রবিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

দ্রোহ ও প্রেমের কবি নজরুল

রণক ইকরাম

দ্রোহ ও প্রেমের কবি নজরুল

প্রতিকৃতি: এম. এ কুদ্দুস

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, গণমানুষের কবি, বিদ্রোহী কবি, সাম্যবাদী কবি। ১৮৯৯ থেকে ১৯৭৬, বর্ণাঢ্য জীবন গড়েন তিনি। যার পুরোটাই ছিল হাজারো বৈচিত্র্যে ভরা। রুটির দোকানের কর্মচারী, সেনাবাহিনীর হাবিলদার এবং পরবর্তীতে তার সৃষ্টিশীল লেখক জীবন। বৈচিত্র্যময় তার জীবন। জীবনের একটি বড় অংশজুড়ে আছে বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর গণমানুষের অধিকার আদায়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। নজরুলের প্রয়াণ উপলক্ষে আজকের বিশেষ আয়োজন।

 

 

তিনি উচ্চকণ্ঠ, দ্রোহে ও প্রেমে, কোমলে-কঠোরে বাংলা সাহিত্য ও সংগীতের রূপকার। জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। বাবা কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন। ১৯৭২ সালের ২৪ মে স্বাধীন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। তাকে দেওয়া হয় জাতীয় কবির মর্যাদা। সেই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আজ মৃত্যুবার্ষিকী।

নজরুলের ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। ১৯০৮ সালে পিতার মৃত্যু হলে পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়ভার আসে তার ওপর। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়েও কবি কখনো আপস করেননি। মাথা নত করেননি লোভ-লালসা, খ্যাতি, অর্থ, বিত্ত-বৈভবের কাছে। এদিকে ছেলেবেলা থেকেই গান বাজনায় ঝোঁক ছিল নজরুলের। তাই নামমাত্র লেখাপড়া করে স্থানীয় ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দেন। কিছুদিন গান করার পর তার মনে হলো, এরকম গান তো তিনি নিজেও বানাতে পারেন। তাই গান লেখা শুরু করলেন। অত অল্প বয়সে লেখা গানের কথা ও ভঙ্গি অনেকের নজর কেড়েছিল, তাদের মধ্যে বেশ একটা কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছিল। মুশকিল হলো তার থেকে তেমন কোনো আয় হচ্ছিল না। আর আয়ে কুলাচ্ছিল না বলে ওই বয়সেই তিনি গ্রামের হাজী পাহালওয়ান শাহের মসজিদে খাদেমগিরি শুরু করে দেন। তিনি গ্রামের মক্তবে প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। মক্তবে পড়াশোনা আর মসজিদে মোয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করে নজরুল শৈশবেই ইসলাম ধর্ম শিক্ষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এই শিক্ষাই নজরুলের পরবর্তী জীবনে বাংলা সাহিত্য ও সংগীতে ইসলামী ঐতিহ্যের রূপায়ণে তা বেশ সহায়ক হয়েছিল।

নজরুল আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন শোষিত-বঞ্চিত-লাঞ্ছিত মানুষের মুক্তির জন্য। মানবতার মুক্তির পাশাপাশি তিনি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন। তার রচিত ‘চল্ চল্ চল্’ গানটি আমাদের রণসংগীত। তিনি যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনি জীবনেও।

নজরুল সাহিত্যকর্ম এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলায় পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ এবং দেশি-বিদেশি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। এ কারণে ইংরেজ সরকার তার একাধিক গ্রন্থ ও পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করেছিল। এমনকি  তাকে কারাদণ্ডে দণ্ডিতও করেছিল ব্রিটিশরা। নজরুলও আদালতে লিখিত রাজবন্দীর জবানবন্দি দেন। এরপর প্রায় চল্লিশ দিন একটানা অনশন করে ইংরেজ সরকারের জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। একবার কুমিল্লা থেকে ফেরার পথে নজরুল বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের সৃষ্টি করেছিলেন। সময়টা তখন ছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাস। সাহিত্য দুটি হলো, ‘বিদ্রোহী’ ও ‘ভাঙ্গার গান’। ১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই বাংলা কাব্যে নতুন বাঁক সৃষ্টি করেছিলেন। শুধু কবিতাতেই নয়, গান রচনায় অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন নজরুল। প্রায় তিন হাজার গান রচনা ও সুর করেছেন তিনি। নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন ধ্রুপদী ধারার সঙ্গে। রাগনির্ভর গানকে ভেঙেচুরে সাধারণের কাছে সহজবোধ্য ও শ্রুতিমধুর করে তুলেছেন। এক রাগের সঙ্গে অন্য রাগের মিলন ঘটিয়ে সংগীতযজ্ঞে নিয়ে এসেছিলেন এক নতুন ধারা। তিনি অসংখ্য ছোটগল্প, উপন্যাস, গান, নাটক লিখলেও কবি হিসেবেই পরিচিতি পান বেশি। নজরুলকে ‘বিদ্রোহী কবি’ ভূষিত করা হয়। তিনি তার কবিতার পঙিক্তমালায় তুলে ধরেন নিপীড়িত অবহেলিত মানুষের কথা। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাজী নজরুলকে ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি তাকে দেওয়া হয় একুশে পদক। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো ভালো কাটেনি। অসুস্থ হয়ে পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট, রবিবার ঢাকার পিজি হাসপাতালে নজরুল ৭৭ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। নজরুল তার এক কবিতায় লিখেছিলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই’। তাই তো নজরুলের মৃত্যুর পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আমাদের জাতীয় জাগরণে নজরুলের ভূমিকা অনবদ্য। ক্রান্তিকালে তাই বার বার নজরুল ফিরে ফিরে আসেন। এ কারণেই তিনি চিরঞ্জীব।

 

 

প্রেমিক নজরুল

তোমাকে লেখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক। যেখানেই থাকি, বিশ্বাস করো, আমার অক্ষয় আশীর্বাদ কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে। তুমি সুখী হও, শান্তি পাও এই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস করো, আমি তত মন্দ নই এই আমার শেষ কৈফিয়ত।’’

 

কাজী নজরুল ইসলামের যৌবনের কিছু সময় কাটে কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুরে। প্রায় ১১ মাসেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন কবি। নজরুল ১৯২১ সালের এপ্রিলে কুমিল্লার দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাড়িতে অতিথি হয়ে আসেন। সেখানে বাড়ির পাশের কামরাঙাতলায় বাঁশিতে সুর তুলে, আর পুকুরঘাটে বসে কবিতা লিখে লিখে সময় কেটেছে তার। নজরুলের প্রথম প্রেম সৈয়দা খানম (নজরুল তাকে নাম দেন নার্গিস, ফারসি ভাষায় যার অর্থ গুল্ম)। তিনিও দৌলতপুর গ্রামের মেয়ে ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকালে নার্গিসের মামা ক্যাপ্টেন আলী আকবর খানের সঙ্গে পরিচয় হয় নজরুলের। ১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষ হয়। কবি তখন মুসলিম সাহিত্য সমিতির (কলকাতা) অফিসে আফজাল-উল হকের সঙ্গে থাকতেন। তখন আলী আকবর খানের সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। আকবর খান নজরুলের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে কুমিল্লায় নিজের গ্রামের বাড়ি ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানান। আলী আকবর খানের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে কলকাতা থেকে ১৯২১ সালের ৩ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেইলে নজরুল কুমিল্লা এসে পৌঁছান। যাওয়ার পথে তিনি ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতাটি লেখেন। ট্রেনে কুমিল্লা পৌঁছে নজরুলকে নিয়ে আলী আকবর তার স্কুলের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় ওঠেন। চার-পাঁচ দিন সেখানে কাটিয়ে কবি রওনা দেন দৌলতপুরের উদ্দেশে। সেই চার-পাঁচ দিনেই সেনবাড়ির সবাই বিশেষ করে বিরজা দেবীর সঙ্গে নজরুলের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। নজরুল তাকে ‘মা’ সম্বোধন করতেন।

দৌলতপুরে নজরুলকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বাড়ির জ্যেষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে খুব গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। কবিতা শুনিয়ে, গান গেয়ে তাদের তো বটেই দূর-দূরান্ত থেকেও লোকজন ছুটে আসত কবির নৈকট্য লাভের আশায়। আলী আকবর খানের বোন আসমাতুন্নেসার বিয়ে হয়েছিল খাঁ বাড়ির পাশেই। অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ থাকায় আসমাতুন্নেসা তার ভাইয়ের বাড়িতে তেমন সমাদর পেতেন না। আসমাতুন্নেসা স্বামী মুনশি আবদুল খালেক ও একটি মেয়ে রেখেই মৃত্যুবরণ করেন। আর সেই মেয়েটিই কবি নজরুলের প্রথম প্রেম নার্গিস। তার সঙ্গে কবির আলোচনার সূত্রপাত ঘটেছিল কবির বাঁশি বাজানো নিয়ে। এক রাতে কবি খাঁ বাড়ির দিঘির ঘাটে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, সেই বাঁশির সুরে মুগ্ধ হন নার্গিস। খাঁ বাড়ির মুরব্বিরা নার্গিসের বর হিসেবে নজরুলকে পছন্দ করতেন না। নজরুলকে তারা বাউণ্ডুলে হিসেবেই দেখেছিলেন। কিন্তু গ্র্যাজুয়েট আলী আকবরের জন্য প্রতিবাদ করতেন না। এক পর্যায়ে খোদ নজরুলই বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। একদিন নার্গিস নজরুলের কাছে এসে বললেন, ‘গত রাতে আপনি বাঁশি বাজিয়েছিলেন? আমি শুনেছি।’ এভাবেই প্রেমের সূত্রপাত। আলী আকবর খান নজরুল-নার্গিসের বিয়ের আয়োজন করলেন জাঁকজমকের সঙ্গে। তার অতি আগ্রহ ও নার্গিসের কিছু আচরণ নজরুলকে এই বিয়ের প্রতি বিতৃষ্ণা করে তোলে। সম্পর্কের অবনতি হয় যখন কাবিননামায় আলী আকবর একটি শর্ত রাখতে চাইলেন— ‘বিয়ের পরে নজরুল নার্গিসকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবেন না, দৌলতপুরেই তার সঙ্গে বাস করবে।’ এ অপমানজনক শর্ত মেনে না নিয়ে কবি বিয়ের মজলিশ থেকে উঠে গিয়েছিলেন। তার মানে, নার্গিস বেগমের সঙ্গে নজরুল ইসলামের ‘আকদ’ বা বিয়ে একেবারেই হয়নি।

১৩২৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ আষাঢ় বিয়ের দিন ধার্য করা হয়। এরপর শুরু হয় নাটকীয়তা। আলী আকবর তার গ্রাম্য ভগিনীকে বিখ্যাত কবি নজরুলের জন্য গড়তে নেমে পড়লেন। অশিক্ষিত নার্গিসকে খুব কম সময়ে শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব ছিল না। কিন্তু তিনি শরত্চন্দ্র ও অন্যান্য সাহিত্যিকের উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলো থেকে নার্গিসকে জ্ঞান দিতে থাকলেন। নার্গিস কবির প্রথম স্ত্রী নন, তিনি নজরুলের বাগদত্তা। প্রমীলাই কাজী নজরুলের প্রথম ও একমাত্র স্ত্রী।

১৩২৮ বঙ্গাব্দের ৩ আষাঢ় নার্গিস-নজরুলের আকদ হওয়ার কথা ছিল। কাজী নজরুল ৩ আষাঢ় রাতে দৌলতপুর ছেড়ে ৪ আষাঢ় সকালে কুমিল্লায় এসে পৌঁছান। নার্গিস পরবর্তীতে তাদের ভুলগুলো বুঝতে পেরে প্রায় ১৫ বছর পর নজরুলকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠির উত্তরে নজরুল একটি চিঠি ও গান পাঠিয়েছিলেন, যাতে চিঠির উত্তরটি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছিল। নজরুল বিয়েতে তার পক্ষের অতিথি হিসেবে বিরজাসুন্দরী দেবী ও তার পরিবারকে মনোনীত করেন। বিয়ের আগের দিন সবাই দৌলতপুরে এসে উপস্থিত হন। কলকাতায় নজরুলের বন্ধুদের এমন সময় দাওয়াত দেওয়া হয় যেন কেউ আসতে না পারে। কবির অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু কমরেড মোজাফফর আহমেদ নিমন্ত্রণপত্র পান বিয়ের পরে। যতদূর জানা যায়, ৩ আষাঢ় আকদ সম্পন্ন হয়। কিন্তু কাবিনের শর্ত উল্লেখ করার সময়ই ঝামেলা বাধে। আকদ হয়ে যাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক অন্যান্য কাজে যখন সবাই ব্যস্ত তখন নজরুল অন্তর্দ্বন্দ্বে বিক্ষুব্ধ। তিনি ছুটে যান বিরজাসুন্দরী দেবীর কাছে। তাকে বলেন, ‘মা, আমি এখনই চলে যাচ্ছি।’ বিরজাসুন্দরী দেবী বুঝতে পারেন এ অবস্থায় নজরুলকে ফেরানো সম্ভব নয়। তিনি তার ছেলে বীরেন্দ্রকুমারকে নজরুলের সঙ্গে দিয়ে দেন। সেই রাতে দৌলতপুর থেকে কর্দমাক্ত রাস্তা পায়ে হেঁটে নজরুল ও বীরেন্দ্রকুমার কুমিল্লা পৌঁছান।

পরিশ্রম ও মানসিক চাপে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। নজরুলের জীবনে নার্গিস অধ্যায় সেখানেই শেষ হয়। শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে সংগীতচর্চা এবং একটা সুসম্পর্ক ছিল কবির। সেই সূত্রে কুমিল্লার কান্দিরপাড়ের ইন্দ্রকুমার সেনের বাড়িতে ১৯২১ থেকে ১৯২৩ সালের বিভিন্ন সময়ে অবস্থান করেন কবি। সেখানেই ইন্দ্রকুমারের ভাইয়ের মেয়ে আশালতা সেনগুপ্তা ওরফে প্রমীলা দেবীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়, যা পরে পরিণয়ে রূপ নেয়।

 

 

হাবিলদার নজরুল

শাহের মসজিদে খাদেমগিরিতে কবির সুবিধা হচ্ছিল না দেখে তিনি মিলিটারিতে যোগ দেন। ওই ইউনিটের নাম ছিল ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগ থেকে ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক করপোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। স্কুলের পড়াশোনার সুযোগ না হলেও জ্ঞান আহরণের অদম্য ইচ্ছা ছিল তার। তাই কাজের ফাঁকে খোঁজাখুঁজি করে সেখানে একজন জ্ঞানী পাঞ্জাবি মৌলভী সাহেবের সন্ধান পান। তার কাছ থেকে দেওয়ান-ই-হাফিজ ও ফারসি ভাষার আরও নানা মূল্যবান কাব্যগন্থের সংস্পর্শে আসেন। বিষয়গুলোর ওপর শিক্ষা লাভ করার বিরল সৌভাগ্য তিনি অর্জন করেন। এভাবেই তিনি পৃথিবীর অন্যতম প্রথম সারির মহৎ সাহিত্যের সংস্পর্শে আসেন। এ ছাড়া সহ- সৈনিকদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সংগীতের চর্চা অব্যাহত রাখেন, আর গদ্য-পদ্যের চর্চাও চলতে থাকে একই সঙ্গে। করাচি সেনানিবাসে বসে নজরুল যে রচনাগুলো সম্পন্ন করেন তার মধ্যে রয়েছে— বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী (প্রথম গদ্য রচনা), মুক্তি (প্রথম প্রকাশিত কবিতা); গল্প : হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধি ইত্যাদি। সেনানিবাসে থাকা সত্ত্বেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। নজরুলের সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি চলে করাচি সেনানিবাসেই। সৈনিক থাকা অবস্থায় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।

সর্বশেষ খবর