বুধবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিখ্যাত যত ব্যর্থ অভিযান

মানুষের জীবনে ব্যর্থতার কোনো ঠাঁই নেই। অথচ অস্বীকার করার জো নেই যে, প্রায় প্রতিটি সাফল্যের পেছনেই কোনো না কোনোভাবে জড়িত ব্যর্থতার গ্লানি। বিশ্বের যত ইতিহাসখ্যাত কীর্তি রয়েছে তার বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই রয়েছে কোনো না কোনো ব্যর্থতার ইতিহাস। আর সেই ব্যর্থতার পথ ধরেই উত্তরসূরিরা কোনো না কোনোভাবে নিয়ে নিয়েছেন ইতিহাসের অংশীদারিত্ব। ইতিহাসে আলাদা করে ঠাঁই করে নেওয়া এমনই কিছু বিখ্যাত অথচ ব্যর্থ অভিযানের গল্প নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।

রণক ইকরাম

বিখ্যাত যত ব্যর্থ অভিযান

রবার্ট এডউইন [এভারেস্ট]

  রিয়ার অ্যাডমিরাল রবার্ট এডউইন পেরি [৬ মে ১৮৫৬-২০ ফেব্রুয়ারি ১৯২০] ছিলেন একজন আমেরিকান অভিযাত্রী। তিনি ১৯০৯ সালের ৬ এপ্রিল সর্বপ্রথম মানুষ হিসেবে উত্তর মেরুতে পা রাখার দাবি করেন। বিংশ শতকজুড়েই তার এই দাবিটি আলোচিত হয়ে আসছিল।

এর মধ্যেই ফ্রেডরিক কুক নামের আরেক অভিযাত্রী দাবি করেন তিনি এক বছর আগেই সেখানে গিয়েছিলেন। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক চলছিল। পরপর দুইবার ব্যর্থ হওয়ার পর তৃতীয়বারের চেষ্টায় সাফল্য এসেছে দাবি করলেও পেরির এই দাবি নিয়ে অধিকাংশ মানুষেরই সংশয় ছিল। তিনি আসলেই উত্তর মেরুর ঠিক মধ্যবিন্দুতে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ধরে নেওয়া হয় যে, তিনি এর কমপক্ষে ৫ মাইলের মাঝে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন। পুরোপুরি স্বীকৃতি না মেলায় তার এই অভিযানকে ব্যর্থ ধরা হয়। তবুও এটি বিখ্যাত কারণ এর সূত্র ধরেই পরবর্তীতে উত্তর মেরুর বিন্দুতে পৌঁছা সম্ভব হয়।

 

আর্নেস্ট শ্যাকল্টন

[দক্ষিণ মেরু অভিযান]

 

আর্নেস্ট শ্যাকল্টন [১৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৭-৫ জানুয়ারি ১৯২২] ছিলেন একজন ব্রিটিশ মেরু অভিযাত্রী, যিনি মোট তিনবার দক্ষিণ মেরু জয়ের চেষ্টা করেছিলেন। মূলত তার হাত ধরেই এন্টার্টিকা অভিযানের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। তার স্বপ্ন ছিল একটাই, দক্ষিণ মেরুর মধ্যবিন্দুতে পৌঁছে পৃথিবীর প্রথম মানুষ হিসেবে দক্ষিণ মেরু বা বরফরাজ্য জয় করা। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হয়নি। একবার, দুইবার, তিনবারের চেষ্টায়ও তিনি তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলেন না। ব্যর্থতার পর করা শ্যাকল্টনের একটি উক্তি ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। তিনি অনেক কষ্টে জীবিত ফেরত এসে বলেছিলেন- ‘আমি বিস্মিত হই এই ভেবে যে, সাফল্য আর ব্যর্থতার মাঝে ফারাকটা কত সূক্ষ্ম’। বরফের ভিতর জাহাজ আটকে গেলে ১৯১৪ সালে শুরু করা শ্যাকল্টনের তৃতীয় অভিযানটি ব্যর্থ হয়। এরপর প্রায় দুই বছরের সংগ্রাম শেষে তারা নিরাপদে লোকালয়ে পৌঁছতে সক্ষম হন।

 

 

অ্যামেলিয়া এয়ারহার্ট

 [পৃথিবী প্রদক্ষিণ]

 

অ্যামেলিয়া ম্যারি এয়ারহার্ট [২৪ জুলাই ১৮৯৭-২ জুলাই ১৯৩৭ সালে নিখোঁজ] ছিলেন একজন আমেরিকান বিমানচালক এবং একজন লেখিকা। ইতিহাসে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন বিশ্বের প্রথম নারী বিমানচালক হিসেবে। তিনিই প্রথমবারের মতো এককভাবে আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে বিমান চালান। বিমান চালনা বিষয়ে তিনি একাধিক বিশ্ব রেকর্ডের অধিকারী। আর উড়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা তার একাধিক বই ঠাঁই করে নিয়েছিল বেস্ট সেলারের তালিকায়। এর মধ্যেই এয়ারহার্ট বিমানে করে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ঘটনাটি ১৯৩৭ সালের। ভাবনা অনুসারে বিষুব রেখা বরাবর পৃথিবী প্রদক্ষিণের লক্ষ্য নিয়ে আকাশে উড়লেন এয়ারহার্ট। প্রশান্ত মহাসাগরের হাওল্যান্ড দ্বীপের কাছাকাছি গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় তার বিমান। ফলে এ যাত্রায় আর বিশ্বরেকর্ড করা হয়নি তার। পরবর্তীতে যা করে দেখান ভেলেন্টিনা তেরেসকোভা।

 

অ্যাপোলো ১৩ [চন্দ্রাভিযান]

অ্যাপোলো ১৩ ছিল চাঁদের অভিমুখে চালানো মনুষ্যবাহী সপ্তম যান। আমেরিকান স্পেস প্রোগ্রামের আওতায় দীর্ঘদিন ধরেই পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চন্দ্র জয়ের প্রচেষ্টা চলছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালের ১১ এপ্রিল চন্দ্রাভিমুখে যাত্রা শুরু করে অ্যাপোলো ১৩। কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে যাত্রা শুরু করা এই যানে মোট তিনজন আরোহী ছিলেন। কিন্তু অ্যাপোলো ১৩-তে রাখা একটি অক্সিজেন ট্যাংক মাঝপথে বিস্ফোরিত হলে পুরো অভিযানটি ব্যর্থ হয়ে যায়। আশ্চর্যজনকভাবে সংশ্লিষ্টরা মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে এসেছিল। এরপরই অ্যাপোলো ১১ মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চাঁদের বুকে অবতরণ করে। আর পৃথিবীর প্রথম মানুষ হিসেবে চাঁদে পা রাখেন নিল আর্মস্ট্রং।

 

জর্জ ম্যালোরি

 [এভারেস্ট]

 

জর্জ হারবার্ট লেই ম্যালোরি [১৮ জুন ১৮৮৬-৮ বা ৯ জুন ১৯২৪] ছিলেন একজন ইংলিশ পর্বতারোহী। তিনি প্রথম তিন ব্রিটিশ পর্বতারোহীর একজন, যিনি মাউন্ট এভারেস্ট জয়ের চেষ্টা করেন। ঘটনাটি ১৯২৪ সালের। তখনো মাউন্ট এভারেস্ট জয় করা সম্ভব হয়নি। এ সময় একদল অভিযাত্রীর সঙ্গে ক্যাম্প করেন তিনি। অভিযানে তার সবচেয়ে কাছের সঙ্গী ছিলেন এন্ড্রু স্যান্ডি। তাদের উদ্দেশ ছিল এভারেস্টের শীর্ষে মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পা ফেলা। কিন্তু সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। এই যাত্রায় ৮ জুন পাহাড়ে ওঠার প্রচেষ্টায় ম্যালোরি ও স্যান্ডি নিখোঁজ হয়ে যান। পরবর্তীতে অবশ্য হিলারি ও তেনজিং প্রথমবারের মতো এভারেস্টের শীর্ষে পা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

 

বেলুন অভিযান

এস এ আন্দ্রেই প্রথমবারের মতো উত্তর মেরুতে বেলুন অভিযান চালিয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ১৮৯৭ সালের ঘটনা। ফরাসি অভিযাত্রী আন্দ্রেই, নাট ফ্রাঙ্কেল এবং নিলস স্ট্রিন্ডবারগ বেলুনে করে উত্তর মেরু পাড়ি দেওয়ার প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু খুব দ্রুতই মেরুর হিমেল বাতাস ও জমাট কুয়াশায় ভেস্তে যায় তাদের এ অভিযান। আর এ অভিযানে ঝরে যায় সব কটি তাজা প্রাণ। ৩৩ বছর পর উদ্ধার করা সম্ভব হয় তাদের দেহাবশেষ। এই ব্যর্থ অভিযানের পথ ধরেই পরবর্তীতে নানাভাবে উত্তর মেরু জয়ের চেষ্টা চালিয়ে সাফল্যের মুকুট পরেন অভিযাত্রীরা।

সর্বশেষ খবর