধনকুবেরের নাম। নিজস্ব আইল্যান্ড, আলিশান বাংলো, ব্যক্তিগত বিমান, এয়ারবাস, গাড়ি, কী ছিল না তার! ভারতের একসময়ের জনপ্রিয় পানীয় কোম্পানির মালিক তিনি। ২০০৫ সালে ধুমধাম করে চালু করেন কিংফিশার এয়ারলাইনস। তা আবার ব্যাপক জনপ্রিয়তাও পায়। শখের বশে রয়েল চ্যালেঞ্জার্স  বেঙ্গালুরুর ফ্র্যাঞ্চাইজিও হন। কিন্তু ২০১২ সালের পর হিসাবের অঙ্কটা পাল্টে যায়। ভারতের এই কিংফিশারের গল্প জানাচ্ছেন— আবদুল কাদের

 

বিজয় মালিয়া। ভারতের একসময়ের শীর্ষ বিয়ার ব্যারন সাম্রাজ্যের অধিপতি। ভারতের ইউনাইটেড ব্রিউয়ারিজ গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং সিইও। পাশাপাশি ছিলেন ইউনাইটেড স্পিরিট গ্রুপের সাবেক চেয়ারম্যানও। নিজস্ব আইল্যান্ড, বিমান, এয়ারবাস, বাংলো, গাড়ি ছাড়াও তার ছিল কিংফিশার এয়ারলাইনস। তিনি শুধু ভারতের একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীই ছিলেন না, ছিলেন রাজনীতিবিদও। তাকে বলা হতো ‘কিং অব গুড টাইম।’ কিন্তু এই কিং অব গুড টাইমের আজ বেহালদশা। নইলে সবকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক জোট বেঁধে সুপ্রিম কোর্টের কাছে এভাবে আর্জি জানায়!

১৯৭৩ সালে ভারতের শীর্ষ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ব্রিউয়ারিজ গ্রুপের ডিরেক্টর নিযুক্ত হন। এর ঠিক দশ বছর পর ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন মালিয়া। একই বছরে ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিয়ার ব্যারন ম্যাক ডুয়েলসও চালু করেন তিনি। তার কোম্পানির এই পানীয় ১৯৮৩ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বেশ সুনাম অর্জন করে। একের পর এক সফলতা ধরা দেয় তার হাতে। ইউনাইটেড ব্রিউয়ারিজ গ্রুপের দায়িত্ব পাশাপাশি ইউনাইটেড স্পিরিট গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। ২০০৫ সালে মালিয়া শ’ ওয়েলস কিনে নেন। শ’ ওয়েলস ভারতের অন্যতম মদ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। তখন ইউনাইটেড ব্রিউয়ারিজ গ্রুপ শ’ ওয়েলসে ৯৪০ কোটি টাকা দিয়ে ৩৭.৫ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। সে সময় মালিয়ার বিয়ার জনপ্রিয়তায় ব্রিটিশ বিয়ার স্কটিশ এবং নিউক্যাসেলকেও ছাড়িয়ে যায়। একই বছরের মে মাসে বিজয় মালিয়া ভারতে কিংফিশার এয়ারলাইনসও চালু করেন। তখন পর্যন্ত সবই ভালো চলছিল। এরপর বাধেই বিপত্তি। যত নষ্টের মূল সম্ভবত বিমান সংস্থার নামেই ছিল। নামটা যে ‘কিংফিশার’, যার বাংলা মাছরাঙা। মনে পড়ে যায় পুরনো প্রবাদ- ‘সকল পক্ষী মৎস্য ভক্ষি, মাছরাঙা হয় কলঙ্কিনী।’ প্রবাদ যেমনই হোক, চলে আসি মূল ঘটনায়।

২০০৬ সালের বিজয় মালিয়া আইডিবিআই ব্যাংকের কাছে কিংফিশার এয়ারলাইনসের নামে ঋণ আবেদন করেন। আইডিবিআই ব্যাংককে কিংফিশার এয়ারলাইনসের শেয়ার কেনার প্রস্তাবও করেন মালিয়া। এর আগে মালিয়ার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শেকড় ডালপালা ছড়িয়ে ছিল গোটা ভারতে। মালিয়ার ব্যবসায় ছিল বিমানবন্দর নির্মাণ, বিদ্যুৎ  কেন্দ্র, সড়ক উন্নয়নসহ আরও অনেক কিছু। কিংফিশারের প্রস্তাবে আইডিবিআইর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে মালিয়া বিমানের জমি অধিগ্রহণ পরিকল্পনায় ব্যাংকের অর্থায়ন সহায়তা চান। প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্বের তিনি ভারতের বিমান শিল্পকে নতুন স্বপ্ন দেখান। কিন্তু তখন কমিটি প্রস্তাবটি অনুমোদন দেয়নি। কয়েক বছর পর ২০০৯ সালে ব্যাংকের শীর্ষকর্তার দুর্নীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৯০০ কোটি টাকা ঋণ নেন। কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা (সিবিআই) তখন মালিয়া এবং তার অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে। মালিয়া তখন ঋণ পরিশোধে বিলম্ব করেন। যদিও মালিয়া এটাকে ‘ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা’ বলেন। তাহলে কি মালিয়াকে ঋণ দেওয়া ভুল ছিল! হয়তো এমনটা অনেকেই মনে করেন। বিজয় মালিয়ার কিংফিশার চালু হওয়ার আগে থেকেই বিমান শিল্পে ব্যাপক সংকট দেখা গিয়েছিল। বিমানের অর্ধেক অপারেটিং খরচই ছিল জ্বালানি খরচ। তবে মালয়েশিয়া ঘোষণা করেছিল কিংফিশার এয়ারলাইনস প্রিমিয়াম বিমান সংস্থা হবে। বলিউড অভিনেত্রী ইয়ানা গুপ্তাকে দিয়ে তখন বিজ্ঞাপনও তৈরি করা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে কিংফিশার এয়ারলাইনস বেশ জনপ্রিয়তা পায়। মালিয়া অন্যান্য বিমান সংস্থাগুলোর মতো বিভিন্ন যাত্রী পরিসেবা নিশ্চিত করেন। একসময় কিংফিশার প্রিমিয়াম বিমান সংস্থা হয়ে ওঠে। ২০০৭ সালে মালিয়া এয়ার ডেকানের (২০০৮ সালে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়) কাছে কিংফিশারের ২৬ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে ঋণের ৫৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করেন। অনেকেই মনে করেন, এটি ছিল কিংফিশার ধ্বংসের অন্যতম কারণ। ২০০৮ সালে কিংফিশার এয়ারলাইনস ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ২০০৫-১০ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে (গড়ে ৭২.৬৮ মার্কিন ডলার) তেলের দাম বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর এতেই কিংফিশার এয়ারলাইনস আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে থাকে। আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি মালিয়ার ঋণের বোঝাও ত্বরান্বিত হতে থাকে হু হু করে। এতকিছুর পরও ‘কিং অব গুড টাইম’ খ্যাত কিংফিশার মালিয়া সতর্ক হননি। খেলায় মেতে ওঠেন মালিয়া। ২০০৮ সালে আইপিএলের টিম রয়েল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর ফ্র্যাঞ্চাইজি হন। এ ছাড়াও মালিয়া ছিলেন বেহিসাবি এবং আয়েশি। ২০০৮ সালের শেষের দিকে কিংফিশারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৩৪ কোটি টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মালিয়ার ঘনিষ্ঠ এক সূত্রে জানা যায়, ‘এয়ার ডেকানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় কিংফিশারের সমাপ্তি ঘটে। তখন বিমান চলাচলে এয়ার ডেকানের হাতে ক্ষমতা ছিল বেশি। সেই সুযোগে বিমানের টিকিটের মূল্য হ্রাস করা হয়। এ ছাড়া বিমানের তেলের মূল্য বৃদ্ধি, ট্যাক্স, অন্যান্য কারণ তো আছেই।’

এই বিশাল আর্থিক ক্ষতি শুধু যে কিংফিশারের হয়েছে এমনটাও নয়, ২০০৮ সালের দিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিমান শিল্পও এমন ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। কিন্তু সবাই টিকে গেলেও কিংফিশার ধসে পড়ে।

কয়েক বছরের মধ্যে কিংফিশারের ঋণের লাগাম বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫,৬৬৫ কোটি টাকা। ২০০৯-১০ সালের মধ্যে ভারতীয় এই ধনকুবের কিংফিশার মালিয়া ৬,৯৬৩ কোটি টাকা ঋণে পড়ে যান। ঋণে জর্জরিত মালিয়ার ওপর নানা দিক থেকে চাপ আসতে থাকে। ভারতের ১৭টি ব্যাংক থেকে মালিয়া কিংফিশার এয়ারলাইনসের নামে এই ঋণ নিয়েছিলেন। যার মধ্যে শুধু স্টেট ব্যাংকেরই মালিয়ার ‘কিংফিশার’-এর কাছে পাওনা ১৬০০ কোটি টাকা। এর বাইরে যথাক্রমে আইডিবিআই ব্যাংকের ৮০০ কোটি, পিএনবির ৮০০ কোটি, ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ৬৫০ কোটি, ব্যাংক অব বারোদার ৫৫০ কোটি, ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ৪৩০ কোটি, সেন্ট্রাল ব্যাংকের ৪১০ কোটি, ইউসিও ব্যাংকের ৩২০ কোটি, করপোরেশন ব্যাংকের ৩১০ কোটি, স্টেট ব্যাংক অব মায়সর-এর ১৫০ কোটি, ইন্ডিয়ান ওভারসিস ব্যাংকের ১৪০ কোটি, ফেডারেল ব্যাংকের ৯০ কোটি, পাঞ্জাব অ্যান্ড সাইন্ড ব্যাংকের ৬০ কোটি, এক্সিস ব্যাংকের ৫০ কোটি টাকাসহ আরও তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ৬০৩ কোটি টাকা। যার সুদে আসলে ৯ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ঋণের এই বেড়াজালে মালিয়ার ওপর নানা দিক থেকেই ধাক্কা আসে। তাই তো চলতি বছরেই তিনি লন্ডনে পাড়ি জমান বলে গুঞ্জন ওঠে। ইউনাইটেড স্পিরিটসের কর্তার পদ ছাড়ার জন্য বলা হয়। এদিকে ব্যাংক ঋণ আদায় ট্রাইব্যুনাল (ডিআরটি) জানিয়েছে, যতদিন না ঋণের টাকা ফেরত পেতে স্টেট ব্যাংকের দায়ের করা মূল মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে, ততদিন সেই টাকা ডিয়াজিওকে না-মেটাতে। এর মধ্যে ২০১২ সালে মালিয়ার কিংফিশার এয়ারলাইনস বন্ধ হয়ে যায়। ২০১২-১৩ সালে ইউএসএল দেওয়া লোনের কারণে তাদের অর্থনৈতিক ফলাফল করতে বিলম্ব করে। অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অর্থ সরানোর অভিযোগে কালো টাকা প্রতিরোধ আইনে মামলা করে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। ২০১৫ সালের এপ্রিলে ডিয়াজিও মালিয়াকে সবকিছু গুটিয়ে নিতে বলে। এমনকি এসবিএল ঘোষণা দেয় মালিয়া ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। এজন্য চলতি বছরের মে মাসের দিকে ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচারের অভিযোগে দেশান্তরী হওয়া মালিয়াকে লন্ডনে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড গ্রেফতার করে। যদিও মালিয়া গ্রেফতারের ৩ ঘণ্টার মধ্যে জামিনে ছাড়াও পান।

 

কে এই বিজয় মালিয়া

বিজয় মালিয়া, ভারতের একজন ধনকুবের। জন্ম ১৯৫৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর; ভারতের কর্ণাটকের এক ধনাঢ্য পরিবারে। বাবা ভিত্তাল মালিয়া ছিলেন ইউনাইটেড ব্রিউয়ারিজ গ্রুপের সাবেক চেয়ারম্যান। মা ললিতা রামিয়াহ মালিয়ার আদরেই বড় হন বিজয় মালিয়া। ছেলেবেলা থেকেই অত্যন্ত দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন তিনি। কর্ণাটকের বান্তাল শহরেই কেটেছে তার ছেলেবেলা। তিনি ছেলেবেলা থেকেই পড়াশোনায় পাকাপোক্ত ছিলেন। লা মার্টিনিয়া থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। তার দূরদর্শিতার জন্য স্কুলে তাকে হস্টিং হাউস ক্যাপ্টেন নিযুক্ত করা হয়েছিল। এরপর ডিগ্রি অর্জনে পাড়ি দেন কলকাতা। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ব্যাচেলর অব কমার্সে ডিগ্রি অর্জন করেন। মালিয়া জীবনের একটি বড় অংশ কলকাতায় কাটিয়ে দেন। তিনি কলেজের পড়াশোনার পাশাপাশি পারিবারিক ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হোয়েস্ট এজি-তে যুক্ত হন। সেই থেকে হাতেখড়ি শুরু। বাবার মৃত্যুর পর মাত্র ২৮ বছর বয়সে ইউনাইটেড ব্রিউয়ারিজ গ্রুপের চেয়ারম্যান পদের দায়িত্ব পান মালিয়া। যদিও এর দশ বছর আগেই এই গ্রুপের ডিরেক্টর হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। এরপর ভারতের এই গ্রুপ অব কোম্পানিটি ৬০টিরও বেশি বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৯৯৮-৯৯ সালে ইউনাইটেড ব্রিউয়ারিজ গ্রুপের বার্ষিক লেনদেন বেড়ে গত ১৫ বছরে ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়। মালিয়া বিভিন্ন কোম্পানিকে ইউবি গ্রুপ নামের ছাতার নিচে নিয়ে আসেন। মালিয়ার মূলত মদ তৈরির প্রতি ঝোঁক ছিল বেশি। ১৯৮৩ সালে বহুজাতিক ব্র্যান্ডের মদের ব্যবসায় যুক্ত হয়ে পরবর্তীতে ২০০৫ সালে ভারতের সবচেয়ে পুরনো মদের কোম্পানি শ’ ওয়েলস কিনে নেন এবং ২০০৮ সালে ভারতে ইউরোপের জনপ্রিয় বিয়ার হ্যানিকেন চালু করেন। ইউনাইটেড স্পিরিট গ্রুপের সাবেক চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি। পাশাপাশি আরও কয়েকটি কোম্পানিতে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। মালিয়ার আরেকটি পরিচয়, কর্ণাটকের একজন এমএলএ। শুরুতে তিনি ব্যবসায়ের পাশাপাশি আখিলা ভারত জনতা দলের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। সেই থেকে ধনাঢ্য রাজনীতিবিদ হিসেবে গোটা রাজ্যের নজর কাড়েন। এরপর ২০০৩ সালে সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে ভারতের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল জনতা দলে যোগ দেন মালিয়া। এর আগে ২০০২ সালে মালিয়া কংগ্রেস পার্টি এবং জনতা দলের সমর্থন নিয়ে নিজ রাজ্য কর্ণাটকের রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। পাশাপাশি ২০১০ সাল পর্যন্ত মালিয়া কর্ণাটকের জনতা দলের কার্যকরী সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ সালে ভারতীয় জনতা পার্টির সমর্থন নিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

 

বিলিওনিয়র থেকে মিলিওনিয়র

ফোর্বসের তালিকায় থাকা ভারতের ধনকুবের বিজয় মালিয়া এখন ঋণের বোঝায় কোণঠাসা। কিন্তু একটু পেছনে তাকালেই দেখা যাবে বিলাসী মালিয়ার আয়েশি জীবনযাপন। কী ছিল না তার! নিজস্ব আইল্যান্ড, ব্যক্তিগত বিমান, এয়ারবাস, আলিশান বাংলো, দামি গাড়ি এমনকি ভারতের অন্যতম বিমান সংস্থা কিংফিশার এয়ারলাইনস। সুসময়ের দিনগুলোয় মালিয়ার মোট সম্পদ ছিল ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু অর্থ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ার পর তা মিলিওনিয়রের তলানিতে এসে ঠেকেছে। বর্তমানে মালিয়ার মোট সম্পদের পরিমাণ ১.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যদিও ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ১৭টি ব্যাংকের অধীনে রয়েছে মালিয়ার সব সম্পত্তি। সম্পত্তিগুলো নিলামের দায়িত্বও দেওয়া হয় এসবিআইক্যাপ ট্রাস্টি কোম্পানিকে। দেশের ভিতরে মালিয়ার রয়েছে আলিশান বাংলো। গোয়ার ক্যান্ডোলিম বিচে অবস্থিত ১২৩৫০ স্কয়ার ফিটের কিংফিশার ভিলা মালিয়ার বিলাসবহুল বাড়ির একটি। বাড়িটির প্রতিটি আসবাব হ্যান্ড-ক্রাফটেট টিকউডের তৈরি। যদিও বর্তমানে বাড়িটি নিলামে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। কর্ণাটকের আরেকটি ফার্ম রয়েছে যা ৪০০ একর জমির ওপর তৈরি। ফার্মটিতে প্রতিযোগী ঘোড়া প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রেখেছেন মালিয়া। এ ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ার সওসালিতোর ১১ হাজার ফুটের বিলাসবহুল বাড়ি এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকা ১২ হাজার হেক্টর জমির ওপর তৈরি দৃষ্টিনন্দন মুম্বালা গেম লজও এখন তার ধনকুবেরের সাক্ষ্য বহন করে। লিয়েরিনসের চারটি দ্বীপের মধ্যে সবচেয়ে বড় সান্ত-মার্গারিট দ্বীপে একটি বিলাসবহুল রিয়েল এস্টেট কেনার কথাও শোনা গিয়েছিল। ৩ কিলোমিটার লম্বা এবং ৯০০ মিটার এলাকাজুড়ে থাকা ‘দ্য গ্র্যান্ড গার্ডেনটি’ কিনতে তিনি ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছিলেন। লা গ্র্যান্ড জার্ডিন নামেই এটি বেশ পরিচিত। নিউইয়র্কের ট্রাম্প প্লাজায়ও বিজয় মালিয়ার বিলাসবহুল একটি পেন্ট হাউস রয়েছে। এই পেন্ট হাউসের জন্য তিনি ২.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করেছিলেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে। ভারতের  বেঙ্গালুরু তথ্যপ্রযুক্তির শহর হিসেবে বেশ পরিচিত। এই শহরেই মালিয়া ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে একটি বিশাল টাওয়ার তৈরি করেছিলেন। সম্ভবত এর নাম কিংফিশার টাওয়ার। টাওয়ারটিতে তিনটি ব্লকে মোট ৮২টি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে যার মধ্যে ৭২টি বিক্রি করা হয়েছে। এত সব সম্পদের ভিড়ে বিজয় মালিয়ার একটি ব্যক্তিগত বিশালাকার ইয়টও রয়েছে। ৯৫ মিটার (৩১১ ফুট ৮ ইঞ্চি) ইয়টটি বিশ্বের ৩৩তম বৃহত্তম ব্যক্তিগত ইয়ট। শোনা যায়, ইয়টটি প্রাথমিকভাবে ২০০০ সালের দিকে কাতারের রাজপরিবার এবং তাদের পূর্বসূরিদের জন্য চালু করা হয়েছিল। ইয়টটির আসবাব আভিজাত্য এবং বিলাসী আবহকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এ ছাড়া ভারতীয় ধনকুবের মালিয়ার বিমান সংস্থা কিংফিশারের কথা সবারই জানা। এর বাইরেও মালিয়ার ব্যক্তিগত বিমানও ছিল বলে জানা যায়। এ ছাড়া মালিয়া ছিলেন সৌখিন প্রকৃতির। তার সংরক্ষণে ছিল ক্যালিফোর্নিয়া স্পাইডার ফেরারি ১৯৬৫, জ্যাগুয়ার এক্সজে ২২০, জ্যাগুয়ার এক্সজেআর ১৫ রিসিংকার, এনসাইন এমএস ০৮ রেসিং কারসহ সিলভার ঘোস্ট রোলস রয়েস ১৯১৩ গাড়ির কালেকশন।

 

 

অবশ্যই এক দিন আমি ফিরব, ভারত তখন আমার সব ফিরিয়ে দেবে...

— বিজয় মালিয়া

৯ হাজার কোটি টাকা, সংখ্যাটা নেহাতই কম নয়। বিশাল অঙ্কের ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত মালিয়া। তবুও ইউবি গ্রুপের চেয়ারম্যান বিজয় মালিয়া মোটেও বিচলিত নন। গেল বছর তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আমি আশা রাখি এক দিন অবশ্যই ফিরে আসব। ভারত আমাকে সব ফেরত দেবে।’ তিনি আরও বিশ্বাস করেন যে, তিনি কোনো ভুল করেননি। তিনি মূলত ষড়যন্ত্রের শিকার। মালিয়া বলেন, ‘আমি দেশ ছেড়েছি শুধু কয়েকটি লাগেজ নিয়ে। ঋণের বোঝার কারণে পালিয়ে আসিনি। পালিয়েছি এমন কথার কোনো ভিত্তি নেই। অন্যদিকে, হায়দরাবাদ কোর্ট তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, ‘জিএমআর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৫০ লাখ রুপির চেক করাকে কেন আজ চিহ্নিত আসামি বলা হচ্ছে? ঋণখেলাপি তো ব্যবসায়িক ব্যাপার।’

 

মালিয়ার অজানা কাহিনী

►  বিজয় মালিয়া প্রচণ্ড ধর্মপ্রেমী একজন ব্যক্তি। ব্যক্তিগত বা পেশাগত যত ব্যস্ততায় থাকুক তিনি সময় বের করে মন্দিরে যান। এমনকি তিনি খালি পায়ে সেখানে পদচারণা করেন।

►  বিজয় মালিয়া ভয়ানক রকমের প্রযুক্তি আসক্ত একজন ব্যক্তি। তিনি ব্লাকবেরির মোবাইলের প্রতি চরম আগ্রহী। বাড়ির বাইরে বেরোলে কখনই ব্লাকবেরির সঙ্গ ছাড়তে রাজি নন।

►  বিজয় মালিয়া নিলামে বিড দিতে পছন্দ করেন। ২০০৪ সালেই এমন এক ঘটনার জন্ম দেন মালিয়া। মালিয়া লন্ডন থেকে টিপু সুলতানের ব্যবহার করা তলোয়ারটি নিলামে কিনে নেন ১ লাখ ৭৫ হাজার ইউরোয়। এর বাইরেও মালিয়া নিউইয়র্কের এক নিলামে অহিংস নেতা মহাত্মা গান্ধীর চশমা ও পকেট ঘড়িটি ১.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে কিনে নিয়ে আসেন।

►  ব্যবসায়ের পাশাপাশি মালিয়া লেডিস ম্যানের তকমাও পান। সবাই জানেন তিনি দুটি বিয়ে করেছেন। তবে এখনো বাতাসে রটে মালিয়া-পিঙ্কির প্রেমের কাহিনী। 

►  কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়ালেখা করার সময় বাইসাইকেলে যাওয়া-আসা করতেন।

►  মালিয়া একজন বহুভাষাবিদ। তিনি বাংলা, কান্নাড়ি, হিন্দি, কোঙ্কানি, গুজরাটি, ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় কথা বলতে পারেন।

 

 

প্রেমে মশগুল

ভারতীয় এই ধনকুবেরের প্রথম স্ত্রী সমীরা তায়বেজি। সুন্দরী সমীরা ছিলেন এয়ারহোস্টেস। পরিচয়টাও হয়েছিল বিমানেই। ১৯৮৬ সালে বিজয় মালিয়া তখন আমেরিকা যাচ্ছিলেন। বিমানে সুন্দরী সমীরাকে দেখে মালিয়ার ভালো লেগে যায়। পরে সেই পরিচয় পরিণয়ের দিকে এগিয়ে যায়। মালিয়া-সমীরা দম্পতির ছেলে সিদ্ধার্থ মালিয়া। যদিও মালিয়া-সমীরা এই দম্পতির দাম্পত্য জীবন খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।

 

 

প্রথম বিয়ে সমীরার সঙ্গে হলেও বিজয় মালিয়ার অতীতে একটি প্রেম ছিল। তার শৈশবের প্রেমিকার নাম ছিল রেখা। ১৯৯৩ সালে মালিয়া জানতে পারেন রেখার সঙ্গে তার স্বামীর বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ব্যস, আর দেরি করেননি তিনি। বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দেন রেখাকে। তারপরই বিয়ে। রেখার প্রথম পক্ষের দুই ছেলে-মেয়ের মধ্যে, বিজয় মালিয়া মেয়ে ল্যায়লাকে দত্তক নেন বলেও জানা যায়। তবে রেখাই তার দ্বিতীয় এবং শেষ বিবাহ কিনা তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর জল্পনা।

 

 

প্রথম বিয়ে সমীরার সঙ্গে হলেও বিজয় মালিয়ার অতীতে একটি প্রেম ছিল। তার শৈশবের প্রেমিকার নাম ছিল রেখা। ১৯৯৩ সালে মালিয়া জানতে পারেন রেখার সঙ্গে তার স্বামীর বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ব্যস, আর দেরি করেননি তিনি। বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দেন রেখাকে। তারপরই বিয়ে। রেখার প্রথম পক্ষের দুই ছেলে-মেয়ের মধ্যে, বিজয় মালিয়া মেয়ে ল্যায়লাকে দত্তক নেন বলেও জানা যায়। তবে রেখাই তার দ্বিতীয় এবং শেষ বিবাহ কিনা তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর জল্পনা।

 

 

সর্বশেষ খবর