রবিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

দুর্ধর্ষ নারী যোদ্ধা

সাইফ ইমন

দুর্ধর্ষ নারী যোদ্ধা

কবির ভাষায়, নারী হেসে ওঠার আগে পৃথিবী ছিল বিষণ্ন, বাগান ছিল জঙ্গল আর পুরুষ ছিল সন্ন্যাসী। শতাব্দীর পর শতাব্দী সৌন্দর্য আর কোমলতার প্রতীক হলো নারী। যার মায়াজালে আটকা পড়েছে অনেক বাঘা বাঘা পুরুষ। অথচ এই নারীরাই হাতে তুলে নিয়েছে অস্ত্র, অর্জন করেছে যুদ্ধকলায় যোগ্যতা, সামর্থ্য, বীরত্ব। যুগে যুগে এমন কিছু সাহসী নারীর আবির্ভাব ঘটেছে, যারা সম্মুখ সমরে পরাজিত করেছেন বহু বীরকে। যাদের নেতৃত্ব তাক লাগিয়ে দিয়েছিল প্রাচীন বিশ্বকে। তেমনই কয়েকজন দুর্ধর্ষ নারী যোদ্ধাকে নিয়ে আজকের রকমারি—

ইতিহাসের প্রথম নারী নৌবাহিনী প্রধান

আরতেমিশিয়া

আরতেমিশিয়া ছিলেন পারস্যের পক্ষ থেকে নিযুক্ত আইওনিয়ার শাসনকর্তা। সেইসঙ্গে তিনি ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম নারী নৌবাহিনী প্রধান। রণক্ষেত্রে মহাপরাক্রমশালী ছিলেন এই নারী। তীক্ষ বুদ্ধি আর অভিনব রণকৌশলে দক্ষ যোদ্ধা হিসেবে এই নারী নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। সালামিসের যুদ্ধে তার ভূমিকার জন্য তাকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করা হয়। একমাত্র আরতেমিশিয়াই পারস্যের রাজা জারজিসকে সমুদ্রে যুদ্ধ না করে গ্রিক বাহিনীর সঙ্গে স্থলযুদ্ধের পরামর্শ দেন। জারজিস তার রণকৌশলে খুবই মুগ্ধ হন। তিনি বলেন, ‘আমার পুরুষেরা সব মেয়েমানুষ হয়ে গেছে আর মেয়েরা পুরুষ হয়ে উঠেছে।’ রাজ্যের স্বার্থে আরতেমিশিয়া অন্য জেনারেলদের পরামর্শের বিরুদ্ধে যেতে দ্বিধাবোধ করতেন না। এমনই অসীম সাহসী ছিলেন বীরযোদ্ধা আরতেমিশিয়া।

 

সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিদ্রোহী রানী

ব্যুদিক্বা

ব্যুদিক্বা ছিলেন নরফোকের রানী। তার স্বামী নরফোকের রাজার মৃত্যুর পর রাজ্য যখন অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে তখন রানী ব্যুদিক্বা রাজ্যকে যৌথভাবে তার কন্যাদের এবং রোমান সম্রাটের অধীনে ন্যস্ত করে দেন। কিন্তু রোমানরা বেঁকে বসে। এ যৌথ শাসন তারা মেনে নেয়নি। তারা পুরো সাম্রাজ্য দখল করে। ব্যুদিক্বাকে নির্যাতন করে বিতাড়িত করা হয়। আর তার কন্যাদের ধর্ষণ করা হয়। এরপর রানী ব্যুদিক্বা রোমান সাম্রাজ্যের দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘটিত বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। শেষ পর্যন্ত নরফোক এবং প্রতিবেশী এলাকার জনগণ ব্যুদিক্বাকে সমর্থন করে। তার নেতৃতে ্বরোমানদের ওপর হামলা করা হয়। এ যুদ্ধে ব্যুদিক্বার সেনাবাহিনী ব্যাপক সাফল্য পায়। তারা রোমান নেতৃত্বাধীন কামুলোডুনম শহর সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলেন। এই রানীর মূর্তি এখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতীক হয়ে আছে।

 

ছিলেন সর্বোচ্চ পূজারি এবং সেনাপতি

ফু হাউ

পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন এবং সফল নারী  সেনাপতি সম্ভবত ফু হাউ। চীনের সাং রাজবংশের রাজা উ ডিং এর স্ত্রী ছিলেন তিনি। তিনি একই সঙ্গে সর্বোচ্চ পূজারি এবং সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যা তখনকার সময়ের জন্য ছিল এক বিরল ঘটনা। প্রাচীন চিত্রে তাকে বহু সামরিক অভিযানে  নেতৃত্ব দিতে দেখানো হয়েছে। তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান অধিনায়ক। প্রায় ১৩ হাজার সৈন্য নিয়ে ফু হাউ সেই সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন করেছিলেন। বিশেষ করে ‘বা’ এর যুদ্ধ ছিল চীনের ইতিহাসে পাওয়া প্রাচীনতম বড় মাপের গেরিলা যুদ্ধ। এই যুদ্ধের বর্ণনায় বা-ফ্যাং বাহিনীকে মরণফাঁদে ফেলতে ফু হাউর চমৎকার রণকৌশলের পরিচয় দিয়েছিলেন। এই বিজয়ের কিছুকাল পরই শারীরিক ক্লান্তি ও দুর্বলতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ইয়ানঝুতে এই বীর নারীর সমাধি সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়েছে।

 

ভিয়েতনামের শ্রেষ্ঠ বীর দুই নারী

টুরিং বোনদ্বয়

টুরিং বোনেরা ছিলেন ইতিহাসের দুই বিখ্যাত নারী যোদ্ধা। তারা ছিলেন ভিয়েতনামের সর্বোচ্চ সামরিক নেতা। টানা তিন বছরেরও বেশি সময় চীনা হান সাম্রাজ্য ভিয়েতনামে আক্রমণ করে। এ সময় এই দুই বোনের সমরবিদ্যা তাদের প্রতিহত করে। এই কৃতিত্বের জন্য তাদের ভিয়েতনামের জাতীয় বীর হিসেবে স্মরণ করা হয়। ভিয়েতনাম এক সময় প্রায় হাজার বছর চীনা সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। সে সময়েই দুই বোনের আবির্ভাব। টুরিং ত্রামের স্বামী থি সাক গোপনে চাইনিজ বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু হান শাসকরা থি সাককে হত্যা করেন। এরপরই টুরিং ত্রাম এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। বোন টুরিং নিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি কয়েক মাসের মধ্যেই ভিয়েতনামের বহু এলাকাকে চৈনিক শাসন থেকে মুক্ত করেন। দুই রানী খ্রিস্টীয় ৪৩ সালে নদীতে ডুবে আত্মহত্যা করেন।

 

দ্য নাইট ইন দ্য প্যানথারস স্কিন

তামারা

রাজাদের রাজা ও রানীদের রানী তামারা ছিলেন জর্জিয়ান রাজার কন্যা। জীবিত থাকতেই কন্যা তামারাকে যুগ্ম শাসক নিয়োজিত করেছিলেন এবং সিংহাসনের উত্তরাধিকার ঘোষণা করেছিলেন জর্জিয়ান রাজা। তামারাও তার বাবার মৃত্যুর পর অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। শাসক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। তার শাসনকালে জর্জিয়া সাম্রাজ্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছায়। প্রজারা তামারাকে ভালোবেসে ‘রাজাদের রাজা’ ও ‘রানীদের রানী’ উপাধি দিয়েছিলেন। তামারার জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা হয় মহাকাব্য ‘দ্য নাইট ইন দ্য প্যানথারস স্কিন’। তামারা নিত্যনতুন রণকৌশলে জর্জিয়া তখন অনেকগুলো শহর অধিগ্রহণ করতে সমর্থ হয়। ১২০৪ সালে তামারা তার সেনাবাহিনী নিয়ে ক্বার শহর দখল করেন। অত্যন্ত ক্ষমতাশালী এই রানী ১২১৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

 

মাত্র ১৭ বছর বয়সেই বিজয় এনে দেন ফ্রান্সকে

জোয়ান অব আর্ক

ফরাসি বীরকন্যা জোয়ান অব আর্ককে ১৪৩১ সালের ৩০ মে ডাইনি আখ্যা দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। এর আগে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধকালে ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর একটি অংশের নেতৃত্ব দেন। ফ্রান্সের ইতিহাসে তিনি এক কিংবদন্তি চরিত্র। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই পলাতক সপ্তম চার্লসের সঙ্গে দেখা করে দেশের স্বাধীনতা উদ্ধারের জন্য সৈন্য প্রার্থনা করেন।  সাদা পোশাকে জোয়ান ঘোড়ায় চড়ে পঞ্চক্রুুসধারী তরবারি হাতে ৪ হাজার সৈন্য নিয়ে ১৪২৯ সালের ২৮ এপ্রিল অবরু নগরী অরলেয়াঁয় প্রবেশ করেন। প্রথম আক্রমণেই জয়লাভ করেন ও একের পর এক সাফল্য আসতে থাকে। উদ্ধার করেন তুরেলবুরুজ, পাতে এবং সৈনা রিইঁ নগরী। এভাবেই সপ্তম চার্লস ফ্রান্সের শাসনভার গ্রহণ করেন।

 

রাজত্ব করেন একটানা ৪০ বছর

জুডিথ

৯৬০ খ্রিস্টাব্দে দামোত নগরের শাসনকর্তা ছিলেন রানী জুডিথ। তিনি সেই সময়ে স্মৃতিসৌধ ও গির্জা ধ্বংস করে এক্সম নগরী ও তার আশপাশের এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করেন। তিনি রাজবংশের সব সদস্যকে, সেবার রানীর বংশধরদের হত্যা করে তাদের সম্পূর্ণ চিহ্ন মুছে দিতে চেষ্টা করেন। তার ভয়ানক কর্মকাণ্ড লোকমুখে বছরের পর বছর বর্ণিত হয়ে এসেছে। নানা ঐতিহাসিক দলিলেও তার নিষ্ঠুর আক্রমণের কথা উল্লেখ রয়েছে। তিনি একটানা ৪০ বছর রাজত্ব করেন। তিনি ইথিওপিয়ার রাজ কোষাগার ডেবরে ডেমো লুটপাট ও রাজার পুরুষ আত্মীয়দের জন্য তৈরি জেলখানা ধ্বংস করেন। রানী জুুডিথের নিষ্ঠুরতায় আমহারিক ভাষায় তাকে ‘এসাতো’ বলে ডাকা হতো, যার অর্থ আগুন।

 

সম্রাট ক্লাডিয়াসকে পরাজিত করেন

সেপটিমা জেনোবিয়া

সেপটিমা জেনোবিয়া ২৫০ সাল থেকে প্রায় ২৭৫ সাল পর্যন্ত সিরিয়ার শাসনকর্তা ছিলেন। সমরাস্ত্রে সজ্জিত  জেনোবিয়া ঘোড়ার পিঠে চড়ে তার সেনাবাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতেন। জেনোবিয়ার স্বামী অডেনথাস ছিলেন রোম নিযুক্ত সিরিয়ার শাসনকর্তা। তার মৃত্যুর পর জেনোবিয়া শাসক পদে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু তিনি রোমান সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে সিরিয়ার আশপাশের অঞ্চল এবং মিসরীয় বিদ্রোহ দমন করে মিসর দখল করেন। এ সময় মিসর পুনঃদখলের চেষ্টায় রোমের সম্রাট ক্লাডিয়াসের   সেনাবাহিনী তার কাছে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। ফলে এশিয়া মাইনরের একটি বড় অংশ থেকে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। আরমেনিয়া, আরব ও পারস্য তার সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে।

 

হাতির পিঠে চড়ে দুই তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধে যেতেন

ট্র্যু থি ত্রিন

২৫০ খ্রিস্টাব্দের একজন ভিয়েতনামি নারী যোদ্ধা ছিলেন ট্র্যু থি ত্রিন। তিনি চীনের দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পরিচালনা করেন। তিনি ভিয়েতনামে রাজত্বের সময় সফলভাবে দখলদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করেন। তিনি থান হোয়া প্রদেশের ট্র্যু সন জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তখন এলাকাটি চীন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। অনাথ ট্র্যু থি ত্রিন বাড়ি থেকে পালিয়ে ছিলেন খুব অল্প বয়সে। এর পর প্রায় ১ হাজার পুরুষ ও নারী সৈনিকের মিলিত বাহিনী গড়ে তোলেন ত্রিন। এই বাহিনীর মাধ্যমে চীনা সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। যুদ্ধে জয়লাভ করে ভিয়েতনামের একটি এলাকা দখলমুক্ত করতে সক্ষম হন। সেখানে নিজেই স্বতন্ত্র শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি হাতির পিঠে চড়ে, গায়ে সোনার বর্ম পরে, হাতে দুটি তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধে যেতেন। ২৪৮ খ্রিস্টাব্দে নিজের জীবনের সমাপ্তি ঘটান।

 

রূপ আর রণকৌশলে সবাইকে ছাড়িয়ে

ক্লিওপেট্রা

এই নারীকে নিয়ে যুগের পর যুগ অনেক বড় বড় সাহিত্যিক লিখে চলেছেন নানান উপাখ্যান। এই তালিকায় যেমন আছেন শেকসপিয়র তেমনি আছেন জর্জ বার্নার্ড শ, হেনরি রাইডার, হ্যাগার্ডের মতো সাহিত্যিক। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত নারী শাসক ক্লিওপেট্রার জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৬৯ সালে প্রাচীন মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায়। সাধারণভাবে তিনি ক্লিওপেট্রা সপ্তম হিসেবে পরিচিত। রূপ-লাবণ্যে যেমন ক্লিওপেট্রা সবাইকে ছাড়িয়ে তেমনি রণক্ষেত্রেও পুরুষের সমান পরদর্শী। ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ফারসালুসের যুদ্ধে দায়িতপ্রাপ্ত সেনাপতি পম্পে পরাজিত হন। সে বছরই আলেকজান্দ্রিয়ায় ফেরার পথে পম্পে ফারসালুসের হাতে নিহত হন। যুদ্ধ থেকে পালাতে গিয়ে ক্লিওপেট্রার স্বামী টলেমি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর ক্লিওপেট্রা হয়ে ওঠেন মিসরের একচ্ছত্র রানী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর