শনিবার, ১০ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

সময় এখন নারীর

সময় এখন নারীর

বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, রাজনীতি, অর্থনীতি, নেতৃত্বসহ সব পেশায় বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা। ৮ মার্চ ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ প্রতিদিনের আয়োজনে ‘সময় এখন নারীর’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ইডব্লিউএমজিএল কনফারেন্স রুমে নিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রধান বার্তা সম্পাদক শাহ্নাজ মুন্নী অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। বৈঠকে অংশ নেন রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, শিক্ষক, পুলিশ, খেলোয়াড়, আলোকচিত্রী ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।  বৈঠকের চুম্বকাংশ তুলে ধরেছেন— গোলাম রাব্বানী, জয়শ্রী ভাদুড়ী, তানিয়া তুষ্টি, আব্দুল কাদের, সাইফ ইমন মিডিয়া পার্টনার : নিউজ টোয়েন্টিফোর ছবি : রোহেত রাজীব

 

পুরুষ এবং নারী মানুষ হিসেবে মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবে

—শামীম আজাদ, কবি ও শিক্ষক

সময় সবসময়ই নারীর ছিল। কিন্তু নারী তার সুব্যবহার করতে পারেনি। প্রচলিত একটি কথা আছে, তোর বাপেরও সাধ্য নাই। কিন্তু নারীর সাধ্য আছে। মায়ের সাধ্য আছে। মানুষের ভিতরের প্রতিটি কণায় তার মাকে দেখা যায়। একজন পুত্রও যখন তার আয়নায় চোখ মেলে তখন তার মাকেই দেখে। মায়ের এই যে স্থান তা কৌশলগত কারণে একসময় বেহাত হয়ে যায়। আমরা তার পুনরুদ্ধার করতে চাইছি না। কারণ সমাজ বিবর্তনের সঙ্গে  সঙ্গে সেই বেশি উত্তম মানুষ, যিনি পরিবর্তনকে স্বীকার করে এগিয়ে যান। আন্তর্জাতিক নারী দিবস এলে আমরা বুঝি আমরা নারী।  আমাদের শনাক্ত করা হয় আমাদের গুণে। নারীর দীর্ঘজীবন লাভ এবং সে জীবনে শূন্যস্থান না রাখার প্রতিফলন পাওয়া যায়। আমি আমার জীবনে এটাই করেছি যে, কোনো শূন্যস্থান রাখিনি। সেটা ন্যায়ের ভিত্তিতে করেছি। যে মা আমাকে কোলে নিয়েছে সেই মা একই সঙ্গে আমার ভাইকেও কোলে নিয়েছে। মায়ের ঘুম পাড়ানি গানের মধ্য দিয়ে যদি সেই মন্ত্র সন্তানদের মাঝে তুলে দেওয়া যায় তাহলে তারা সত্যিকার মানুষ হয়ে উঠবে। মানুষ সমান। পুরুষ মানুষ, শিশু পুরুষ, যুবা পুরুষ, তরুণ পুরুষ—মেয়েদের আয়ে বেঁচে থাকা পুরুষ, প্রতিবন্ধী পুরুষ এবং অসহায় পুরুষ নয়। আরও একটি বিষয় বলতে চাই, তা হলো পুরুষ সমান সমান, বিয়োগ নারী নয়। হায়রে মানুষ, হায়রে মানুষের বীজ তুমি কেন মানুষ হলে না।  এই মন্ত্র প্রতিটি মাকে দিয়ে দিতে হবে। তাহলে পুরুষ এবং নারী উভয়ই মানুষ হিসেবে মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবে।

 

নারীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে তারা সামনে এগিয়ে যাবে

নঈম নিজাম, সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সময় এখন নারীর এগিয়ে যাওয়ার। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি রাজনীতি, অর্থনীতি ও নেতৃত্বে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা নারী ক্ষমতায়নের কথা বলি কিন্তু এখনো নারীকে অর্থের অভাবে রাস্তায় সন্তান প্রসব করতে হয়। সময়ের অনেক পরিবর্তন এলেও এখনো গ্রামের মেয়েটি জানে না তার বয়ঃসন্ধিতে করণীয় কী? সে তার সমস্যা কার সঙ্গে শেয়ার করবে?  তার মার শিক্ষাগত যোগ্যতা বা সচেতনতা না থাকার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা কোনটি হবে তা সে জানে না। আমরা নারী দিবসের রং নিয়ে চিন্তা করি। রং বা দিবস তো দূরের কথা, এখনো প্রত্যন্ত এলাকার নারী তার ন্যূনতম অধিকারের কথাও জানে না। সেগুলো পূরণ তো আরও সুদূরপ্রসারী। আমরা ২০ বছর আগের জায়গা থেকে হিসাব করলে দেখব, এখন হয়তো অনেক এগিয়েছি। কিন্তু নারীদের এগিয়ে নিতে আমাদের পদক্ষেপ আরও জোরালো হতে হবে। নারীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে। এই নারীই ঘুরে দাঁড়াতে পারে, সামনে এগিয়ে যাবে। গণমাধ্যমেরও নারীদের এগিয়ে নিতে কাজ করতে হবে। নিজেদের অবস্থান থেকে নারীদের এগিয়ে নিতে হবে। নারী ক্রিকেটার, ফুটবলাররা মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, অন্য দেশের খেলোয়াড়দের পরাস্ত করছে।  তখন আমরা আশার আলো দেখি। প্রতিটি পেশায় এখন দুর্দান্ত দাপটে অবস্থান করছে নারীরা। এখনো যেসব সমস্যা আছে তা চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করলে নারীদের অগ্রযাত্রা আরও বেগবান হবে।

 

তিরাশি ভাগ নারী পরিবারের কাছে অবহেলিত

—ইমদাদুল হক মিলন, সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

সময় এখন নারীর— আমি এ কথাটির সঙ্গে পুরোপুরি একমত নই। আমি প্রথমেই বলতে চাই, শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বের পুরুষ মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত সময় পুরোপুরি নারীর হবে না। এই মানসিকতার পরিবর্তনটা কীভাবে হতে পারে? আর এটা নানাভাবেই হতে পারে। বেগম রোকেয়া ছিলেন এই উপমহাদেশে নারী শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়ার প্রথম পথিকৃৎ। কীভাবে পুরুষের পাশাপাশি নারী  এগিয়ে যাবে সেই চিন্তাধারা থেকে তিনি কাজ করেছেন। তখনই তিনি বলেছিলেন, মানুষের সভ্যতা একটি সাইকেলের মতো। সাইকেলকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যেমন দুটো চাকার প্রয়োজন হয়, তেমনি সভ্যতার উন্নয়নেও নারী-পুরুষ উভয়ের ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের নারীদের নানাভাবে হেনস্থা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কিছুক্ষণ আগে সম্মানিত এমপি মহোদয় বলেছেন, একটি গবেষণায় দেখা গেছে নারীদের শত্রু নারীই। আমরা যদি আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষগুলোর দিকে তাকাই তবে দেখব ৮৩ ভাগ নারী পরিবারের কাছে অবহেলিত। আর ৯২ ভাগ নারী গণপরিবহনে নির্যাতিত। খবরের কাগজ খুললেই দেখব নারী ও শিশু হত্যা, ধর্ষণ, যৌতুক ও নানাভাবে নির্যাতিত। শুধু তাই নয়, একটি কন্যাশিশু তার পরিবারের কাছেই নিরাপদ নয়। এ জন্য সচেতন ভূমিকায় থাকবেন শিক্ষিত শ্রেণি, রাজনৈতিক দল, সরকার।

 

গণমাধ্যমকেও নারীদের এগিয়ে নিতে হবে

অ্যাডভোকেট নূরজাহান বেগম মুক্তা, সংসদ সদস্য

একটি প্রবাদ ছিল—‘ভাগ্যবানের বউ মরে, অভাগার মরে গরু’। কারণ, স্ত্রী মারা গেলে আবার বিয়ে হবে, যৌতুক পাবে, বাড়তি অর্থ সমাগম হবে। সে অবস্থা আর নেই। নারী নির্যাতন আইন হয়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে। এখন পুরুষ নির্যাতন আইনের কথা অনেককেই বলতে শুনি। একজন বাবা তার মেয়েকে বিয়ে দেবেন অপ্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থাতে। তখন মা বাধা দিলেই ওই পুরুষ মনে করছেন তাকে নির্যাতন করা হচ্ছে। গণমাধ্যমকেও নারীদের এগিয়ে নিতে কাজ করতে হবে। নারীরা রাজনীতিতে এগিয়ে আসছে। কিন্তু নারীরা কি এলাকায়  গিয়ে স্বাধীনভাবে গণসংযোগ, মিটিং, মিছিল করতে পারে? পুরুষরা ভাবে আমরা থাকতে নারীকে কেন মিছিলে নেতৃত্ব দিতে হবে। নারীরা কীভাবে কাজ করছে এলাকায়, সংসদে তাদের পারফরম্যান্স জরিপ করতে হবে। নারীরা কতটুকু কাজ করতে পারছে তা যাচাই-বাছাই করতে হবে। বর্তমানে সংসদে ৭২ জন নারী সদস্য আছেন। সংরক্ষিত আসনে ৫০ আর ২২ জন সরাসরি আসনে।  প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেত্রী, সংসদ উপনেতাও নারী। এটা সাফল্যের ব্যাপার।

 

নারী-পুরুষের কোনো ভেদাভেদ নেই

—নিলোফার চৌধুরী মণি, সাবেক সংসদ সদস্য

নানী-দাদিরা ছেলেদের বলতেন, সোনার আংটি বাঁকাও ভালো। সে সময় মেয়ে হিসেবে নিজেকে কিছুটা ছোট মনে হতো। ভাত-কাপড়ের অভাবটা হয়তো বুঝিনি কিন্তু মানসিকতার অভাবটা ঠিকই টের পেয়েছি। বাবাকে বলতে শুনেছি, মেয়ে অনেক বড় হলেও আমার নাম হবে না। কিন্তু ভাইকে বুঝিয়ে বলতেন তুমি কিছু করলে আমারই নাম হবে। সেই সময় আমি সংকল্প করেছি আমাকে যেভাবেই হোক বড় হতেই হবে। আমি এও বলব, সেদিন পরোক্ষভাবে আমার বাবাও আমার পাশে ছিলেন। সেদিন বাবার মুখে এ  কথা না শুনলে হয়তোবা আপনাদের সামনে আমার এভাবে আসা হতো না। আর সেদিক থেকেই বলব আমি সফল। কিন্তু সময় এখন নারীর। এটা অনেকটা এরকম ব্যাপার, রাজা রাজ্য শাসন করে আর রানী রাজাকে শাসন করে। সুতরাং রানী রাজ্য শাসন করে এমনটা যদি আমি মনে করি তবে তা হবে পাগলের সুখ মনে মনে। এমনটা মনে করলে আমার কিছু বলার নেই।  কিন্তু আমরা তো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে মানুষ। নারী-পুরুষের কোনো ভেদাভেদ নেই। এটি ভাবতে পারলেই আমরা সফল হব।

 

সম্পত্তির সমবণ্টন হওয়া উচিত

—কামরুন নাহার ডানা, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদ

নারী হিসেবে নয়, প্রথমত আমি মানুষ। আমার বাড়ি রংপুর। বেগম রোকেয়ার বাড়িও ছিল সেখানেই। নারীদের এগিয়ে যাওয়ার যাত্রাটা শুরু করেছিলেন তিনি। একা একা যুদ্ধ করেছেন পুরো সমাজের বিরুদ্ধে। তার কথা আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। আমি যে পরিবারে বড় হয়েছি তা ছিল সংস্কৃতিবান্ধব। তাই নিজেকে আমি সৌভাগ্যবান মনে করছি। আমি খুব ছোটবেলা থেকেই সাইকেল চালাতাম। আমি সেই শহরে হোন্ডাও চালিয়েছিলাম টানা তিন মাইল। আমাকে কেউ টিজ করেনি। কটু কথা বলেনি। তবে খেলাধুলায় আসার পর  আত্মীয়স্বজনরা কটু কথা বলত। ভালো বিয়ে হবে না এসব কথা বলত। খেলাধুলার পর এক সময় সংগঠক হিসেবে কাজ শুরু করি। অনেকেই ঈর্ষা করত। টানা কয়েক বছর যুদ্ধ করলাম। এক সময় মেয়েদের ফুটবল ক্যাম্পিং শুরু করলাম। মৌলবাদীরা বাধা দিতে শুরু করে। কিন্তু আমি কোনো কিছুকে পাত্তা না দিয়ে ক্যাম্পিং শুরু করলাম; যার ফলাফল আজকের মহিলা ফুটবল দল, মহিলা ক্রিকেট দল।  আর একটা বিষয় হলো, সম্পত্তির বণ্টনে ছেলে ও মেয়ের ক্ষেত্রে সমান হওয়া উচিত।

 

নারীরা নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন

—অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা, প্রভোস্ট, রোকেয়া হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সময় এখন নারীর পক্ষে কথাটি নিয়ে অনেকের মাঝে প্রশ্ন উঠেছে। আমি মনে করি কথাটি ঠিক। এক সময় নারীকে  সতী প্রমাণে মৃত স্বামীর সঙ্গে দাহ হতে হয়েছে। বাল্যবিয়ে করেও দুই বছরের মাথায় বিধবা হতে হয়েছে। এখন অন্তত সে পরিস্থিতির পরিবর্তন এসেছে। নারীর পদচারণা বেড়েছে সামাজিক বিভিন্ন অঙ্গনে। তারা সফলও হচ্ছে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। যখন নারী এমন নেতৃত্বস্থানীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তখন অনেকেই ভাবছেন কাজটি অনেক সহজ। কিন্তু আসলেই কি তা সহজ ছিল? ছিল না।  অনেক চড়াই-উত্রাই পার হয়ে নারীকে এখানে আসতে হয়েছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে নারী যখন তার যোগ্যতা দিয়ে এগিয়ে তখনো ভাবা হয় অনেক কিছু। নানা ঝড়-ঝাপটা আসবে, রাজনীতি উত্তাল হবে, ছাত্রদের বিক্ষোভ ঘটবে, দাবি-দাওয়া পূরণের মুখে একজন নারী কীভাবে সব সামলাবেন। নারীরা সেখানেও নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন। পড়াশোনা ও চাকরির ফলাফলে নারীরা এগিয়ে, ঝরে পড়া মেয়ের সংখ্যা কমে এসেছে।  উচ্চ আসনেও আজ নারী নিজেকে বসাতে সক্ষম হয়েছেন।

 

নারী তার অন্তর্গত চেষ্টায় এগিয়েছে

—অধ্যাপক রূপা চক্রবর্তী, চেয়ারপারসন, বাংলা ভাষা বিভাগ, ঢাবি

সফল নারীদের পেটে চাবুকের দাগ আছে। তাদের প্রতিটি অগ্রযাত্রায় একবার করে মেরেছে। এই দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। জনগোষ্ঠীর প্রতিটি নারী যদি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে তাহলে সময় হবে নারীর। আমাদের সমাজে আমরা নারীদের অতটা সাবলম্বী করে গড়ে তুলতে পারিনি। নারীরাও হয়তো অনেক সময় জানে না সে শুধু নারী নয়, সে মানুষ। পুরুষতন্ত্র বাল্যকালে তার মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেয় সে বালিকা। তার কাজ তার ভায়ের মতো নয়, তার কাজ, চিন্তা, কাজের পরিধি আলাদা। আলাদা করে তাকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।  তারও যে সবকিছুতে অধিকার আছে এটা বোঝে না বলে সে বড় হয় বৈষম্যের মধ্য দিয়ে। কৃতী নারীরা তাদের যোগ্যতায়, তাদের স্পৃহায়, তাদের অন্তর্গত চেষ্টায় নিজেদের এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। বলিষ্ঠভাবে তাদের হাতটি ধরে আছে তাদের পিতা, স্বামী, ভাই। এ কথা স্বীকার করতে হবে। একা নারী এসে এ জায়গায় দাঁড়ায়নি। নারীরা এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।  তার সিদ্ধান্ত দেয় বাড়ির অন্য কেউ। তবুও নারীরা এগোচ্ছে, এগিয়ে যাবেই।

 

নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে

—লাবণ্য আহমেদ, পরিচালক (গণসংযোগ-২) বাংলাদেশ সংসদীয় সচিবালয়

সময় এখন নারীর, দুঃসময় তো একেবারেই না বরং এগিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে। নারীর এগিয়ে যাওয়ার ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। ভাষা আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন আন্দোলনে আমাদের নারীরা প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে। দেশ, সমাজ যেভাবে আজকের অবস্থানে এসেছে তাতে বলা যায়, সময় থাকবে নারী এবং সময় থাকবে নারী-পুরুষের। আমি যে কর্ম পরিবেশে কাজ করি তা সত্যিকার অর্থেই নারীবান্ধব। কারণ দেশের আইনসভার মতো বড় একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নারী, এই গৌরব আমাকেও  অনুপ্রাণিত করে। ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত আনন্দের ও গৌরবজনক। আমরা নারীরা এখন বিভিন্ন পেশায় আছি। সমাজে এগিয়ে যেতে হলে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকবেই। কিন্তু আমি আমার সক্ষমতা দিয়ে সেই প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে উঠতে পারলেই আমি সফল। এ ক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা থাকলে আমরা আমাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারব।  নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারলে আমাদের দেশ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

 

আত্মবিশ্বাস শিশুকাল থেকে তৈরি হতে হবে

—ডা. সেগুফা আনোয়ার, ইউনাইটেড হাসপাতাল

নারী আসলে স্বাস্থ্যসচেতন নয়। তবে পরিবারের সবার স্বাস্থ্যের প্রতি সে খুব সচেতন। নিজের দিকে সময় দেওয়ার সময় নেই নারীর। নিজের নাম থাকে প্রায়োরিটি লিস্টের সবার নিচে। নারী ও পুরুষ লিঙ্গভেদে বৈষম্য নয়। এটা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। এখন সময় বদলেছে। আত্মবিশ্বাস শিশুকাল থেকেই মনের ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়া উচিত। আর এটা করা উচিত পরিবার থেকেই। নারীত্ব হলো শক্তি। আমার জন্য এখন জীবনটা অনেক সহজ। কিন্তু যারা উঠতি অবস্থায় তাদের অনেক সমস্যা হয়। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অবহেলার চোখে দেখা হয়।  এমন অনেকেই আমাকে বলেছে। ‘আপনার তো একটা হাসি দিলেই হবে’— এই রকম কথা বলে মেয়েদের হেয় করা হয়। এ রকম খোঁচাকে উপেক্ষা করতে হবে। যে যা বলুক তা মাথায় নেওয়া চলবে না। নিজে যেমন তেমন করেই কাজ করে যেতে হবে। আর একটা কথা আমি বলি, তা হলো— ‘ইউ কেন নট কুইট’। কোনো অবস্থাতেই জব কুইট করা চলবে না।  যুদ্ধ করে সফল হতে হবে। যে কোনো ঘটনাতেই ‘নিশ্চয়ই মেয়েটার দোষ ছিল’— এ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

 

নারীদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে

—সামিয়া রহমান, সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আমি নারী বা পুরুষবাদী নই, আমি মানুষবাদে বিশ্বাসী। মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী। এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে অনেকেই বলে থাকেন, অর্থনৈতিক মুক্তির কথা। যখন কোনো মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটে তখনই সে অধিকার ভোগ করতে সমর্থ হয়। আমি এ কথাটিকেও পুরোপুরি সমর্থন করি না। কারও সামাজিক সম্মান, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষমতা ও অধিকার এবং গ্রহণযোগ্যতায় তাকে পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। এক্ষেত্রে বর্তমান যুগের এগিয়ে থাকা নারী গোষ্ঠীকেই বলতে পারি— সময় এখন তাদের পক্ষে। কিন্তু বেশিরভাগ নারীই প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সংস্কৃতির বিভিন্ন অঙ্গনে এখন নারীর পদচারণা। কিন্তু সে সংখ্যাটা হাতেগোনা মাত্র। আমি প্রথমেই রাজনীতিবিদদের প্রতি প্রশ্ন রাখব— আপনারা রাজনীতির জন্য যতটা রাজপথ দাপিয়ে বেড়ান, নারী অধিকার বাস্তবায়নে তার কতটা করেন?  কেন এটি নিয়ে আপনাদের বলিষ্ঠ ভূমিকা থাকে না? নারীদেরও মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। 

 

দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে

—রহিমা আক্তার লাকী, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, এডিসি ট্রাফিক উত্তর

গোলটেবিল বৈঠকের আজকের বিষয় ‘সময় এখন নারীর’ আমি এর বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছি। কারণ আমি মনে করি সময় এখন নারীর নয়। তবে এটুকু বলতে পারি যে, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আজ আমি ফার্স্ট চয়েস পুলিশ দিয়ে আসতে পেরেছি এই অবস্থানে। পড়াশোনা শেষে প্রথমবার যখন বিসিএস দিলাম পরীক্ষা খুবই ভালো হলো। যথারীতি ভাইভা বোর্ডে ডাক পেলাম। অথচ ভাইভা বোর্ডে আমাকে মেয়ে হিসেবে ছোট করা হয়েছিল। প্রশ্নকর্তা আমাকে বললেন, আপনার স্বামী আপনাকে পুলিশে কাজ করতে দেবেন না। অথচ আমি তাকে আশ্বস্ত করেছিলাম যে, আমি বাসার সবার অনুমতি নিয়েই ফার্স্ট চয়েস পুলিশ দিয়ে এসেছি।  কিন্তু সেবার আমার বিসিএসে জব হলো না। মনের মধ্যে জিদ চেপে বসল। চ্যালেঞ্জ নিলাম। এখন আমি আমার লক্ষ্যে ঠিকই পৌঁছাতে পেরেছি। পুলিশে অনেক অফিসার আছেন যারা ভাবে মেয়েদের দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে না।  তাদের ধারণা সঠিক নয়। এক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়াতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।  

 

আত্মবিশ্বাস মানুষকে এগিয়ে নিতে পারে

—সাথীরা জাকির জেসি, জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য

ছোটবেলা থেকে মেয়েদের হাতে পুতুল ধরিয়ে দেওয়া হয়। এটা মায়েরা দেন, আমরাই দিই। আমার এক বছর বয়সী মেয়ের হাতে আমি বল দিই। পুতুল দিই না। কেউ পুতুল উপহার দিলে আমি সেগুলো অন্য জায়গায় গুছিয়ে রাখি। ও যদি বড় হয়ে পুতুল খেলতে ইচ্ছা হয় তখন সেগুলো তাকে দেব। তাকে আমি তৈরি করার চেষ্টা করছি— সে মেয়ে, এ জন্য সে বল খেলতে পারবে না— এ ধরনের চিন্তাবাদ যেন ওর মাথায় না ঢোকে। আমরা কীভাবে তৈরি হব সে সিদ্ধান্ত পরিবার নিয়ে থাকে। তাই মা-বাবাকেও ভাবতে হবে।  ২০০৭ সালে যখন শুরু করি তখন খুব কম মেয়েরা খেলত। একটা সময় বলত, এ কেমন মেয়ে সারা দিন ছেলেদের সঙ্গে খেলে। যখন জাতীয় দলে খেলে দেশে-বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছি তখন তারা বাহবা দিয়েছে। তবে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের জনপ্রিয়তা কম। কারণ আমরা শুরু করেছি অনেক পরে।  তাই সময়ের ধারাবাহিকতায় নারীরাও এগিয়ে যাবে। আত্মবিশ্বাস মানুষকে এগিয়ে নিতে পারে।

 

বাবাই আমার প্রেরণা

—পিংকী সানোয়ার, সাবেক ফুটবলার

আমি প্রেরণা পেয়েছি আমার বাবার কাছ থেকে। ভিকারুন্নেসা নূন স্কুলে পড়াশোনার সময় ২০০৫ সালে মহিলা ফুটবলের ক্যাম্পিং শুরু হলো। আমার বাবা এক প্রকার জোর করে আমাকে সেই ক্যাম্পে নিয়ে যান। আমি প্রথম ধাপেই উত্তীর্ণ হই। এক সময় জাতীয় ফুটবল দলে ডাক পাই। প্রতিদিন ভোর ৫টায় উঠে আমাদের প্র্যাকটিস করতে হতো। তারপর স্কুল। পরিবারের সাপোর্ট ছিল বলেই পেরেছিলাম। অথচ এক সময় আমাকে খেলা ছেড়ে দিতে হয়েছিল। এখন আর আমি ফুটবল খেলি না।  কারণ আমাদের এখানে অনেক অবহেলা মেয়েদের প্রতি। ফেডারেশন থেকেও কোনো সাপোর্ট পাচ্ছিলাম না। একসময় এমন হলো যে, আমাকে পড়াশোনা অথবা খেলাধুলা এই দুইয়ের মধ্যে যে কোনো একটি বেছে নিতে হবে। আমি বেছে নিলাম পড়াশোনা। কারণ অনিশ্চয়তার মধ্যে খেলাধুলা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল না।  আমাদের প্র্যাকটিস করানো হতো না ভালো করে। কোনো প্ল্যানিং ছাড়াই আমাদের খেলতে হতো।

 

পরিবার মেয়েকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে

—কাকলী প্রধান, সিনিয়র ফটোসাংবাদিক, কালের কণ্ঠ

একদিন এক গার্মেন্ট কর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি নারী অধিকার সম্পর্কে কিছু জান? এ বিষয়ে কি কিছু ভাবতে পার? উত্তরে বলল, জানি। বছরের অন্তত একটি দিন আমার। এই দিনে আমি একজন মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পাই, আমি পরিবারকে খাওয়াই, পরাই। এটি সবাইকে বুঝতে হবে। আমার পরিবারের সবাইকেও আমাকে বুঝতে হবে। এটি ছিল একজন গার্মেন্ট কর্মীর কথা। আগে একটি মেয়ের পক্ষে ফটোসাংবাদিকতায় নিজের ভবিষ্যৎ ভাবা সম্ভব ছিল না। কিন্তু এখন সম্ভব হয়েছে। হয়তো আমার পরিবার আমাকে সাপোর্ট দিচ্ছে।  কিন্তু কয়টি পরিবার আছে এমন? আসলে পরিবারই একটি মেয়েকে এগিয়ে নিতে পারে। আমি মনে করি শুধু পরিবারের সমর্থন থাকলেই একটি মেয়ে তার যোগ্যতা প্রদর্শনে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারে। কিন্তু পরিবারের সমর্থন না থাকলে সেই মেয়ের ক্ষেত্রে প্রতিটি পদক্ষেপই বাধার মনে হয়।  আত্মবল কমে যায়। পরিবার  একটি মেয়েকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে।

 

 

যারা অংশ নিলেন

শামীম আজাদ, কবি ও শিক্ষক

ইমদাদুল হক মিলন, সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

নঈম নিজাম, সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

অ্যাডভোকেট নূরজাহান বেগম মুক্তা, সংসদ সদস্য

নিলোফার চৌধুরী মণি, সাবেক সংসদ সদস্য

কামরুন নাহার ডানা, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদ

অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অধ্যাপক রূপা চক্রবর্তী, চেয়ারপারসন, বাংলা ভাষা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সামিয়া রহমান, সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

লাবণ্য আহমেদ, পরিচালক (গণসংযোগ-২), বাংলাদেশ সংসদীয় সচিবালয়

ডা. সেগুফা আনোয়ার, চিফ অব কমিউনিকেশন অ্যান্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্ট, ইউনাইটেড হাসপাতাল

রহিমা আক্তার লাকী, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, এডিসি ট্রাফিক উত্তর, ঢাকা

সাথিরা জাকির জেসি, জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়

পিংকী সানোয়ার, সাবেক ফুটবলার

কাকলী প্রধান, সিনিয়র  ফটোসাংবাদিক, কালের কণ্ঠ

সঞ্চালনা : শাহ্নাজ মুন্নী, প্রধান বার্তা সম্পাদক, নিউজ টোয়েন্টিফোর

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর