রবিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ক্রীতদাস থেকে ইতিহাসের পাতায়

সাইফ ইমন

ক্রীতদাস থেকে ইতিহাসের পাতায়
অর্থনৈতিক অবস্থা ও বর্ণভেদে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে ক্রীতদাস হিসেবে ব্যবহার করা হতো এক সময়। যাদের মানুষ বলে কোনো স্বীকৃতি ছিল না। এমনকি কোনো মানবিক অধিকারও ছিল না। মালিকের আদেশ পালনেই তাদের সর্বদা নিয়োজিত থাকতে হতো। তবে অনেক মালিকই নিজের ক্রীতদাসদের ভালো-মন্দ নিয়ে ভেবেছেন, গড়ে তুলেছেন শিক্ষিত নাগরিক হিসেবে। তবুও এই কষ্ট আর প্রতিকূল জীবন থেকে পৃথিবীর ইতিহাসে অনেকেই আলোচিত হয়েছেন, সম্মানিত হয়েছেন-

 

ফরাসি বিপ্লবের একমাত্র বাঙালি

জামর

ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক দাসের নাম। তার পরিচয় শুধু দাস নয়, তিনি একজন বিপ্লবী। তার নাম জামর। ১৭৭৩ সাল। চট্টাগ্রাম উপকূলে ইংরেজ দাস-ব্যবসায়ীদের হাতে ধরা পড়েছিলেন তিনি। তখন বয়স সবেমাত্র ১১। জাহাজে করে তাকে পাচার করা হয়। গন্তব্য ফ্রান্স। এই দাসকে কিনে নেন ফরাসি সম্রাট পঞ্চদশ লুই। জামর পড়তে জানতেন। জামর পড়েছিলেন জাঁ জাক রুশোর বই। রুশোর দর্শন তাকে বিদ্রোহী করে তুলল। ধীরে ধীরে আগ্রহ বাড়ল রাজনীতিতে। এরই ফাঁকে একবার গোপনে যোগাযোগ হলো জ্যাকবপন্থী বিপ্লবীদের সঙ্গে। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব শুরু হলে জামর হলেন কমিটি অব পাবলিক সেফটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। বিপ্লবীদের হাতে সম্রাটের পতন ঘটল। ৬ ডিসেম্বর ১৭৯৩ সালে মাদাম বারি গ্রেফতার হন। ১৮২০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি জামর মারা যান।

 

 

ভাগ্যের ফেরে দাস হয়ে বারো বছর

লোমন নর্থাম্প

টুয়েলভ ইয়ার্স আ স্লেইভ ২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়া জীবনীমূলক চলচ্চিত্র। যেখানে সলোমন নর্থাম্প নামের একজন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানের ভাগ্যের ফেরে দাস হয়ে বারো বছর কাটানোর সত্যি কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। সলোমন নর্থাম্পের একই নামের লেখা বই থেকে ভিত্তি করে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে। ১৮৪১ সাল, তখন আমেরিকার দাস প্রথার যুগ। সলোমন নর্থাম্প ভায়োলিন বাজিয়ে, স্ত্রী অ্যান আর দুই সন্তান মার্গারেট আর আলোনজোকে নিয়ে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে থাকতেন। কাজের প্রস্তাব দিয়ে সলোমনকে এক দাস ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে যায় সলোমনের জীবন। বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয় তার জীবনে। নাম পাল্টে ফেলা হয়। নতুন নাম রাখা হয় প্ল্যাট। নানা ঘটনা, দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে ১২ বছর তাকে দাস হয়েই কাটাতে হয়।

 

 

ভাগ্যবান দিল্লির সুলতান

শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ

শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ দিল্লির মামলুক সালতানাতের একজন সুলতান ছিলেন। তিনি ১১৮০ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাকে দিল্লি সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। এর আগে প্রথম জীবনে তাকে ক্রীতদাস হিসেবে থাকতে হয়। তার ভাইয়েরা তাকে এক দাস ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেয়। বিক্রির পর তাকে বুখারার কাজী সদর জং কিনে নেন। বুখারায় তিনি ভালো শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পান। এর পরে তাকে কুতুবউদ্দিন আইবেক কিনে নেন। কুতুবউদ্দিন আইবেক তার যোগ্যতায় খুশি হয়ে তাকে সার-জান্দার হিসেবে নিয়োগ দেন। কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা তিনি আমির-ই-শিকার এবং পরে গোয়ালিয়রের আমির হিসেবে উন্নীত হন। আইবেক তার কন্যাকে ইলতুতমিশের সঙ্গে বিয়ে দেন। কুতুবউদ্দিন আইবেকের মৃত্যুর পর তার পুত্র শাসনভার গ্রহণের অযোগ্য প্রমাণিত হলে তুর্কিরা তাকে সুলতান হিসেবে মনোনিত করে।

 

 

বণিকের কাছে বিক্রি হওয়া সেই মানুষ

মুর্শিদকুলি খাঁ

মুর্শিদ কুলি খাঁ ছিলেন বাংলার প্রথম নবাব। এ ছাড়াও বিভিন্ন নথিপত্র নির্দেশ করে তিনিই মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুপরবর্তী প্রথম স্বাধীন নবাব। মুর্শিদ কুলি খাঁ দরিদ্র দাক্ষিণাত্য মালভূমি ওড়িয়া ব্রাহমীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ক্রীতদাস হিসেবে পারস্যের বণিক ইসফাহান তাকে ক্রয় করে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করেন এবং নাম পরিবর্তন করে মুহাম্মদ হাদী বা মির্জা হাদী রাখেন। অবশ্য এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। একটি দাবি মতে, মুর্শিদ কুলি খাঁকে হাজি শফি ইসফাহানি নামে ইরানের একজন মুঘল কর্মকর্তা ক্রীতদাস হিসেবে ক্রয় করেন। ১৭১৭ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে কার্তালাব খান নামে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তারিত করেন। অপর সংস্করণ মতে, তিনি ছিলেন মারাঠা জেনারেল মুহাম্মদ কুলি খাঁর নাতি।  

 

 

স্বাধীনতার আশায় উন্মাদ একজন

মার্গারেট গার্নার

কেন্টাকির ক্রীতদাস মার্গারেট স্বাধীন জীবনের জন্য উন্মাদ হয়েছিলেন। স্বাধীনচেতা মার্গারেটের এই গল্পকে পুঁজি করে টনি মরিসন একটি কালজয়ী উপন্যাস রচনা করেন। এর মাধ্যমে মার্গারেটের নাম পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। আর ১০ জন সাধারণ ক্রীতদাসের মতোই দুর্বিষহ ছিল মার্গারেটের জীবন। ১৮৫৬ সালের জানুয়ারিতে একটি ট্রেনে করে পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করেন মার্গারেট। ২৭ জানুয়ারি ভোরবেলা পালিয়ে যান কানাডার দিকে। কানাডায় জোসেফ কাইট নামক এক লোকের বাড়িতে আশ্রয় নেন পরিবার নিয়ে। কিন্তু গার্নারের পূর্বের মালিক গেইনস পুরো ঘটনা জেনে পুলিশ সদস্যের সহায়তায় কানাডা পৌঁছেন। তারপর নানা ঘটনার মধ্যদিয়ে মার্গারেটকে দাসত্বের জীবনেই ফিরে যেতে হয়। স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় এক ঐতিহাসিক উদাহরণ মার্গারেট।

 

 

কালজয়ী একজন গল্পের জাদুকর

ঈশপ

ঈশপের গল্প শুনে বড় হয়েছি আমরা সবাই।  শিক্ষণীয় সব গল্পের মাধ্যমে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন ঈশপ। তিনি ছিলেন একজন ক্রীতদাস।

প্রাচীন গ্রিস এবং তুরস্কের কোনো এক অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন তিনি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৬২০ সালে। তিনি জন্মান্ধ ছিলেন। তার মালিক ছিলেন লোডম্যান। কাজ করার সময় ইশপের মুখে হাস্যরসাত্মক নানা গল্প শুনে মুগ্ধ হয়ে যান লোডম্যান। তিনি উপহারস্বরূপ ঈশপকে মুক্তিদান করেন। মুক্ত ঈশপ শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়াতেন আর মানুষদের গল্প শোনাতেন। তার গল্পে মুগ্ধ হতো শ্রোতারা। চারদিকে নাম ছড়িয়ে পড়ে ঈশপের। একপর্যায়ে ঈশপকে চুরির দায়ে হত্যা করা হয়।

 

 

ব্রিটিশবিরোধী সেই বিপ্লবী

শমসের গাজী

বঙ্গবীর বলা হয় শমসের গাজীকে। তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী এবং ত্রিপুরার রোশনাবাদ পরগনার কৃষক বিদ্রোহের নায়ক। ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন। নবাব সিরাজুদ্দৌলার পর তিনিই ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে প্রথম নিহত হন। বঙ্গবীর শমসের গাজী বর্তমান ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতার নাম ছিল পীর মুহাম্মদ এবং মাতার নাম ছিল কৈয়্যারা বিবি। প্রথম জীবনে এক জমিদারের ক্রিতদাস ছিলেন তিনি। মগ-পর্তুগিজ জলদস্যুদের বিরুদ্ধে তিনি গড়ে তোলেন এক লাঠিয়াল বাহিনী। ‘বাংলার বীর’, ‘ভাটির বাঘ’ ইত্যাদি উপাধিতে তাকে ভূষিত করা হয়।

 

 

 

বাঁক বদলে সেনা প্রধান জেনারেল

আব্রাম পেট্রোভিচ হ্যানিবল

হ্যানিবলের ১৬৯৭ সালে আফ্রিকার দেশ ইরিত্রিয়ায় এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেন। কয়েকবার অপহরণের শিকার হয়েছিল শিশু হ্যানিবল। প্রথমে তুরস্কে, তারপর মস্কোতে পাচার করা হয় তাকে। তাকে স্বয়ং জার ‘পিটার দ্য গ্রেট’র সেবায় নিয়োজিত করা হয়। জার হ্যানিবলের মেধায় মুগ্ধ হন তিনি। পিটারের নির্দেশে তাকে ফ্রান্সে পাঠানো হয় উচ্চশিক্ষার জন্য। এর পর সেনাবাহিনীতে যোগ দেন হ্যানিবল। পরবর্তীকালে তিনি রুশ সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। এক সময় হ্যানিবল মেজর জেনারেল পদে উত্তীর্ণ হন। রাশিয়ার হয়ে বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেন। ক্রীতদাস থেকে হ্যানিবল হয়ে যান রুশ সেনাবাহিনীর জেনারেল।

সর্বশেষ খবর