পৃথিবীতে এমন অনেক স্থান রয়েছে যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ করার কোনো অধিকার নেই। স্বাভাবিকভাবেই এই স্থানগুলো নিয়ে ঘনীভূত হয়েছে রহস্য। তালিকায় থাকা তেমনি একটি স্থান রয়েছে সবচেয়ে রহস্যময় দেশ ভ্যাটিকান সিটিতে। কারণ ভ্যাটিকান সিটির গোপনীয়তা ও রহস্যময়তা নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন নেই, কারও কোনো দ্বিধা বা সংশয় নেই। প্রকৃত অর্থেই এটি রহস্য এবং গোপনীয়তার নগরী। আর যুগ যুগ ধরেই মানুষের আগ্রহ আর রহস্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এই ভ্যাটিকান সিটি—
রহস্যময় সিক্রেট আর্কাইভ
যুগ যুগ ধরেই মানুষের আগ্রহ আর রহস্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এই ভ্যাটিকান সিটি। পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র এই দেশের রয়েছে নিজস্ব সংবিধান, ডাকব্যবস্থা, সীলমোহর, পতাকা এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতীক। ভ্যাটিকানের নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী আছে। নাম ‘পটেনশিয়াল সুইস আর্মি’। সদস্যসংখ্যা মাত্র ১৩৫। ভ্যাটিকান শহরের জনসংখ্যা বর্তমানে এক হাজার। এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে ও পোপের দেওয়া বিশেষ দায়িত্ব পালন করে এখানকার নাগরিকত্ব অর্জন করা সম্ভব।
পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক পট পরিবর্তন ও গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী এই দেশটি। পৃথিবীতে এমন অনেক স্থান রয়েছে যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ করার কোনো অধিকার নেই। স্বাভাবিকভাবেই এই স্থানগুলো নিয়ে ঘনীভূত হয়েছে রহস্য। তালিকায় থাকা তেমনি একটি স্থান রয়েছে সবচেয়ে রহস্যময় দেশ এই ভ্যাটিকান সিটিতে। কারণ ভ্যাটিকান সিটির গোপনীয়তা ও রহস্যময়তা নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন নেই, কারও কোনো দ্বিধা বা সংশয় নেই। প্রকৃত অর্থেই এটি রহস্য এবং গোপনীয়তার নগরী। আর যুগ যুগ ধরেই মানুষের আগ্রহ আর রহস্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এই ভ্যাটিকান সিটি। এ দেশের সবচেয়ে রহস্যের জায়গাটি হলো ভ্যাটিকান সিটি আর্কাইভ বা সংগ্রহশালা।
জায়গাটিকে বলা হয়, ‘স্টোর হাউস অব সিক্রেট’। অর্থাৎ গোপনীয়তার সংগ্রহশালা। বিগত শতাব্দীগুলোতে বিভিন্ন সময়ে পোপদের আদান-প্রদানকৃত নানা চিঠিপত্র, অধ্যাদেশ এবং এমনই অনেক ঐতিহাসিক জিনিস নিয়ে গড়ে উঠেছে ভ্যাটিকানের এ আর্কাইভটি। সপ্তদশ শতকে পোপ পঞ্চম পলের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এর যাত্রা। ভ্যাটিকান সিটি আর্কাইভ বা সংগ্রহশালাতে সাধারণ তো নয়ই; ভ্যাটিকান সিটির কেউই ঢোকার অনুমতি পান না। খুব অল্প সংখ্যক পণ্ডিতরাই এখানে প্রবেশ করতে পারেন। মহামান্য পোপের অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে হয় এখানে। পোপোর অনুমতি ছাড়া সেটি একেবারেই অসম্ভব।
১৮৮১ সালে পোপ ত্রয়োদশ লিওর অনুমোদনের আগ পর্যন্ত ভ্যাটিকানের এ সিক্রেট আর্কাইভে গবেষকদেরও প্রবেশাধিকার ছিল না। তিনিই প্রথম সেই ব্যবস্থা চালু করেন। শুধু গবেষণার কাজেই স্বল্প সময়ের জন্য প্রবেশের অনুমতি পাওয়া যায় এই সংগ্রহশালাতে। সংগ্রহশালাতে রয়েছে ৮০০ শতক থেকে বিভিন্ন ডকুমেন্ট। আর্কাইভে পাওয়া ডকুমেন্টগুলোর মাঝে সবচেয়ে পুরনোটি ৮০৯ খ্রিস্টাব্দের।
সংগ্রহশালাটি নিয়ে অনেক রকম কথা প্রচলিত আছে। যার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হচ্ছে বাইবেলের সংরক্ষণের কথাটি। ধারণা করা হয়, ভ্যাটিকানের এই সংগ্রহশালাতেই রয়েছে বাইবেলের সবচেয়ে পুরনো ভার্সনগুলো এবং এটি অনেক গোপনীয়তার সঙ্গে সযত্নে লুকানো আছে।
এখানে প্রায় ৮৪ হাজার বই আছে। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টান মিশনারি, প্যাগান আরও কিছু ধর্ম আর মতবাদের অনেক গোপন ডকুমেন্ট সংরক্ষিত আছে রহস্যময় এই সিক্রেট আর্কাইভে।
অতীত-ভবিষ্যৎ দেখতে পারা যন্ত্র
রোমান সাম্রাজের সময় ভ্যাটিকান সিটিতে উপাসনা করা হতো ফ্রিজিয়ান দেবী সিবেল এবং দেব আর্টিসের। এখানে সবচেয়ে রহস্যজনক যে বস্তুটিকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক রয়েছে তা হচ্ছে টাইম ভিউয়ার। অর্থাৎ সময়কে দেখার যন্ত্র। অতিপ্রাকৃত বিষয় যারা বিশ্বাস করেন তারা মনে করেন অসাধারণ প্রযুক্তিগত ক্ষমতা ভ্যাটিকানের রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে বিশেষ এক যন্ত্র যা দিয়ে অতীত এবং ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়া যায়। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন দ্বারা চালিত সময়ের এই যন্ত্রটিকে ভ্যাটিকান গির্জার গোপন স্থানে রাখা হয়েছে। শুধু গির্জার শীর্ষ ব্যক্তিরাই প্রয়োজনে এটি ব্যবহার করেন। দেখে নেন অতীত ও ভবিষ্যতের বিভিন্ন ঘটনা। তাদের দাবি, সেই যন্ত্রটিই গির্জার ক্রমাগত শক্তি ও ক্ষমতা ধরে রেখেছে। এই যন্ত্রটি ১৯৫০ সালের দিকে তৈরি করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। ফাদার মারিয়া আর্নেত্তির নেতৃত্বে ১২ জন বিজ্ঞানী এই বিশেষ যন্ত্রটি নির্মাণ করেন। বলা হয়, ধর্মীয় দায়িত্ব গ্রহণের আগে মারিয়া আর্নেত্তি প্রকৃতিবিজ্ঞানী ছিলেন। গবেষকরা আরও দাবি করেছেন, ভ্যাটিকানের বিজ্ঞানী দল যন্ত্রটি নির্মাণ করলেও তা সবার কাছে প্রকাশ্যে আনায় আপত্তি জানান ফাদার আর্নেত্তি। তাতে সময়ের স্বাভাবিক প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। এতে সবার মাঝে বিশৃঙ্খতা দেখা দেবে। এই যন্ত্র থেকে ফাদার আর্নেত্তি অতীতের অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন বলেও শোনা যায়। গ্রিসের পতন থেকে যিশু খ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার দৃশ্য সবই দেখেছেন ফাদার আর্নেত্তি। ধারণা করা হয় মহাজাগতিক বিষয়ও পর্যবেক্ষণ করা যায় যন্ত্রটি দিয়ে।
অবাক করা তথ্য
অপরাধের দেশ বলে থাকেন অনেকে ভ্যাটিকান সিটিকে। জনসংখ্যার তুলনায় এখানে অপরাধ অনেক বেশি সংঘটিত হয়, তাই। ২০০৬ সালে দেশটির জনসংখ্যা ছিল ৪৯২। আর একই সঙ্গে রেজিস্ট্রীকৃত অপরাধকর্মের সংখ্যা ৮২৭টি। মানে প্রত্যেক নাগরিক ১.৬৮টি অপরাধের সঙ্গে জড়িত বলে হিসাব বলছে।
ওয়াইন আসক্ত ভ্যাটিকান সিটি। শীর্ষ পাঁচটি ওয়াইন আসক্ত দেশের একটি বলা হয় দেশটিকে। বাকি চারটি হলো অ্যান্ডোরা, ক্রয়োশয়া, স্লোভেনিয়া ও ফ্রান্স। প্রতি বছর একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ দেশটিতে কমপক্ষে ৫৪.২৬ লিটার ওয়াইন পান করেন।
এই দেশেই বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্র রেলওয়ে অবস্থিত। মাত্র ৩০০ মিটার রেল লাইনবিশিষ্ট এই রেলওয়ের নাম সিটা ডেল ভ্যাটিক্যানো। তবে কোনো যাত্রী নেওয়া হয় না। মূলত মালামাল আনা-নেওয়ায় রেলওয়েটি ব্যবহৃত হয়।
ভ্যাটিকানে চাইলেই কেউ বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারবেন না। কারণ, বিচ্ছেদের আপিল করলেও কোনোটাই আমলে নেওয়া হয় না। এমন আজব নিয়ম আর আছে কেবল ফিলিপাইনে। এমন কি নিজস্ব ইউরো ব্যবস্থা চালু রয়েছে দেশটিতে। ২০০০ সালে ইতালির সঙ্গে ভ্যাটিকানও ইউরো মুদ্রা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তবে ভ্যাটিকানের ইউরো একটু আলাদা।
ভ্রমণপিপাসুদের তীর্থস্থান
খ্রিস্টধর্ম প্রবর্তনের আগে থেকেই ভ্যাটিকান সিটিকে পবিত্র স্থান বলে গণ্য করা হতো। বর্তমানে ভ্যাটিকান সিটি ইতালির রোম শহরের ভিতরে অবস্থিত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। পোপ এখানকার রাষ্ট্রনেতা। ভ্রমণপিপাসুদের তীর্থস্থানও এই ভ্যাটিকান সিটি। জনসংখ্যার তুলনায় এখানে টুরিস্ট বেশি আসে। জনসংখ্যা যেখানে বর্তমানে এক হাজারের আশপাশে সেখানে প্রতি বছর ভ্রমণ করতে আসে সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন মানুষ। কারণ ধর্মীয়, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক দিক থেকে ভ্যাটিক্যান বেশ সমৃদ্ধিশালী। এটি রোমান ক্যাথলিক গির্জার বিশ্ব সদর দফতর হিসেবেও কাজ করে। ভ্যাটিকান শহর মধ্যযুগ ও রেনেসাঁর সময়ে নির্মিত প্রাচীর দিয়ে রোম শহর থেকে বিচ্ছিন্ন। প্রাচীরের ভিতরে আছে উদ্যান, বাহারি দালান ও চত্বরের সমাবেশ। সবচেয়ে বড় দালানটি হলো সেন্ট পিটারের ব্যাসিলিকা; যা রোমান ক্যাথলিকদের প্রধান গির্জা। ভ্যাটিকান সিটিতে রয়েছে একটি মহাকাশ অবজারভেটরি, লাইব্রেরি ভ্যাটিকান। ভ্যাটিকান সিটি শেষ পোপীয় রাষ্ট্র। ক্যাথলিক গির্জা বহু শতাব্দী ধরে মধ্য ইতালির বেশ কিছু এলাকাতে এই রাষ্ট্রগুলো স্থাপন করেছিল, যার শাসনকর্তা ছিলেন পোপ।
সুইস গার্ড
ভ্যাটিকান সিটির অফিশিয়াল নিরাপত্তারক্ষীর নাম ‘পটেনশিয়াল সুইস আর্মি’। সদস্য সংখ্যা মাত্র ১৩৫। পোশাকটা যথেষ্ট ভুতুড়ে হলেও এই বাহিনীতে যোগ দিতে যথেষ্ট নিয়মকানুন মানতে হয়। বয়সসীমা ১৯ থেকে ৩০। প্রত্যেকের উচ্চতা হতে হয় কমপক্ষে পাঁচ ফিট সাড়ে আট ইঞ্চি। ক্যাথলিক হতে হয়, এর চেয়েও বড় ব্যাপার এদের বিয়ে করা নিষিদ্ধ। ৫০০-এর বেশি বছর ধরে এই বাহিনী পোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আসছে। কিন্তু এরা মাঝে মাঝে বেতন পায় না বলে কথা প্রচলিত আছে। যেমন ইতালিয়ান ভাস্কর, কবি, চিত্রশিল্পী ও স্থপতি মাইকেল অ্যাঞ্জেলো একবার পোপকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে, ভ্যাটিকানের প্রহরীরা গত তিন মাস ধরে তাদের বেতন পাচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে তারা চাকরি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হবে। অবশ্য মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর এ সতর্কবার্তায় শেষ পর্যন্ত সেই প্রহরীরা তাদের বেতন পেয়েছিল কিনা তা জানা যায়নি। তবে সেই চিঠিটি আজও রয়ে গেছে ভ্যাটিকানে।