শনিবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
সুলতানা রাজিয়া
৮০০ বছর আগে শাসন করেছেন গোটা ভারতবর্ষ

উপমহাদেশের প্রথম নারী শাসক

তানিয়া তুষ্টি

উপমহাদেশের প্রথম নারী শাসক

শিল্পীর চোখে সুলতানা রাজিয়া

ইতিহাসে আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি নাম সুলতানা রাজিয়া। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক। এ ছাড়াও মমতাময়ী সুলতান ও যুদ্ধক্ষেত্রে একজন দক্ষ সৈনিক হিসেবে তার ছিল সুখ্যাতি। সুলতানা রাজিয়া জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১২০৫ সালে। দৃপ্ত কঠিন ক্ষণজন্মা এই নারীর জীবন প্রদীপ নিভে গিয়েছিল খুব অল্পদিনেই। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১২৪০ সালে। তার তীক্ষ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে রাজকার্য পরিচালনার জন্য নামের আগে সুলতানা না হয়ে সুলতান হওয়াই হয়তো যুক্তিযুক্ত ছিল। সুলতানা রাজিয়ার বাবা শামস-উদ-দীন ইলতুিমশ ছিলেন দিল্লির সুলতান। ১২১০ সাল থেকে ১২৩৬ সাল পর্যন্ত সুলতানি আমলে ইলতুিমশ নিজেও একজন দক্ষ শাসকের খ্যাতি অর্জন করেন। বিভিন্ন অঞ্চলের বিক্ষোভ, বিদ্রোহ দমন করা ছিল তার কাজ। মৃত্যুর আগে নিজের উত্তরাধিকারী মনোনয়নের বিষয়ে সুলতান ইলতুিমশ চিন্তায় পড়ে যান। কারণ ইতিমধ্যে তার বড় ছেলে নাসিরুদ্দিন মাহমুদ মারা গেছেন। সুলতান নিজ সন্তানদের মধ্যে নাসিরুদ্দিনের ওপর বেশি ভরসা করতেন। বাকি যে দুই ছেলে আছেন তাদের কেউই সিংহাসনে বসার যোগ্য ছিলেন না। এমন অবস্থায় চিন্তায় পড়ে গেলেন সুলতান। এরই মধ্যে তার জ্যেষ্ঠ মেয়ে রাজিয়া বেশ বুদ্ধিমতী, চৌকস, প্রজাপ্রীতি ও যুদ্ধকৌশল শিখে গেছেন। তখন রাজ্য চালানোর দায়িত্ব মেয়ে সুলতানার ওপর দিয়ে নির্ভার হন।

 

রূপে-গুণে অনন্য

কন্যা রাজিয়া রাজকুমারী বলে নয়, সত্যিকার অর্থেই ইলতুিমশের এই মেয়েটি মেধা, বুদ্ধি এবং অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন। সুগঠিত সুন্দর দেহ এবং রূপ সৌন্দর্যের অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে তিনি গড়ে ওঠেন। যোগাযোগ ও প্রযুক্তিবিহীন সে যুগে রাজিয়ার মতো বিরল প্রতিভাধারীর অন্দরমহলে বেড়ে ওঠা বিস্ময়েরই ছিল। তার সাহসিকতা এবং মেধায় মোহিত হতেন স্বয়ং সুলতান ইলতুিমশ। আদর সোহাগে তিনি রাজিয়াকে ভালোবাসতেন ছেলেদের চেয়েও বেশি। বাবার শাসনকাজের প্রতি মেয়ের আগ্রহ  পরিলক্ষিত হতো সব সময়। তাই পড়ালেখার পাশাপাশি সমরবিদ্যা এবং শাসনকার্য পরিচালনার নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে তিনি রাজিয়াকে নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন।

 

প্রতিবাদী

সুলতানা রাজিয়ার ভাই তরুণ শাসক সুলতান রুকনুদ্দীন অশ্লীলতা ও অনৈতিকতার সাগরে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। তার এসব অন্যায় ও বর্বরতার মুখে প্রাণভয়ে সবাই চুপ থাকলেও অন্দর মহল থেকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন রাজিয়া। সে সময় সবাই সাদা পোশাক পরতেন। কিন্তু বাবা ইলতুিমশ প্রচলন করেন, নির্যাতিতরা রঙিন জামা পরে মসজিদে গিয়ে নিজের সমস্যার কথা তুলে ধরবেন। এই রীতি অনুযায়ী এক শুক্রবারে রাজিয়া একটি লাল রঙের জামা পরে মসজিদে গেলেন। তাকে দেখে আশপাশের লোকজন জড়ো হলেন। রাজিয়া তাদের সবার কাছে ভাইয়ের কুকর্ম তুলে ধরেন। বাবার সুনাম রক্ষার জন্য নিজের পক্ষে সাহায্য চাইলেন। সমবেত সবাই রাজিয়ার পাশে থাকার শপথ নিলেন। তখনই সবাইকে নিয়ে প্রাসাদ অবরোধ করে সুলতান রুকনুদ্দীনকে পদচ্যুত করলেন। এরপর সুলতানের আসনে বসে আপন ভাইকে হত্যার অভিযোগে রুকনুদ্দীনকে মৃত্যুদণ্ড দিলেন।

 

বিস্ময়কর উত্থান

পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে একজন নারী অপরিসীম দক্ষতা এবং অসীম দৃঢ়তায় সব প্রতিকূলতা জয় করে তুলে ধরলেন সাহসিকতার মশাল। ১২৩৬ সালের এই ঘটনায় শুধুই পাকভারত এবং আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ইতিহাস নয়, গোটা পৃথিবী এবং ইসলামের ইতিহাসে একজন রমণীর এমন বিস্ময়কর উত্থান আজও অমলিন।

সে সময় দিল্লির সর্বত্র তুর্কিদের প্রভাব প্রতিপত্তি থাকায় সুলতানা রাজিয়াকে সবাই নিরঙ্কুশভাবে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। তারপরও সব প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে প্রায় চার বছর ধরে গোটা সাম্রাজ্য শাসন করেছিলেন সুলতানা রাজিয়া।

 

পুরুষের পোশাক পরে সিংহাসনে

যেদিন আমির-উমারা এবং প্রজারা তার নেতৃত্ব মেনে নিলেন, সেদিন থেকেই যেন রাজিয়া বদলে গেলেন। সুলতানা একজন নারী হয়েও পুরুষের পোশাক পরে  সিংহাসনে বসেছেন। বাবার মতো তিনিও ন্যায় ও সাম্যের বিজয় নিশ্চিত করার আদেশ দিলেন প্রশাসনের সর্বত্র। সুলতানা রাজিয়া এখানেই থামেননি। নারীসুলভ আচার-আচরণ ও স্বভাব-প্রকৃতি বাদ দিয়ে তিনি শক্ত হাতে হাল ধরলেন সাম্রাজ্যের। সেকালের প্রথা ও প্রচলন ডিঙিয়ে তিনি ঘোষণা দিলেন, একজন সুলতান হিসেবে। তিনি তখন থেকে নিজের চেহারা অনাবৃত রেখে দরবারে হাজির হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। নিয়মমাফিক দরবারে এসে তিনি নিজেই সবার অভিযোগ শুনতেন, নিজেই সমাধান দিতেন।

 

দুঃসাহসী যোদ্ধা

কোথাও যুদ্ধের প্রয়োজন দেখা দিলে তিনি নিজেই সেনাবাহিনী নিয়ে রওনা হতেন এবং লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতেন। ইতিহাসে স্বীকৃতি মেলে, ‘সুলতানা রাজিয়ার শাসনামল হিন্দুস্তানের ইতিহাসে একটি অন্যতম সফল অধ্যায়।’ এতকিছুর পরেও প্রজাদের অনেকে নারী নেতৃত্ব মেনে নিতে পারছিলেন না। শেষে তাকেও ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়।

 

ট্র্যাজেডি

মেয়ে রাজিয়াকে সুলতানি ভার বুঝিয়ে গেলেও ইলতুিমশের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় টানাপড়েন দেখা দেয়। সুলতানা রাজিয়ার এক ভাই রুকনুদ্দীন ফিরোজ শাসনভার কেড়ে নেয়। এভাবে প্রায় সাত মাস চলার পর ১২৩৬ সালে দিল্লির জনগণের সাহায্যে রাজিয়া সুলতানা আবার ক্ষমতায় আরোহণ করেন। সাম্রাজ্যে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার সঙ্গে শাসনকার্য দৃঢ়ভাবে পালন করেন। ব্যক্তিগত বিশ্বস্ত কর্মকর্তা হিসেবে রাজিয়া জালাল উদ্দিন ইয়াকুত নামক একজন ইথিওপিয়ান দাসকে নিয়োগ দেন। এ কারণে তুর্কিরা হিংসায় পড়ে রাজিয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নামেন। ১২৩৯ সালে লাহোরের তুর্কি গভর্নর বিদ্রোহ করে বসেন। সেবারের মতো রাজিয়া শক্তহাতে বিদ্রোহ প্রতিহত করতে সক্ষম হন। তার কিছুদিন পর ভাতিন্ডার গভর্নর বিদ্রোহ করেন। তখন রাজিয়াকে পরাজিত করে মসনদ থেকে নামিয়ে দেন। এবার সুলতান হয় রাজিয়ার ভাই বাহারাম। ক্ষমতা ফিরে পাবার জন্য রাজিয়া বুদ্ধি গোছাতে থাকেন। শেষমেশ ভাতিন্ডার গভর্নরকে বিয়ে করে সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু তাতেও শেষ ঠেকাতে পারেননি রাজিয়া সুলতানা। ক্ষমতা দখলের যুদ্ধে রাজিয়া সুলতানা পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ১২৪০ সালে পলায়নকালে এক ভৃত্য তাকে খাদ্যে বিষ দিয়ে হত্যা করেন।

সর্বশেষ খবর