সোমবার, ৭ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিশ্বের সবচেয়ে দামি বস্তু

সাইফ ইমন

বিশ্বের সবচেয়ে দামি বস্তু
মানুষের প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু হলো সোনা। কিন্তু বাস্তবতা হলো সোনার চেয়েও মূল্যবান অনেক বস্তু রয়েছে পৃথিবীর বুকে। আবার অধিকাংশ মানুষই মূল্যবান বস্তু হিসেবে হীরা কিংবা ইউরেনিয়ামকে সবার ওপরে রাখবে। এগুলো অবশ্যই দামি কিন্তু বাস্তবতা বলছে, এগুলো ছাড়াও এমন কিছু বস্তু আছে যাদের দামের কাছে বাকি সব তুচ্ছ। এর মধ্যে আছে প্রতিবস্তু বা অ্যান্টিম্যাটার, গণ্ডারের শিং, জেড পাথর, রোডিয়াম ইত্যাদি। এরকম কিছু মূল্যবান বস্তু নিয়ে আজকের আয়োজন-

 

প্রতি গ্রাম ১১০ ডলার

গণ্ডারের শিং

গণ্ডারের শিং এখন বিশ্বের সবচেয়ে দামি বস্তুগলোর একটি। এর মূল কারণ এশিয়ার বাজারে এর বিশাল চাহিদা। ফলে গত বছরই প্রায় ১২শ’র বেশি গণ্ডার শিকারিদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। বিবিসির দক্ষিণ আফ্রিকার সংবাদদাতা লিয়ানা হোসের পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণ্ডারের শিংয়ের সন্ধানে দক্ষিণ আফ্রিকায় চোরা শিকারিরা যায় মূলত প্রতিবেশী দেশ মোজাম্বিক থেকে। বন্যপ্রাণী মেরে তাদের দেহাংশ বিক্রি, বছরে ১৯০০ কোটি ডলারের আন্তর্জাতিক ব্যবসা। এ ব্যবসায় এ মুহূর্তে সবচেয়ে চড়া হলো গণ্ডারের শিংয়ের বাজারমূল্য। আর তাই চোরা শিকারিরা হয় গণ্ডারকে মেরে তার শিং উবড়ে নেয় অথবা শিং কেটে গণ্ডারকে আহত অবস্থায় জঙ্গলে ফেলে রেখে যায়। এশিয়ার বাজারে গণ্ডারের একটা শিং থেকে আড়াই লাখ মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব। তাই রেকর্ড সংখ্যায় গণ্ডার নিধন করা হচ্ছে।

 

প্রতি গ্রাম ৫৫ হাজার ডলার

হীরক

হীরার মূল্য কেমন হবে তা নির্ভর করে চারটি বিষয়ের ওপর। যথা রং কিরূপ, কীভাবে কাটা হয়েছে, কতটা স্বচ্ছ প্রকৃতির এবং কত ক্যারেট ওজনের। ক্যারেট স্বর্ণের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধতার একক। মানে যে কোনো স্বর্ণের ২৪ ভাগের কত ভাগ স্বর্ণ তা বোঝাতেই ক্যারেট ব্যবহৃত হয়। ২৪ ক্যারেট বলতে বোঝায় ২৪ ভাগের ২৪ ভাগই স্বর্ণ অর্থাৎ ৯৯.৯ শতাংশ খাঁটি স্বর্ণ যা ব্যবহারের অনুপযোগী। আর রত্নপাথরের ক্ষেত্রে ক্যারেট হচ্ছে ভরের একক। এক্ষেত্রে ১ ক্যারেট = ০.২ গ্রাম বা ২০০ মিলিগ্রাম। খনিজ হীরক এবং অলঙ্কারের জন্য প্রস্তুত কাটা হীরার মাঝে মূল্য পার্থক্য ব্যাপক। হীরক বা হীরা বা হীরে হল সর্বাপেক্ষা মূল্যবান একটি রত্ন যা গহনা তৈরিতে বহুল ব্যবহৃত হয়। বর্ণহীন এ রত্নটি একটি মাত্র বিশুদ্ধ উপাদান কার্বন থেকে সৃষ্ট। অন্য ভাষায় হীরক কার্বনের একটি বিশেষ রূপ মাত্র। পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ২৬ হাজার কেজি. খনিজ হীরা উত্তোলিত হয়।

 

প্রতি গ্রাম ৩০ হাজার ডলার

ট্রিটিয়াম

হাইড্রোজেনের একটি সাধারণ আইসোটোপ যার কোনো নিউট্রন নেই, তাকে কখনো কখনো প্রোটিয়াম বলা হয়। হাইড্রোজেন, ডিউটেরিয়াম এবং ট্রিটিয়াম।

পার্থক্য শুধু নিউট্রন সংখ্যায়। প্রোটন সংখ্যা কিন্তু একই। কারণ তারা একই মৌল। মৌলের আইডেন্টিটি হলো প্রোটন সংখ্যা। এজন্যই ভিন্ন দুটি মৌলের প্রোটন সংখ্যা কখনোই এক নয়। হাইড্রোজেন হলো একমাত্র উপাদান যার আইসোটোপগুলো আজকাল বিভিন্ন নামে ব্যবহার করা হয়। হাইড্রোজেন-৩ আইসোটোপকে সাধারণত ট্রিটিয়াম বলা হয়। D এবং T অক্ষর দুটি (2H ও 3H-এর পরিবর্তে) কখনো কখনো ডিউটেরিডাম এবং ট্রিটিডামের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এটি পেশ করা হয় না, কারণ এটি রাসায়নিক সূত্রের বর্ণানুক্রমিক শ্রেণিবিভাজনে সমস্যা সৃষ্টি করে।

 

প্রতি গ্রাম ১০০ ডলার

মেথামফেটামিন

মেথামফেটামিন একটি উদ্দীপক মাদকদ্রব্য। সাধারণত এটি সাদা, তিক্ত-চিকন গুঁড়া বা পিল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ক্রিস্টাল মেথামফেটামিন হচ্ছে মাদকের একটি ফর্ম, যা কাচের টুকরো বা চকচকে, নীল-সাদা শিলাগুলোর মতো দেখতে। এটি কৃত্রিমভাবে অ্যামফেটামিনের অনুরূপ। এটি মনোযোগ-ঘাটতি, বিচ্ছৃঙ্খলা এবং ঘুম-ব্যাধি রোগে ব্যবহৃত হয়। মেথামফেটামিনের প্রচলিত নামগুলো হলো চক, ক্র্যাং, স্ফটিক, বরফ, মেথ এবং গতি। দীর্ঘমেয়াদি মেথামফেটামিন ব্যবহারে অনেকগুলো নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে- ওজন কমানো; দাঁতের সমস্যা, ইন্টেন্স খিঁচুনির কারণে স্ক্যাচিং থেকে ত্বকে ত্বক জড়িয়ে যায়, কনফিউশান, স্লিপিং সমস্যা, অহিংস আচরণ, অন্যদের মধ্যে চরম এবং অবাধ্য অবিশ্বাস, হ্যালুসিনেশান সেন্সেশন এবং ইমেজ, যা বাস্তব বলে মনে হয়, যদিও তা নয়।

 

১৭০ মিলিয়ন মূল্যমানের দুর্লভ এই জেড পাথর

জেড পাথর

মিয়ানমারের একটি খনিতে ১৭৫ টন ওজনের বিশাল এক জেড পাথর পাওয়া যায়। পাথরটি ১৪ ফুট উঁচু ও ১৯ ফুট লম্বা। ধারণা করা হচ্ছে, এর দাম প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ ডলার। দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় কাচিন প্রদেশের একটি খনিতে বিশালাকৃতির এই জেড পাথর পাওয়া গেছে। মিয়ানমারেই বিশ্বের সবচেয়ে ভালো জেড পাথর পাওয়া যায়। জেড সবুজ রঙের প্রায়-স্বচ্ছ একটি পাথর। মিয়ানমারের মোট জিডিপির অর্ধেকই আসে জেড শিল্প থেকে। জেড পাথরের সবচেয়ে বড় বাজার পাশের দেশ চীন। সেখানে এটিকে ‘স্বর্গের পাথর’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ৩০০ টনি বিশাল জেড পাথরটি ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে কাচিন প্রদেশের ফাকান্তের মাত লিন চাউং খনি থেকে আহরণ করা হয়েছিল। মিয়ানমার সরকার এরই মধ্যে জেড পাথরটি থেকে ২০০ কোটি কিয়েত উত্তোলন শুল্ক আদায় করে ফেলেছে।

 

প্রতি গ্রাম ৫৮ ডলার

রোডিয়াম

রোডিয়াম পর্যায় সারণীর ৪৫তম মৌলিক পদার্থ।  এটি একটি বিরল ধাতু। এটি রূপার মতো সাদা বর্ণের, কঠিন এবং রাসায়নিকভাবে নিষ্ক্রিয় একটি রূপান্তর ধাতু। পর্যায় সারণীতে এটি প্লাটিনাম দলের অন্তর্গত। প্রকৃতিতে এটির একটি মাত্র আইসোটোপ ১০৩Rh পাওয়া যায়। ধাতুটিকে প্রকৃতিতে আলাদা বা মুক্ত অবস্থায় কিংবা অন্য ধাতুর সঙ্গে শংকর অবস্থায় পাওয়া যায়। যৌগের অংশ হিসেবে প্রকৃতিতে এটি খুবই বিরল। রোডিয়াম একটি অভিজাত ধাতু। এটির ক্ষয়নিরোধী ক্ষমতা আছে। ১৮০৩ সালে উইলিয়াম হাইড ওলাস্টন এটিকে একটি প্লাটিনাম-নিকেল আকরিক থেকে অবিষ্কার করেন ও ক্লোরিনের সঙ্গে এর যৌগের গোলাপি বর্ণের জন্য নাম রাখেন রোডিয়াম।

 

প্রতি গ্রাম ৩ হাজার ডলার

এলএসডি

লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড (এলএসডি) এক ধরনের সাইকেডেলিক ওষুধ যা মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের জন্য পরিচিত। যার মধ্যে পারিপার্শি¦ক পরিবর্তিত সম্পর্কে সচেতনতা, উপলব্ধি ও সেই সঙ্গে সংবেদন অনুভূত হওয়া এবং অবাস্তব চিত্রগুলো বাস্তব মনে হওয়া প্রভৃৃতি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এটি প্রধানত প্রমোদমূলক ওষুধ হিসেবে এবং আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। এলএসডি সাধারণত জিভের নিচে রাখা হয়। এটি প্রায়ই বল্টার কাগজ, চিনির কিউব বা জেলটিনে বিক্রি করা হয়। এটি ইনজেকশনের সাহায্যে নেয়া হতে পারে। এলএসডি আসক্তিজনক যদিও নয়, তবু প্রতিকূল মনস্তত্ত্ব প্রতিক্রিয়া যেমন উদ্বেগ, প্যারানয়া এবং বিভ্রম ঘটার সম্ভাবনা থাকে। এলএসডি অ্যাগ্রোলাইন পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।

 

প্রতি গ্রাম ৪ হাজার ডলার

প্লুটোনিয়াম

প্লুটোনিয়াম একটি তেজস্ক্রিয় রাসায়নিক উপাদান, যার প্রতীক চঁ এবং পারমাণবিক সংখ্যা ৯৪। এটি রুপালি-ধূসর বর্ণের একটি অ্যাক্টিনাইড ধাতু। এই উপাদানটি সাধারণত ছয়টি অ্যালোট্রোপ এবং চারটি জারন অবস্থা প্রদর্শন করে। এটা কার্বন, হ্যালোজেন, নাইট্রোজেন, সিলিকন এবং হাইড্রোজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে। এটি তেজস্ক্রিয় পদার্থ এবং হাড়ে জমা হতে পারে। প্লুটোনিয়ামের এসব বৈশিষ্ট্য একে নিয়ন্ত্রণ করাকে বিপজ্জনক করে তোলে। রুপালি-সাদা রঙের হয়ে থাকে এরা। সাধারণত নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র কিংবা নিউক্লিয়ার বোমা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। মহাকাশযানের চলার জন্য জ্বালানির প্রয়োজন হয়। এর পারমাণবিক শক্তির জোগানের জন্য বিজ্ঞানীরা প্লুটোনিয়াম ব্যবহারের কথা ভাবছেন।

 

প্রতি গ্রাম ৬২.৫ ট্রিলিয়ন ডলার

প্রতিবস্তু

মহাবিশ্বে যা কিছু আছে সবকিছুই এক অপরিহার্য উপাদান দিয়ে তৈরি। আর তা হচ্ছে বস্তু। ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাংগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাবিশ্বে বস্তু এবং বস্তুর বিপরীত সত্ত্বা প্রতিবস্তু সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বস্তু এবং প্রতিবস্তুর ধর্মই ছচ্ছে তারা একে অপরকে ধ্বংস করবে। তাই সে হিসেবে সদ্য নির্মিত তৎকালীন মহাবিশ্বে শুধু শক্তি ছাড়া আর কিছুই থাকার কথা নয়, কারণ বস্তু এবং প্রতিবস্তুর সংঘর্ষে শক্তি নির্গত হয়। মহাবিশ্ব এই দুই সত্ত্বার মধ্য থেকে সে বস্তুকে বেছে নেয়। বর্তমানের প্রযুক্তি অনুসারে মানবজাতির সবাই যদি বিরতিহীনভাবে টানা পরিশ্রম করে যায় তাহলে এক বছরে মাত্র এক গ্রাম অ্যান্টিম্যাটার তৈরি করতে পারবে। বিজ্ঞানীরা অ্যান্টিম্যাটারের দেখা পেয়েছিলেন, তবে স্বাভাবিকভাবে নয়। লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে অপ্রত্যাশিতভাবে এটি তৈরি হয়েছিল।

 

প্রতি গ্রাম ২৭ মিলিয়ন ডলার

ক্যালিফোর্নিয়াম

১৯৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় এটি আবিষ্কৃত হয়েছিল। এটা খুবই বিরল একটি ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে। এই বস্তু প্রাকৃতিকভাবে তৈরিই হয় না। কৃত্রিমভাবে তৈরি মৌল এটি।    রসায়ন শাস্ত্রের পর্যায় সারণীর আরও কিছু মৌল আছে যাদের কৃত্রিমভাবে পরীক্ষাগারে তৈরি করতে হয়। এটিও সবচেয়ে দামি মৌল। কারণ এটি তৈরিতে প্রচুর অর্থ খরচ করতে হয়। এসব মৌল স্বাভাবিকভাবে প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না। ক্যালিফোর্নিয়ায় আবিষ্কার হয়েছিল বলে এই মৌলের নাম রাখা হয় ক্যালিফোর্নিয়াম। পৃথিবীর ইতিহাসে এই বস্তু একবারই তৈরি করা হয়েছিল। অন্যান্য মৌলের মতোই এর বৈশিষ্ট্য। তবে এটি অত্যন্ত তেজস্ক্রিয়। এক মাইক্রোগ্রাম ক্যালিফোর্নিয়াম থেকে প্রতি মিনিটে ১৭০ মিলিয়ন নিউট্রন কণা নিঃসরিত হয়; যা যেকোনো জীবন্ত প্রাণীর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

সর্বশেষ খবর