শনিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা
বিশ্বজুড়ে আলোচিত সৌদি সাংবাদিক

জামাল খাশোগি

তানিয়া তুষ্টি

জামাল খাশোগি
২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে নিজ দেশের দূতাবাসে গিয়ে নিখোঁজ হন বরেণ্য সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি। ঘটনার প্রথম থেকেই তুরস্কের দাবি, তাকে হত্যা করা হয়েছে। অথচ বরাবরই ঘটনার দায় অস্বীকার করে যাচ্ছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। এদিকে প্রতিদিন বেরিয়ে আসছে রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের নানা বিবরণ। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে আলোচিত হচ্ছে খাশোগির ওপর নির্মমতার ঘটনা। সমসাময়িক সময়ের সবচেয়ে বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী এই সাংবাদিক। কট্টর সৌদি সরকার গৃহীত যেকোনো পদক্ষেপের গঠনমূলক সমালোচনা করতে কখনো পিছপা হতেন না। নিজের লেখনীতে উঠে আসত নিজ দেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার বর্ণনা। সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে নিয়ে আজকের রকমারি আয়োজন।

 

কে এই খাশোগি

সৌদি আরব ও আরব বিশ্বে বর্তমান প্রজন্মের একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে পরিচিত ছিলেন জামাল খাশোগি। তার পুরো নাম জামাল আহমেদ খাশোগি। তিনি সৌদির আলোচিত অস্ত্র ব্যবসায়ী প্রয়াত আদনান খাশোগির ভাতিজা। জামাল খাশোগির চাচাতো ভাই দোদি আল ফায়েদ ছিলেন ব্রিটিশ রাজকুমারী ডায়ানার প্রেমিক। ক্ষুরধার বিচক্ষণতার অধিকারী এই সাংবাদিকের জন্ম ১৯৫৮ সালে সৌদি আরবের মদিনায়। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা নিয়ে পড়েছেন। প্রথমে ইংরেজি ভাষার সৌদি গেজেট পত্রিকায় প্রতিনিধি হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত তিনি লন্ডনভিত্তিক সৌদি মালিকানাধীন আশারক আল-আওসাতের প্রতিনিধি ছিলেন। তারপর আট বছর কাজ করেছেন আরবের বহুল পরিচিত আল-হায়াত পত্রিকায়। তার ৩০ বছরের সাংবাদিকতায় সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পান নব্বইয়ের দশকে। আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, কুয়েত ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে তিনি দুঃসাহসিক সংবাদ উপস্থাপন করেন। সে সময় তিনি বেশ কয়েকবার ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার নেন। ১৯৯৯ সালে সৌদি আরবের বিখ্যাত পত্রিকা আরব নিউজের উপ-সম্পাদক হন। এর চার বছর পর খাশোগি আল ওয়াতান পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হন। তবে ২০০৩ সালে মাত্র দুই মাসের মাথায় তাকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর তিনি সৌদি আরবের গোয়েন্দা সংস্থা জেনারেল ইন্টিলিজেন্স ডিরেক্টরেটের প্রধান প্রিন্স তুর্কি বিন ফয়সালের গণমাধ্যম উপদেষ্টার কাজ করেন। ২০০৫ থেকে ২০০৬ সালের শেষ পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ২০০৭ সালে খাশোগি ফের আল ওয়াতান পত্রিকার সম্পাদক হলেও ২০১০ সালে বরখাস্ত হন।

 

মাত্র সাত মিনিটেই হত্যা হয় খাশোগি

খাশোগিকে হত্যা করতে মাত্র সাত মিনিট সময় লেগেছে। পরে একজন সৌদি ফরেনসিকের নেতৃত্বে খাশোগির মৃতদেহ টুকরা করা হয়। এ সময় তিনি সহকর্মীদের গান শুনতে বলেন। মিডল ইস্ট আইয়ের খবরে এমনটিই বলা হয়েছে। ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনে প্রবেশের পর থেকে তিনি নিখোঁজ হন। তুরস্কের সরকার-সমর্থিত দৈনিক ‘ইয়েনি সাফাক’-এর বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, হত্যার আগে ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়েছিল সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার আঙ্গুল কেটে ফেলা হয়। অপরদিকে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর খবরেও বলা হয়েছে খাশোগিকে কেটে টুকরা করা হয়। নাম প্রকাশ না করে তুর্কি কর্মকর্তারা সন্দেহ প্রকাশ করেন, খাশোগির মরদেহ কাছের কোনো বন বা খামারে ফেলে দেওয়া হতে পারে। স্কাই নিউজ দাবি করছে দ্রুত ক্রিয়াশীল অ্যাসিড ব্যবহার করা হয়েছে খাশোগির দেহাবশেষ নিশ্চিহ্ন করতে।

 

খাশোগির বিচক্ষণ কর্মজীবন

খাশোগি পুরো কর্মজীবনে ছাপ রেখেছিলেন বিচক্ষণতার। এক সময় তিনি সৌদি রাজপরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকলেও নিজেকে প্রচলিত স্রোতে ভাসিয়ে দেননি। রাজপরিবারে সংস্কারবাদী হিসেবে তার সুনাম ছিল। সৌদি আরবের আঞ্চলিক ও ঘরোয়া অনেক নীতিমালার সমালোচনাও করতেন তিনি। সৌদি আরবের বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বিভিন্ন ঘরোয়া নীতি বিশেষ করে, যুবরাজের সংস্কারের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ভিন্ন মতালম্বীদের গ্রেফতার ও নির্যাতনে খাশোগি সরব ছিলেন। এসবের বাইরে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে সৌদি ও আরব চ্যানেলগুলোতে প্রায়ই কথা বলতেন তিনি।

ওয়াশিংটন পোস্টে নিয়োগ

ওয়াশিংটনে থাকাকালে খাশোগি স্বাধীনতা ও অধিকারের স্বপক্ষে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় তিনি মতামত সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর খাশোগি সৌদি যুবরাজের সমালোচনা আরও বাড়িয়ে দেন। এমনকি নিজ দেশে থাকা অবস্থায় বাক-স্বাধীনতার পক্ষে বক্তব্য দেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডকে সৌদিআরবে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্তিরও সমালোচনা করেন।

নিউজ চ্যানেলের ম্যানেজার

২০১০ সালে খাশোগি আল আরব নিউজ চ্যানেলের জেনারেল ম্যানেজার পদ পান। এই চ্যানেলের মালিক ছিলেন প্রিন্স আল ওয়ালিদ বিন তালাল। এটি পরিচালিত হতো বাহরাইনের মানামা থেকে। কিন্তু ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে যাত্রা শুরুর মাত্র এক দিনের মাথায় রাজনৈতিক কারণে চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে যায়।

‘শেষ টুকরো’

জামাল খাশোগির সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবনের ‘শেষ টুকরো’ ওয়াশিংটন পোস্ট ১৭ অক্টোবর প্রকাশ করেছে। জীবনের শেষ কলামেও আরব বিশ্বে অবাধ বাক-স্বাধীনতার সুযোগ চেয়েছিলেন তিনি। ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশের আগেই ৭০০ শব্দের ওই নিবন্ধটি সহকারীকে পাঠিয়েছিলেন। এটি প্রকাশ করেন পত্রিকাটির বৈশ্বিক নিবন্ধ সম্পাদক কারেন আতিয়াহ।

 

১১ ঘণ্টার অপেক্ষাতেও খাশোগিকে ফিরে পাননি বান্ধবী

ইস্তাম্বুলের সৌদি দূতাবাসে তিনি প্রথম প্রবেশ করেন ২৮ সেপ্টেম্বর। সেদিন সাবেক স্ত্রীর সঙ্গে তার ডিভোর্স সংক্রান্ত কাগজপত্র তুলতে এসেছিলেন। বান্ধবী হাতিস চেঙ্গিসকে বিয়ে করার প্রস্তুতিও চলছিল তার। প্রথম দিন দূতাবাসে প্রবেশ করলে কর্মকর্তারা খাশোগির সঙ্গে খুব আন্তরিকতা দেখায়। বিষয়টি কাছের সবাইকে জানিয়ে খাশোগি আশ্বস্ত করেন, দূতাবাসে তার কোনো ক্ষতি হবে না। এরপর ২ অক্টোবর স্থানীয় সময় দেড়টার দিকে অ্যাপয়েনমেন্ট অনুযায়ী দূতাবাসে প্রবেশ করেন। তারপরও তুর্কি বান্ধবী হাতিস চেঙ্গিসকে নিজের দুটি মোবাইল ফোন দিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যদি তিনি কনস্যুলেট থেকে বের না হন তাহলে হাতিস যেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়েপ এরদোগানের একজন উপদেষ্টাকে ফোন করেন। জামাল খাশোগির অপেক্ষায় দূতাবাসের বাইরে ১১ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করেন হাতিস চেঙ্গিস। কিন্তু তিনি ফিরে আসেননি। হাতিস জানান, আমি ১১ ঘণ্টা অপেক্ষা করেও খাশোগিকে বের হতে দেখিনি।

 

এখনো দায় এড়াচ্ছেন যুবরাজ

খাশোগি হত্যায় জড়িত ১৫ জনের মধ্যে চারজন যুবরাজের ঘনিষ্ঠ। তাদের একজন মেহের আবদুল আজিজ মুত্রেব লন্ডনের সৌদি দূতাবাসের কূটনীতিক ছিলেন। সম্ভবত যুবরাজের দেহরক্ষীও তিনি। বাকি তিনজন সৌদি নিরাপত্তাজনিত সংশ্লিষ্টতায় আছেন। পঞ্চম জন সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। সন্দেহভাজনদের পরিচয় শনাক্ত হওয়া নয়জনই সৌদি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। তারপরও জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডে সৌদি বাদশা ও ক্রাউন প্রিন্স সালমান এখনো অস্বীকার করে যাচ্ছেন। এই খাশোগি গ্রেফতার আতঙ্কে এক বছর আগেই দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যান। একুশ মে’তে খাশোগি এক কলামে লিখেন, ‘আমাদের কাছ থেকে আশা করা হয় আমরা সামাজিক সংস্কারের প্রশংসা করব। যুবরাজের প্রশংসা করব। কিন্তু কয়েক দশক আগে যেসব সৌদি অগ্রদূত এসব নিয়ে কথা বলার সাহস দেখিয়েছিলেন তাদের ব্যাপারে কোনো অবতারণাই করব না।’ তিনি আরও লিখেন, ‘আমাদের বলা হচ্ছে রাজনৈতিক স্বাধীনতার যেকোনো আশা পরিত্যাগ করতে। এ ছাড়া সমালোচক ও তাদের পরিবারের ওপর যে দমন-পীড়ন, গ্রেফতার ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ হচ্ছে তা নিয়ে চুপ থাকতে।

 

ঘাতকের একজন নিহত

গাড়িচাপায় নিহত হয়েছে খাশোগি হত্যায় জড়িত ‘কিলিং স্কোয়াড’-এর এক সদস্য। গাড়িচাপার ঘটনাটি ঘটে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে। তুরস্কের দৈনিক ইয়েনি সাফাক বলেছে, নিহত ব্যক্তি হলেন সৌদি রয়্যাল এয়ারফোর্সের লেফটেন্যান্ট মেশাল সাদ আলবোস্তানি। কনস্যুলেট থেকে ফেরার দিন তিনি নিহত হন। খাশোগি নিখোঁজের দিনে তুরস্কে উড়ে যাওয়া সৌদি আরবের ১৫ সদস্যের কিলিং স্কোয়াডে আলবোস্তানি ছিলেন অন্যতম। ঘাতক টিমের অপর ১৪ জনের মুখ চিরতরে বন্ধ রাখতে এ কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানায় পত্রিকাটি। সাজানো সড়ক দুর্ঘটনায় বোস্তানিকে হত্যার মাধ্যমে খাশোগি হত্যার তথ্যপ্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পত্রিকাটি আরও জানায়, আলবোস্তানি সে দিন কনস্যুলেট ভবনে না গিয়ে মাত্র কয়েক ঘণ্টা ইস্তাম্বুলের উইন্ডহাম গ্র্যান্ড হোটেলে অবস্থান করেন। পরে হোটেল থেকে বেরিয়ে তুরস্ক ত্যাগ করেন। তবে ১৫ সদস্যের এই ঘাতক দলে কার কী দায়িত্ব ছিল তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে তিনি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত ছিলেন তা নিশ্চিত করে পত্রিকাটি।

 

খাশোগি হত্যায় অভিযুক্তরা

সিসি টিভির ফুটেজে দেখা গেছে, খাশোগি ভবনের ভিতরে প্রবেশের দুই ঘণ্টা পর সৌদি কূটনৈতিক নম্বর প্লেটের কয়েকটি গাড়ি ঢুকছে। তুরস্কের দাবি, খাশোগিকে হত্যার উদ্দেশ্যে সৌদির ১৫ সদস্যের একটি দল ইস্তাম্বুলে উড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে আল-জাজিরাও একই তথ্য জানিয়েছে। তুরস্কের সরকার-সমর্থক একটি দৈনিকের এক খবরে ওই ১৫ সদস্যের আততায়ী দলের প্রত্যেক সদস্যের নাম ও ছবি প্রকাশ করা হয়েছে আগে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ‘শীর্ষ কর্মকর্তাদের’ বরাত দিয়ে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ জানিয়েছে, ওই আততায়ী দলে একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞও ছিলেন। তিনি হাড় কাটতে করাত সঙ্গে এনেছিলেন। করাত আনার কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হত্যার পর খাশোগির দেহ টুকরো টুকরো করা। ওই আততায়ী দলটি হলিউডের সিনেমা স্টাইলে খাশোগিকে হত্যা করে। দুই ঘণ্টার ভিতর মিশন শেষ করে তারা বিভিন্ন দেশের উদ্দেশে রওনা হয়ে যান। খাশোগি হত্যাকাণ্ডকে কোয়েন্টিন তারান্টিনো পরিচালিত হলিউডের সিনেমা ‘পাল্প ফিকশন’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন এক মার্কিন কর্মকর্তা।

 

মধ্য ভূমিকায় ট্রাম্প

জামাল খাশোগির নিখোঁজ থাকাটা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে অন্তর্ধানই ছিল। তিনি সরাসরি মানতে রাজি হননি সাংবাদিক খাশোগি মারা গেছেন। তবে যখন হুলুস্থূল শুরু হলো তখন এ বিষয়ে নিজের মতামত তুলে ধরলেন ট্রাম্প। সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকা ট্রাম্প খাশোগি হত্যার বিষয়ে দেখালেন মধ্য ভূমিকা। গণমাধ্যমে তিনি বলেন, খাশোগির মৃত্যুর জন্য সৌদি আরব দোষী প্রমাণিত হলে যুক্তরাষ্ট্র ‘কঠিন শাস্তির’ ব্যবস্থা নেবে। তিনি জানান, এমন কিছু হলে তিনি ‘খুবই মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ’ হবেন। তবে সৌদির সঙ্গে অস্ত্র চুক্তি বাতিল করার বিষয়ে তিনি রাজি নন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, এটা করা হলে আমাদের নিজেদের শাস্তি দেওয়া হবে। তারা যদি আমাদের কাছ থেকে না কেনে, তাহলে রাশিয়া বা চীনের কাছ থেকে কিনবে।’ তবে শেষমেশ ১৮ অক্টোবর সাংবাদিকদের কাছে ট্রাম্প নিজের অনুমানের কথা জানান। বার্তা সংস্থা রয়টার্সে বলা হয়, তার অনুমান সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি বেঁচে নেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ট্রাম্পের এটিই এখন পর্যন্ত শেষ মন্তব্য।

 

হত্যা তদন্তে তুরস্কের ভূমিকা

খাশোগি নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই তুর্কি সরকার যথেষ্ট তৎপর ভূমিকা রেখেছে। তুরস্ক কর্তৃপক্ষের দাবি, ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনের ভিতরে সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার সব ধরনের তথ্যপ্রমাণ রয়েছে তাদের কাছে। কর্তৃপক্ষের আরও দাবি, এ ব্যাপারে তাদের কাছে অডিও-ভিডিও ও অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে। তবে সবার সামনে তা এখন পর্যন্ত উন্মুক্ত করেনি তুরস্ক সরকার। সাংবাদিক খাশোগি সৌদি কনস্যুলেট ভবনে ঢোকার পর আর বেরিয়ে আসেননি। এই দাবিটিও শুরু থেকে তুরস্ক শক্তভাবে করে আসছে। প্রথমদিকে সৌদি সরকার খাশোগির ব্যাপারে দায় এড়িয়ে গেছে। পরবর্তীতে অবশ্য খাশোগি নিখোঁজের ঘটনায় তুরস্কের সঙ্গে যৌথভাবে তদন্তে যোগ দিয়েছে সৌদি প্রতিনিধি দল। ঘটনাটি তদন্তে যুক্ত তুর্কি গোয়েন্দা বিভাগের একজন বিবিসিকে জানিয়েছেন, খাশোগিকে হত্যার ব্যাপারে ‘সঠিক তথ্যপ্রমাণ’ রয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্টকে একটি সূত্র জানিয়েছে, খাশোগিকে মারধরের শব্দ শোনা গেছে। রেকর্ডিং থেকে বোঝা গেছে, খাশোগিকে হত্যার পর কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছে। আরেকটি সূত্র ওয়াশিংটন পোস্টকে জানিয়েছে, খাশোগি এবং আরবি ভাষায় কথা বলা বেশ কয়েকজন মানুষের আওয়াজ পাওয়া গেছে। খাশোগিকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করা হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে এবং হত্যা করা হয়েছে। খাশোগি নিখোঁজ, কিন্তু তার হত্যার ব্যাপারে নিশ্চিত তুরস্ক কর্তৃপক্ষ। ১১ অক্টোবর সৌদি রাজ পরিবারের প্রভাবশালী ব্যক্তি প্রিন্স খালেদ আল-ফয়সাল তুরস্কে গিয়েছিলেন। তিনি দুদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সংকট সমাধানের চেষ্টা করেছেন। তার সফরের সময় দুই দেশের যৌথ তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়।

 

সৌদিতে ব্যবসা নয় ভার্জিন উবারের

সাংবাদিক জামাল খাশোগি নিখোঁজের ঘটনায় সৌদি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বিশ্বের জায়ান্ট গ্রুপগুলো। সৌদি থেকে তারা তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার পক্ষে। সৌদি আরবের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ব্রিটিশ ধনকুবের ভার্জিন গ্রুপের প্রধান রিচার্ড ব্রানসন ও উবারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) দারা খোসরোওশাহী। খাশোগি নিখোঁজের পরই মূলত এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছায় তারা। ব্লুমবার্গ ও সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, রিচার্ড ব্রানসন সৌদি আরবের সঙ্গে তার কোম্পানির হতে যাওয়া ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন। ভার্জিন গ্যালাটিক গ্রুপের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে রিচার্ড ব্রানসন বলেন, খাশোগির নিখোঁজের ঘটনা যদি সত্যিই প্রমাণিত হয় তাহলে সৌদি সরকারের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর ব্যবসায়ীদের মতো আমাদের কারও ব্যবসার সুযোগ আর থাকবে না। সৌদি আরবে তার দুটি বড় বিনিয়োগ প্রকল্প হাইপারলুপ ট্রেন ও স্পেস কোম্পানি ভার্জিন অরবিটের কার্যক্রম নিয়ে সব ধরনের আলোচনা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন। উবারের সিইও দারা খোসরোওশাহী এক বিবৃতিতে বলেন, খাশোগির ঘটনায় আমি খুবই সমস্যার মধ্য আছি। আমরা বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি এবং এ সমস্যার একটা সুন্দর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সৌদি আরবে আর যাচ্ছি না। অক্টোবরে (২৩ ও ২৫ অক্টোবর) রিয়াদে বিনিয়োগ সম্মেলনেও যোগ দিচ্ছি না।’ ২০১৬ সালের পর থেকে সৌদি আরবে উবার বড় বিনিয়োগ করে চলেছে। সৌদি আরবে অক্টোবরে হতে যাওয়া বিনিয়োগ সম্মেলনে জেপি মরগ্যানের সিইও জেমি ডিমন, ব্ল্যাক করের চেয়ারম্যান ল্যারি ফিঙ্কসহ বিশ্বের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাদের যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে। সম্মেলনে মিডিয়া পার্টনার ফিনান্সিয়াল টাইমস তাদের নাম আগেই প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

 

পাল্টা ব্যবস্থা নেবে সৌদি

সৌদি আরব যেকোনো বাধার মুখে নিজের অনড় অবস্থানে থেকে বীরত্ব জানান দিয়ে থাকে। সাংবাদিক জামাল খাশোগি নিখোঁজ ইস্যুতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এ ঘটনায় যেকোনো ধরনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও রাজনৈতিক চাপের হুমকি উড়িয়ে দিয়েছে সৌদি সরকার। সৌদি কর্তৃপক্ষ উল্টো যেকোনো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পাল্টা অথবা বড় ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানিয়েছে এক বিবৃতিতে। সিএনএন জানায়, খাশোগি নিখোঁজের ঘটনায় সৌদি আরব ও বেশ কিছু পাশ্চাত্যের দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে। সৌদির ওই বিবৃতিতে বলা হয়, এটা সত্য যে বিশ্ব অর্থনীতিতে তাদের রাজ্যের অর্থনীতি প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাদের রাজ্যের অর্থনীতিই হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি। খাশোগির নাম উল্লেখ না করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২ অক্টোবর কে যেন ইস্তাম্বুলে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেট ভবনে প্রবেশের পর নিখোঁজ হন। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, আসন্ন বিয়ের জন্য তুর্কি এক নারীর সঙ্গে তার বাগদান হয়েছিল। এদিকে খাশোগির নিখোঁজের ঘটনায় নিজেদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে জোরালোভাবে জানিয়ে আসছে সৌদি আরব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর