শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিশ্বের যত নিকৃষ্ট শহর

তানভীর আহমেদ

বিশ্বের যত নিকৃষ্ট শহর

প্রায় দুই কোটি মানুষের চাপে ধুঁকছে ঢাকা। এই শহরের প্রধান নাগরিক সমস্যার তালিকায় রয়েছে জলাবদ্ধতা, তীব্র যানজট ও বর্জ্য অব্যবস্থাপনা। -ছবি : জয়ীতা রায়

বৈশ্বিক বসবাস সূচকভিত্তিক সংগঠন ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) প্রকাশ করেছে বিশ্বের বাসযোগ্য ও নিকৃষ্টতম শহরের তালিকা। ইআইইউর তালিকায় সবচেয়ে নিকৃষ্ট শহর হয়েছে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক। অন্যদিকে বসবাসযোগ্য শহরের শীর্ষে অবস্থান করছে মেলবোর্ন। পাঁচটি মহাদেশের ১৪০টি শহরের ওপর পরিচালিত এক জরিপ শেষে ইআইইউ এ তালিকা করে। অবাসযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকা রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে।

নাগরিক নিরাপত্তা, দালানকোঠা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা সুবিধাসহ বেশ কয়েকটি নিরিখে একটি শহরের বাসযোগ্যতা বিবেচনা করা হয়। সাধারণভাবে একজন নাগরিক শহরে বসবাস করতে গিয়ে প্রয়োজনীয় যে সুবিধাগুলো পেতে চান তা কতটা সহজলভ্য সেটাই এখানে মূল বিষয়। বিশ্বের সবচেয়ে বাসযোগ্য শহর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন। আছে ভিয়েনার নাম। এই শহরগুলোকে স্বর্গের সঙ্গেই তুলনা করেন সেখানকার বাসিন্দারা। উল্টো চিত্র রয়েছে বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে। ঢাকাবাসী খুব ভালোমতোই টের পান বাসযোগ্যতার স্কেলে নিজেদের অবস্থান। সাম্প্রতিক হিসাব বলছে, বিশ্বের দ্বিতীয় নিকৃষ্টতম বা অবাসযোগ্য শহর ঢাকা। স্বাভাবিকভাবেই এ শহরের প্রধান নাগরিক সংকটের তালিকায় রয়েছে সড়কের বেহাল দশা, জলাবদ্ধতা, যানজট। এছাড়া বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, গ্যাস সংকটেও ভুগছে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পয়ঃনিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও নাজুক। ১০০ রেটিং পয়েন্টে মাত্র ৩৮ পয়েন্ট জুটেছে ঢাকার। বিশ্বের দ্বিতীয় অবাসযোগ্য এই শহরে  অবকাঠামোগত স্থায়িত্ব মাত্র ২৬.৮ শতাংশ। প্রশ্ন রয়েছে স্বাস্থ্যসেবার ওপরও। স্বাস্থ্যসেবায় ২৯.২ পয়েন্ট মনে করিয়ে দেয় ঢাকায় স্বাস্থ্যসেবার হতাশাজনক পরিস্থিতি। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ সূচকেও খুব ভালো অবস্থানে নেই ঢাকা। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও মানুষের চাপে ঢাকার এই চিত্র দেখা যাচ্ছে।

বিশ্বের সবচেয়ে দুর্দশাপূর্ণ শহরটি এখন সিরিয়ার দামেস্ক। সিরিয়ার এই রাজধানী শহর এখন বোমা বর্ষণের শহর। ড্রোন আর বোমারু বিমানের হামলা তো রয়েছেই। সঙ্গে যোগ হয়েছে সরকারি  সেনাদের হামলা। জঙ্গি প্রতিরোধের কথা বলে পশ্চিমা বিশ্বের চাপিয়ে দেওয়া এই যুদ্ধ সাধারণ সিরিয়ান নাগরিকদের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। শরণার্থী হয়ে যারা দেশ ছেড়েছেন তারাও আছেন জীবন সংকটে। আর দামেস্ক? এই শহরের বাড়িগুলো বোমায় ধসে আছে, রাস্তা বলতে কিছু নেই আর। সব ধরনের নাগরিক নিরাপত্তা হারিয়ে গেছে। যারা প্রাণ নিয়ে এখনো এই শহরে বসবাস করছেন তাদের জীবনের নিরাপত্তা নেই। ভাগ্যই নির্ধারিত করছে এই শহরে একজন নাগরিকের ভবিষ্যৎ। পুরোপুরি অবাসযোগ্য এই শহর ১০০ রেটিং পয়েন্টের নিরিখে পেয়েছে ৩০.৭ পয়েন্ট।

অবাসযোগ্য শহরের তালিকায় তিন নম্বরে রয়েছে নাইজেরিয়ার লাগোস শহরটি। ৩৭.৫ পয়েন্ট পাওয়া লাগোসের স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা কাঠামো নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। ইআইইউ বলছে, এই শহরের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বলতে যা রয়েছে তা অপ্রতুল। এছাড়া নাগরিকরাও নিরাপদ বোধ করেন না। ড্রেনেজ সিস্টেম নিয়েও সন্তুষ্ট নন তারা। ময়লা-আবর্জনার শহর বলেও কুখ্যাতি জড়িয়ে পড়েছে শহরটির সঙ্গে। সাংস্কৃতিকভাবে লাগোস বরাবরই বেশ নামকরা শহর। সেই নিরিখেও এবার তলানিতে পৌঁছেছে তারা। পর্যটকদের জন্য এক সময়ের আকর্ষণ ছিল লাগোসের ঐহিত্যমণ্ডিত নানা উৎসব। ৫৩.৫ পয়েন্ট নিয়ে লাগোস তার সাংস্কৃতিক গৌরব নিয়ে কিছুটা হলেও পিছিয়ে পড়েছে।

পাকিস্তানের করাচি বিশ্বের চতুর্থ অবাসযোগ্য ও নোংরা শহর বলে তালিকায় জায়গা পেয়েছে। এই শহরের প্রধান সংকটের মধ্যে রয়েছে অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও নাগরিক নিরাপত্তার অভাব। সাংস্কৃতিকভাবেও বেশ পিছিয়ে পড়া শহর হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। শিক্ষার হার নিরিখে ৬৬ পয়েন্ট পেলেও এই শহরের স্ট্যাবিলিটি বা অবকাঠামোগত স্থায়িত্ব নিয়ে সংকট রয়েছে। জঙ্গি হামলা খবর করাচির পত্রিকায় প্রায়ই জায়গা করে নেয়। ঘর থেকে বেরিয়ে, ঘরে জীবিত ফিরে আসার নিশ্চয়তা নেই জঙ্গি হামলার কারণে। জঙ্গিদের বোমা হামলার শহরে পাকিস্তানি সেনাদের নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে নাগরিকদের মনে। দেশে ক্যু বা সরকার পতনের হুমকি নিয়ে করাচির বাসিন্দাদের আলাদা করে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। অপরাধীদের বাড়াবাড়িও এই শহরকে ঠেলে দিয়েছে অবাসযোগ্য শহরের তালিকায়। শহরটির স্থায়িত্ব বা টেকসই নিরিখে মাত্র ২০ পয়েন্ট থাকায় এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না করাচি নাগরিকদের জন্য মোটেই বাসযোগ্য নয়। সাংস্কৃতিকভাবে করাচি বেশ সংকটে রয়েছে। ধর্মীয় উগ্রপন্থা ও নানা ধরনের বিধি-নিষেধের বেড়াজালে করাচির নাগরিকদের আটকে থাকতে হয়। খেলাধুলা, অভিনয় করার ওপরও রয়েছে বিতর্ক, নিষেধাজ্ঞা।

পাপুয়া নিউগিনির রাজধানী ও সবচেয়ে বড় শহর পোর্ট মরেসবি। ৯০ বর্গমাইলের এই শহরে সাড়ে ৩ লাখের কিছু বেশি মানুষ বসবাস করে। এই শহরের অবকাঠামো বেশ নাজুক। এছাড়া শহরটি খুব টেকসই নয় বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা। বিশ্বের পাঁচ নম্বর অবাসযোগ্য শহর এটি। শহরটি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠে। দরিদ্রতার ছোবলে শহরটি কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। সঙ্গে রয়েছে দুর্নীতি। এসব কারণে সম্ভাবনাময় হওয়া সত্ত্বেও নাগরিকদের জন্য পোর্ট মরেসবি কখনোই পছন্দের শহর হয়ে উঠতে পারেনি। দিন দিন এই শহরের নাগরিক সুবিধাগুলো আরও দুর্লভ হয়ে উঠছে, বাড়ছে দুর্দশা ও সংকট।

দরিদ্রতার কারণে ক্যামেরুনের দৌআলা শহরটিও অবাসযোগ্য শহর বলে বিবেচিত হচ্ছে। ২৪ লাখ মানুষের শহর এটি। ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরে অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় নাগরিকরা রয়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়।

 

সংকটে ত্রিপোলির বাসিন্দা

অটোমান সাম্রাজ্যের সময় ত্রিপোলি হয়ে উঠেছিল ধনী ও আদর্শ শহর। সেই আভিজাত্য নিয়ে শত শত বছর থাকার পর গৃহযুদ্ধের কবলে পড়ে সব হারিয়ে নিঃশ্ব এক শহর এখন। সত্তরের দশকের পর থেকেই এই শহরের কপালে দুর্যোগ নেমে আসতে শুরু করে। গাদ্দাফির দুর্গ বলে পরিচিত শহরটি টার্গেট করে যুক্তরাষ্ট্র। গাদ্দাফিকে হটানোর নামে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্র। এতে লিবিয়ার অন্য শহরগুলোর মতো ত্রিপোলি হয়ে ওঠে মৃত্যুপুরী। বোমা বর্ষণে শহরের রাস্তাঘাট, বাড়ি, দোকানপাট সব মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার মিশনে নামে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের রোষানলে পড়ে পুরো ত্রিপোলি ধংসস্তূপে পরিণত হতে শুরু করে। ১৯৮৬ সালে সেই খেলা শুরু হয়েছিল। এখনো শান্ত হয়নি ত্রিপোলি। অবকাঠামো যা ছিল সবই ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। অস্থিরতা ভর করেছে শহরটির ঘাড়ে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও আর ঢেলে সাজানো হয়নি। গাদ্দাফির পতনের সঙ্গে সঙ্গে ত্রিপোলির ভাগ্যও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সেই অনিশ্চয়তায়ই কাটছে এই শহরের মানুষের দিনকাল।

 

 

নাগরিক ভোগান্তি হারারেতে

দরিদ্রতার সঙ্গে অনেক বিষয় সরাসরি জড়িয়ে পড়ে। অপরাধপ্রবণতা ও দুর্নীতি এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত। বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় সংকটও বাড়ছে। জিম্বাবুয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর হারারে দিন দিন অবাসযোগ্য হয়ে পড়ছে। নাগরিকরা ভুগছে লোডশেডিংয়ে। রাস্তাঘাটও সংস্কার করা হয় না সময়মতো। সড়কের বেহাল দশা দেখার যেন কেউ নেই। শহরের অনেক জায়গায়ই কার্পেটিং রাস্তা নেই। যেগুলো রয়েছে সেগুলো অনেক সরু। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় গোটা শহরই ময়লার ভাগার হয়ে উঠেছে। মানুষজনের হাতে টাকা কম থাকায় বিপত্তি বাড়ছে নাগরিক সুবিধা পেতে। শহরের বেশির ভাগ এলাকাই স্যুয়ারেজ সিস্টেমের সুবিধার বাইরে রয়ে গেছে। নাগরিকদের চাওয়া- পাওয়ার ব্যবধান বাড়িয়ে তুলেছেন দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তারা। মাদক সমস্যায় ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছে। বিশ্বের ৬ নাম্বার অবাসযোগ্য এই শহরে বাসযোগ্যতার পয়েন্ট মাত্র ৪২.৬। স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি এই শহরের নাগরিকদের জন্য সৌভাগ্যই বলা যায়। ভালো মানের চিকিৎসাসেবার কথা বাদই দেওয়া যাক, সাধারণ চিকিৎসা সুবিধা পেতেই হিমশিম খেতে হয় নাগরিকদের। চিকিৎসাসেবায় ২০.৮ পয়েন্ট পাওয়া হারারের এই করুণ দশা নাগরিকদের ভোগাচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর