শনিবার, ৩ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
জহিরউদ্দিন মুহাম্মাদ বাবর

মুঘল ই আজম

পর্ব-১

র ণ ক ই ক রা ম

মুঘল ই আজম

ভারতবর্ষের সবচেয়ে ঐশ্বর্যমণ্ডিত সময় মনে করা হয় মুঘল সম্রাটদের শাসনামলকে। সম্রাট আওরঙ্গজেবের পতনকে অনেকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন বললেও প্রকৃত অর্থে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল ১৮৫৭ সালে। এর আগ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ বছরের বেশি সময় ভারতবর্ষ শাসন করেছেন মুঘলরা। যার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন মধ্য এশিয়ার সমরখন্দ ও ফারগানার অধিপতি বাবর। স্থাপত্যকলা, সমাজ সংস্কার, ঐশ্বর্যমণ্ডিত শাসন আর নানা কারণে মুঘল সম্রাটরা বরাবরই মানুষের কৌতূহলের শীর্ষে থেকেছেন। সেই মুঘল সম্রাটদের নিয়ে রকমারির শনিবারের বিশেষ ধারাবাহিক মুঘল ই আজম। প্রথম পর্বে থাকছে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের আদ্যোপান্ত।

 

ফারগানার উত্তরপুরুষ

ভারতের ইতিহাসের পুরোটা তাদের দখল অথচ মুঘল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর ভারতীয় ছিলেন না। সুদূর ফারগানা থেকে এসে ভারতবর্ষে স্থায়ী আসন গেড়েছিলেন তিনি। বর্তমান উজবেকিস্তানের পূর্বদিকে অবস্থিত একটি প্রদেশ ফারগানা। উজবেক রাজধানী তাসখন্দ থেকে ৪২০ কিলোমিটার পূর্বদিকে এর অবস্থান। ১৪৬৯ থেকে ১৫০৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে বর্তমান ফারগানা ও এর আশপাশের অনেক এলাকা নিয়ে গড়ে ৮৩৪৩৪২৮উঠেছিল ফারগানা রাজ্য। শুরুর দিকে ফারগানার রাজধানী ছিল আন্দিজান। সেই সময় ফারগানা ফলমূল উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। শুধু তাই নয়, আশপাশের রাজ্যগুলোর মধ্যে ফারগানা তুলনামূলকভাবে ঐশ্বর্যমণ্ডিত ছিল। রাজধানী আন্দিজানের সর্বত্র তুর্কিদের আধিক্য ছিল। ফারগানার আনাজপাতি, আঙ্গুর, তরমুজ আর নাশপাতি তখন দুনিয়াজোড়া প্রসিদ্ধ ছিল। আন্দিজান ছিল পশুচারণের জন্য বিখ্যাত। তা ছাড়া এখানকার মানুষও বেশ স্বাস্থ্যবান ছিলেন। এই স্বাস্থ্যবান ফারগানার রাজপরিবারের উত্তরপুরুষ ছিলেন মুঘল সম্রাট বাবর।

 

এক কিশোরের সংগ্রাম

বাবর তখনো কৈশোর পেরোননি। ১৪৯৪ সালের ৮ জুন ভূমিধসে ফারগানার আমির উমর শেখ মির্জা প্রাসাদের ওপর থেকে উপত্যকার গভীরে পড়ে নিহত হন। উমর শেখ মির্জার বড় পুত্র বাবর তখন অকশা থেকে ৩০ মাইল দূরে আন্দিজানের চারবাগিতে অবস্থান করছিলেন। পিতার মৃত্যুর একদিন পর খবর জানতে পারেন বাবর। বড় পুত্র হিসেবে উত্তরাধিকার সূত্রে রাজ্যের শাসনভার বাবরের হাতে চলে আসার কথা। কিন্তু ফারগানার অভিজাতরা মাত্র ১১ বছর বয়সী বাবরের কাছে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কারণ ফারগানার পার্শ্ববর্তী সমরখন্দের আহমেদ মির্জা উমর শেখ মির্জার মৃত্যুর এ সুযোগটি কাজে লাগাতে চাইবেন। আহমেদ মির্জা ছিলেন বাবরেরই আপন চাচা। ফারগানার সবার ধারণা ছিল আহমেদ মির্জা অবশ্যই ফারগানা আক্রমণ করবেন। এমন পরিস্থিতিতে ১১ বছরের এক কিশোরকে তারা কোনোমতেই নিরাপদ মনে করলেন না। ততদিনে কিশোর বাবর সিংহাসন বুঝে নেওয়ার জন্য চারবাগি থেকে ফারগানায় ফিরেছেন। অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর রাজ্যের অভিজাতরা বাবরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন। ফারগানার বেগ দলপতিরাও বাবরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন। নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার কাজে বাবর তার পরিবারের লোকজনের তীব্র সমর্থন ও সাহায্য লাভ করেন। বাবরের জীবনের শুরু থেকে পরবর্তী সময়ে অনেকেই তার স্বপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আল মজালদ বেগ, হাসান ইবনে ইয়াকুব, বাইসালঘা, মীর গিয়াস তগাই, কম্বর আলী, কাসিম বেগ, বাবা কুল বেগ, নিজের নানী আলসান দৌলত বেগম, ঔজিগ হাসান, আলী দরবেশ খোরাসানিসহ বেশকিছু মানুষকে নিজের চারপাশে বিশ্বস্ত হিসেবে পেয়েছিলেন। তাদের উদার সহায়তার ফলেই শেষ পর্যন্ত তিনি সিংহাসনে টিকে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।

১৪৯৪ সালে বাবর যখন প্রথম ফারগানার সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন চারপাশ শত্রু ঘেরা ছিল। বাবরের চাচা অনবরত তাকে সিংহাসনচ্যুত করার চেষ্টা করেছিলেন। এক সময় তিনি বাবরকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সফল হন। ফলে জীবনের বেশকিছু সময় বাবরকে আশ্রয়হীন এবং যাযাবর থাকতে হয়েছিল। ওই সময় বাবরের সঙ্গে কেবল তার বন্ধু এবং সাধারণ চাষিদের যোগাযোগ ছিল।

 

সমরখন্দ-ফারগানা পেয়েও হারালেন

সমরখন্দে অভিযানের উদ্দেশ্যে বাবর প্রথমে প্রায় ৩০০ অশ্বারোহীর একটি দল ইয়ারলকের দিকে প্রেরণ করেন। দলটি কোনো বাধা ছাড়াই ইয়ারলকে পৌঁছতে সক্ষম হয়। বাবর এখানে প্রচুর পরিমাণে ধনসম্পদ লাভ করেন। এর ঠিক দুদিন পর বাবর সিরাজে পৌঁছেন। সিরাজ বাবরের কাছে আত্মসমর্পণ করে। সিরাজ থেকে বাবরের বাহিনী ইয়াম নামক একটি স্থানে পৌঁছে। এর কয়েক দিন পরই বাবর সমরখন্দের সীমানায় পৌঁছেন। তিনি সমরখন্দ অবরোধ করলেন। বাবর প্রায় সাত মাস সমরখন্দ অবরোধ করে রেখেছিলেন। দীর্ঘ অবরোধের ফলে সমরখন্দ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। সেই যুগের রীতিই ছিল যুদ্ধজয়ের পর বিজয়ী সেনাবাহিনী বিজিত রাজ্যে লুটপাট চালাবে। কিন্তু তৈমুরের রাজধানী হওয়ায় বাবর শহরটিকে ধ্বংস করতে চাচ্ছিলেন না। নীতিগতভাবেও বাবর ধ্বংসলীলার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাই তিনি কঠোরভাবে লুটপাট নিষিদ্ধ করেন। বাবরের এমন সিদ্ধান্তে বাহিনীর অধিকাংশ যোদ্ধা অসন্তুষ্ট হয়ে বাবরকে ত্যাগ করে। সমরখন্দের নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য বাবরের হাতে খুব অল্প সংখ্যক যোদ্ধাই ছিল। অন্যদিকে কিছুদিনের মধ্যে ফারগানায় বিদ্রোহের কারণে আবার ক্ষমতা হারান বাবর। ফারগানা পুনরুদ্ধারের জন্য পুনরায় অগ্রসর হলে তার বাহিনীর লোকজন তাকে ফেলে চলে যায়। ফলে সমরখন্দ ও ফারগানা উভয় রাজ্য হারিয়ে ফেলেন বাবর।  ১৫০১ সালে বাবর আবার সমরখন্দের দখল নিতে প্রস্তুতি নেন, তবে আবারও তার পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষ মোহাম্মদ শিবানি খানের কাছে পরাজিত হন। তিনি তার কিছু অনুসারী নিয়ে পালিয়ে আসতে সমর্থ হন।

পরবর্তীতে বাবর একটি শক্তিশালী দল গঠনে মনোযোগী হন এবং প্রধানত তাজিক ও বাদাকশানদের তার দলে অন্তর্ভুক্ত করেন। আস্তে আস্তে শক্তি বাড়তে থাকে বাবরের।

 

রক্তে নাচে তৈমুর-চেঙ্গিস

বাবর কেবল ফারগানার রাজপরিবারের উত্তর-পুরুষ হয়েই পৃথিবীতে আসেননি, তার পূর্বপুরুষদের গল্পটা আরও বেশি তাত্পর্যপূর্ণ। পৃথিবী-বিখ্যাত যোদ্ধা তৈমুর লং। তিনি অর্ধেক পৃথিবীর অধীশ্বর ছিলেন। পৃথিবীটা নিজের পায়ের নিচে পিষে ফেলতে চেয়েছিলেন তৈমুর লং। সাফল্যও নেহাতই কম ছিল না। আজকের তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, কুয়েত, ইরান থেকে মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ অংশ (কাজাখস্তান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান, পাকিস্তান, ভারত, এমনকি চীনের কাশগর পর্যন্ত) তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৪০৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মারা যান তৈমুর লং। তৈমুরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই ভেঙে পড়ে এই বিশাল সাম্রাজ্য। সাম্রাজ্যের বিশাল আয়তন, যোগ্য নেতৃত্ব আর ক্ষমতার লোভ ছিল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ। অল্প সময়ের মধ্যেই তৈমুরের স্বপ্নের সাম্রাজ্যের অনেকাংশই বেদখল হয়ে পড়ে। তবে তৈমুরের পৌত্র আবু সাঈদ মির্জা বিশাল এই সাম্রাজ্যের বেশকিছু ভূখণ্ড পুনরায় উদ্ধার করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দাদার সাম্রাজ্য অটুট রাখার চেষ্টা করে গেছেন আবু সাঈদ মির্জা। কিন্তু সাঈদ মির্জার মৃত্যুর পর তার পুত্ররা সাম্রাজ্যের বাকি অংশটুকু নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেন। আর তখনই ফারগানা রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন আবু সাঈদ মির্জার চতুর্থ পুত্র উমর শেখ মির্জা।

১৪৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। উমর শেখ মির্জার ঔরসে জন্মগ্রহণ করলেন বাবর। তার মাতার নাম কুতলুগ নিগার খানম। তিনি সরাসরি চেঙ্গিস খানের বংশধর। কুতলুগ নিগার খানমের পিতার নাম ইউনুস খান। ইউনুস খান চেঙ্গিস খানের দ্বিতীয় পুত্র চুগতাই খানের বংশধর ছিলেন।

অন্যদিকে উমর শেখ মির্জা সরাসরি তৈমুরের বংশধর। সেই সূত্রে বাবর তৈমুর এবং চেঙ্গিস খান—উভয়েরই বংশধর। এই শিশুর শরীরে দুই বিজয়ীর রক্ত বইছে। পরবর্তীতে বাবরের বৈচিত্র্যময় জীবনে যার ছাপ মেলে। ত্রয়োদশ শতকের শুরুর দিকে চেঙ্গিস খানের রাজ্য বৃদ্ধি পায় এবং তিনি একটি স্থায়ী রাজ্যের পত্তন করেন। তো এই চেঙ্গিস খানের বংশধরদের অর্থাৎ চেঙ্গিস, তৈমুর, বাবর সবাইকেই মোঙ্গল বলা হয়। তাদের আবার তুর্কি/টার্কিও বলা হয়।

 

বাবার পথ ধরে তৈমুরের রাজধানীতে

তৈমুর আর চেঙ্গিসের রক্ত যার শরীরে, বিজয়ের নেশা তাকে আন্দোলিত করবেই। সেই সঙ্গে বাবরের পিতা উমর শেখও ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কিশোর বাবরের ভিতর সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা সঞ্চারিত হয়েছিল দারুণভাবে। চাচার হাত থেকে ফারগানাকে রক্ষা করার পর বাবর নজর দেন তৈমুরের রাজধানী সমরখন্দের দিকে! চাচার রাজ্যে তখন নতুন শাসক বাবরের চাচাতো ভাই সুলতান হোসেন। খবর এলো সমরখন্দের ভিতর তখন অভ্যন্তরীণ কোন্দলে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। বাবর এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইলেন। কিশোর বয়সেই সমরখন্দ অবরোধের মতো দুঃসাহসিক ঘটনা ঘটিয়ে বাবর সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। ঘটনা ১৪৯৬ সালের শেষ দিকের। কিন্তু সে সময় বাবর সমরখন্দের ভিতরে প্রবেশ করতে পারেননি। দীর্ঘদিনের অবরোধের পর বাবর ফারগানায় ফিরে আসতে বাধ্য হন। কারণ খাদ্যাভাব ও তীব্র শীত। ফেরত এসে নিজেকে আরও শানিয়ে নিতে চাইলেন। দেখা করলেন বাবরের আরেক চাচা মাহমুদ মির্জার সঙ্গে। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে তৎকালীন তৈমুরের জীবিত বংশধরদের ভিতরে মাহমুদ মির্জা ছিলেন সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে। তৈমুরের অন্য বংশধররা মাহমুদ মির্জাকে খুব সম্মান এবং তার কথা মেনে চলত। বাবর যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন মাহমুদ মির্জা অস্তারাবাদ ও খোরাসানের শাসক ছিলেন। চাচার সঙ্গে দেখা করে নিজের অভিভাবক হিসেবে তার স্নেহ চাইলেন বুদ্ধিমান বাবর। মাহমুদ মির্জা তখন বাবরের রাজ্য পরিচালনার অনুমতি দিলেন। মাহমুদ মির্জার মতো শক্তিশালী হাতের স্নেহ পেয়ে নিজের ক্ষমতা আরও বেশি পাকাপোক্ত করার পরিকল্পনা হাতে নিলেন। ফারগানার নিরাপত্তা আরও বাড়িয়ে দিলেন। এরপর আন্দিজানে কাসিম বেগের নেতৃত্বে একটি অভিযান পরিচালনা করেন। সেখানে জংলি উপজাতির লোকেরা বাস করত। আক্রমণে ভীত হয়ে তারা আত্মসমর্পণ করল এবং বাবরের আনুগত্য স্বীকার করল। সেই সঙ্গে রাজস্ব হিসেবে দুই হাজার ভেড়া ও এক হাজার ৫০০ ঘোড়া প্রদান করে। আন্দিজান থেকে ঔরাটিয়া দখল করে বাবরের সেনাবাহিনী। পরে সেটি হাতছাড়া হয়ে গেলেও থামেননি বাবর। বাবরের মাথায় তখনো সমরখন্দ। ১৪৯৭ সালে তিনি আবারও সমরখন্দ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। প্রায় একই সময়ে তৈমুরের বংশধরদের ত্রাসে পরিণত হন হুসাইন মির্জা নামক একজন সুলতান। কারণ তখন তার আক্রমণে খসরু শাহ, মাসুদ মির্জাসহ তৈমুরের অনেক বংশধরই নিজ নিজ এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারান। তখন অনেক নিঃস্ব রাজাই বাবরের শরণাপন্ন হন। বাবর সরাসরি তাদের সাহায্য করতে না পারলেও নিরাশ করেননি। সময়-সুযোগ বুঝে আবুল করিম নামক একটি স্থানে বাবর হুসাইন মির্জাকে বাধা দেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে হুসাইন মির্জাকে পরাস্ত করেন বাবর। পরাজিত হুসাইন মির্জা খোরাসানের দিকে ফেরত যান। পরবর্তীতে সমরখন্দ আক্রমণে বাবর এসব মির্জার সহায়তা পেয়েছিলেন।

 

চাচার মৃত্যু আল্লাহর অনুগ্রহ

ধবলা হয়ে থাকে বাবর যখন সিংহাসনে বসেন তখন চাচা আহমেদ মির্জাই ছিলেন তার সবচেয়ে বড় শত্রু। সেই আহমেদ মির্জার আকস্মিক মৃত্যু বাবরের জন্য আশীর্বাদ হয়ে ধরা দিল। আহমেদ মির্জা ফারগানা অভিমুখে যাত্রা করার পর প্রচণ্ড বৃষ্টির কবলে পড়েন। কর্দমাক্ত রাস্তার কারণে কোনো ঘোড়া, উট বা সৈন্য কেউই সামনে এগোতে পারছিল না। অন্যদিকে আহমেদ মির্জার সৈন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে মহামারী।

মহামারীতে সৈন্য-সামন্ত আর পশুদের গণমৃত্যু আহমেদ মির্জাকে বিব্রত করে তুলল। তিনি সমরখন্দে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। অভিযান পরিত্যক্ত ঘোষণা করেও আর শেষ রক্ষা হয়নি আহমেদ মির্জার। ফেরার পথেই কষ্ট আর ক্লান্তি জ্বরে ভুগতে শুরু করেন তিনি। বেশ কিছুদিন জ্বরে ভোগার পর ১৪৯৪ সালের জুলাই মাসে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন আহমেদ মির্জা। ৪৪ বছর বয়সী চাচার মৃত্যু বাবরের সামনে সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়।

নিজের আত্মজীবনী ‘বাবরনামা’য় এ ঘটনাটিকে বাবর তার প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ এ ঘটনাটিই বাবরকে সাফল্যের দিকে ধাবিত করে।

 

শৈশবের দুরন্তপনা

জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর। তার নামের শেষ অংশ অর্থাৎ ‘বাবুর’/‘বাবর’ শব্দটির অর্থ হলো ‘বাঘ’। শিশু বাবর সত্যিকার অর্থেই পরবর্তী জীবনে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। বাবর বাঘের মতো সাহসী আর ক্ষিপ্র ছিলেন। বারলাস উপজাতির মাঝখানে বেড়ে উঠলেও বাবর জাতিতে তুর্কি ও পারস্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ছিলেন।

এসব অঞ্চল পরবর্তীতে ইসলামিক জাতিতে পরিণত হয়। পরবর্তী সময়ে তুর্কিস্তান এবং খোরাসান নামে পরিচিতি লাভ করে। ছোটবেলা থেকেই বাবরের দুরন্তপনার প্রমাণ পাওয়া যায়। কথিত আছে বাবর ছোটবেলা থেকেই দৃঢ়চিত্তের মানুষ ছিলেন। শুধু তাই নয়, শক্তি, সামর্থ্য এবং শারীরিকভাবেও দারুণ সামর্থবান ছিলেন। তিনি কেবল ব্যায়ামের জন্য দুই কাঁধে দুজনকে নিয়ে ঢাল বেয়ে দৌড়ে নামতেন। কিংবদন্তি আছে, বাবর তার সামনে পড়া সব নদী সাঁতরে পার হতেন এবং উত্তর ভারতের গঙ্গা নদী দুবার সাঁতরে পাড়ি দিয়েছিলেন।

 

আত্মজীবনী বাবরনামা

বিশ্ব ইতিহাসে খুব কম বিখ্যাত ব্যক্তিই নিজের কীর্তিগাথা নিজের জীবদ্দশায় লিপিবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। সেদিক থেকে হিসাব করলে বাবরকে বুদ্ধিমান ও ভাগ্যবান একজন বলা চলে। বাবরের আত্মজীবনী বাবরনামা ইতিহাসের এক অনন্য দলিল হিসেবে সর্বত্র দারুণভাবে সমাদৃত। বাবরনামার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ‘বাবরের লেখা’ বা ‘বাবরের বই’। বাবরের এই আত্মজীবনী তুজুক-ই-বাবরি নামেও যথেষ্ট পরিচিত। এই ঐতিহাসিক গ্রন্থটি চাঘতাই তুর্কি ভাষায় রচিত। উইগুর ও উজবেক ভাষার সংমিশ্রণে তৈরি এই কৃত্রিম ভাষাটি মধ্য এশিয়ায় চাঘতাই খানদের রাজত্বে সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্তও এই ভাষা মধ্য এশিয়ার একটি অন্যতম সাহিত্যিক ভাষা হিসেবে ব্যাপক প্রচলিত ছিল।

বাবরের মৃত্যুর পর মুঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে হিজরি ৯৯৮ সন বা ১৫৮৯-৯০ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সভাসদ আবদুল রহিম বইটি সম্পূর্ণ পারসিক ভাষায় অনুবাদ করেন। বাবরের জীবন ও ইতিহাস সংক্রান্ত বিষয়ে ওই বইটিকে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বস্ত গ্রন্থ মানা হয়। তবে কেবল আত্মজীবনী বা ইতিহাসগ্রন্থ হিসেবেই নয়, সাহিত্য মূল্যের দিক থেকেও বইটি দারুণ প্রশংসিত।

গ্রন্থটির ঐতিহাসিক মূল্য যথেষ্টই বেশি। বাবরের ব্যক্তিজীবনের ইতিহাসের পাশাপাশি মধ্যযুগের মধ্য এশিয়ার অধিবাসীদের জীবন, চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা, ধর্মাচরণ, অভিজাত শ্রেণির জীবন, লেগে থাকা ক্রমাগত সংঘর্ষ, তার ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে আসা দুর্ভোগ প্রভৃতি নানা বিষয়ে মূল্যবান আলোকপাত পাওয়া যায় এই গ্রন্থটি থেকে। বাবরের সমকালীন দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের বিষয়ে দারুণ ধারণা পাওয়া যায়।

 

হিন্দুকুশে ভাগ্যবদল

ফারগানা আর সমরখন্দ হারিয়ে সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়লেন বাবর। দীর্ঘদিন কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করলেন। অবশ্য তখনো তার দলে বিভিন্ন যোদ্ধা ভিড় করছিল। ফলে ফাঁকে ফাঁকে বাবরের শক্তিও বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বাবরের সৈন্য ও অনুসারীদের মধ্যে একটা বিশ্বাস ছিল, বাবর নিশ্চিত কোনো না কোনো সুফল বয়ে আনবেন। তারা স্বপ্ন দেখত বাবর কোনো না কোনো বড় রাজ্যের শাসক হবেন। আর বাবর রাজা হওয়ার অর্থই হচ্ছে তাদের ভাগ্য বদল। তাদের সেই স্বপ্ন আস্তে আস্তে সত্যি হচ্ছিল। কারণ তখন ভাগ্যও আস্তে আস্তে বাবরের সুপ্রসন্ন হয়ে ওঠে।

বাবর যখন দিগ্বিদিক উদ্দেশ্যহীন ঘুরছেন, তখন কাবুলের শাসক উলুঘ বেগ মির্জা মৃত্যুবরণ করেন। উলুঘ বেগও সম্পর্কে বাবরের চাচা। উলুঘ বেগের মৃত্যুর পর কাবুলের সিংহাসনে বসেন মির্জা আবদুর রাজ্জাক। এর মধ্যেই মুহাম্মদ মুকিম নামে এক উপজাতি সরদার আবদুর রাজ্জাককে ক্ষমতাচ্যুত করে সিংহাসন দখল করে বসেন। তখন কাবুলের অভ্যন্তরে দারুণ কোন্দল দেখা দিল। সেখানকার অভিজাতরা চাইছিলেন শক্তিশালী কেউ একজন কাবুলের ক্ষমতা গ্রহণ করুক। অল্পদিনের মধ্যেই কাবুল রাজদরবারের অভিজাতদের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণের আমন্ত্রণ পেলেন বাবর। তখন বাবরের কাছে এই প্রস্তাব ছিল রীতিমতো স্বপ্ন। কোনো ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই এই প্রস্তাব লুফে নিলেন বাবর। কিন্তু বাবরের অবস্থান ছিল কাবুল থেকে অনেক দূরে। তা ছাড়া পথিমধ্যে শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকিও ছিল। তখন যাত্রাপথ সংক্ষিপ্ত করার জন্য হিন্দুকুশ পর্বতের মধ্য দিয়ে  যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন বাবর। উদ্দেশ্য একটাই—যত দ্রুত সম্ভব কাবুলে পৌঁছানো। কিন্তু কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। পুরো পর্বতশ্রেণি বরফে ঢাকা। এরপরও বাবর পিছু হটলেন না। এর মধ্যেই আবার বাবরের পক্ষে আরও ৩০ হাজারের একটি সেনাবাহিনী যোগ দিল। এরা মূলত মাহমুদ মির্জার সৈন্য। মির্জার স্বেচ্ছাচারিতায় বিরক্ত হয়ে তারা বাবরের পক্ষে যোগ দিল। মূলত এই ৩০ হাজার সৈন্য যোগ দেওয়ার পরই বাবরের ভাগ্য পাল্টে যেতে শুরু করে।

তবে হিন্দুকুশের বরফে ঢাকা রাস্তায় চলতে গিয়ে খসরু শাহ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে তিনি আর সামনে না এগিয়ে কাহমর্দ ফিরে যান। তিনি বাবরের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তিনি বাবরের সঙ্গে কাবুলে দেখা করবেন। এ প্রসঙ্গে বাবর তার ‘বাবরনামা’য় লিখেছেন— ‘খসরু শাহের এই চরিত্রের কথা আমার কাছে অজানা ছিল না। আমি আগে থেকেই জানতাম তিনি কাপুরুষ এবং কষ্ট সহ্য করার মতো শক্তি তার ছিল না। তিনি আমার সঙ্গে ওয়াদা করলেন, তিনি খোরাসান, ঘুলে ও দজানার রাস্তা ধরে খোরাসানের উদ্দেশে রওনা হবেন। তারপর তিনি কাহমর্দ থেকে নিজের পরিবার-পরিজনকে নিয়ে কাবুলে আবার আমার কাছে ফিরে আসবেন। তবে আমার কাছে তার ওয়াদার কোনো গুরুত্ব ছিল না।’

এদিকে কাবুলের উদ্দেশে বাবরের যাত্রা একেবারে শত্রুমুক্ত ছিল না। উজবেকরা তখন বাবরের পিছু নিয়েছিল। ফলে অনেক জায়গাতেই ছোটখাটো সংঘর্ষের মুখোমুখি হতে হয়েছে বাবর ও তার সৈন্য দলকে। ছোটখাটো সংঘর্ষ হচ্ছিল। উজবেকরা বেশির ভাগ সংঘর্ষেই পরাজিত হয়ে পিছু হটছিল। বাবর এরপর কোনো প্রকার বাধা ছাড়াই ঘুরবুন্দ, লমঘান তুরখানি এলাকা পাড়ি দিতে লাগলেন। এসব এলাকা মূলত আফগানদের অধীনে ছিল। তারাও বাবরকে বাধা দেওয়ার সাহস করেনি।

দুর্গম বরফাবৃত পথের কারণে বাবরের বেশকিছু সহযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করলে বাবর কিছুটা ভেঙে পড়েন। বাবর এমনিতেই পূর্ববর্তী ঘটনাগুলোর জন্য বিপর্যস্ত ছিলেন। এরপরও সব দ্বিধা ছুড়ে ফেলে বাবর আর তার সেনাবাহিনী আবারও কাবুলের দিকে ছুটতে থাকলেন। সব বাধা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত কাবুল দখল করলেন বাবর। ধীরে ধীরে কাবুল এবং সমগ্র গজনি এবার বাবরের পদানত হলো। ‘হুমায়ুননামা’র বর্ণনানুযায়ী, এই ঘটনা ৯১০ হিজরির রবিউস সানি মাসের শেষ ১০ দিনের ঘটনা। গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, ১৫০৪ সালের অক্টোবরের ঘটনা এগুলো। এ সময় বাবরের বয়স মাত্র ২৩ বছর। এর ফলে তিনি একটি নতুন ধনী রাজ্য লাভ করেন এবং নিজের ভাগ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন এবং বাদশাহ উপাধি গ্রহণ করেন। ১৫০৬ সালে হুসাইন বায়কারাহর মৃত্যু তার অভিযানকে বিলম্বিত করে। বাবর তার মিত্রপক্ষের শহর হেরাতে দুমাসের জন্য অবস্থান করে সম্পদের অভাবে এলাকা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

এর মধ্যেও তিনি এই রাজ্যকে প্রাচুর্যমণ্ডিত করেছেন।

হেরাতের শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের আধিক্য তাকে চমত্কৃত করে। তিনি অহিগুরের কবি মীর আলী শির নাভাইর সঙ্গে পরিচিত হন। নাভাই তার সাহিত্যে চাঘাতাই ভাষা ব্যবহার করতেন, তিনিই বাবরকে তার আত্মজীবনী লিখতে উৎসাহিত করেন।

পরবর্তী পর্ব আগামী শনিবার

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর