রবিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

নিষ্ঠুর কারাগার

তানভীর আহমেদ

নিষ্ঠুর কারাগার

নানা অপরাধে বন্দী হন অপরাধীরা। অনেক সময় আক্রোশের শিকার হয়েও অনেকে বন্দী হন। কারাগার সংশোধনাগার না হয়ে যখন নির্যাতন সেল বা নির্যাতন কেন্দ্র হয়ে ওঠে তখন কারাবন্দীদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। বন্দীদের ওপর নির্মম, নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানোর জন্য কুখ্যাত কারাগারগুলো নিয়ে আজকের রকমারি—

কুখ্যাত গুয়ানতানামো বন্দীশিবির

যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারের হামলার পর জঙ্গি সংগঠনগুলোর ব্যাপারে কঠোর হয়ে ওঠে আমেরিকা। দেশে দেশে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে কার্যত যুদ্ধ চালিয়ে বসে যুক্তরাষ্ট্র। ইরাক, আফগানিস্তানের পর সিরিয়া। হামলার পাশাপাশি গ্রেফতার অভিযানে তাদের হাতে ধরা পড়ে জঙ্গি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। তবে তাদের গ্রেফতার অভিযান নিয়ে সমালোচনা কম হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নতুন করে কলঙ্ক বুনে গুয়ানতানামো বে কারাগার। এই বন্দীশিবির রীতিমতো এক নির্যাতন ও নৃশংসতার বিকল্প নাম হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র কিউবায় গুয়ানতানামো বে-তে তাদের নৌঘাঁটিতে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে এই বন্দীশিবির তৈরি করে। এখানে এনে রাখা হয় বন্দীদের। ২০০২ সালের জানুয়ারির ১১ তারিখ এই মার্কিন বন্দীশিবিরে প্রথম বন্দীরা আসেন। সে সময় ইউএস মেরিনের মেজর জেনারেল মাইক লেনেট ছিলেন শিবিরের অফিসার ইনচার্জ। একটি সি-সেভেনটিন বিমানে করে প্রথম ২৯ জন বন্দী এসেছিলেন। এই বন্দীরা আফগানিস্তান থেকে গুয়ানতানামো বে-তে এসেছিলেন সরাসরি বিমানে।  প্রায় এক দিনের ফ্লাইটের এই দীর্ঘ সময় তাদের বাথরুমে যাবার কোনো উপায় ছিল না। তাদের পানিও খেতে দেওয়া হয়নি। আফগানিস্তানে আল কায়েদা ও তালেবানকে লক্ষ্য করে চালানো হামলায় বন্দীদের গ্রেফতার করে পাঠানো হতো এই কারাগারে। প্রথমে মাত্র ২০০ জন বন্দীকে এখানে রাখার ব্যবস্থা থাকলে বন্দী আসতে শুরু করে হাজার হাজার। ১০০টি কারাকক্ষ তৈরি করা হয় মাত্র ৯৬ ঘণ্টায়। এখানকার বন্দীদের ব্যাপারে বলা হয়, তারা ছিলেন তালেবান এবং আলকায়েদার ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই এই কারাগারের ব্যাপারে ছিল সংবেদনশীল। কখনই ঠিক চিত্র তুলে ধরতে পারেনি তারা। বন্দীদের আইনি দিক নিয়ে তো বটেই কারাগারের ভিতরের পরিবেশ নিয়েও ছিল চরম গোপনীয়তা। তবে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে গুয়ানতানামো বে কারাগারের ভিতরকার ছবি। বন্দী নির্যাতনে পৃথিবীর সব ইতিহাসকে পেছনে ফেলে দেয়। যেখানে ১৩০ জন বন্দী রাখা সম্ভব ছিল সেখানে রাখা হয় ১ হাজার ২০০ জন বন্দী। কার্যত বন্দীশালায় মানুষের দাঁড়ানোর মতো জায়গা ছিল না। খাবার ও পানি মিলত না। যদিও মিলত তা ছিল পরিমাণে খুব সামান্য। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া বন্দীদের বয়ান থেকে আন্তর্জাতিক মিডিয়া প্রকাশ করে কারাগারের ভিতরে অবিশ্বাস্য নির্যাতনের কথা। বন্দীদের ওপর কুকুর ছেড়ে দেওয়া হতো। পোশাক কেড়ে নিয়ে দিনের পর দিন তাদের গাদাগাদি করে রাখার মতো লোমহর্ষক বর্ণনাও রয়েছে। বন্দীদের দিনের পর দিন মাথায় কালো ব্যাগ পরিয়ে রাখা হতো। হাত-পা বাঁধা অবস্থাতেই চলত নির্যাতন। যৌন হয়রানি বিকৃত ছবিও প্রকাশ পায় এক পর্যায়ে। কারাগার রক্ষীদের হাতে পশুর জীবন ভোগ করতে হয় বন্দীদের। মুক্তি পাওয়া বন্দীদের অনেকেই বলেন, নির্যাতনের এক পর্যায়ে সবাই মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা করত দিনের পর দিন।

 

যে দুটি কারাগারের নাম শুনলেই আতঙ্কে বুক কাঁপে বন্দীদের

ব্রাজিলের কারানদিরু

কুখ্যাত কারাগারের একটি কারানদিরু। ১৯৯২ সালে বন্দী নির্যাতনের ঘটনা এখনো বিশ্ববাসীকে আতঙ্কিত করে। কারারক্ষীদের হাতে প্রাণ হারান প্রায় ১ হাজার ৩০০ বন্দী। এই কারাগারের ভলান্টারি এক চিকিৎসক জানান, কারাগারের ৪৬ বছরের ইতিহাসে কত বন্দী যে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন তার ঠিক চিত্র দেওয়া কঠিন। ব্রাজিলের এই কারাগারে বন্দীদের বেশির ভাগই ছিল খুনি ও মাদক ব্যবসায়ী। কারাগারে তাদের খাবার দেওয়া হতো না। লাঠি দিয়ে পেটানো হতো নিয়মিত। সামান্য বিষয়েই তাদের বেধড়ক পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়া ছিল মামুলি ব্যাপার। বন্দীদের মধ্যে কেউ প্রতিবাদ করতে এগিয়ে এলে তার পরিণতি হতো করুণ। রোদের মধ্যে খালি গায়ে তাদের মাঠে শুইয়ে রাখা হতো। কেউ পানি চাইলে, গরম পানি দিয়ে গোসল করিয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলা ও বন্দীকে মেরে ফেলার ঘটনায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বন্দীদের মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুললে তার ঠিক উত্তর দিতে পারেনি ব্রাজিলের সরকার। অনেক সমালোচনার পর ২০০২ সালে এই কারাগার বন্ধ করে দেওয়া হয়।

 

তাদমর বন্দীশালা

সিরিয়ার তাদমর মিলিটারি বন্দীশালাকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ‘বিশ্বের সবচেয়ে অত্যাচারী বন্দীশালা’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। কারারক্ষীরা ধমক ছাড়া কথাই বলেন না এখানে। খাবার-পানি কিছু চাইলে উল্টো পেটানো শুরু হয়। বাথরুমের ভিতরেও বন্দীদের রাতে ঘুমাতে বাধ্য করা হতো। বন্দীরা কোনো কষ্টে বলতে এলেই লোহার পাইপ দিয়ে পেটানো হতো এখানে। অভিযোগ রয়েছে ১৯৮০ সালে এই কারাগারে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে বন্দী হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। অন্য বন্দীদের সামনেই হাত-পা বেঁধে একজন একজন করে বন্দীকে কুপিয়ে মারার কথাও অনেকে জানিয়েছেন মিডিয়াকে!

 

বন্দীদের কাছে এ যেন নির্যাতন সেল

কথায় কথায় পেটানো, খাবার পানি না পাওয়া এই কারাগারের সাধারণ দৃশ্য। দিনে এক বাটি খাবারই বন্দীদের এখানে অনেক বড় পাওয়া!


থাইল্যান্ডের ব্যাং কাং কারাগার নিয়ে সমালোচনার শেষ নেই। বন্দী নির্যাতনের ঘটনার অন্ত নেই এই কারাগারের। এই কারাগারে বন্দীদের শিকল দিয়ে দিনরাত বেঁধে রাখার অভিযোগও রয়েছে। পায়ে শিকল বেঁধে তাদের সব ধরনের চলাচল, খাওয়া, শৌচকর্ম সারতে হয়। কারাগারে যতজন বন্দী থাকতে পারে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বন্দী থাকায় নানা ধরনের অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়। খাবারের সংকট, ঘুমানোর ব্যবস্থা না থাকায় কষ্ট বাড়ে বন্দীদের। সঙ্গে রয়েছে দুর্ব্যবহার ও কথায় কথায় শারীরিক নির্যাতন। দুই-তিন ঘণ্টার নোটিস দিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত বন্দীদের সবার সামনেই টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। ছোট ঘরে গাদাগাদি করে থাকেন বন্দীরা, ময়লা পোশাক পরে কাটাতে হয় দিনের পর দিন। পিপাসায় খাবার পানিও মেলে না।

 

এর চেয়ে মৃত্যু ভালো!

কেনিয়ার এই কারাগারে যৌন নির্যাতনের শিকার বন্দীরা মিডিয়াকে জানায়, এই নির্যাতনের চেয়ে মৃত্যুও ভালো!

কেনিয়ার নাইরোবি। ‘কামিতি ম্যাক্সিমাম সিকিউরিটি প্রিজন’ এখানেই। কারাগার না বলে, নিষ্ঠুরতা আর নির্যাতনের কেন্দ্র বললেও ভুল হবে না। বার বার এই কারাগারে বন্দী নির্যাতনের খবর ফলাও করে ছেপেছে শীর্ষস্থানীয় দৈনিকগুলো। সেসব খবরে বলা হয়, বন্দীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয় এই কারাগারে। থাকার ঘরগুলো ছিল নোংরা। মলমূত্রের গন্ধে ঘরে থাকাই দায় হয়ে যেত। এ ছাড়া এখানকার পরিবেশও ছিল কঠিন। কারারক্ষীদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আসার পর চাপে পড়ে কারাকর্তৃপক্ষ। যৌন নির্যাতনের শিকার বন্দীরা অভিযোগ করেনি— এমন দায়সারা মন্তব্য করেই চুপ করে যায় কারাকর্তৃপক্ষ। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, বন্দীদের যৌন নির্যাতনের ব্যাপারটা ব্যক্তিগত বিষয় বলেও মন্তব্য করে তারা। এ নিয়ে সমালোচনা প্রবল হলে কারা কর্তৃপক্ষ উল্টো হুমকি দিয়ে বলে, ‘আমার বন্দীদের যৌন নির্যাতন কেন, যা ইচ্ছা করি আমরা, তাতে কী যায় আসে?’

 

কারাগারে কত দুর্দশা!

ভেনেজুয়েলার লা সাবানতা কারাগার

দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে কুখ্যাত কারাগার এটি। ভেনেজুয়েলার লা সাবানতা কারাগারে বন্দী নির্যাতনের ঘটনা কারও অজানা নয়। কারাবন্দীদের ওপর নির্মম অত্যাচার আর নির্যাতন এখানকার নিয়মে পরিণত হয়েছে যেন। বন্দীদের চিকিৎসাসেবা বলতে কিছু নেই। নির্যাতনের পর চিকিৎসা মেলার কথা এখানে ভাবাও যায় না। ময়লা-আবর্জনাময় খাবার দেওয়া হয় বন্দীদের। সেই খাবারই খেতে হয় তাদের। এ ছাড়া স্যানিটেশন সমস্যা ভয়াবহ। শৌচকর্ম সারতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। পরিচ্ছন্নতার জন্য পানিও দেওয়া হয় না। ১৯৯৪ সালে এই কারাগারে কলেরা ছড়িয়ে পড়েছিল এই নোংরা পরিবেশের জন্য। সে বছর ১০০ জনের মতো বন্দী কলেরায় আক্রান্ত হন। সব মিলিয়ে অন্তত ৭০০ বন্দীকে কলেরায় ভুগে অসহনীয় জীবন পার করতে হয়েছে। সুযোগ-সুবিধা কম থাকায় সীমিত খাবার, পোশাক নিয়ে বন্দীদের মধ্যে মারামারি বেঁধে যায় বেশ কয়েকবার। কারা কর্তৃপক্ষ তাদের মোটেই আটকায়নি। উল্টো নির্যাতন চালিয়ে গেছে সবার ওপর— এমন অভিযোগ এই কারাগারের ওপর বার বার উঠেছে।

রুয়ান্ডার গিতারামা বন্দীশিবির

রুয়ান্ডার এই কারাগার কুখ্যাত হয়েছে বন্দীদের ওপর নির্মম অত্যাচারের নিত্যনতুন কৌশল ব্যবহারের কারণে। নানা ধরনের অত্যাচার যন্ত্র ব্যবহার করে এখানকার বন্দীদের নির্যাতন করা হয়। এই কারাগারে ৬ হাজার বন্দীকে নিয়ন্ত্রণ ও অত্যাচারের জন্য এসব নির্যাতন যন্ত্র ব্যবহার করা হয় বলে বিভিন্ন সময় দাবি করেছেন মানবাধিকারকর্মীরা। এসব নির্যাতন যন্ত্রের সাহায্যে হাতে পায়ে ও লজ্জাস্থানে আঘাতের কথা উঠে এসেছে। নির্যাতন সইতে না পেরে, অসুস্থ হয়ে বন্দীরা মৃত্যুর মুখেও ঢলে পড়েছেন— এ ধরনের গুরুতর অভিযোগ পাত্তাই দেয়নি কারাকর্তৃপক্ষ। কারাগারে ভয়াবহ খাদ্য সংকট থাকায় বন্দীরা ক্ষুধার্ত থাকেন। খাবার না পেয়ে একজন অন্যের মাংস খাওয়ার চেষ্টা করেছেন— এ কথাও দাবি করেছেন বন্দীরা। এখানে থাকা বন্দীদের বেশির ভাগই গণহত্যা চালানোর অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দী হয়েছেন।

কলোরোডায় কুখ্যাত ফ্লোরেন্স ফ্যাসিলিটি

যুক্তরাষ্ট্রের কলোরোডায় রয়েছে কুখ্যাত এডিএক্স ফ্লোরেন্স সুপারম্যাক্স ফ্যাসিলিটি। অনেকের চোখের আড়ালে গড়ে তোলা বিশাল কারাগার এটি। বিশ্বের অন্যতম নির্দয় কারাগার হিসেবে এটিকে আখ্যায়িত করা হয়। বন্দীদের আদৌ এখানে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় কিনা তা নিয়ে মানবাধিকারকর্মী বরাবরই সন্দেহ প্রকাশ করে এসেছেন। বন্দীরা নিজেরা যেমন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন এখানে তেমনি কারারক্ষীদের হাতেও মার খেতে হয় বেধড়ক। এই কারাগারে মানসিকভাবে অসুস্থ, বিকৃত অপরাধীদেরও রাখা হয়। তারা বরাবরই নানা ধরনের হিংস্র আচরণ করে থাকেন। এই বন্দীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রায়শই মারমুখী ভূমিকায় থাকে কারা কর্তৃপক্ষ। বন্দীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাদের সঙ্গে পশুর মতো আচরণের অভিযোগ রয়েছে।

অত্যন্ত গোপনীয় ও সুরক্ষিত এই কারাগারে নির্যাতনের আসল চিত্র কখনোই জনসম্মুখে আসেনি। গোপনীয়তার চাদর ভেঙে সে চিত্র সবার সামনে আসলে বন্দী নির্যাতনের স্বরূপ সবাইকে বিস্মিত করবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর