রবিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

দেশে দেশে নির্বাচন কমিশন

দেশে দেশে নির্বাচন কমিশন

বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে নির্দিষ্ট একটি সময়সীমা পরেই অনুষ্ঠিত হয় পার্লামেন্টারি নির্বাচন। এই নির্বাচন পরিচালনা করে থাকে স্ব স্ব দেশের নির্বাচন কমিশন। একেক দেশে আবার এই কমিশনের কর্মপদ্ধতি থাকে ভিন্ন। তবে সব দেশেরই একটি মূল বিষয়ে মিল থাকে। তাদের নেওয়া যুগপোযোগী সিদ্ধান্ত, কর্ম পরিচালনা এবং নিরপেক্ষতার ওপর নির্ভর করে দেশটির গণতন্ত্রের সফল বাস্তবায়ন। তাদের দক্ষ পরিচালনায় দেশের গণতান্ত্রিক দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। দলীয় এজেন্ডা নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। সর্বশেষ পর্যায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সেই দলকে দেওয়া হয় দেশ শাসনের ভার। মোটামুটি এই নিয়মগুলো সব দেশেই এক। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বেশ কিছু পার্থক্য থাকে একে অপরের মধ্যে। দেশে দেশে নির্বাচন কমিশনগুলোর সেসব বিষয় নিয়েই আজকের রকমারি আয়োজন। বিস্তারিতা লিখেছেন— তানিয়া তুষ্টি

 

স্বশাসিত সংস্থা

ভারতের নির্বাচন কমিশন

ভারতের একটি স্বশাসিত সংস্থা ‘ভারত নির্বাচন কমিশন’। কমিশনটি দেশের সব নির্বাচন পরিচালনা করে থাকে। পৃথিবীর বৃহত্তম সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ ভারত হওয়ায় প্রাপ্তবয়স্ক ভোটারের সংখ্যা এখানে অনেক বেশি। আর তাই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীনও হতে হয় কমিশনকে। এ কারণেই প্রয়োজন পড়ে একটি নিরপেক্ষ, দায়িত্বশীল ও কার্যকরী নির্বাচন কমিশনের। দেশভাগের পর স্বাধীন ভারতে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের উদ্দেশ্যে ১৯৫০ সালের ২৫ জানুয়ারি গঠিত হয় প্রথম নির্বাচন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার, সুকুমার সেনের দায়িত্বে স্বাধীন ভারতের প্রথম দুটি (১৯৫২ ও ১৯৫৭ সালে) সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন হয়।

কমিশনের সংস্কার

১৯৯০ সাল থেকে ভারতের নির্বাচন কমিশনের এক নতুন যাত্রা শুরু হয়েছিল। এর আগে, নির্বাচন কমিশন বলতে ছিলেন শুধুই একজন প্রধান কমিশনার। কিন্তু ১৯৯০ সালে নতুন আইন প্রণয়ন করা হলে, অন্তত তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন গড়ার প্রচলন শুরু হয়। আইন বদলের সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ছিলেন আর ভি এস পেরি শাস্ত্রী। তাঁর নেতৃতে ভোট দিতে পারার বয়স কমিয়ে ১৮-তে আনা এবং একাধিক সদস্যের নির্বাচন কমিশনের শুরুও হয় শাস্ত্রীর আমলে। শাস্ত্রীর পর নির্বাচন প্রক্রিয়ার দায়িত্ব পান ভারতের প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী প্রধান নির্বাচন কমিশনার, ভি এস রামাদেবী। তিনি অল্পদিন দায়িত্বে থাকার পর কমিশনের ভার নেন টি এন সেশন। তাঁর অধীনে (১৯৯০ থেকে ১৯৯৬) ভারতের নির্বাচনের সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন আসে। তামিলনাড়ুর এই সাবেক প্রশাসনিক ক্যাডারকে অনেকে ‘চেঞ্জমেকার’ বা পরিবর্তনের রূপকার হিসেবে চেনেন। আমলাতান্ত্রিকতা ও রাজনীতিকদের একাধিপত্য থেকে মুক্ত করেছিলেন তিনি ভারতের নির্বাচনকে। পুলিশ-প্রশাসনের ওপর ক্ষমতা ধরে রেখে আইনশৃঙ্খলা ও গণতন্ত্রের রক্ষায় নামেন। তার হাত ধরেই ভারতে শুরু হয় পরিচয়পত্রের প্রচলন - দুর্নীতিমুক্ত হয় নির্বাচন ব্যবস্থা। কিন্তু ২০০৯ সালের পর আবার নির্বাচন কমিশনের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে শুরু করে। ২০১৫ সালে প্রবল মাওবাদী সংঘর্ষের মধ্যেও সংবাদমাধ্যমের বাড়তি নজর এড়িয়ে সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হয় নির্বাচন ভি এস সম্পতের কর্তৃত্বে।

কমিশনের উদ্দেশ্য ও কার্যাবলি

সীমানা পুনর্নিধারণ আইন, ১৯৫২ অনুসারে প্রতি দশ বছর অন্তর আয়োজিত জনগণনা অনুযায়ী নির্বাচন কেন্দ্রগুলোর সীমা পুনর্নির্দেশ ও ভোটদাতার পরিধির পুনর্বিন্যাস, ভোটদাতাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করা, রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া, রাজনৈতিক দল ও নির্দল প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রতীক ঠিক করা, নির্বাচন প্রক্রিয়ার অনুকূলে নিরপেক্ষ পরিবেশ সৃষ্টি করা, অবৈধ কিছু ঘটলে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে স্থগিত বা বাতিল করা, কোনো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি অযোগ্য বিবেচিত হলে এই সংক্রান্ত সুপারিশ ক্ষেত্রবিশেষে রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতিকে পাঠানো। এ ছাড়াও ভোটপ্রার্থী ও রাজনৈতিক দলগুলোর অবশ্যপালনীয় কর্তব্যের তালিকা ও বিধিনিষেধ রচনা ও প্রয়োগ, আকাশবাণী ও দূরদর্শনে ভোটপ্রার্থীদের প্রচারের সময় বণ্টন, প্রার্থীপিছু নির্বাচনজনিত ব্যয়ের সীমা নির্ধারণ করা, প্রযুক্তিগত বিষয়ে (যেমন বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্রের ব্যবহার) ভোটদাতাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করাও এই কমিশনের কাজ।

কমিশন গঠন, নিয়োগ ও অপসারণ

ভারতীয় সংবিধানের ৩২৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালনা করার জন্য ভারতের নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সংবিধান-স্বীকৃত কর্তৃপক্ষ। মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের অপসারণ ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অপসারণের নিয়মের অনুরূপ। অবশ্য মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের সুপারিশ অনুযায়ীও রাষ্ট্রপতি অপর নির্বাচন কমিশনারকে অপসারিত করতে পারেন।

 

ভুটানের রাজা নিয়োগ দেন নির্বাচন কমিশন

ভুটানের সংবিধান মোতাবেক দেশে দুই দফা নির্বাচন পর্ব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রথম দফায় সব অংশগ্রহণকারী দলকে ভোটাররা ভোট প্রদান করে। এ পর্যায়ে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত দুটি দল দ্বিতীয় দফা বা চূড়ান্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এতে বিজয়ী দলটি সরকার গঠন করে। এই কাজগুলো সে দেশের নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়ে থাকে। রাজাশাসিত স্বাধীন পর্বতময় দেশ ভুটান কখনো ভারতের অংশ ছিল না। তবুও এটা স্বীকৃত সত্য যে, ঐতিহাসিকভাবেই ভুটান ভারতনির্ভর। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই ভারতের মধ্যে আগ্রাসী মনোভাবের প্রকাশ ঘটতে থাকে। তারই পরিণতিতে ১৯৪৯ সালে ভুটানকে ভারতের সঙ্গে ‘বন্ধু চুক্তি’ নামের এক চুক্তি স্বাক্ষরে কার্যত বাধ্য হতে হয়। এ চুক্তিতে ভুটানকে সম্পূর্ণরূপে ভারতনির্ভর করা হয়। চুক্তির প্রধান শর্ত ছিল, নয়াদিল্লির সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে ভুটান তার বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করবে। আজও সে চুক্তি বহাল আছে। কিন্তু, ২০০৮ সালে ভুটানের রাজা ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেন। ভুটানে বইতে শুরু করে গণতন্ত্রের সুবাতাস। তা এখনো অব্যাহত রয়েছে। বিগত ১০ বছরে দেশটিতে গণতন্ত্র বিস্তৃতি লাভ করেছে। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত দেশটির প্রথম নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে ডিপিটি। প্রধানমন্ত্রী হন জিগমে থিনলে। বলা হয়, তিনি ছিলেন ভারতের আধিপত্যবিরোধী। তাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই তিনি ভারতের প্রভাব থেকে দেশকে মুক্ত করার চেষ্টা শুরু করেন। সে বছরই রাজা প্রধান নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিয়ে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, জাতীয় পরিষদের স্পিকার, জাতীয় কাউন্সিলরের চেয়ারপারসন এবং বিরোধীদলীয় নেত্রীর লিখিত তালিকা থেকে আরও দুজন কমিশনার পাঁচ বছর মেয়াদে নিয়োগ পান। কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর নজরদারি, নির্বাচন পরিচালনা, নির্বাচনী ব্যবস্থা পর্যালোচনা, আইন ও বিধি প্রণয়ন, আদালতের সমালোচনার পরিদর্শন ও বিচারিক ক্ষমতা রাখে। কমিশন যথাযথ ক্ষমতাবলে যুক্তিসঙ্গত ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য প্রাইভেট পার্টির কাছ থেকে নিরাপত্তা কর্মীদের এবং প্রয়োজনীয় স্থান, যানবাহন এবং ঘোড়া মোতায়েন করতে পারে।

 

স্বায়ত্তশাসিত ‘ইলেকশন কমিশন অব পাকিস্তান’

পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকে একটি স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ‘ইলেকশন কমিশন অব পাকিস্তান’। ১৯৫৬ সালে জারি করা শাসনতন্ত্রের ১৩৭নং ধারা অনুসারে ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিয়োজিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং চারজন সদস্য নির্বাচন কমিশনারের সমন্বয়ে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। ১৮তম সংশোধনীতে এই নিয়োগ-পদ্ধতির পরিবর্তন করা হয়েছে। ওই সংশোধনীর পর থেকে সরকারি ও বিরোধীদলীয় সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সংসদীয় কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনের সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের মধ্যে যারা সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য, তাদের মধ্য থেকেই সিইসি নিয়োগ করা হয়। নির্বাচন কমিশনের অপর চারজন সদস্য, অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনারদের একেকজনকে পাকিস্তানের একেকটি প্রদেশের হাই কোর্টের বিচারপতিদের মধ্য থেকে নিয়োগ করা হয়ে থাকে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান একসঙ্গে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু, ভারত নিরবচ্ছিন্নভাবে গণতন্ত্রের পথে হাঁটলেও পাকিস্তান তা পারেনি। ভারতে ১৯৫২ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও পাকিস্তানে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৬ সালে। কারণ, ১৯৪৮ সালে দেশটির স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মারা যান, ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের ষড়যন্ত্রে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানও প্রাণ হারান। এরপর চলে সামরিক-বেসামরিক আমলাদের কর্তৃত্ব। চৌধুরী মুহম্মদ আলী যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তখন বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তাঁদের দুজনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৫৬ সালে একটা শাসনতন্ত্র পাস হয়। এরপর সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

 

২৪০ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে

নেপালের নির্বাচন কমিশন

১৯৫১ সালে গঠিত হওয়া নেপালের নির্বাচন কমিশনের অধীনে ২০০৮ সালে প্রথম বিশুদ্ধ সংসদীয় গণতান্ত্রিক নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আসে। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নেপালে ২৪০ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান হয়। তখন কমিশনের প্রধান ছিলেন সাবেক সচিব ভোঙ্গরাজ পোখারেল। ওই নির্বাচন ছিল ‘পোস্ট-কনফ্লিক্ট’ তথা সংঘাত-উত্তর সময়ের নির্বাচন। নেপালের ২০ বছরের মাওবাদী ‘ইনসারজেন্সি’ পরবর্তী নির্বাচন। প্রথম গণপরিষদে প্রায় ২৬টি দলের উপস্থিতি ছিল। এত বড় সংখ্যক দলের সংসদে থাকার কারণ ছিল মিশ্র নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা। যেখানে ছোট ছোট দল আনুপাতিকহারে আসন পেয়েছিল। অতীতের দুটি গণপরিষদ নির্বাচন একদিনে অনুষ্ঠিত করতে নেপালের নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থাপনায় যে জটিল অভিজ্ঞতা অর্জন করে, সে প্রেক্ষাপটে হালের নির্বাচন দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৭ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় নতুন সৃষ্ট প্রাদেশিক নির্বাচনও। এটাও একটি কারণ ছিল দুই পর্বে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পেছনে। তাছাড়া নেপালে মিশ্র নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিধান রাখা আছে যাতে বহুজাতিক দেশটির পিছিয়ে পড়া জাতি-গোষ্ঠী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকতে পারেন। এ বিষয়টি সংবিধানের ৮৪(২) এ নিশ্চিত করা হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নেপালের ইতিহাসে প্রথম বহুদলীয় গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নতুন প্রজাতন্ত্রের জন্য একটি সংসদীয় গণতন্ত্রের সংবিধান রচনায় গণপরিষদ গঠন করা হয়। নির্বাচন হয়েছিল ৫৭৫টি আসনে। এ উপমহাদেশে নেপালই প্রথম দেশ যেখানে মিশ্র নির্বাচনী প্রক্রিয়া তথা মিক্সড ইলেক্টোরাল সিস্টেম, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট এবং আনুপাতিক হারে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

 

স্বৈরাচার হটিয়ে শ্রীলঙ্কায় গণতন্ত্র

শ্রীলঙ্কার নির্বাচন কমিশনার মাহিন্দা দেশাপ্রিয়া। দৃঢ়চেতা এই ব্যক্তির কারণেই শ্রীলঙ্কায় বর্তমান পাল্টে যাওয়া নির্বাচন ব্যবস্থা বহাল রয়েছে। ২০১৫ সালের নির্বাচন ছিল দেশটিতে গণতন্ত্রের ভাগ্য নির্ধারণের নির্বাচন। সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের শাসনামলে তারই নিয়োগকৃত নির্বাচন কমিশনার হয়ে দেশাপ্রিয়া রাজাপাকসের সব অন্যায় আবদার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে ঐতিহাসিক নির্বাচন সম্পন্ন করেন। ফলে রাজাপাকসের ১০ বছরের ‘একনায়কতন্ত্রে’র অবসান হয়। সে নির্বাচনে রাজাপাকসের থেকে জনগণ মুখ ফিরিয়ে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করার পক্ষেই রায় দিয়েছিল। দেশাপ্রিয়া স্বৈরাচারের নিপাত ঘটিয়ে গণতন্ত্রের চর্চা শুরু করেন। শ্রীলঙ্কার সংসদ নির্বাচন কিছুটা জটিল। এর মোট আসন সংখ্যা ২২৫টি। এর মধ্যে ১৯৬টি আসনে সরাসরি নির্বাচন হয় এবং বাকি ২৯টি আসনে নির্বাচন হয় আনুপাতিক হারে। এই ২৯ সংসদ সদস্যের পদকে বলা হয় ন্যাশনালিস্ট। একজন ভোটার ব্যালটে প্রথমে একটি রাজনৈতিক দলকে ভোট দেবেন। তারপর ভোটার সেই পার্টির সর্বোচ্চ তিনজনকে ভোট দিতে পারবেন। ভোটাররা যখন ভোট দেবেন তখন অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যে কোনো তিনজনকে ভোট দিতে পারবেন। এটাকে বলা হয় প্রিফারেন্সিয়াল ভোট। আবার ইচ্ছে করলে সিঙ্গেল ভোটও দিতে পারবেন। প্রথমে এক পার্ির্টকে ভোট দিয়ে পরে অন্য পার্টির মনোনীত ব্যক্তিকে ভোট দিলে সেই ভোট বাতিল হয়ে যাবে। এ ছাড়া মূল নির্বাচনের আগে ছিল পোস্টাল ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা। প্রতিটি জেলার সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীরা এই পোস্টাল ভোটে অংশ নেন ভোট গ্রহণের কয়েক দিন আগে। সেখানে মোট ১৩টি নির্বাচনী এলাকা থেকে ১২ জন নির্বাচিত হবেন। এক একটি রাজনৈতিক দল ১২টি সংসদ সদস্য পদের জন্য ১৫ প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়। এই নির্বাচনে বিচ্ছিন্নভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই। স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হলে সব স্বতন্ত্র প্রার্থীকে একটি প্লাটফর্মে এসে তাদের প্রার্থিতা ঘোষণা করতে হবে এবং সে মোতাবেক নির্বাচন কমিশন তাদের স্বতন্ত্র প্রার্থীর জোট হিসেবে ঘোষণা দেবে।

 

পূর্ণ গণতান্ত্রিক যুক্তরাজ্য

গণতান্ত্রিক রাজনীতির সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হয়েছে যুক্তরাজ্য। জনমত, রাজনৈতিক দল, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ওপর নির্ভর করে একটি দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির সাফল্য। যুক্তরাজ্যে এর সব কিছুই বিদ্যমান। আর তাই গ্রেট ব্রিটেন বা যুক্তরাজ্য হয়ে উঠেছে একটি আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। ব্রিটেনে এখনো রাজতন্ত্র বিদ্যমান আছে। কিন্তু রাজা-রানীকে চলতে হয় পার্লামেন্টের নির্দেশ মেনে। পার্লামেন্টের নিম্ন কক্ষ, অর্থাৎ হাউস অব কমন্স নির্বাচিত হয় সাধারণ ভোটারদের ভোটে। শুধু তাই নয়, দেশের বৃহত্তর নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে সাধারণ ভোটারদের বেশ প্রভাব পড়ে। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ বা হাউস অব লর্ডস থাকলেও তার তেমন ক্ষমতা নেই। বর্তমানে ব্রিটেনে হাউস অব কমন্স-ই হল প্রকৃত নীতিনির্ধারক ও দেশের পরিচালক। সে দেশের হাই কোর্ট অব দ্য পার্লামেন্ট বলতে বোঝায়, রাজা বা রানী, হাউস অব লর্ডস ও হাউস অব কমন্সকে একত্রে। এই নামটি এখনো ব্যবহার হয় অতীত ইতিহাসের ধারাবাহিকতা হিসেবে। কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা এখন একমাত্র হাউস অব কমন্সেরই হাতে। গ্রেট ব্রিটেনের কোনো লিখিত সংবিধান নেই। তাদের আছে কতগুলো মৌলিক আইন, যা ব্রিটেনে পালিত হয় খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে। এসব আইন হলো ব্রিটিশ গণতন্ত্রের ভিত্তি। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট সার্বভৌম। সেখানকার পার্লামেন্টের বিশেষ কমিটি যদি কোনো বিচারপতিকে অসাধু আচরণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য সুপারিশ করেন, তবে রাজা অথবা রানীর নির্দেশে তাকে পদত্যাগ করে চলে যেতে হবে। কিন্তু সাধারণত এ রকম কিছু ঘটে না। সেখানে বিচার বিভাগ অনেক মুক্ত ও সম্মানের অধিকারী। তাদের সিভিল সার্ভিস, সেনাবাহিনী ও পুলিশ রাজনীতি করবার কথা ভাবতে পারে না। ফলে ভোট হয় অবাধ ও নিরপেক্ষ। যুক্তরাজ্যে নির্বাচনের সময় বিগত সরকার ক্ষমতায় থাকেন, কিন্তু তারা ভোটের ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপের কথা আদৌ ভাবেন না। আর সে কারণেই যুক্তরাজ্যে নির্বাচন হতে পারে পূর্ণ গণতান্ত্রিক, অবাধ ও নিরপেক্ষ।

 

ইলেকট্রোরাল পদ্ধতিতে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন

আমেরিকার সবকটি স্টেট এবং ওয়াশিংটন ডিসি মিলিয়ে মোট ইলেকট্রোরাল ভোট সংখ্যা ৫৩৮। প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য প্রার্থীকে এর অর্ধেকের চেয়ে এক বেশি অর্থাৎ ২৭০টি ইলেকট্রোরাল ভোট পেতে হবে। ধরা যাক কোনো প্রার্থী জনবহুল ১১টি স্টেটের সব মানুষের ভোট মানে ৭৮ শতাংশ ভোট পেয়েছেন এবং জনবিরল ৩৯টি স্টেটের বাইশ শতাংশ ভোটের ১০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। সে ক্ষেত্রে, গোটা দেশের ভোটারদের ৮৮ শতাংশ মানুষের ভোট পেয়েও তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। মাত্র বারো শতাংশ ভোট পেয়েই অন্য প্রার্থী প্রেসিডেন্ট হয়ে যাবেন। সাধারণ মানুষের ভোট বেশি পেয়েও ইলেকট্রোরাল ভোটের নিয়মে প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি, আমেরিকায় এমন উদাহরণ আছে। ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট আল গোর পান ৪৮.৪% ভোট। রিপাবলিকান বুশ তাঁর চেয়ে কম ৪৭.৯% পপুলার ভোট পেয়েও ইলেকট্রোরাল ভোট সংখ্যার হিসাবে আল গোরকে টেক্কা দিয়ে প্রেসিডেন্ট বনে যান। ১৮৮৮ এবং ১৮৭৬ সালেও পপুলার ভোটে পিছিয়ে থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার নজির আছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে স্টেটে যে দল যতগুলো ইলেকট্রোরাল ভোট হাসিল করে, সেই দলের ততজন প্রতিনিধি আবার সরাসরি প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে ভোট দেন। অর্থাৎ, কোনো প্রার্থী যদি ২৭০টি ইলেকট্রোরাল ভোট পান তা হলে তাঁর দলের ২৭০ জন প্রতিনিধির দেওয়া সরাসরি ভোটে তিনি প্রেসিডেন্ট হবেন। তবে চাইলে ইলেকট্রোরাল কলেজের কোনো দলীয় প্রতিনিধি নিজের দলের বদলে অন্য দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন। এঁদের বলা হয় ফেথলেস ইলেক্টর বা বেইমান ইলেক্টর। আমেরিকায় এরকম বেইমানির একশ’ সাতান্নটি উদাহরণ আছে। তবে, তাতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল বদলের নজির নেই।

সর্বশেষ খবর