রবিবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া বিশ্বনেতা

অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া বিশ্বনেতা

ফিদেল কাস্ত্রোর পেছনে লেলিয়ে দেওয়া হয় মারিতা লরেঞ্জকে

রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রচলনের শুরু থেকে অদ্যাবধি বিভিন্ন দেশে নেতাদের হত্যার কলঙ্ক লিপিবদ্ধ হয়েছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। অনেক নেতা আবার অলৌকিকভাবে বেঁচেও গেছেন এসব হত্যাচেষ্টা বা ব্যর্থ অভ্যুত্থান থেকে। হিটলার কিংবা মুসোলিনি থেকে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেক নেতার নামই রয়েছে এ তালিকায়। কলঙ্কিত ২১ আগস্টের আগে  তাদেরই কয়েকজনের কথা লিখেছেন— মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.), পিএইচডি

 

৬৩৮ বার হত্যাচেষ্টা থেকে প্রাণে বাঁচেন কাস্ত্রো

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে কিউবার হাভানার দূরত্ব মাত্র ৫১৭ কিলোমিটার বা ৩১৭ মাইল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমস্ত পৃথিবীতে কমিউনিজম, সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদের অসারত্ব প্রমাণ করে ধনতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় লিপ্ত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এমনই এক প্রেক্ষাপটে খোদ মার্কিন মুল্লুক থেকে মাত্র ৩১৭ মাইল দূরে কিউবায় ফিদেল আলেজান্ড্রো কাস্ত্রো রুজবা ফিদেল কাস্ত্রো প্রমাণ করেন কমিউনিজমের শ্রেষ্ঠত্ব। আর তাই ৪০ বছরের মধ্যে ফিদেল কাস্ত্রো মার্কিন গোয়েন্দা বা সিআইএ সমর্থিত অন্তত ৬০০ হত্যাচেষ্টা থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান।

স্পেন বংশোদ্ভূত এক ধনাঢ্য কৃষক পরিবারে কাস্ত্রোর জন্ম ১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট। ছাত্রজীবন থেকে তিনি রাজতন্ত্র আর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছিলেন। কার্ল মার্কস এবং লেনিন দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাস্ত্রো ডোমিনিকান রিপাবলিক এবং কলম্বিয়ায় কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যোগ দেন। নিজ দেশ কিউবায় ১৯৫৩ সালে প্রেসিডেন্ট ফালগেনসিও বাতিস্তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ব্যর্থ কাস্ত্রোকে এক বছর জেল খাটতে হয়। জেল থেকে বেরিয়ে কাস্ত্রো পাড়ি জমান মেক্সিকোতে। এখানে বসেই তিনি এক বিপ্লবী বাহিনী সংগঠিত করেন। এরপর ভাই রাহুল কাস্ত্রো আর কিংবদন্তি বাম নেতা চে গুয়েভারাকে নিয়ে কিউবায় শুরু করেন তীব্র আন্দোলন। ১৯৬৯ সালে বাতিস্তার পতন ঘটলে কিউবার রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব আসে কাস্ত্রোর হাতে। মার্কিনিরা তখন থেকেই কাস্ত্রোর জীবনের প্রতি হুমকি হয়ে ওঠে। কাস্ত্রোকে হটানোর জন্য ১৯৬১ সালে ‘বে অব পিগ’ নামে সামরিক অভিযানও চালায় সিআইএ। কিন্তু কাস্ত্রোকে কাবু করা যায়নি। বরং কাস্ত্রো সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে জোট বেঁধে কিউবায় সোভিয়েত পারমাণবিক অস্ত্র স্থাপন করেন। শুরু হয় স্নায়ুযুদ্ধের নতুন উপাখ্যান। বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে প্রায় অর্ধশতাব্দী পর ভাই রাহুল কাস্ত্রোর কাছে ক্ষমতা দিয়ে অবসরে যান ফিদেল কাস্ত্রো।

১৯৫৫ সালে অর্থাৎ ক্ষমতা গ্রহণের আগেই ফিদেল কাস্ত্রো বাতিস্তা সরকারের এজেন্টদের হত্যাচেষ্টা থেকে রক্ষা পান। ১৯৬৬ সালে নিউইয়র্কে ফিদেল কাস্ত্রোকে বারুদভর্তি চুরুট (সিসার) সরবরাহের চেষ্টা হয়, যা আগুনের স্পর্শ পেলেই কাস্ত্রোর মাথা উড়ে যেত। ১৯৬০ সালে সিআইএ আবারও কাস্ত্রোর প্রিয় চুরুটে বিষ মিশিয়ে তাকে সরবরাহ করার চেষ্টা করে। চুরুটের মতো আইসক্রিমও পছন্দ করতেন কাস্ত্রো। সুযোগটা কাজে লাগাতে ১৯৬১ সালে বিষ মিশানো আইসক্রিম তৈরি করে রাখা হয় কাস্ত্রোর জন্য। কিন্তু পরিবেশনের আগে ফ্রিজে জমাট বেঁধে শক্ত করে লেগে থাকায় তা বের করতে পারেননি ওয়েটাররূপী সিআইএ এজেন্ট। কাস্ত্রোর শখ ছিল সমুদ্রের তলদেশে সাঁতার কাটা ও শামুক সংগ্রহ করা। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে কাস্ত্রোর প্রিয় সাঁতারের জায়গায় বিস্ফোরক ভর্তি উজ্জ্বল শামুক রাখা হয় যা ধরলেই বিস্ফোরিত হয়। এই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয় ১৯৬৩ সালে। এর আগে সাঁতারের পোশাকে বিষাক্ত ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণু ঢুকানোর মাধ্যমে তার শরীরে পচন ধরানোর প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। একইভাবে ব্যর্থ হয় জুতা কিংবা কলমে রাসায়নিক বিষ মিশানোর মাধ্যমে কাস্ত্রোকে হত্যার চেষ্টা। চলচ্চিত্রের গল্পের মতো ফিদেল কাস্ত্রোর পেছনে লেলিয়ে দেওয়া হয় মারিতা লরেঞ্জকে। সিআইএর পরিকল্পনা অনুসারে মারিতা প্রেমের অভিনয় করে বিষ মেশান এবং ঠাণ্ডা মিষ্টি খাবার নিয়ে কাস্ত্রোর কাছে পৌঁছে যান। কাস্ত্রো বিষয়টি টের পেয়ে মারিতার হাতে বন্দুক তুলে দিয়ে বুক চেত্তিয়ে তাকে (কাস্ত্রোকে) হত্যা করতে বলেন। মারিতা তা করতে পারেননি কোনো দিন। ২০০৬ সালে প্রচারিত ব্রিটিশ সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ফোরের ডকুমেন্টারি ফিল্মের অনুসন্ধানে জানা যায় অন্তত ৬৩৮ বার বিভিন্নভাবে কাস্ত্রোকে হত্যার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে?

 

নেতা-কর্মীদের মানববর্মে বেঁচে যান শেখ হাসিনা

আগস্ট মাসটি বাংলাদেশের জন্য এক শোকের মাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একদল বিপথগামী সেনার অভ্যুত্থানে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন। এই অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী, তিন পুত্র, দুই পুত্রবধূ, ভাইসহ অনেক নিকটাত্মীয় ও নেতাকে হত্যা করা হয়। এদিন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। ছয় বছর বিভিন্ন দেশে নির্বাসিত থাকার পর ১৯৮১ সালে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। নেতা-কর্মীদের অনুরোধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বও গ্রহণ করেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বরণের পর স্তিমিত আওয়ামী লীগে নবজাগরণ সৃষ্টি হয়। ফলে আওয়ামীবিরোধীদের লক্ষ্যে পরিণত হন শেখ হাসিনা। শুরু হয় তাঁর প্রাণনাশের নানাবিধ ষড়যন্ত্র। কখনো কখনো এই ষড়যন্ত্রে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার ইন্ধনের খবরও প্রকাশিত হয়। ছোট-বড় গুপ্ত হামলা, বাড়িতে গুলিসহ বিভিন্ন কায়দায় শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টা চলে বছরের পর বছর। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নিজ এলাকা গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভা ও যাওয়ার রাস্তার পাশে শক্তিশালী বোমা পুঁতে রাখার ঘটনাও ঘটে। এক চা দোকানি বোমার সঙ্গে সংযুক্ত বৈদ্যুতিক তার দেখে ফেলায় বানচাল হয় সে প্রচেষ্টা। এমনিভাবে চরম উত্কণ্ঠা আর হুমকি মাথায় নিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। ঢাকার গুলিস্তানের দলীয় কার্যালয়ের সামনে এক জনসভার আয়োজন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দলীয় নেতাদের বক্তৃতা শেষে প্রধান বক্তা ও প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা মঞ্চে ওঠেন বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। তাঁর বক্তৃতা চলাকালে পাশের দালানের ছাদ থেকে তাঁকে উদ্দেশ্য করে ছোড়া হয় শক্তিশালী আর্জেস গ্রেনেড, যা যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী। মুহূর্তে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় জনসভা। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে আহত ও নিহত নেতা-কর্মীর নিথর দেহ। মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন আরও অনেকে। এদেরই একজন বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এবং পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান। বক্তৃতা মঞ্চে শেখ হাসিনাকে নিজ দেহ দিয়ে মানববর্ম তৈরি করে ঘিরে রাখেন ঢাকার তৎকালীন মেয়র হানিফসহ অন্য নেতা-কর্মী ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। তারা কেউ গ্রেনেডের স্প্লিন্টার থেকে রক্ষা না পেলেও শারীরিকভাবে অক্ষত থাকেন শেখ হাসিনা। তবে গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে তাঁর কান তথা শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর স্প্লিন্টারবিদ্ধ নেতা-কর্মীদের জীবনে নেমে আসে এক যন্ত্রণাময় অধ্যায়। এখানেই শেষ নয়, এত কিছুর পরও পুলিশ বা সরকারি বাহিনীর কোনো উদ্ধার তৎপরতা পরিলক্ষিত না হওয়ায় নেতা-কর্মীরা শেখ হাসিনাকে তার বুলেট প্রুফ গাড়িতে তুলে দেন। ঘাতকরা এই গাড়িতেও গুলিবর্ষণ করে। তবুও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই হত্যাচেষ্টার সঠিক তদন্ত ও বিচারের বদলে এক নাটক সাজায় তৎকালীন প্রশাসন। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রকাশিত হয় মূল রহস্য।

 

পাঁজর ভেঙে ফুসফুসে গুলি লাগে রিগানের

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫ প্রেসিডেন্টের মধ্যে চারজনের মৃত্যু ঘটে আততায়ীর গুলিতে। তাও আবার ক্ষমতায় থাকাকালে। এরা হলেন ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন, ২০তম প্রেসিডেন্ট জেমস-এ গারফিল্ড, ২৫তম প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাক কিনলে এবং ৩৫তম প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। এর বাইরে হামলার শিকার হয়েও জীবন ফিরে পেয়েছেন এমন ১৩ প্রেসিডেন্টের নাম পাওয়া যায় মার্কিন ইতিহাসে। এদেরই একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪০তম প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান। পর পর দুবার নির্বাচিত রিগান ১৯৮১ থেকে ৮৯ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। এক সময়ের চলচ্চিত্র অভিনেতা, সেনা অফিসার এবং ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের গভর্নর রিগান ১৯৮১ সালের ২০ জানুয়ারি প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মাত্র দুই মাসের মাথায় ১৯৮১ সালের ৩০ মার্চ বেলা ২টা ২৭ মিনিটে এক মানসিক বিকারগ্রস্ত ব্যক্তির ছোড়া গুলিতে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যান রিগান। গুলিটি তার বুকের বাঁ-দিকের হাড় ভেঙে ফুসফুস ছিদ্র করে ফেলে। হৃৎপিণ্ড থেকে ছিদ্র হওয়া ফুসফুসের দূরত্ব ছিল মাত্র এক ইঞ্চি। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ট্যাক্সি ড্রাইভার নামক এক চলচ্চিত্রের নায়িকা জোডি ফস্টারের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হয়ে জন হিনকলে নামক এক ব্যক্তি এই দুঃসাহসিক ঘটনা ঘটান। এরই মাঝে হোয়াইট হাউসে ক্ষমতার পালাবদল হয়। জিমি কার্টারের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন রিগান। ফলে রিগান হিনকলের লক্ষ্যে পরিণত হন। ১৯৮১ সালের ৩০ মার্চ হিনকলে প্রেমিকা ফস্টারের কাছে এক চিঠিতে লিখেন, ‘রিগানের পিছু নেওয়া এক সেকেন্ডেই ছেড়ে দিতে পারি যদি তোমার হৃদয় জয় করতে পারি এবং তোমার সঙ্গে বাকিটা জীবন কাটাতে পারি।’ চিঠি লিখে তার রম আর জি ১৪.২২ এল আর রিভলবার আর গুলি নিয়ে ওয়াশিংটন হিলটন হোটেলের সামনে অবস্থান নেন। বেলা ২টা ২৭ মিনিট। হোটেলের মধ্যাহ্নভোজ ও রাজনৈতিক সভা শেষে হেঁটে বেরিয়ে এলেন রিগান। হোটেল থেকে গাড়ির দূরত্ব মাত্র ৯ মিটার বা ৩০ ফুট। এই দূরত্ব অতিক্রমকালে হিনকলে গুলি ছুড়তে শুরু করেন। তার ছোড়া প্রথম গুলিটি আঘাত করে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জেমস ব্রেডির মাথায়। দ্বিতীয় গুলিতে রিগানকে বাঁচাতে যাওয়া পুলিশ অফিসার হামাস ডিল হাটনি ঘাড়ে আঘাতপ্রাপ্ত হন। এ সময় প্রেসিডেন্ট রিগানকে পরিষ্কার দেখতে পেয়ে হিনকলে ছুড়লেন তৃতীয় গুলি, যা রিগানের মাথার ওপর দিয়ে চলে যায় ও একটি জানালা ভেঙে ফেলে। প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তায় নিয়োজিত স্পেশাল এজেন্ট জেরি পার এ সময় প্রেসিডেন্ট রিগানকে ধাক্কা দিয়ে তার লিমোজিন গাড়িতে তুলে দেন। সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট টিম ম্যাক ম্যাকার্থি এ সময় ঘাতক আর প্রেসিডেন্টের মাঝে ‘লাইন অব ফায়ারে’ অবস্থান নেন এবং তার লম্বা দেহ আরও সম্প্রসারিত করেন। এতে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত হলেও ঘাতকের আবশ্যিক টার্গেটে পরিণত হন ম্যাক। পরিণতিতে চতুর্থ গুলিটি লাগে ম্যাকের পেটে। ম্যাক না থাকলে গুলিটি নিশ্চিতভাবে লিমোজিনে বসা রিগানকে আঘাত করত। প্রেসিডেন্ট রিগান লিমোজিনে বসলেও গাড়ির দরজা বন্ধ করা হয়নি তখনো। পঞ্চম গুলি এসে লাগে গাড়ির এই খোলা দরজার বুলেট প্রুফ জানালার কাচে। ষষ্ঠ বা শেষ গুলিটি গাড়ির স্টিল বডিতে লেগে গতি পরিবর্তন করে এবং প্রেসিডেন্ট রিগানের পাঁজর ভেঙে ফুসফুস ছিদ্র করে ফেলে। স্পেশাল এজেন্ট জেরি পার রিগানকে জোর করে লিমোজিনে তুলে না দিলে গুলিটি নিশ্চিত প্রেসিডেন্টের মাথায় আঘাত করত। মাত্র ১৭ সেকেন্ডে ৬টি গুলি ছুড়ে হিনকলে ধরা পড়েন উপস্থিত কর্মকর্তা ও নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে। ১৩ দিন চিকিৎসা শেষে রিগান হাসপাতাল ত্যাগ করেন এবং ধীরে ধীরে সেরে ওঠেন। অন্যদিকে ফেডারেল কোর্টে শুরু হয় ঘাতক হিনকলের বিচার। আদালতের আদেশে হিনকলের সামনে হাজির করা হয় ট্যাক্সি ড্রাইভার চলচ্চিত্রের নায়িকা ফস্টারকে। তখন প্রমাণিত হয় হিনকলে ছিলেন মূলত একজন মানসিক রোগী। ফলে সাজার বদলে মানসিক চিকিৎসা শুরু হয় হিনকলের এবং পরবর্তীতে তার মায়ের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়।

 

স্প্লিন্টারে ডান চোখ হারান চন্দ্রিকা

১৯৪৫ সালের ২৯ জুন কলম্বোর এক ধনাঢ্য ও রাজনৈতিক পরিবারে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার এ যাবৎকালের একমাত্র মহিলা প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা। তিনিই পৃথিবীর একমাত্র প্রেসিডেন্ট যার বাবা-মা উভয়েই দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মাত্র ১৪ বছর বয়সে চন্দ্রিকা তার বাবাকে হারান। বাবা বন্দরনায়েকে ছিলেন ধর্মভীরু। তাই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অবাধ যাতায়াত ছিল তার বাসায়। এমনই একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু তাল দুউই সোমারাশ পিস্তল নিয়ে চন্দ্রিকাদের বাসায় ঢুকে পড়েন। ওই বৌদ্ধ ভিক্ষুর গুলিতে আহত হন তিনি এবং পরদিন মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর পরিবার, দল, জোট ও দেশের হাল ধরেন মা সিরিমা রাতওয়াতি দিয়াস বন্দরনায়েকে। এই মহীয়সী নারী তিন মেয়াদে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর থেকেই কিশোরী চন্দ্রিকা রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। লেখাপড়া শেষে ১৯৭৮ সালে তিনি বিয়ে করেন অভিনেতা ও রাজনীতিবিদ বিজয়া কুমারাতুঙ্গাকে। বিয়ের মাত্র ১০ বছরের মাথায় ১৯৮৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আরেক হত্যাকাণ্ডে প্রাণ হারান স্বামী বিজয়া। ১৯৯০ সাল থেকে কুমারাতুঙ্গা আবার শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এ সময় তিনি পিপলস অ্যালায়েন্স নামে এক জোট গড়ে তোলেন। ১৯৯৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর পিপলস অ্যালায়েন্স সরকার গঠন করলে চন্দ্রিকা প্রধানমন্ত্রী ও তার মা পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। একই বছরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে চন্দ্রিকা শ্রীলঙ্কার প্রথম এবং এ যাবৎকালের একমাত্র প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং মাকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। ১৯৯৯ সালে অক্টোবরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী চন্দ্রিকা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার আশায় চন্দ্রিকা যখন দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে চলেছেন, তখনই তার জীবনে নেমে আসে এক করুণ পরিণতি। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৯৯ রোজ শনিবার। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাত্র দুই দিন আগে রাজধানী কলম্বোর টাউন হলে এক জনসভা ও নির্বাচন র‌্যালিতে যোগ দেন চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা। র‌্যালি চলাকালে এক আত্মঘাতী মহিলা নিরাপত্তারক্ষীদের সৃষ্ট নিরাপত্তা ভেঙে চন্দ্রিকার কাছে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু নিরাপত্তারক্ষীদের বাধা পেয়ে ঘাতক তার শরীরে পেঁচানো বোমার বিস্ফোরণ ঘটান। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ১৪ নিরাপত্তারক্ষী। আর অল্পের জন্য রক্ষা পেলেও একটি স্প্লিন্টারের আঘাতে চিরতরে ডান চোখ হারান চন্দ্রিকা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে বিস্ফোরিত হয় আরেকটি বোমা। এতেও প্রাণ হারান সাতজন। আর উভয় বিস্ফোরণে আহত হন শতাধিক নেতা-কর্মী, সমর্থক ও নিরাপত্তারক্ষী।

 

কাঁধে গুলি নিয়ে বেঁচে ছিলেন লেনিন

ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভের সংক্ষিপ্ত পরিচয় সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট নেতা ও সাবেক রাষ্ট্রনায়ক লেনিন হিসেবে। ১৯১৭ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি সোভিয়েত রাশিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৭০ সালের ২২ এপ্রিল লেনিন এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্ম নেন। ১৮৮৭ সালে বিপ্লবের দায়ে বড় ভাই আলেকজান্ডার ওরফে শাসার ফাঁসি হয়। তখন থেকেই লেনিন পরিচিতি পান মার্কসবাদী বিপ্লবী নেতা হিসেবে। বিপ্লবের কারণে কাজান ইমপেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তিনি অন্যত্র আইন বিষয়ে লেখাপড়া করেন। মার্কসবাদ ছড়ানোর কারণে তিনি তিন বছর নির্বাসিত জীবনযাপন করেন। নির্বাসন শেষে দেশে ফিরে আবারও রাজনীতিতে নিয়মিত হন। এরই মাঝে দল গঠন, জোট গঠন ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পর ১৯১৭ সালে ক্ষমতাসীন হন। ১৯১৮ সালের ১৪ জানুয়ারি রাশিয়ার পেট্রোগ্রাদ শহরে লেনিনের গাড়িতে গুলি ছোড়া হয়। এ সময় গাড়িতে থাকা তার বিশ্বস্ত সহযোগী সুউশ কমিউনিস্ট নেতা ফ্লিজ প্ল্যাটেন তাকে নিচু করে চেপে রাখেন এবং নিজের শরীর দিয়ে আগলে রাখেন। এতে ফ্লিজের হাতে গুলি লাগে এবং শরীর রক্তে ভিজে যায়। মাত্র সাত মাসের মাথায় ৩০ আগস্ট ১৯১৮ সালে লেনিন মস্কোর দক্ষিণাঞ্চলে এক অস্ত্র কারখানায় ভাষণ দেন। ভাষণ শেষে কারখানা বিল্ডিং ত্যাগ করে গাড়িতে ওঠার সময় সোশ্যালিস্ট রেভ্যুলুশনারি পার্টির এক নারী সদস্য ফানিয়া ইয়েফিমোভনা কাপলান লেনিনকে পেছন থেকে ডাক দেন। ফিরে দেখা মাত্র লেনিনকে নিজস্ব ব্রাউনিং পিস্তল থেকে তিন রাউন্ড গুলি করেন কাপলান। এর একটি লেনিনের গায়ের কোট ছিদ্র করে বেরিয়ে যায়। অপর দুটি গুলি তার শরীরে প্রবেশ করে। এতে তার গলা ও কাঁধ মারাত্মকভাবে জখম হয় এবং বাম ফুসফুস ছিদ্র হয়ে যায়। একটি গুলি রয়ে যায় বাম কাঁধে। আরও হত্যা প্রচেষ্টা ও জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে লেনিন হাসপাতালের বদলে তার ক্রেমলিনের নিরাপত্তাবলয়ে থাকা বাসস্থানে চলে আসেন। ডাক্তার ডেকে বাড়িতেই তার চিকিৎসা করা হয়, তবে তার বাঁ কাঁধে থেকে যাওয়া গুলিটি বের করা সম্ভব হয়নি ডাক্তারদের পক্ষে। এই হত্যাচেষ্টার পর আরও ছয় বছর বেঁচে ছিলেন লেনিন। তবে কখনো পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। এ ঘটনার ৩ দিন পর ১৯১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ক্রেমলিনের আলেকজান্ডার গার্ডেনে মাথার পেছন থেকে গুলি করে কাপলানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

 

সর্বশেষ খবর