বৃহস্পতিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
ব্রিটেনের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী

আয়রন লেডি মার্গারেট থ্যাচার

সাইফ ইমন

আয়রন লেডি মার্গারেট থ্যাচার

মার্গারেট হিলডা থ্যাচার একজন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এবং কনজার্ভেটিভ পার্টির নেত্রী ছিলেন। তিনি বিংশ শতাব্দীর দীর্ঘ সময় শাসন করা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও ব্রিটেনের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। তার আপসহীন রাজনীতি ও নেতৃত্বের ধরনের জন্য একজন সোভিয়েত সাংবাদিক তাকে ‘আয়রন লেডি’ বলে খেতাব দেন। তিনি বলতেন, ‘একমত হওয়া মানে আসলে সব বিশ্বাস, নীতি, মূল্যবোধ, নিয়ম বাদ দিয়ে এমন একটা বিশ্বাসে পৌঁছানো, যাতে কেউই বিশ্বাস রাখেন না এবং যার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদও জানান না।’ মার্গারেট থ্যাচারকে নিয়ে আজকের রকমারি—

 

লিংকনশায়ারের গ্রানামের এক সাধারণ মুদি দোকানির পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মার্গারেট থ্যাচার। ৮৭ বছর বয়সে মারা যান ব্রিটেনের সাবেক প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার।

তার বাবা আলফ্রেড রবার্টস মূলত ছিলেন নর্থহ্যাম্পটনশায়ারের বাসিন্দা। তবে তার মা বিট্রাইস ইথেল ছিলেন লিংকনশায়ারের অধিবাসী। মার্গারেটের শৈশব কেটেছে গ্রানামে রেললাইনের ঠিক পাশের একটি বাড়িতে। আর তার বাবা আলফ্রেড রবার্ট এখানে দুটি মুদি দোকানের মালিক ছিলেন। তার বাবা স্থানীয় রাজনীতি এবং ওখানকার মেথডিস্ট চার্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে মার্গারেটও একজন কড়া মেথডিস্ট হিসেবে বেড়ে উঠেন। বাবার কাছ থেকেই মূলত পরবর্তী জীবনের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন মার্গারেট।

কারণ তার বাবা ১৯৪৫-৪৬ সালে গ্রানামের মেয়র নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে লেবার পার্টির বিজয় মার্গারেটের বাবাকে মেয়রের পদ ছাড়তে বাধ্য করে। মার্গারেট হান্টিংটন রোডের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করলেও অল্প সময়ের মধ্যেই স্কলারশিপ পেয়ে গ্রানাম গার্লস স্কুলে যোগ দেন।  সেখানকার পাঠ চুকিয়ে তিনি বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে পড়াশোনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মার্গারেট থ্যাচারকে সর্বকালের অন্যতম সেরা মেধাবী রাজনীতিক ও ক্ষমতাশালী মহিলা মানা হয়। তার রাষ্ট্র পরিচালনার ধরন এখনো বিশ্বের বড় বড় দেশের শাসকদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থার শীর্ষে পৌঁছতে তাকে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয়েছিল। পেরোতে হয়েছিল হাজার প্রতিবন্ধকতা। শুধু তাই নয়, ক্ষমতায় থাকাকালীন তার গৃহীত অনেক সিদ্ধান্তই দারুণ সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। থ্যাচার যখন ক্ষমতায় আসলেন তখন ব্রিটেনে জিনিসপত্রের দাম ছিল তখন বেশ চড়া। বাজেট ঘাটতি ছিল বিপুল। অসন্তোষের জেরে টালমাটাল দশা শিল্পক্ষেত্রের। তখনই কড়া হাতে হাল ধরলেন থ্যাচার। সরকারি খরচ কমিয়ে রাশ টানলেন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির। দরজা খুলে দিলেন বেসরকারি পুঁজির জন্য। সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণা পাল্টে আধুনিক অর্থনৈতিক ধারণার সূচনা করলেন। তার শাসনামলে তিনি প্রত্যক্ষ ট্যাক্স কমিয়ে দিয়ে পরোক্ষ ট্যাক্স বাড়িয়ে দেন। অর্থের সরবরাহ কমানোর জন্য সুদের হার বাড়িয়ে দেন যাতে করে মুদ্রাস্ফীতি কম থাকে। সরকারি খরচের সীমা রেখা বেঁধে দেন এবং সামাজিক কার্যক্রম, শিক্ষা, আবাসন খাতে ব্যয় কমিয়ে দেন। শিক্ষা খাতে ব্যয় কমানোর জন্য তিনিই প্রথম অক্সফোর্ড গ্র্যাজুয়েট প্রধানমন্ত্রী যাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয়নি। জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপারে মার্গারেট থ্যাচার দেখালেন অনমনীয় মনোভাব। খনি শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে অনড় রইলেন প্রায় পুরো এক বছর। তার অদম্য মনোভাবের কারণে  শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য হয় শ্রমিক নেতারা। মার্গারেট থ্যাচারের হাত ধরে ধীরে ধীরে পাল্টাতে থাকে ব্রিটেন। ১৯৭৬ সালে রাশিয়াকে উদ্দেশ করে একটি বক্তব্য রাখার পর তাকে ‘আয়রন লেডি’ বা ‘লৌহমানবী’ উপাধি দেয় সোভিয়েত ইউনিয়নের সংবাদ মাধ্যমগুলো। এরপর থেকেই তিনি সারা বিশ্বে আয়রন লেডি হিসেবে সুপরিচিত। সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসী মনোভাবকে তাচ্ছিল্য করে তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্বের কর্তৃত্বের কাছে রাশিয়ানরা কিছুই নয়।’ বিশ্বে একরোখা রাজনীতির জন্য থ্যাচারের অন্যরকম পরিচিতি ছিল। বলাচলে নারীনেত্রীদের মধ্যে একরোখা নীতির শাসনের পথপ্রদর্শক তিনি। ঐকমত্যের দর্শনে মার্গারেট থ্যাচারের বিন্দুমাত্র বিশ্বাস ছিল না। বলতেন, ‘একমত হওয়া মানে আসলে সব বিশ্বাস, নীতি, মূল্যবোধ, নিয়ম বাদ দিয়ে এমন একটা বিশ্বাসে পৌঁছানো, যাতে কেউই বিশ্বাস রাখেন না এবং যার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদও জানান না।’ নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকার কারণে তিনি বিশ্ব নেতাদের কাছ থেকেও প্রশংসা কুড়ান। নিজের দেশের অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রনীতি যাই থাকুক না কেন বিশ্বে তিনি সবসময় ভারসাম্য রেখে চলতেন। থ্যাচারের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান। রিগানের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করেছিলেন থ্যাচার। থ্যাচার প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে অব্যাহতি  নেওয়ার পর ১৯৯১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এইচ ডব্লিউ বুশের হাত থেকে ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ গ্রহণ করেন। ব্রিটেনের সর্বোচ্চ ক্ষমতা গ্রহণের পর নৈতিক রাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সার্বিক অধিকারের ওপর জোর দেন তিনি। ১৯৮৭ সালে এক ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বলেন, ‘সমাজের ওপর আর কোনো কিছু থাকতে পারে না।’

 

জন্ম ও ছোটবেলা

মার্গারেট থ্যাচারের পুরো নাম মার্গারেট হিলডা রবার্টস। তিনি জন্মে ছিলেন ১৯২৫ সালের ১৩ অক্টোবর লিংকনশায়ারের গ্রান্থামে। তার বাবার নাম ছিল আলফ্রেড রবার্টস ও মায়ের নাম ছিল বিয়েট্রিশ ইথেল। মার্গারেট থ্যাচার গ্রান্থামে বড় হয়েছেন। সেখানে তার বাবার দুটো মুদির দোকান ছিল। মার্গারেট থ্যাচারের বাবা স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং মেথডিস্ট চার্চে ধর্মযাজক হিসেবে কাজ করতেন। আলফ্রেড ১৯৪৫-১৯৪৬ সাল পর্যন্ত গ্রান্থামের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি হান্টিং টাওয়ার রোড প্রাইমারি স্কুলে অধ্যয়ন করেন। অসামান্য মেধাবী মার্গারেট থ্যাচার বৃত্তি পেয়ে কেস্টেভেন অ্যান্ড গ্রান্থাম গার্লস স্কুলে যান। এট ছিল তখনকার সময়ের বিখ্যাত স্কুল। তার রিপোর্ট কার্ড থেকে জানা যায় তিনি খুবই পরিশ্রমী ছিলেন ছাত্রাবস্থায়। এ ছাড়াও তিনি পিয়ানো বাজাতে পারতেন। আবার খেলাধুলাসহ অন্যান্য বিষয়েও বেশ ভালো ছিলেন। যেমন ফিল্ড হকি, কবিতা আবৃত্তি, সাঁতার ও দৌড় প্রতিযোগিতায় ইত্যাদি এক্সট্রাকারিকুলাম এক্টিভিটিসে উত্তরোত্তর উন্নতি করছিলেন।

 

রাজনীতির শুরু

১৯৪৭ সালে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিস্ট্রিতে দ্বিতীয় শ্রেণি নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। কেমিস্ট্রি পড়ার সময়ই তিনি আইন বিষয়ে পড়ার প্রতি আগ্রহ হন। তখনই রাজনীতি করা নিয়ে ভাবছিলেন। এরপর তিনি নির্বাচনে অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কনজার্ভেটিভ অ্যাসোসিয়েশনে। ১৯৪৬ সালে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কনজার্ভেটিভ অ্যাসোসিয়েশনের

প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন। শুরু হয় থ্যাচারের রাজনৈতিক জীবন। এদিকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর তিনি কলচেস্টারের বি এক্স প্লাস্টিকে রিসার্চ কেমিস্ট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৮ সালে তিনি আইসিআইতে চাকরির জন্য আবেদন করেন। কিন্তু সেখানে ঠাঁই হয়নি তার। মার্গারেট থ্যাচার খুবই উদ্ধত, একগুঁয়ে স্বভাবের ও স্বমতে ভয়ংকরভাবে অটল থাকা একজন ব্যক্তিত্ব হিসেবে চাকরির জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হন।

১৯৪৮ সালে মার্গারেট থ্যাচার পার্টি কনফারেন্সে যোগদান করেন এবং সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। অ্যাসোসিয়েশনের কর্তা ব্যক্তিরা তার প্রতি এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে তারা তাকে ডার্টফোর্ডের প্রার্থী হিসেবে আবেদনের জন্য প্রস্তাব করেন যদিও তিনি অনুমোদিত প্রার্থী তালিকার মধ্যে ছিলেন না। মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি ডার্টফোর্ডের কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। পার্টির প্রার্থী হিসেবে বিজয়ের পর দেওয়া ডিনার পার্টিতে মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গে দেখা হয় একজন সম্পদশালী ও সফল ব্যবসায়ী ডেনিস থ্যাচারের সঙ্গে। ১৯৫০ ও ১৯৫১ সালে লেবার পার্টির নিরাপদ আসন ডার্টফোর্ড থেকে তিনি সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেন কিন্তু দুবারই ব্যর্থ হন তবে পরাজয়ের ব্যবধান কমিয়ে আনেন। একই সঙ্গে সবচেয়ে কম বয়সী এবং একমাত্র মহিলা প্রার্থী হিসেবে মিডিয়া আকর্ষণে সক্ষম হন মার্গারেট থ্যাচার। এ সময়ই মার্গারেট থ্যাচার ও ডেনিস থ্যাচারের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে ডেনিস থ্যাচার ও মার্গারেট থ্যাচার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৫১ সালে। ১৯৫৩ সালে তাদের যমজ সন্তান ক্যারল ও মার্ক জন্ম গ্রহণ করেন।

 

মেম্বার অব পার্লামেন্ট

১৯৫৯ সালে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মার্গারেট থ্যাচার  মেম্বার অব পার্লামেন্ট নির্বাচিত হন। তার কৈশোরকালীন সময়েই প্রতিভা এবং কাজের প্রতি অনুপ্রেরণার কারণে মার্গারেট থ্যাচারের মধ্যে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল। যদিও তিনি এ ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করে বলেছিলেন যে তার জীবদ্দশায় কেউ মহিলা প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না কারণ পুরুষ জনগোষ্ঠী কুসংস্কারাচ্ছন্ন। ১৯৬৪ সালের নির্বাচনে কনজার্ভেটিভ পার্টির পরাজয়ের পর তিনি তার দলের ভূমি ও গৃহায়ণ দফতরের মুখপাত্র নির্বাচিত হন। সে সময় তিনি ভাড়াটিয়াদের কাউন্সিল হাউস কেনার পক্ষে অবস্থান নেন। লেবার পার্টির উচ্চ রাজস্ব নীতির কড়া সমালোচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এ ছাড়াও তিনি ছিলেন উদারমনা। তার দৃষ্টি চিল সুদূর প্রসারী। পুরুষ সমকামিতার বৈধতা ও গর্ভপাতের পক্ষে আনীত বিলের সমর্থক ছিলেন এই নেত্রী। এমনকি মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি বহাল রাখার পক্ষে তিনি কাজ করেন।

 

ক্যাবিনেট মিনিস্টার ও শিক্ষামন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে একটু একটু করে নিজেকে তৈরি করেছেন মার্গারেট থ্যাচার। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে কনজার্ভেটিভ পার্টি জয় লাভ করে। এ জয়ের পর মার্গারেট থ্যাচার ক্যাবিনেটে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। দায়িত্ব গ্রহণ করেই তিনি জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। তিনি শুধু শিক্ষাব্যবস্থার ওপর জোর দেন। কারণ তিনি জানতের একটি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাই তিনি মান সম্মত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। স্কুলগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজনগুলো অগ্রাধিকার দেন। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় এই যে তিনি রাষ্ট্রীয় শিক্ষা পদ্ধতি খাতের ওপর ব্যয় কমিয়ে দেন। যার ফলে সাত থেকে এগার বছরের শিশুদের মধ্যে বিনামূল্যে দুধ বিতরণ কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হয়। পরে অবশ্য জানা যায় মার্গারেট থ্যাচার এটি করতে চাননি কিন্তু রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ সংকটের কারণে এমনটা করতে বাধ্য হন। অনেকে দাবি করেন এ সিদ্ধান্তের ফলে গণবিক্ষোভের মুখে তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভেবেছিলেন।

এ প্রসঙ্গে পরে তার আত্মজীবনীতে তিনি লিখেন, ‘এ অভিজ্ঞতা থেকে কিছু মূল্যবান পাঠ শিখেছি। স্বল্প রাজনৈতিক ফায়দার জন্য ব্যাপক রাজনৈতিক জঘন্যতা মেনে নিতে হয়েছিল।’

আসলে এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে তাকে পড়তে হয়েছিল নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। কিন্তু রাজনীতির স্বার্থেই অনেক কিছুর সঙ্গেই আপস করতে হয়।

 

বিরোধীদলীয় নেত্রী

কনজার্ভেটিভ পার্টি ১৯৭৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে হেরে যায়। লেবার পার্টি সরকার গঠন করে। এর ফলে কনজার্ভেটিভ পার্টির সভাপতি এডওয়ার্ড হিথের নেতৃত্ব হুমকির মুখে পড়ে। যার ফলে মার্গারেট থ্যাচার হয়ে

ওঠেন তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ দলে মার্গারেট থ্যাচার তখন দারুণভাবে জনপ্রিয়। মার্গারেট থ্যাচার হিথকে প্রথম ব্যালট নির্বাচনে পরাজিত করেন। দ্বিতীয় ব্যালট নির্বাচনে পরাজিত করেন হোয়াইট ল-কে। এর ফলে মার্গারেট হয়ে ওঠেন দলীয় প্রধান ও বিরোধীদলীয় নেত্রী। তিনিই প্রথম ব্রিটেনের ইতিহাসের নারী বিরোধীদলীয় নেত্রী। ১৯৭৬ সালের ১৯ জানুয়ারি কেন্সিংটন টাউন হলে এক বক্তৃতায় তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিয়ে কঠোর আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেন।  সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসী মনোভাবকে তাচ্ছিল্য করে তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্বের কর্তৃত্বের কাছে রাশিয়ানরা কিছুই নয়।’ এর উত্তরে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পত্রিকা ‘ক্রাস্নায়া জাভেজডা’ তাকে আয়রন লেডি বা লৌহমানবী বলে আখ্যা দেয় এবং তিনি আনন্দের সঙ্গে এ উপাধি গ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে ব্রিটেনের অর্থনীতি খুবই নাজুক অবস্থার সম্মুখীন হয় এবং ১৯৭৮ সালের

মাঝামাঝি এসে অর্থনীতি কিছুটা উন্নতির দিকে যায়। সে বছর ফরেইন মিনিস্টার জেমস কেলাঘান ঘোষণা করেন ওই বছর কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না। এতো জনরোষের মুখে পড়তে হয় লেবার পার্টিকে। থ্যাচার সে সময় লেবার পার্টিকে মুরগির বাচ্চা বলে অভিহিত করেন। জনগণের চাপের মুখে পড়ে একটি সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করা হয় ১৯৭৯ সালে। কিন্তু তখন লেবার পার্টির জনপ্রিয়তা তলানির দিকে। নির্বাচনে কনজার্ভেটিভ পার্টি ৪৪ আসন পেয়ে হাউস অব কমনসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। যার ফলশ্রুতিতে মার্গারেট থ্যাচার ব্রিটেনের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মার্গারেট থ্যাচারের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠার পর প্রক্রিয়াটি মোটেই সহজ ছিল না। রীতিমতো পদে পদে নিজেকে প্রমাণ করে মার্গারেট থ্যাচার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্করণ করেন।  

 

প্রধানমন্ত্রী থ্যাচার

মার্গারেট থ্যাচার প্রধানমন্ত্রী হন ১৯৭৯ সালের ৪ মে ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে এসে ওঠেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থ্যাচার সাপ্তাহিকভাবে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে দেখা করতেন। ১৯৮৬ সালের দিকে দ্য সানডে টাইমসের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে রানী এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মতানৈক্যের সংবাদ দেয়। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয় বিশ্বজুড়ে। পরবর্তীতে প্রাসাদ থেকে এ দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়। থ্যাচার নিজেও পরবর্তীতে নিজের জীবনীগ্রন্থতে উল্লেখ করেন যে সরকারের কর্মকাণ্ডের ওপর রানীর সন্তোষজনক মনোভাব ছিল। তার সময়ে তিনি ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষমতা প্রায় ধ্বংস করে ফেলতে সক্ষম হন। কারণ তার মতে এটি সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যাহত করে ও অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধন করে। ১৯৯০ সালের ১ নভেম্বর থ্যাচারের সবচেয়ে পুরনো ক্যাবিনেট মন্ত্রী গফ্রি হয়ি ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার হিসেবে পদত্যাগ করলে থ্যাচারের প্রধানমন্ত্রিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। পরের দিন মাইকেল হাসেলটিন কনজার্ভেটিভ পার্টির নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেন। যদিও থ্যাচার প্রথম ব্যালট জয় পান কিন্তু মাইকেল যথেষ্ট সমর্থন পাওয়ায় দ্বিতীয় ব্যালট আদায় করে নিতে সক্ষম হন। তবে দ্বিতীয় ব্যালটে থ্যাচার চার ভোট কম পান। প্রাথমিকভাবে তিনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও পরে ক্যাবিনেটের পরামর্শে তিনি নিজেকে সরিয়ে নেন। তারপর পরিত্যাগ করেন। এ সময় তিনি নিজেকে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে বিতাড়িত হয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। এ কারণে তিনি কখনো ক্ষমা করবেন না বলে জানান। থ্যাচারের পর জন মেজর কনজার্ভেটিভ পার্টির নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগের পর মার্গারেট থ্যাচার দুই বছর ফিনচলির এমপি ছিলেন। ১৯৯২ সালে তিনি ৬৬ বছর বয়সে হাউস অব কমনস থেকে পদত্যাগ করেন। 

 

মৃত্যু

১৯৮৪ সালে ১২ অক্টোবর সকালে এক হত্যাচেষ্টায় তিনি অল্পের জন্য বেঁচে যান। এ হামলায় পাঁচজন নিহত হয়। পরবর্তীতে অবসর জীবনে মার্গারেট থ্যাচার ২০১৩ সালের ৮ এপ্রিল লন্ডনের রিজ হোটেলে অবস্থানকালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর।

 

চলচ্চিত্র আয়রন লেডি

অস্কারের কল্যাণে আয়রন লেডি চলচ্চিত্রটি এখন সবার কাছেই পরিচিত। মার্গারেট থ্যাচারের জীবনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয় এই আয়ো পিকটি। মার্গারেট থ্যাচারের চরিত্রে মেরিল স্ট্রিপ অসাধারণ অভিনয় করে বিশ্বজোড়া প্রশংসিত হন।

মার্গারেট থ্যাচারের ভূমিকায় সম্ভবত আর কাউকে এতটা মানাত না। মূলত চলচ্চিত্রটি একজন নারীর সামর্থ্যকে তার স্বামীর সম্মান এবং এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণাকেই উপজীব্য করে তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে মার্গারেট থ্যাচারের সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে তার স্বামীর ভালোবাসা এবং সব সময় পাশে থেকে অনুপ্রেরণা দেওয়াকে মুখ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। যার ফলে একজন মার্গারেট থ্যাচার তার সামর্থ্য ও যোগ্যতার ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে নিজের প্রতি সুবিচার করতে পেরেছেন। যিনি সংসারের ভালোবাসা নিয়ে পরিচালনা করেছেন দেশ।

 

ছবি কথা বলে...

সর্বশেষ খবর