শনিবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

সেই কেজিবি এখন

সেই কেজিবি এখন

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা বাহিনী কেজিবি। কেজিবির তত্পরতা ছিল বিশ্বজুড়ে। তাদের গুপ্তচরবৃত্তি আর গোপন কার্যক্রম নিয়ে তোলপাড় চলে সর্বত্র। সবার চোখের সামনে থেকেও যেন অদৃশ্য ছিল এই গোয়েন্দারা। সেই কেজিবি এখন নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গড়ে উঠেছে রাশিয়া। বিশ্বের অন্যতম সামরিক শক্তিধর দেশ রাশিয়ার গোয়েন্দা বাহিনী এখন এফএসবি। কেজিবি থেকে এফএসবি এখন আরও দুর্ধর্ষ। এ নিয়েই লিখেছেন— তানিয়া তুষ্টি

 

কেজিবির গঠন

১৯১৭ সালের ২০ ডিসেম্বর ‘কম্যুটেট গসুডারস্টভেনয় বিজোপাসনিস্টি’ বা কেজিবি গঠিত হয়। রুশ ভাষার কেজিবি ইংরেজিতে দাঁড়ায় ‘কমিটি ফর স্টেট সিকিউরিটি’, বাংলায় ‘রাজ্য নিরাপত্তার জন্য কমিটি’। প্রতিষ্ঠাকালীন কেজিবির চেয়ারম্যান ছিলেন ফিলিক্স এডমাউন্ডভিচ জারসিংকি। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্তি ঘোষণার আগ পর্যন্ত ২০ জন চেয়ারম্যান কেজিবির দায়িত্বে ছিলেন। এর সর্বশেষ চেয়ারম্যান ছিলেন ভাডিম ভিক্টোরোভিচ বাকাটিন। ১৯৯১ সালের ২৩ আগস্ট কেজিবির ১৯তম চেয়ারম্যান কর্নেল জেনারেল ক্রাইচকভকে ব্যর্থতার দায়ে গ্রেফতার করে ভাডিম ভিক্টোরোভিচ বাকাটিনকে চেয়ারম্যান করা হয়। ভাডিম ভিক্টোরোভিচ বাকাটিনকে কেজিবির কার্যক্রম গুটিয়ে আনতে বলা হয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কেজিবির কার্যক্রম গুটিয়ে আসে। একই বছর ৬ নভেম্বর অফিশিয়ালি কেজিবির কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৫ সালের ২১ ডিসেম্বর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলিসন রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য এফএসবি নামে অপর একটি গোয়েন্দা সংস্থা গঠন করেন। অবশ্য কেজিবির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই এফএসবির কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। কেজিবিকে কমিউনিস্ট পার্টি অব সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘সোর্ড অব শিলড’ বলা হতো। তখনকার দিনে কেজিবির পক্ষে নিশ্চিন্তে কাজ করা সম্ভব ছিল না। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটি এজেন্সি সিআইএ। তবে প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সিকিউরিটি এজেন্সি এফবিআই, ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি, ফেডারেল প্রোটেকটিভ সার্ভিস ও সেক্রেট সার্ভিস ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যৌথ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই ফাইভ এবং যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা এমআই সিক্স-এর অভ্যন্তরে কেজিবি পরোক্ষভাবে তার গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করত।

 

কেজিবির সফলতা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখে কেজিবি। সমাজতান্ত্রিক দেশে প্রায় ৩ হাজার শিল্পসংস্থা নির্মাণ, পুনর্গঠন ও সম্প্রসারণে কৌশলগত সহায়তা দেওয়া হয়। বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও কৌশলগত বন্ধন ছিল অত্যন্ত মজবুত। উন্নয়নশীল দেশগুলোর সহযোগিতায় হাত বাড়িয়ে দেয়। ভারত, আলজেরিয়া, এঙ্গোলা, ইথিওপিয়াসহ অনেক দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভ ও সামাজিক উন্নয়নে সহায়তা দিয়েছে এই দেশ। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাকৃতিক সম্পদভার বিশাল ছিল। অফুরান সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহারে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিবিধ ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছিল। কিন্তু কিছু অনিয়ম আর অবহেলায় মাত্র ৭০ বছরের মাথায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়। বিশ্ববাসী হয়তো এটা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। মাত্র কিছু দিনের মধ্যেই ইয়েলিসনের উত্থান হয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মানচিত্র মুছে যায়। অথচ বিশ্বের একসময়ের সবচেয়ে বড় দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নকে বহিঃশক্তির হাত থেকে রক্ষার জন্যই গঠন করা হয়েছিল কেজিবি নামের গোয়েন্দা সংস্থাটি। অল্পদিনে ঐতিহ্য, সুনাম আর সফলতার শীর্ষে পৌঁছায়। অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে কেজিবি সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিশ্বের পরাশক্তিতে পরিণত করতে সফল হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে সিআইএ, এফবিআই কিংবা মোসাদের সম্মিলিত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কাছে।

 

কেজিবি এখন এফএসবি

রাশিয়ার বর্তমান গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবির পূর্বসূরি ছিল দুনিয়া কাঁপানো গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি। রুশ ভাষায় একে ফেডারেলনায়া সুলঝবা বেজপাসনোস্তি রাশিস্কয় ফেডেরাটসি বলা হয়। এটি গঠিত হয় ১৯৯৫ সালের ১২ এপ্রিল। এফএসবির কর্মী সংখ্যা আনুমানিক ৩ লাখ ৫০ হাজারের মতো। এফএসবির সদর দফতর রাশিয়ার মস্কো শহরের ল্যুবিয়াঙ্কা স্কোয়ারে। এর জবাবদিহিতা প্রেসিডেন্ট রাশিয়ান ফেডারেশন। এফএসবির সাহায্যকারী সংস্থার নাম গ্রু। এফএসবির মোট ১০টি বিভাগ রয়েছে। এফএসবির মূল দায়িত্ব বৈদেশিক গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স পরিচালনা, গুপ্তহত্যা, বর্ডার সার্ভেইল্যান্স, রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ, কাউন্টার টেররিজম, নিজস্ব লোক সংগ্রহ ও নেটওয়ার্ক তৈরি, বিদেশি কূটনীতিকদের ওপর নজরদারি। জরুরি প্রয়োজনে রাশিয়ার সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করে এফএসবি দিকনির্দেশনা অনুযায়ী। এ ছাড়াও বিদেশি স্পাইদের রাশিয়ায় গোপন কার্যক্রম প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান, অস্ত্রের চোরাচালান রোধ করতে কাজ করে। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এফএসবির সব দুর্ধর্ষ স্পাই যারা নিয়মিত এফএসবিকে গোপন তথ্য সরবরাহ করে যাচ্ছে।

 

দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা দল

প্রতিষ্ঠা লাভের কিছুদিনের মধ্যে বৃহৎ ক্ষমতাসম্পন্ন ও কার্যকর গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে কেজিবির আত্মপ্রকাশ ঘটে। যে কোনো দেশকে টার্গেট করে বৈধ ও অবৈধ সব ধরনের কার্যক্রম চালাত। উদ্দেশ্য একটিই ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্য সমাজতান্ত্রিক দেশের নিরাপত্তা সুসংহত রাখা। কেজিবি নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে গোয়েন্দাগিরির জন্য বিদেশে অবস্থিত নিজেদের দূতাবাসকে ব্যবহার করত। সোভিয়েতের দূতাবাসগুলো দায়িত্ব হিসেবে টার্গেট দেশে বিশ্বস্ত গোয়েন্দা বাছাই করত। যারা কমিউনিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী হতেন তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সেসব প্রশিক্ষিত লোককে বসানোর চেষ্টা থাকত কেজিবির। শুধু তাই নয়, এসব মানুষকে বিভিন্নভাবে আর্থিক সহায়তা ছাড়াও প্রযুক্তিগত সহযোগিতাও করত এই কেজিবি। সমাজতান্ত্রিক লোক তৈরির কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৪৯ সালের ২৩ আগস্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ‘মলোটোভ-রিবেনট্রোপ’ চুক্তি করে। চুক্তির ভিত্তিতে কোল্ড ওয়ারের পর তাদের কার্যক্রম আরও বিস্তৃতি লাভ করে। টার্গেট দেশের বৈধ অধিবাসীদের দিয়ে চারটি ভিন্ন বিভাগে অপারেশন চালাতে থাকে কেজিবি। এগুলো হলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক কৌশল ও তথ্যের বাইরে থেকে যায় এমন সব কাজের বিভাগ। কেজিবির এসব বিভাগের বিভিন্ন কাজকে কেজিবি পিআর লাইন, কেআর লাইন, এক্স লাইন, এন লাইন, ইএম লাইন নামে আখ্যায়িত করা হয়। কেজিবি নিজেদের কাজের ব্যাপারে এতটাই কৌশলী ছিল যে টার্গেট দেশে অবৈধ অধিবাসীদের কখনো এক কেন্দ্রের অধীনে রাখেনি। তবে বৈধ অধিবাসীদের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে একত্রিত রাখত। পশ্চিমা দেশগুলোতে কেজিবি স্পাইদের এজেন্টদের অধীনে কাজ করাত। স্পাইরা এজেন্টদের কাছে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য সরবরাহ করত। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্টের নাম ছিল ক্যামব্রিজ ফাইভ। অবশ্য এরা কেউই কেজিবির কর্মকর্তা নয়। এমনকি কর্মকর্তা দাবি করাও তাদের জন্য অপরাধের শামিল ছিল। ১৯২৩ সালে স্টেট পলিটিক্যাল ডিরেক্টরেট, ১৯৪১ সালে পিপলস কমিসারিয়্যাট ফর স্টেট সিকিউরিটি এবং ১৯৪৬ সালে মিনিস্ট্রি অব স্টেট সিকিউরিটি চেকা থেকেই করা হয়। অবশ্য এসব সংস্থাও কেজিবির সংগঠন নামেই বেশি পরিচিত ছিল। কেজিবির কার্যক্রমই এরা সুসংঘবদ্ধভাবে বাস্তবায়ন করত।

 

নিষ্ঠুরতার ধরন

কেজিবি নিজেদের কাজ সম্পাদনের জন্য ব্যবহার করত আলাদা কৌশল। প্রয়োজনে হয়ে উঠত কঠোর। এ কাজ পরিচালনা করত সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সেক্রেটারি নিকিতা খ্রুসেহেভ। তিনি ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি এবং ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিনি একই সঙ্গে পার্টির সেক্রেটারির দায়িত্বও পালন করেন। অ-সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো কেজিবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেই তাদের ওপর নেমে আসত নির্দয় আচরণ। নিকিতা খ্রুসেহেভ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং কেজিবি বিপক্ষীয়দের নানা অজুহাতে গ্রেফতার ও নির্যাতন করা হয়। এটা কেজিবির অন্যতম একটি রুটিন কাজ ছিল। তাদের বিরুদ্ধে গবেষণা প্রতিবেদন, বই অথবা খবর প্রকাশ করলে কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো। ১৯৬৫ সালে আন্দ্রেয় সিনইয়াভস্কি ও আই ইউলি দানিয়েল নামের মস্কোর দুই লেখক ছদ্মনামে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে দেশের বাইরে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পরে তাদের গ্রেফতার ও বিচারের সম্মুখীন করে কেজিবি। এর প্রক্রিয়ায় সফল হলে ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত চেকোশ্লোভাকিয়াকে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করা হয়। যাকে প্রাগ স্প্রিং বলা হয়। এ সময়ে কেজিবির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি এন্ড্রোপভ।

 

স্নায়ুযুদ্ধে কেজিবির ভূমিকা

স্নায়ুযুদ্ধের আগে কেজিবির সমর্থন ছিল ব্রিটেন ও ইউরোপের অন্য দেশগুলোর প্রতি। তবে ১৯৩৫ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী নাগরিকদের বরিস বাজারভ ও অস্থায়ী নাগরিকদের ইসখাখ আখমেরভের অধীনে কেজিবির স্পাই করা হয়। ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নেতা ও কর্মকর্তা, সেনা ও প্রযুক্তিগত বিষয়ে গোয়েন্দা তত্পরতা চালানো হতো। তবে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ওপর কেজিবির নজরদারি ছিল বেশি। এ সময়ের মধ্যে কেজিবি প্রযুক্তিগত বিষয়ে উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করে। ১৯৪১ সালে তাদের বিশ্বস্ত স্পাই ও ব্রিটিশ পদার্থ বিজ্ঞানী ক্লাউচ ফুসকে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম আণবিক বোমা তৈরির প্রজেক্ট ম্যানহাটন প্রজেক্টের দায়িত্ব দেয়। তার তত্ত্বাবধানে ম্যানহাটন প্রজেক্টে কেজিবির অনেক স্পাই নিয়োগ পায়। ১৯৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আণবিক গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ দলিল সোভিয়েত ইউনিয়নে পাচার হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পর পর্যন্ত কেজিবি দাপটের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে তার গোয়েন্দা তত্পরতা পরিচালনা করে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কেজিবির প্রতিদ্বন্দ্বী গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ব্যাপক তত্পরতা শুরু করে। তাদের বিপরীতে গিয়ে  কেজিবি অনেক ক্ষেত্রেই সফল হতে পারেনি। এ সময় টার্গেট দেশের স্থায়ী নাগরিকরা বেশি সফল হয়েছে। বিভিন্ন দেশে তাদের টিম পরিচালনায় ব্যয় বেড়ে যায় অনেক বেশি। সংকটকালীন এই মুহূর্ত কাটিয়ে তোলা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে নেমে আসে বিপর্যয়।

 

দেশে দেশে সিক্রেট সার্ভিস

রাশিয়ার ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সময়ের ব্যবধানে গুপ্তচর সংস্থার নাম পরিবর্তন হয়। সোভিয়েত সময়ে প্রথম যে এজেন্সিটি ছিল তার নাম ছিল চেকা। পরে চেকা হয়েছিল কেজিবি। পরবর্তীকালে সোভিয়েত জামানার শেষে রাশিয়ায় নতুন সিক্রেট সার্ভিস এজেন্সির জন্ম হয়। যার নাম হয় এফএসবি। সেই হিসেবে কেজিবিকে অনেকেই এফএসবির পূর্বসূরি বলে থাকেন। আমেরিকার সিআইএ এফএসবির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী।

এমআই সিক্স ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থা। মিলিটারি ইন্টেলিজেন্ট সিক্স নামে এই সংস্থাকে সংক্ষেপে এমআই সিক্স বলা হয়। প্রযুক্তির ব্যবহারে এমআই সিক্সের তুলনা নেই। ইসরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদও সারা বিশ্বে একটি প্রথম সারির গুপ্তচর সংস্থা। তালেবান জঙ্গিদের নিকেশে মোসাদের বহু কোভার্ট অপারেশন সাফল্য পেয়েছে। তালেবান জঙ্গিদের কাছে দুঃস্বপ্নের নাম মোসাদ। ‘র’ বা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং। দক্ষতার জন্য সারা বিশ্বে ভারতের এই গুপ্তচর সংস্থার সুনাম রয়েছে। পাকিস্তানের আইএসআই ‘র’-এর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। ১৯৬৮ সালে ‘র’-এর জন্ম। স্মাইলিং বুদ্ধ, মেঘদূত, চাণক্যর মতো একাধিক অপারেশনে সাফল্যের জন্য ‘র’কে বিশ্বের প্রথম সারির গুপ্তচর সংস্থা হিসেবে ধরা হয়। কমিউনিস্ট দেশ চীনের গুপ্তচর সংস্থা এমএসএস তার বিশাল ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্কের জন্য বিশ্বজোড়া সুনাম রয়েছে। ভারত, আমেরিকা এবং জাপানের মতো দেশগুলোতেই এমএসএস এজেন্টরা সব থেকে বেশি সক্রিয় বলে ধরা হয়। ডাইরেক্টর জেনারেল ফর সিকিউরিটি এক্সটারনাল, ফ্রান্সের গোয়েন্দা সংস্থা। ১৯৮২ সালে তৈরি ফ্রান্সের এই সিক্রেট সার্ভিস এজেন্সি মধ্য আফ্রিকায় ফরাসি কলোনি তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল। তবে ইতিহাসের পাতায় বিখ্যাত ফোর্টিন জুলিয়েট অপারেশনে ব্যর্থতার দাগও লেগে আছে এই সংস্থার সঙ্গে।

ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স সংক্ষেপে আইএসআই পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা। ১৯৪৮ সালে তৈরি হয় এই সংস্থা। পাকিস্তান যে বিদেশনীতিই নিক না কেন তাতে আইএসআইয়ের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ এমনটাই ভাবা হয়।

 

কেজিবি টার্গেট

১৯৮৩ সালে টাইম ম্যাগাজিনের মতে কেজিবি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সংবলিত একটি গোয়েন্দা সংস্থা। এটি টার্গেট করা দেশে বৈধ বা অবৈধ উপায়ে নিজেদের অভিযান চালাতে সক্ষম ছিল। তারা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ল্যাটিন আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও স্ক্যান্ডেনিভিয়া, পশ্চিম জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, আয়ারল্যান্ড, চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া ও কম্বোডিয়া, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, আরব বিশ্ব, তুর্কি, গ্রিস, ইরান, আফগানিস্তান ও আলবেনিয়া, ফরাসি ভাষা প্রধান আফ্রিকান দেশ, ইংরেজি ভাষা প্রধান আফ্রিকান দেশ এবং ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাতে তাদের কাজ পরিচালনা হতো। এতে সহজেই অনুমেয় তাদের লোকবল সম্পর্কে। তবে বিশ্বের কোনো গোয়েন্দা সংস্থা নিজেদের প্রকৃত জনবল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা প্রকাশ করে না। এমনকি তাদের বাজেট সম্পর্কেও সব ধরনের তথ্য গোপন রাখে। কেজিবিও এই নীতি অবলম্বন করায় বিশ্ব মিডিয়া তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়নি। তবে ১৯৯০ সালে কেজিবির নিরাপত্তা বাহিনীর জনবল ৪০ হাজার ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে এটিও একদম নিশ্চিত তথ্য নয়।

 

মুসলিম দেশে ব্যর্থতা

কেজিবি সমাজতান্ত্রিকতার শিক্ষা দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে পারলেও মুসলিম দেশগুলোতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে শক্তিশালী রাষ্ট্র। বাথ পার্টির মাধ্যমে ইরাকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আশা করেছিল কেজিবি। কিন্তু বাস্তবতা ছিল প্রতিকূলে। নিজেরা খুব সুসংগঠিত হলেও ইরাকে কেজিবি প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। তাদের নিয়ন্ত্রণ উপেক্ষা করে ইরাক ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ফলে দৃশ্যত শত্রুতে পরিণত হয় যুক্তরাষ্ট্র। এই পরিস্থিতিতে তাদের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন শুরু করে কেজিবি। ১৯৮০ সালে কেজিবি চেয়ারম্যান এক গোপন সম্মেলনে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নে পারমাণবিক বোমা হামলা করবে। ফলে সোভিয়েত সৈন্যদের যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের গোপন পরিকল্পনার ওপর গোয়েন্দা তত্পরতা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে কেজিবি পারমাণবিক বোমা হামলার কথা নিশ্চিত করে। কিন্তু দেখা যায় কেজিবির এ ঘোষণা পুরোটাই ছিল ভুল। এরকম অনেক ভুল তথ্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয় কেজিবি। এদিকে অপর একটি মুসলিম দেশ আফগানিস্তান ছিল কেজিবির মাথাব্যথা। কেজিবি আফগানিস্তানে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে মুসলমানদের দমনের চেষ্টা করে। বলতে গেলে কেজিবির তত্পরতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল আফগানিস্তান। অন্যদিকে সিআইএ আফগানিস্তানের কিছু জঙ্গি গ্রুপকে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দিয়ে সোভিয়েত বিরোধিতায় উসকে দেয়। এ সময়ে সিআইএ ওসামা বিন লাদেন ও তালেবান তৈরি করে। শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিদায় নিতে হয়। এর পর থেকে শুরু হয় সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত অন্য দেশগুলোতে সমাজতন্ত্র বিরোধী ব্যাপক গণআন্দোলন।

 

তথ্য সমৃদ্ধ

চলমান সব ধরনের খবর জেনে নিজেদের আপডেট রাখত কেজিবি। তারা তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করত বিশ্বের বড় বড় মিডিয়া। বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যানেল, সরকারি প্রকাশনা, পরিসংখ্যান, সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে কেজিবির প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহে চোখ এড়াত না। তবে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে যারা ভিন্ন মত পোষণ করত তাদের কোনোমতেই দলে সম্পৃক্ত করত না। অবশ্য সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বাইরে ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্তদের স্পাই করা হতো। বিভিন্ন দেশের বড় রাজনীতিকদের সঙ্গে কেজিবি গোপনে যোগাযোগ রাখত। তাদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়ে সময়মতো ব্যবহার করত।

 

সোভিয়েত ইউনিয়নে কেজিবি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা থেকে যেসব দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে যেতে চেয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে কেজিবি দমনমূলক তত্পরতা চালায়। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তাদের তত্পরতা অব্যাহত থাকে। ১৯৫৬ সালে এই দমনের শিকার হয় হাঙ্গেরি। কেজিবির তৎকালীন চেয়ারম্যান ইভান সেরভের নির্দেশে সোভিয়েত রেড আর্মি সশস্ত্র হামলা চালায়। একইভাবে চেকোস্লোভাকিয়ায় ১৯৬৮ সালে রেড আর্মি হামলা করে। কিন্তু ১৯৮০ সালে সলিডারিটি মুভমেন্ট অব পোল্যান্ডের মাধ্যমে পোল্যান্ডে সফল হয়। এরপর একক দল গঠন করে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে পোলিশ ইউনাইটেড ওয়ার্কার্স পার্টিকে ক্ষমতায় আনে কেজিবি।

 

বিশেষ ইউনিট

কেজিবি নিজেদের কাজ সুন্দরভাবে পরিচালনায় গড়ে তুলেছিল বিশেষ কিছু ইউনিট। কেজিবি স্মল, এলিট ও স্পেটনাজ নামে বিভক্ত হয়ে কাজ করত। এই ইউনিটের ছিল অনেকগুলো গ্রুপ। গ্রুপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ছিল আলফা গ্রুপ। ১৯৭৪ সালে গঠিত এই গ্রুপ আফগানিস্তান ও চেচনিয়ায় অপারেশন চালায়। কেজিবির আর একটি গ্রুপকে ভেম্পল বা পেনান্ট বলা হতো। এটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৮১ সালে। এই গ্রুপের স্পাইরা কাজ করত যুদ্ধরত সৈন্যদের মধ্যে। এ ছাড়াও কাসকাড, জেনিট, গ্রুম ও স্পেটসগ্রুপ্পা বি নামে আরও কয়েকটি গ্রুপ ছিল। ভৌগোলিক ভিত্তিতে কেজিবিকে ১১টি বিভাগে ভাগ করে পরিচালনা করা হতো।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর