বৃহস্পতিবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

পোশাকে ব্যতিক্রম ধনকুবের

তানিয়া তুষ্টি

পোশাকে ব্যতিক্রম ধনকুবের

ফ্যাশন সচেতনদের জন্য হালের ফ্যাশনে প্রতিদিন যোগ হয় কত শত ডিজাইনের পোশাক আর অনুষঙ্গ। সবচেয়ে আধুনিক পোশাকটি সংগ্রহে এসব ক্রেতার মাঝে চলে রীতিমতো হুড়োহুড়ি। এমনকি, ফ্যাশন ডিজাইনাররা সময়ভেদে ভিন্ন পোশাকের উপযোগিতা নিয়ে করেন চুলচেরা বিশ্লেষণ। সেখানে বিশ্বের অনেক ধনকুবের আছেন যারা প্রতিদিন একটিমাত্র নির্ধারিত রং আর ডিজাইনের পোশাক পরেই খুশি। এর পেছনে তারা অবশ্য দেখাচ্ছেন যুতসই অনেক কারণ, যা আমাদের কাছে বেশ মজার ও একই সঙ্গে শিক্ষণীয়ও বটে। পোশাকে ব্যতিক্রম ধনকুবেরদের এসব তথ্য নিয়ে আজকের আয়োজন।

 

ওবামার সঙ্গী নীল অথবা ধূসর শার্ট

আপনি পছন্দ করেন আর না করেন, সন্দেহাতীতভাবে স্বীকার করতেই হবে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করাটা খুবই কঠিনতম কাজ। এমনকি গোটা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের প্রধানের ব্যস্ততাও নিশ্চয় অনেক বেশি। তিনি মনে করেন এত এত কাজের ভিড়ে শুধু পোশাকের মতো একটি বিষয়ে এত সময় দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আর তাই তো তিনি প্রতিদিন একই রঙের স্যুট পরে বের হতেন। হোয়াইট হাউসে হোক কিংবা ভিনদেশে, যেখানেই যাক না কেন মার্কিন সাবেক রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার নিত্যকার পোশাক হলো নীল বা ধূসর রঙের শার্ট। কখনো শার্টের ওপরে স্যুট। একই রকমের পোশাক পরা নিয়ে ওবামার বক্তব্য, ‘আমি কী খাচ্ছি বা কী পরছি এমন ছোটখাটো বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাই না। কারণ, আমার আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আপনার দরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণে শক্তির ওপর জোর দেওয়া।’ তার মতে নিজের জীবনকে ছকের মধ্যে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করা উচিত। কোনো তুচ্ছ বিষয়ে ভেবে দিন নষ্ট করার প্রয়োজন নেই।

 

কালো গেঞ্জি আর আকাশি জিন্সের ভক্ত ছিলেন স্টিভ

পুরো টেকনোলজি বিশ্বের জাদুকর হিসেবে পরিচিত স্টিভ জবস। কিছুদিন পর পর আবিষ্কারের চমক ছড়ালেও নিজের পোশাকের ব্যাপারে ছিলেন একদম ধরাবাঁধা রুটিনে। প্রতিদিন পরতেন একই রঙের আর ডিজাইনের পোশাক। তার কথা মনে করলেই চোখের সামনে ভেসে উঠবে আকাশি রঙের জিন্স আর ফুলহাতা কালো গেঞ্জি পরা হালকা গড়নের মানুষটির মুখ। কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ মিটিং, নতুন প্রোডাক্টের লঞ্চিং কিংবা সাধারণ কোনো কর্মদিবস সবই তার কাছে সমান। এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন যেমনই হোক না কেন, সবসময় কালো মোক টার্টেলনেক গেঞ্জি আর আকাশি রঙের জিন্সে স্টিভের ভক্তি প্রকাশ পেত। এটিই পরবর্তীতে টেক বিশ্বে তাকে টেক ফ্যাশনেবল আইকন হিসেবে পরিচিত করে। পোশাক নির্বাচনে তার যুক্তিও সোজাসাপ্টা। তার প্রশ্ন ছিল, কেন শুধু শুধু পোশাকের পেছনে এত সময় ব্যয় করতে হবে? কত কাজ আছে করার, কত সিদ্ধান্ত নিতে হয়! সবুজ নাকি খয়েরি, কোন টি-শার্ট পরব এই ভাবার থেকে আইফোনে কোনো নতুন ফিচার যুক্ত করব এটি ভাবা প্রয়োজনীয় বলে মনে করতেন তিনি। অ্যাপলের অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যেও এ পোশাক প্রায় ছড়িয়ে গিয়েছিল।

 

জোলির পছন্দ খাকি প্যান্ট  একরঙা টি-শার্ট

হাজার যুবকের হৃদকম্পনের কারণ যে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, তার পোশাক সম্পর্কে সহজেই ধারণা করা যায়। আপনিও হয়তো তার পোশাক তালিকায় এক নাগাড়ে অনেক কিছুই বলতে পারবেন। এমনকি রেড কার্পেটে হাঁটা এই লাস্যময়ীর জাঁকজমকপূর্ণ গাউনের কথা বিশেষভাবে মনে থাকতে পারে। বিশ্বমানের যে কোনো অনুষ্ঠানের মূল আইকন হিসেবে তিনিই যে সবচেয়ে বিলাসবহুল গাউনটি পরে থাকেন তাও অনেকের কাছে নিশ্চিত। কিন্তু এই মানুষটি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে চলাফেরার সময় খুব সাদামাটা পোশাক পরে থাকেন। তার এই ধরনের পোশাকের একটি বিশেষ সংগ্রহ রয়েছে। তিনি যখন অবকাশ যাপনে যান অথবা জাতিসংঘের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে নিজেকে সবার সামনে হাজির করেন তখন পুরো সময়টা পরে থাকেন কালো, সাদা অথবা নেভি ব্লু টি-শার্ট। সঙ্গে থাকে খাকি অথবা স্লিমফিট প্যান্ট। এগুলোই তার নিত্যকার পোশাক। কখনো কখনো তাকে শর্ট লেন্থের টি-শার্টও পরতে দেখা যায়। তবে বিশেষ অনুষ্ঠানের বাইরে অ্যাঞ্জেলিনা জোলির নিয়মিত পোশাক হিসেবে ধরা হয় এগুলোই। তিনি মনে করেন, এ ধরনের পোশাক দীর্ঘ ভ্রমণ ও চলাচলে খুব সহায়ক হয়ে থাকে।

 

মার্কের নিয়মিত পোশাক ছাইরঙা টি-শার্ট

ফেসবুকে দেওয়ার জন্য হলেও অন্তত একটি সেলফি, কখনো আবার ঘরের মধ্যেই সাজগোজ করে ছবি তোলা। ফেসবুকে টিপটপ স্ট্যাটাস বোঝাতেও বৈচিত্র্যময় পোশাক পরে ছবি তোলেন অনেকে। এমনকি, ফেসবুকে আড়ম্বর বোঝাতেই বিয়ের পোশাক আর ছবি তোলার জন্য থাকে ব্যাপক আয়োজন। এই ফেসবুক নিয়ে গোটা বিশ্বের যখন এতো মাতামাতি সেই ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মার্ক জুকারবার্গই প্রতিদিন পরেন মাত্র একটি রঙের পোশাক। ৪ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি সম্পদের মালিক হয়ে প্রতিদিন কেন পরেন ছাইরঙা টি-শার্ট আর জিন্স। জানতে ইচ্ছা হতে পারে, তার ওয়ারড্রোবে কী আছে? ভাবছেন, ছবিতে একই পোশাক দেখলেও ওয়ারড্রোবে হয়তো দামি পোশাক, রোলেক্স ঘড়ির সারি, দামি জুতা থাকবে। কিন্তু সত্য হলো, তার ওয়ারড্রোবে এসবের কিছুই নেই। সম্প্রতি তার পোস্ট করা একটি ছবিতে দেখা গেছে, ধূসর বা ছাইরঙা একই রকম কয়েকটি টি-শার্ট আর কয়েকটি হুডি। এগুলোই তিনি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পরেন। পার্থক্য শুধু একই ছাই রঙের মধ্যে সামান্য গাঢ় আর হালকা। কেন একই রকম টি-শার্ট গায়ে দিয়ে কাজে যান তার উত্তরে জুকারবার্গ বলেন, ‘প্রতিদিন একই রকম পোশাক তাকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে।’ ২০১৬ সালে এমন মন্তব্য করার আগে একই প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন ২০১৪ সালে। জবাবে তিনি জানান, ‘ফেসবুক কমিউনিটিকে কীভাবে সবচেয়ে ভালো সেবা দেওয়া যায়, সেটিই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ কারণেই জীবনকে সাদামাটা রাখতে চাই আমি।’ তিনি খুব একটা স্যুট-টাই পরেন না! মাত্র কয়েকটি বিশেষ অনুষ্ঠানে তাকে স্যুট-টাই পরতে দেখা গেছে। ২০১২ সালে ফেসবুকের আইপিও ছাড়ার অনুষ্ঠানে ট্রেডমার্ক পোশাক ‘হুডিযুক্ত ধূসর টি-শার্ট জিন্স-স্নিকার’ পরে হাজির হয়েছিলেন জুকারবার্গ। গুরুত্বপূর্ণ এই অনুষ্ঠানে তিনি পোশাক নির্বাচন নিয়ে প্রযুক্তিবিশ্বে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। কিন্তু মার্ক জুকারবার্গ বাহারি রঙের পোশাক অথবা টাই-স্যুট পরার বিষয়টি রীতিমতো চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন।

 

নোলানের আগ্রহ নীল শার্ট, কালো ব্লেজারে

চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কথা আসতেই তাদের পোশাক হিসেবে বেসবল হ্যাট, টি-শার্ট অথবা খাকি রঙের প্যান্ট পরিহিত ভাবুক চেহারা মনে পড়ার কথা। সেখানে চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক আর লেখক হিসেবে সুপরিচিত ক্রিস্টোফার নোলান নিজেকে একটি বাঁধাধরা পোশাকে সবার কাছে পরিচিত। তিনি মনে করেন, জীবনটাই একটি স্কুল, যেখানে প্রতিদিন ইউনিফর্ম পরা উচিত। আর তাই ব্রিটিশ এই পরিচালকের নিত্যদিনের পোশাক হয়ে উঠেছিল পাতলা কলারের হালকা অথবা গাঢ় নীল শার্টের সঙ্গে একটি গাঢ় রঙের জ্যাকেট। জ্যাকেটে থাকে একাধিক পকেট। এর সঙ্গে থাকতে হবে কালো পায়জামা আর আরামদায়ক জুতা। প্রতিদিন পরার কাপড় বাছাই করার ঝক্কি এড়াতে নোলান সবসময় একই পোশাক পরার পন্থা বেছে নিয়েছিলেন। তার এই বিষয়টি অনেকেরই জানা। তিনি পোশাক ভাবনায় সময় নষ্ট করতে একদমই নারাজ।

 

সাদা টি-শার্ট আর জিন্সে পরিচিত সাইমন কাউয়েল

ইংলিশ টিভি মিউজিক ও আমেরিকান ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগিতার নিয়মিত বিচারক হিসেবে সাইমন ফিলিপ কাউয়েল সবার কাছেই খুব পরিচিত মুখ। এ ছাড়াও তাকে একাধিক রিয়েলিটি শো, প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান ও টিভি শোতে দেখা যায়। বলা যায়, টিভির পর্দায় তার দিনরাত পার হয়। এখানে শো-আপের ব্যাপার থাকলেও এই মানুষটি ধরাবাঁধা একটি পোশাক রীতিতে চলেন। তাকে প্রতিটি সময় দেখা যায় ভি গলার সাদা ক্যাজুয়াল টি-শার্টে। এর সঙ্গে পরেন ঢিলেঢালা জিন্স প্যান্ট। খুব সময়ই এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। কিন্তু সেই ব্যতিক্রমও আহামরি কিছু নয়। ফরমাল কালো প্যান্ট-স্যুট আর সাদা শার্ট হয় তার তখনকার সঙ্গী। তার ওয়ারড্রোবেও পাওয়া যাবে শুধু এই দুই ধরনের আউটফিট। সাইমন মন্তব্য করেন, তার কাছে প্রতিদিন পোশাক বদলানোটা বিরক্তিকর।

 

 

ডিন ক্যামেনের সঙ্গী ডেনিমের শার্ট-প্যান্ট

ব্যাটারি চালিত দুই চাকার বৈদ্যুতিক গাড়ি সেগওয়ের উদ্ভাবক ডিন ক্যামেন। একটু ‘পাগলাটে’ স্বভাবের জন্য সবার কাছে তার পরিচিতি আছে। এই ব্যক্তিকে প্রতিদিন ডেনিম শার্ট, ডেনিম জিন্স আর বুট পরা অবস্থায়ই দেখা যেত। প্রায় ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি এই অভ্যাস অব্যাহত রাখেন। তার বক্তব্য, আমি কাজের সময় কাজের পোশাক পরাটাই উপযুক্ত মনে করি। আর তাই প্রতিদিন একই পোশাক পরায় আমার সময় বেঁচে যায়। তিনি অন্যান্য উদ্ভাবকের মতো অনেকের কাছে অনুকরণীয়। আর তাই তার পোশাক ভাবনাও অনেকে নিজের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছিলেন। ডিন ক্যামেন বলেন, পোশাকের জন্য ভাবনার সময়টুকু নতুন কিছু আবিষ্কারের জন্য ব্যয় করতে পারি।

 

 

৩৫ বছর হলুদ পোশাকে আবু জাকুর

বিশ্বের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের সময় কাটে ক্যালকুলেটরে হিসাব করে। তাই তো, পোশাকের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে সময় নষ্ট করতে নারাজ। কিন্তু বিশ্বের এমন কিছু মানুষ আছেন, যাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকা সত্ত্বেও স্রেফ খেয়াল-খুশিতে যে কোনো একটি রং বেছে নিয়েছেন প্রতিদিনকার পোশাকে। দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে হলুদ রঙের পোশাক পরে আলোচনায় এসেছেন সিরিয়ার আলেপ্পো শহরের আবু জাকুর নামের এক ব্যক্তি। শুধু হলুদ রঙের পোশাক পরেই তিনি ক্ষান্ত নন, আন্ডারওয়ার, মাথার টুপি, ছাতা, ফোনের কভার, দেয়াল ঘড়ি, হাতঘড়ি, চশমার ফ্রেম ও বাসার অনেক আসবাবও হলুদ রংয়ের। একটি চীনা বার্তা সংস্থাকে তিনি বলেন, ‘হলুদ ছাড়া অন্য কোনো রঙের পোশাক পরলে নিজেকে নিষ্প্রাণ মনে হয়। ফলে অন্য কোনো পোশাক পরে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না।’ হলুদ পোশাক পরায় আবু জাকুর এখন আলেপ্পোর খুবই পরিচিত মুখ।

সর্বশেষ খবর