বুধবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

নোবেল পুরস্কার ২০১৮

নোবেল পুরস্কার ২০১৮

পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক নোবেল পুরস্কার প্র্রবর্তিত হয় ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে। ওই বছর থেকে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সফল এবং অনন্য সাধারণ গবেষণা ও উদ্ভাবন এবং মানবকল্যাণমূলক তুলনারহিত কর্মকাণ্ডের জন্য এ পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। মোট ছয়টি বিষয়ে পুরস্কার প্রদান করা হয়। বিষয়গুলো হলো— পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা শাস্ত্র,  অর্থনীতি, সাহিত্য এবং শান্তি। কিন্তু এ বছর সুইডিস একাডেমির সদস্যদের যৌন ও আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ পাওয়ার কারণে সাহিত্যে কাউকে নোবেল দেয়া হয়নি। তবে ইতিমধ্যে অন্যান্য বিভাগে ঘোষিত হয়েছে ২০১৮ সালের নোবেল বিজয়ীদের নাম। সেসব নোবেল জয়ীদের নিয়ে আজকের রকমারি আয়োজন। লিখেছেন —তানিয়া তুষ্টি

 

ডিনামাইট উদ্ভাবকের নামে প্রবর্তিত

১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা শুরু হয়। বর্তমান পৃথিবীতে এটিই সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত। ১৯০১ সাল থেকেই বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সফল এবং অনন্য সাধারণ গবেষণা ও উদ্ভাবন এবং মানবকল্যাণমূলক তুলনারহিত কর্মকাণ্ডের জন্য এই পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। মোট ছয়টি বিষয়ে পুরস্কার প্রদান করা হয়। বিষয়গুলো হলো— পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র, অর্থনীতি, সাহিত্য এবং শান্তি।

সুয়েডীয় বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের ১৮৯৫ সালে করে যাওয়া একটি উইলের মর্মানুসারে নোবেল পুরস্কার প্রচলন করা হয়। নোবেল মৃত্যুর আগে উইলের মাধ্যমে এ পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা করে যান। শুধু শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় অসলো, নরওয়ে থেকে। বাকি ক্ষেত্রে স্টকহোম, সুইডেনে এ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। অর্থনীতি ছাড়া অন্য বিষয়গুলোতে ১৯০১ সাল থেকে পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু অর্থনীতিতে পুরস্কার প্রদান শুরু হয়েছে ১৯৬৯ সালে। আলফ্রেড নোবেল তার উইলে অর্থনীতির কথা উল্লেখ করেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ১৯৪০ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত পুরস্কার প্রদান বন্ধ ছিল। প্রতি বছর পুরস্কারপ্রাপ্তদের প্রত্যেকে একটি স্বর্ণপদক, একটি সনদ ও নোবেল ফাউন্ডেশন কর্তৃক কিছু পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকেন। ২০১২ খ্রিস্টাব্দে এই অর্থের পরিমাণ ছিল ৮০ লাখ সুইডিশ ক্রোনা। নোবেল পুরস্কার মৃত কাউকে দেওয়া হয় না। লরিয়েটকে অবশ্যই পুরস্কার প্রদানের সময় জীবিত থাকতে হবে। আলফ্রেড নোবেল, নোবেল পুরস্কারের প্রবক্তা। আলফ্রেড নোবেল, ২১ অক্টোবর ১৮৩৩ সালে সুইডেনের স্টকহোমে একটি প্রকৌশল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে রসায়নবিদ, প্রকৌশলী ও একজন উদ্ভাবক ছিলেন। ১৮৯৪ সালে তিনি একটি বফর লোহা ও ইস্পাত কারখানা ক্রয় করেন, যা পরে একটি অন্যতম অস্ত্র তৈরির কারখানায় পরিণত করেন। তিনি ব্যালাস্টিক উদ্ভাবন করেন, যা বিশ্বব্যাপী ধোঁয়াবিহীন সামরিক বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহূত হয়। তার ৩৫৫টি উদ্ভাবনের মাধ্যমে তিনি জীবদ্দশায় প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক হন, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ডিনামাইট। ১৮৮৮ সালে তিনি মৃতদের তালিকা দেখে বিস্মিত হন, যা একটি ফরাসি পত্রিকায় এ মার্চেন্ট অব ডেথ হু ডেড প্রকাশিত হয়। যেহেতু নোবেলের ভাই লুডভিগ মারা যান। এ নিবন্ধটি তাকে ভাবিয়ে তোলে এবং খুব সহজেই বুঝতে পারেন যে, ইতিহাসে তিনি কীভাবে স্মরণীয় হতে চান, যা তাকে তার উইলটি পরিবর্তন করতে অনুপ্রাণিত করে। ১০ ডিসেম্বর ১৮৯৬ সালে আলফ্রেড নোবেল তার নিজ গ্রাম স্যান রিমো, ইতালিতে মৃত্যুবরণ করেন। সেই সময় তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। নোবেল তার জীবদ্দশায় অনেক উইল লিখে গিয়েছিলেন। সর্বশেষটা লেখা হয়েছিল তার মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে ২৭ নভেম্বর, ১৮৯৫ সালে প্যারিসে অবস্থিত সুইডিশ-নরওয়ে ক্লাবে। বিস্ময় ছড়িয়ে যায়, নোবেল তার সর্বশেষ উইলে উল্লেখ করেন যে তার সব সম্পদ পুরস্কার আকারে দেওয়া হবে, যারা পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসা, শান্তি ও সাহিত্যে বৃহত্তর মানবতার স্বার্থে কাজ করবেন। নোবেল তার মোট সম্পদের (৩১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা) ৯৪ শতাংশ এ পাঁচটি পুরস্কারের জন্য উইল করেন। ২৬ এপ্রিল, ১৮৯৭-এর আগ পর্যন্ত সন্দেহপ্রবণতার জন্য নরওয়ে থেকে এই উইল অনুমোদন করা হয়নি। নোবেলের উইলের সমন্বয়কারী রগনার সোলম্যান ও রুডলফ লিলজেকুইস্ট নোবেল ফাউন্ডেশন তৈরি করেন, যার কাজ তার সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। নোবেল পাঁচটি ক্ষেত্রে পুরস্কার দেওয়ার জন্য তার মোট সম্পত্তির শতকরা ৯৪ ভাগ দান করে যান। এর মোট পরিমাণ ৩১ মিলিয়ন এসইকে (৩.৪ মিলিয়ন ইউরো, ৪.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)।

 

শান্তি : যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে অভিযান

নাদিয়া মুরাদ

নোবেল জয় করে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন ইরাকের ইয়াজিদি মানবাধিকারকর্মী নাদিয়া মুরাদ। প্রথম ইরাকি হিসেবে নোবেল পাওয়া ২৫ বছর বয়সী নাদিয়ার পথটি মোটেও সহজ ছিল না। ইরাকের সিঞ্জারের পাহাড়ি এলাকায় তার বসবাস ছিল। ২০১৪ সালের আগস্টে আইএস জিহাদিরা নাদিয়াদের গ্রামে ঢুকে পড়ে। এরপর তারা গ্রামের নারী-পুরুষদের একটি স্কুলে আটক করে। সেখানে পুরুষদের গুলি করে হত্যা করে নারীদের বন্দী করে জোরপূর্বক শ্রম ও যৌনদাসী হতে বাধ্য করে। আইএস অপর একটি পক্ষের কাছে যৌনদাসী হিসেবে মুরাদকে বিক্রি করে দেয়। এরপর সিরিয়ান, ইরাকি, তিউনিসিয়ান ও ইউরোপিয়ান আইএস জঙ্গিদের নিষ্ঠুর লালসার শিকার হতে হয় তাকে। যন্ত্রণায় কেটেছে তার প্রতিটি মুহূর্ত। এর তিন মাস পর নভেম্বরে অনেক কষ্টে পালিয়ে আসেন তিনি। পালিয়ে এসেই তিনি ক্ষান্ত হননি, বরং যোগ দেন আইএসের হাতে বন্দী ইয়াজিদি নারীদের মুক্তির সংগ্রামে। রুখে দাঁড়ান নারী পাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ২০১৫ সালে তিনি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সামনে তুলে ধরেছিলেন নিজের ভয়ানক অভিজ্ঞতা। আইএসের হাতে বন্দী থাকা অবস্থায় তার তিন মাসের অভিজ্ঞতা ছিল ভয়ঙ্কর।

এ ছাড়া ধর্ষণকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধেও তিনি কঠিন ভূমিকা পালন করেন। এই অবদান তাকে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়। ৫ অক্টোবর ওসলোতে নরওয়েজিয়ান কমিটির  ঘোষণায় শান্তিতে নোবেল  বেজয়ী হন তিনি।

 

ডেনিস মুকভেগে

চলতি বছরে নোবেল শান্তি পুরস্কার জিতে নিয়েছেন অপর ব্যক্তি কঙ্গোর চিকিৎসক ডেনিস মুকভেগে। তিনিও গোটা বিশ্বে যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে সোচ্চার আওয়াজ তোলার জন্য এই স্বীকৃতি পেলেন। প্রায় দুই দশক ধরে যুদ্ধবিদ্ধস্ত কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের যৌন সহিংসতার শিকার নারীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের পাশাপাশি তাদের ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নজনিত মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে আসছেন ডেনিস মুকভেগে। ১৯৯৯ সালে দক্ষিণ কিভুতে এক হাসপাতাল গড়ে তোলেন। সেখানে ধর্ষণের শিকার নারী, শিশু এমনকি কয়েক মাস বয়সী দুগ্ধপোষ্যদেরও চিকিৎসা করেছেন তিনি।

 

 

 

 

 

 অর্থনীতি : টেকসই প্রবৃদ্ধির কৌশল

উইলিয়াম নরডাস

বিশ্ব অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই প্রবৃদ্ধিসহ মৌলিক ও জরুরি বিষয়গুলো তুলে ধরার নকশা পদ্ধতিতে বিশেষ অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার জিতলেন দুই মার্কিনি। তারা হলেন— উইলিয়াম ডি নরডাস ও পল এম রোমার। ৮ অক্টোবর, সোমবার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের উইলিয়াম ডি. নরডাস ও নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের পল এম. রোমারের নাম ঘোষণা করে দ্য রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস।

৯ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার (১.০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) পুরস্কারের অর্থ ভাগাভাগি করে নেবেন তারা। ১০ ডিসেম্বর অসলোতে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হবে। পুরস্কারের অর্থ তারা ভাগ করে নেবেন।

 

 

 

উইলিয়াম নরডাস

তিনি কাজ করেছেন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে। নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, জলবায়ু পরিবর্তনকে দীর্ঘমেয়াদে ম্যাক্রো ইকোনমিকসের সঙ্গে একীভূত করে বিশ্লেষণের স্বীকৃতি হিসেবে উইলিয়াম ডি. নরডাসকে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে। উইলিয়াম ডি নরডাস যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। একই বিভাগ থেকে তিনি পড়াশুনা শেষ করেছেন। ১৯৪১ সালে উইলিয়াম নরডাস যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোতে জন্মগ্রহণ করেন।

 

পল রোমার

তিনি কাজ করেছেন টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে। নোবেল কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, পল রোমারকে এই পুরস্কার দেয়া হয়েছে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে দীর্ঘমেয়াদে ম্যাক্রো ইকোনমিকসের সঙ্গে একীভূত করে বিশ্লেষণের স্বীকৃতি হিসেবে। পল এম রোমার চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ডেনভারে জন্মগ্রহণ করেন। শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেন তিনি।

মূলত আলফ্রেড বার্নার্ড নোবেলের উইল অনুযায়ী অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু ১৯৬৯ সালে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (রিক্সব্যাঙ্ক) নোবেলের স্মৃতির উদ্দেশে এই পুরস্কারটি চালু করে। সেজন্য এটিকে অর্থনীতিতে নোবেল স্মারক পুরস্কার বলা হয়। তবে পরবর্তীতে পুরস্কারটি অর্থনীতিতে নোবেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এ পুরস্কারের অর্থও যোগান দেয় সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

 

পদার্থ : যুগান্তকারী উদ্ভাবন

এবারের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারের ক্ষেত্রে দুটি রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এর একটি হলো, দীর্ঘ ৫৫ বছরে স্ট্রিকল্যান্ড হলেন পদার্থে নোবেল পাওয়া প্রথম নারী বিজ্ঞানী। আর দ্বিতীয়টি হলো, ৯৬ বছর বয়সী আর্থার আশকিন হলেন সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ নোবেলজয়ী।

 

পদার্থ ক্যাটাগোরিতে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানসূচক পুরস্কার নোবেল পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পদার্থ বিজ্ঞানী আর্থার আশকিন, ফরাসী পদার্থবিজ্ঞানী জেরার্ড ম্যুরো ও কানাডার ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড। ২ অক্টোবর রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি নোবেল জয়ী এই তিন বিজ্ঞানীর নাম ঘোষণা করে। একাডেমি বলছে, কেবল আলো ফেলেই অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা বা জীবাণুকে নাড়ানো আর লেজারের শক্তিকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলার যুগান্তকারী কৌশল উদ্ভাবনের জন্য তাদেরকে যৌথভাবে পুরস্কার দেওয়া হলো। নোবেল পুরস্কারের ৯০ লাখ সুইডিশ ক্রোনারের মধ্যে আশকিন পাবেন অর্ধেক। আর বাকি অর্ধেক ম্যুরো ও স্ট্রিকল্যান্ড ভাগ করে নেবেন। এবারের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারের ক্ষেত্রে দুটি রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এর একটি হলো, দীর্ঘ ৫৫ বছরে স্ট্রিকল্যান্ড হলেন পদার্থে নোবেল পাওয়া প্রথম নারী বিজ্ঞানী। ১৯০৩ সালে প্রথম নারী হিসেবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন মারি কুরি এবং ১৯৬৩ সালে পদার্থে নোবেল পান মারিয়া গোয়েপার্ট মায়ের নামে আরেক নারী বিজ্ঞানী। আর এবার তৃতীয় নারী হিসেবে পদার্থে নোবেল পেলেন স্ট্রিকল্যান্ড। আর দ্বিতীয়টি হলো, ৯৬ বছর বয়সী আর্থার আশকিন হলেন সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ নোবেলজয়ী।

 

আর্থার আশকিন

১৯২২ সালের ২ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জন্ম নেন আর্থার আশকিন। ১৯৮৭ সালে যখন অপটিকাল টুইজার নামের চমকপ্রদ উদ্ভাবনটি করলেন, তখন তিনি কাজ করছিলেন বেল ল্যাবরেটরিজে। তার ওই উদ্ভাবনকে নোবেল কমিটি তুলনা করেছে সায়েন্স ফিকশনের গল্পকে বাস্তবে পরিণত করার সঙ্গে। আশকিনের অপটিক্যাল টুইজার হলো আক্ষরিক অর্থেই লেজার রশ্মির তৈরি চিমটা, যা দিয়ে অতিক্ষুদ্র কণা, পরমাণু, ভাইরাস আর জীবন্ত কোষ ধরে কোনো ধরনের ক্ষতি না করেই ইচ্ছামতো নড়াচড়া করা বা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরানো সম্ভব। আর্থার আশকিকের সেই অপটিক্যাল টুইজার জৈবিক গবেষণাকে আরও সূক্ষ্ম পর্যায়ে নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।  নোবেল কমিটি ফরাসি বিজ্ঞানী জেরার্ড ম্যুরো এবং কানাডীয় গবেষক ডোনা স্ট্রিকল্যান্ডকে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয় লেজার রশ্মির পালসের দৈর্ঘ্য ছোট করে এনে এর শক্তি বহুগুণে বাড়িয়ে তোলার কৌশল উদ্ভাবনের জন্য। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এই বৈপ্লবিক গবেষণার ধারণাটি প্রথমবারের মতো সামনে আনেন তারা। তাদের উদ্ভাবিত ‘চার্পড পালস এমপ্লিফিকেশন’ বা সিপিএ পদ্ধতি বর্তমানে গোটা বিশ্বে মানুষের চোখের সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচারের কাজে ব্যবহূত হচ্ছে। 

 

জেরার্ড আলবার্ট ম্যুরো

তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৪ সালের ২২ জুন। তিনি পরিচিত বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী ও লেজারের ক্ষেত্রে অগ্রদূত হিসেবে।

 

ইউনিভার্সিটি অফ গ্রিনোবেলে বিএসসি, ইকোলে পলিটেকনিকে এমএসসি এবং পিয়েরে অ্যান্ড মেরি কুরি ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

 

 

 

 

ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড

কানাডার অন্টারিওর গুলেফ শহরে ১৯৫৯ সালের ২৭ মে জন্মগ্রহণ করেন ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড। তিনি পরিচিত লেজার বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হিসেবে। ১৯৮১ সালে তিনি ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশল পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেন।

এরপর ১৯৮৯ সালে রোচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ২০১১ সালে সহ-সভাপতি ও ২০১৩ সালে দ্য অপটিক্যাল সোসাইটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 

 

 

 

 

 

রসায়ন : বিবর্তন নিয়ন্ত্রণ

বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস। নোবেল কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, এবার রসায়নে নোবেল জয়ী তিন বিজ্ঞানীর কল্যাণে রসায়নে যে বিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে তা মানবজাতির সর্বাধিক সুবিধা নিশ্চিত হয়।

 

এ বছর রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন দুজন মার্কিনি ফ্রান্সিস এইচ আরনল্ড, জর্জ পি স্মিথ ও একজন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার গ্রেগরি পি উইন্টার। এদের মধ্যে এনজাইমের বিবর্তনের জন্য ফ্রান্সিস এইচ আর্নল্ডকে এবং পেপটাইড ও অ্যান্টিবডির ফেজ প্রদর্শনের জন্য জর্জ পি স্মিথ ও স্যার গ্রেগরি পি উইন্টারকে এ পুরস্কার দেয়া হয়। রয়েল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস জানিয়েছে, এনজাইমের বিবর্তনের জন্য পুরস্কার মূল্যের অর্ধেকটা পাবেন ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির ফ্রান্সিস এইচ আরনল্ড। আর ‘পেপটাইড ও অ্যান্টিবডির ফেজ প্রদর্শন’ এর জন্য পুরস্কার মূল্যের বাকি অর্থ পাবেন উইন্টার ও স্মিথ। ৩ অক্টোবর সুইডেনের স্টকহোমের কারোলিন্স অ্যাকাডেমিতে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস। নোবেল কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, এবার রসায়নে নোবেল জয়ী তিন বিজ্ঞানীর কল্যাণে রসায়নে যে বিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে তা মানবজাতির সর্বাধিক সুবিধা নিশ্চিত হয়।

 

ফ্রান্সিস হ্যামিল্টন আরনল্ড

তিনি একজন আমেরিকান রাসায়নিক প্রকৌশলী এবং ক্যালিফোর্নিয়ার ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক। ১৯৫৬ সালের ২৫ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আর্নল্ড হচ্ছেন রসায়নে নোবেল পাওয়া পঞ্চম নারী। তিনি ১৯৭৯ সালে বিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৯ সালে প্রিন্সটন থেকে স্নাতক করার পর, আরনল্ড দক্ষিণ কোরিয়া ও ব্রাজিলের প্রকৌশলী এবং কলোরাডোয়ের সৌরশক্তি গবেষণা ইনস্টিটিউটে কাজ করেন। সৌরশক্তি গবেষণা ইনস্টিটিউটে দূরবর্তী অবস্থানের জন্য সৌরশক্তি সুবিধা ডিজাইনের কাজ করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। আরনল্ড আমেরিকার অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্স, আমেরিকান একাডেমী অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস, আমেরিকান একাডেমি অফ মাইক্রোবায়োলজি, আমেরিকান ইনস্টিটিউট ফর মেডিকেল অ্যান্ড জৈবিক প্রকৌশল এবং ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যের রয়েল একাডেমি অফ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একজন আন্তর্জাতিক ফেলো। প্রথম নারী হিসেবে ২০১৬ সালে তিনি মিলেনিয়াম টেকনোলজি পুরস্কার জিতেন। কনভারজেন্স গবেষণায় ২০১৭ সালে ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেস এবং বেভারলি স্যাকলার পুরস্কার পেয়েছিলেন।

 

জর্জ পিজজেনিক স্মিথ

তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১০ মার্চ ১৯৪১ সালে। একজন আমেরিকান জৈব রসায়নবিদ এবং নোবেল বিজয়ী হিসেবে তার পরিচয়। ১৯৭৫ সালে তিনি মিশৌরি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে বর্তমানে অধ্যক্ষ হিসেবে আছেন। হার্ভার্ড কলেজ থেকে তিনি জীববিজ্ঞানের উপর স্নাতক করেন এবং একবছরের জন্য মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক ও পরীক্ষাগারের যন্ত্রবিদ ছিলেন।

তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাকটেরিয়া ও প্রতিষেধক বিজ্ঞানের উপর পিএইচডি অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের আগে উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক ছিলেন। তিনি ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৩-৮৪ রবার্ট ওয়েবস্টারের সাথে কাজ করেন। তার সেখানকার কাজই তাকে পরবর্তীতে নোবেল এনে দেয়।

 

 

 

স্যার গ্রেগরি পি উইন্টার

তিনি জন্মগ্রহণ করেন ইংল্যান্ডের লিসেস্টারে ১৯৫১ সালের ১৪ এপ্রিল। ত্রিনিটি কলেজ কেমব্রিজ থেকে তিনি বিএসসি, এমএসসি ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

কাজ করেন বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে। তিনি সর্বাধিক পরিচিত মনোক্লোনাল এন্টিবডির থেরাপিউটিক ব্যাবহার আবিষ্কারক হিসেবে। তিনি ফেলো অফ রয়্যাল সোসাইটি ১৯৯০ এর জন্য মনোনীত হন। এছাড়া ২০১১ সালে উইন্টার রয়্যাল মেডেল জিতে নেন।

 

 

 

 

 

চিকিৎসা : ক্যান্সার প্রতিরোধে পদক্ষেপ

জেমস পি অ্যালিসন

ক্যান্সারের চিকিৎসায় শরীরের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে জোরদার করে নতুন এক থেরাপি-পদ্ধতি আবিষ্কার করে মার্কিন বিজ্ঞানী জেমস পি অ্যালিসন চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার জিতে নিয়েছেন। জেমস পি অ্যালিসন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস ইউনিভার্সিটির এমডি অ্যান্ডারসন ক্যান্সার সেন্টারের অধ্যাপক। অ্যালিসন ১৯৪৮ সালে টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের অ্যালিসে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯০ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের গবেষণাগারে তিনি টি-সেলের প্রোটিন সিটিএলএ-৪ পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি ছাড়াও আরও কয়েকজন গবেষক বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। কিন্তু অন্য গবেষকরা সিটিএলএ-৪-কেই নষ্ট করে স্বয়ংক্রিয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থার (অটোইমিউন সিস্টেম) তত্ত্ব দেন, যা সুস্থ কোষগুলোর জন্যও হুমকি হয়ে ওঠে। কিন্তু অ্যালিসন একটি ভিন্ন অ্যান্টিবডি আবিষ্কার করেন, যা সিটিএলএ-৪-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাকে অকার্যকর করে রাখতে সক্ষম। ২০১০ সালে পূর্ণাঙ্গ সাফল্যের মুখ দেখেন অ্যালিসন। ত্বকের ক্যান্সার ম্যালানোমায় আক্রান্ত এক রোগীর চিকিৎসায় পদ্ধতিটির প্রয়োগ করে ব্যাপক সুফল মেলে।

 

তাসুকু হোনজো

এ বছর ক্যান্সারের চিকিৎসায় সাফল্য অর্জনে জাপানি বিজ্ঞানী তাসুকু হোনজো অ্যালিসনের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার জিতে নিয়েছেন। তিনি ১৯৪২ সালে জাপানের কিয়োটোতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৪ সাল থেকে কিয়োটো ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করছেন। অ্যালিসনের প্রায় সমসাময়িকে কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাসুকু হোনজো আবিষ্কার করেন পিডি-১ নামের এক প্রোটিন। ১৯৯২ সালে আবিষ্কৃত এই প্রোটিন অ্যালিসনের আবিষ্কৃত সিটিএলএ-৪-এর মতোই কাজ করে। হোনজো এবার এই পিডি-১ প্রোটিনকে বন্দী করে টি-সেলকে স্বাধীন করার উপায় বের করেন। তিনি পিডি-১ প্রোটিনকে লক্ষ্য করে এক নতুন থেরাপির তত্ত্ব দাঁড় করান যার সফল প্রয়োগ হয় ২০১২ সালে। পিডি-১ প্রোটিনকে বন্দী করার লক্ষ্য নিয়ে করা থেরাপিতে দারুণ সাফল্য আসে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে এমনকি মেটাস্ট্যাটিক (ব্যাপক বিস্তৃত) পর্যায়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীরও ব্যাপক উন্নতি হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর