শনিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা
বিশ্বের বিস্ময়

সোনার খনি

তানিয়া তুষ্টি

সোনার খনি

মূল্যবান তুলনা সে তো সোনার সঙ্গেই চলে। তাহলে ধাতু হিসেবে সেই সোনার কদর কত তা আর ব্যাখ্যার অবকাশ থাকে না। আদিযুগে এই ধাতু সম্পর্কে মানুষের তেমন ধারণা ছিল না। জানা ছিল না সোনা উত্তোলনের কৌশল। কিন্তু বর্তমানে মানুষ রীতিমতো সোনা নিয়ে রাজত্ব করতে শিখেছে। বিশ্বজুড়ে থাকা এই সোনার ভাণ্ডারের নানা ইতিহাস নিয়ে আজকের রকমারি—

বিশ্বজুড়ে সোনার ভাণ্ডার

সোনা সব মানুষের কাছে মূল্যবান খনিজ পদার্থ। আর সেই সুবাদে যেখানেই সোনার খনির সন্ধান মিলেছে সেখানেই মানুষ ছুটে গেছে। তবে বিশ্বের সব দেশেই তো আর সোনার ভাণ্ডার নেই। হাতেগোনা কয়েকটি দেশে রয়েছে মূল্যবান এই ধাতুর খনি। উপমহাদেশীয় ভারতেই রয়েছে সোনার বিশাল ভাণ্ডার। বিজনেস ইনসাইডারের জরিপে বর্তমানে এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম দেশ ভারতে রয়েছে প্রায় ৫৫৭.৭ টন সোনার মজুদ। ভারতীয়দের নিজেদের পুরনো বিশ্বাস যে, সোনার জন্য টাকা খরচ করলে তা ক্ষয় হয়। তাই হয়তো বিশাল এই ভাণ্ডারের দিকে তাদের কোনো নজর নেই। বিশ্বের আরেকটি সোনার ভাণ্ডারের দেশ নেদারল্যান্ডস।

উত্তোলন ব্যাপক থাকায় বেশ কিছুদিন আগেও তাদের দেশে সোনা বিক্রির হিড়িক ছিল। তবে এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। এর আগে ডাচরা কখনোই তাদের এই হলুদ টাকার ওপর হাত দেয়নি। নেদারল্যান্ডসে প্রায় ৬১২.৫ টন সোনা রয়েছে। এশিয়ার আরেক দেশ জাপানও বিশাল সোনার উৎস। উনিশ শতকের মাঝামাঝি জাপানিদের সোনা ছিল মাত্র ৬ টন। তবে বর্তমানে জাপানে ৭৬৫.২ টন সোনার বিশাল মজুদ রয়েছে। সুইজারল্যান্ড ও রাশিয়াও সোনার দৌড়ে পিছিয়ে নেই। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের কাছে দেশটির দেওয়া তথ্যানুসারে বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের রয়েছে ১,০৪০ টন সোনা।

অন্যদিকে বৃহত্তর রাশিয়ার রয়েছে প্রায় ১৩৫২.২ টন সোনার ভাণ্ডার। এশিয়ায় চীনের সোনার ভাণ্ডার হলো প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সুফল। বর্তমানে দেশটিতে সোনা রয়েছে প্রায় ১,৭০৮.৫ টন। অন্যদিকে ফ্রান্সের কথা বলতে গেলে দেশটির ডানপন্থি নেতা মেরিন লে পেনের ভূমিকা সম্পর্কে বলতেই হয়। যিনি কিনা ২০১৪ সালে দেশটিকে সোনায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে ব্যাপক উৎসাহ দেন। বর্তমানে দেশটির সোনার মজুদ গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৩৫.৫ টনে। ইতালির ভাণ্ডারে রয়েছে ২,৪৫১.০ টন সোনা। অন্যদিকে জার্মানির হাতে রয়েছে প্রায় ৩,৩৮১ টন পরিমাণের সোনা। আমেরিকার সোনার মজুদও কম নয়। ১৯৫২ সালের আগে ছিল প্রায় ২০,৬৬৩ টন। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সে পরিমাণ কমতে থাকে। বর্তমানে এ দেশটির সোনার ভাণ্ডারে মজুদ রয়েছে মোট ৮১৩৩.৫ টন।

স’মিল বসাতে গিয়ে সোনা!

১৮৪৮ সালে জন সাটার নামের এক মার্কিন ধনাঢ্য আবাসন ব্যবসায়ী দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি বড় আবাসন প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেন। সে কাজে তার প্রয়োজন হলো প্রচুর কাঠের। প্রকল্পের পাশেই সাটার একটি স’মিল বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। কাছেই সাক্রামেন্টো পাহাড়ে সেই স’মিল বসানোর দায়িত্ব দিলেন জেমস মার্শালকে। শুরু হলো কাজ। লোকবল নিয়ে হাজির হলেন উক্ত স্থানে। এই কাজে মাটি খোঁড়ার সময় মার্শাল আবিষ্কার করলেন মাটির নিচে সোনালি কিছু একটা চকচক করছে। আবিষ্কারের আনন্দে তার চোখ জোড়াও চকচক করে উঠল। তখন হয়তো তিনি বুঝে উঠতে পারেননি তিনিই প্রথম সোনার খনি আবিষ্কারক। এর কয়েকদিন পর স’মিলে পরিখা খননের প্রয়োজনে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটি ব্যবহার করা হয়েছিল। প্রতি রাতে নদীর পানির দিক পরিবর্তন করে স’মিলের নিচ দিয়ে প্রবাহিত করা হতো। দিনের বেলা সেই প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া হতো। ১৮৪৮ সালের ২৪ জানুয়ারি দিনের বেলায় পানির প্রবাহ বন্ধ করে মার্শাল পরিখার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে গেলেন। শুকনো পরিখায় মার্শাল এক তাল চকচকে উজ্জ্বল ধাতব কিছু একটা দেখতে পান। তিনি দুটি পাথর দিয়ে ধাতব তালটাকে পিটিয়ে দেখলেন। সেটি ছড়িয়ে গিয়ে বড় হলো, কিন্তু ভাঙল না। ব্যস, মার্শাল নিশ্চিত হলেন, ওই তালটা সোনারই।

বিখ্যাত কিবালি

বিশ্বের বৃহত্তম সোনা উৎপাদনকারী দেশ ডি আর কঙ্গোর অন্যতম বৃহত্তম সোনার খনি কিবালি। এই খনিতে উৎপাদন কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে। কিবালি সোনার খনিতে দক্ষিণ আফ্রিকার রেন্ডগোল্ড রিসোর্সের ৪৫ শতাংশ, অ্যাংলোগোল্ড আশহান্তির ৪৫ শতাংশ এবং কঙ্গো সরকারের ১০ শতাংশ অংশীদারিত্ব রয়েছে। আড়াইশ কোটি ডলারের এ প্রকল্পে সাত হাজার লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছে। এখানে যারা কাজ করেন তার ৮০ শতাংশ লোক আবার কঙ্গোর নাগরিক। কিবালি খনিটি অতি আধুনিক পদ্ধতিতে পরিচালনা করা হয়, যা অন্যান্য খনির চেয়ে অনেক বেশি উন্নত ধরা হয়। প্রথম পর্যায়ে খনিটি প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি, ৩৬ ইউনিট উচ্চগতির তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ আধুনিক অবকাঠামো ও তিনটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ভূগর্ভস্থ খনির উন্নয়ন অন্তর্ভুক্ত আছে। এর সঙ্গে দুটি অতিরিক্ত জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও উপগ্রহ কেন্দ্রের পরিচালনা ব্যবস্থা রয়েছে। খনি কর্তৃপক্ষের প্রত্যাশা প্রথম ১০ বছর ধরে বার্ষিক ৬০০ কেজি সোনা উত্তোলন করা সম্ভব হবে। এই উৎপাদন বাড়ানো যাবে ২০৩২ সাল পর্যন্ত। ২০১৭ সালে কিবালি খনি থেকে ৫ লাখ ৯৬ হাজার ২২৫ আউন্স সোনা উত্তোলন করা সম্ভব হয়েছে। প্রতি আউন্সে খরচ পড়েছে ৭৭৩ ডলার। এতে মুনাফা হয় ২৮৭.৭ মিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালে এই উৎপাদন দাঁড়াতে পারে ৭ লাখ ৩০ হাজার আউন্স। এই উৎপাদনেও আগের থেকে খরচ অনেক বেশি কমে যাবে। কোম্পানিটি ২০১৪ সালে প্রথম গ্রেডে আইএসও সনদ পায়।

গ্রাসবার্গ খনি

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সোনার খনি গ্রাসবার্গ। ইন্দোনেশিয়ার ম্যাকমোরান কপান অ্যান্ড গোল্ডের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ফ্রিপোর্ট এই খনির পরিচালনাকারী। খনিটি পরিচালনার ৯০.৬৪ শতাংশ দখলে রয়েছে এই কোম্পানির, বাকি অংশ সরকারের। এটি একই সঙ্গে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তামার খনিও। গ্রাসবার্গ খনিটি ওসেনিয়া মহাদেশের পাপুয়া নিউগিনিতে অবস্থিত। এখানে কর্মরত আছেন ১৯ হাজার ৫০০ কর্মী। খনিতে এখন পর্যন্ত ১.৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন সোনা মজুদ আছে। ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই খনিতে মোট সংরক্ষিত সোনার পরিমাণ ছিল ৬.৫ মিলিয়ন আউন্স। খনি পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলোর মতে, ২০১৩ সালে খনিটি থেকে ১.২৫ মিলিয়ন আউন্স সোনা উত্তোলন করা হয়। ১৯৯০ সালে এই খনি থেকে আকরিক উত্তোলন শুরু হয়। প্রতিদিন ১ লাখ ৬৫ হাজার টন আকরিক প্রক্রিয়াজাত করা হয়। ২০২২ সালের মধ্যে এই পরিমাণ বেড়ে ২ লাখ ৪০ হাজার টনে পৌঁছবে বলে আশা করা যাচ্ছে। তবে দুর্ঘটনাও এড়াতে পারেনি খনিটি। ২০১৩ সালের মে মাসে ৩৩ জন শ্রমিক আটকা পড়ে। একই মাসে আরও ১৪ জন মারা যায়।

ক্যালিফোর্নিয়ার গোল্ডরাশ

১৮৪৮ সালের জানুয়ারিতে ক্যালিফোর্নিয়ার কলোমা নামক শহরে সাটার স’মিলে সোনা খুঁজে পান জনৈক জেমস মার্শাল। এই কথা জানতে পেরে আমেরিকার সব রাজ্যের মানুষ তো বটেই চায়না, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ ও ল্যাটিন আমেরিকার ভাগ্যান্বেষী মানুষরাও খেয়ে না খেয়ে ছুটতে থাকে ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে। স্বপ্ন তাদের একটাই, সোনা খুঁজে বের করা। রাতারাতি বদলে ফেলবেন নিজেদের ভাগ্য। এই সোনা-হুজুগের পাল্লায় পড়ে ঘরবাড়ি বিক্রি করে, প্রিয়জন ছেড়ে, মাইলের পর মাইল পাড়ি দেয় অনেক লোক। দুর্গম পথ ও মৃত্যুভয়কে সঙ্গে নিয়ে মেতে যায় ক্যালিফোর্নিয়ায় যাওয়ার নেশায়। হাজার হাজার মানুষের আগমনে মাত্র আট বছরে ক্যালিফোর্নিয়া পরিণত হয় আমেরিকার অন্যতম বহুজাতিক রাজ্যে। গোটা পৃথিবী থেকে এর মধ্যে শুধু ১৮৪৯ সালেই জনবিরল এ এলাকায় নতুন করে পা রাখে তিন লাখেরও বেশি মানুষ। ওই সালের নামেই ইতিহাস এদের স্মরণে রেখেছে ‘ফর্টি-নাইনার্স’ হিসেবে। ক্যালিফোর্নিয়ার পুরো অঞ্চলে দেখা গেল সর্বত্র মাটি খুঁড়ে অথবা নদীর জল ছেঁকে সোনা খুঁজছে মানুষ। আর এসব সোনাসন্ধানীর অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্রে সদ্য পা রাখা অভিবাসী। সব আশা গুঁড়িয়ে সোনার দেখা আর মেলে না। খনিতে থাকা-খাওয়ার কষ্ট তো আছেই, সঙ্গে যুক্ত হয় একাকিত্বের যন্ত্রণা। তার ওপর খনির হাড়ভাঙা খাটুনি তো আছেই। মূলত অঞ্চলটির সোনার প্রাচুর্যের প্রলোভন দেখিয়ে সেখানে যাত্রী টানার জন্যই হুজুগ তৈরি করেছিল জাহাজ ব্যবসায়ীরা। ওই সময় প্রতিদিন যাত্রীবাহী প্রচুর জাহাজ আর কাভার্ড ওয়াগন এসে হাজির হতো ক্যালিফোর্নিয়ায়।

ভূমিকম্পেই সোনা সৃষ্টি

ভূমিকম্প পাল্টে দিতে পারে পৃথিবীর মানচিত্র। বদলে দিতে পারে গতিপথ। ধ্বংস করে দিতে পারে সভ্যতা, সুউচ্চ পাহাড়। তবে সম্প্রতি ভূমিকম্প নিয়ে বোমা ফাটালেন বিজ্ঞানীরা। ভূমিকম্পের ফলে নাকি তৈরি হয় সোনা। অবাক হলেও এর সত্যতা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা বলেন, আগ্নেয়গিরি ও ভূমিকম্পের ফলে নাকি সৃষ্ট ভূগর্ভস্থ তরল পদার্থগুলো খণ্ডিত হয়ে ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়। পরবর্তীতে রূপান্তরিত হয় মূল্যবান সম্পদে। অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ডের ভূপদার্থ বিজ্ঞানের গবেষক ডিওন ওয়েদারলি এই গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি জানান, ভূগর্ভস্থ তাপ ও চাপের ফলে তরল পদার্থগুলো পৃথক পৃথক কণায় রূপান্তরিত হয়। সৃষ্টি হয় নতুন নতুন পদার্থ। ভূগর্ভের ১০ কিলোমিটার গভীরে পানির সঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও সিলিকা মিশে থাকে। যখন ভূকম্পন হয়, তখন প্রচণ্ড তাপ ও চাপের ফলে ভেঙে যায় সেখানকার পানির কণাগুলো। এতে বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান খনিজ পদার্থের সৃষ্টি হয়। তখন অবশ্য অন্যান্য খনিজ পদার্থের মতো সোনার উপাদানগুলোও বালি আর কাদামিশ্রিত অবস্থায় থাকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর