শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

রূপ, বিদ্যা, বিত্তে প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে

সামিয়া রহমান

রূপ, বিদ্যা, বিত্তে প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে
রোজ ডে, প্রপোজ ডে, চকলেট ডে, হাগ ডে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে! কত উৎসব-কত্ত প্রেম। আদৌ কি ভালোবাসা? আজকাল বিয়ে, ভালোবাসা সব কমার্শিয়াল। এসব বাণিজ্যিক, ঝাঁ চকচকে লোক দেখানো আয়োজনে সব আছে, শুধু নেই ভালোবাসা। বিয়ে যেন বন্ধন নয়, শর্তের লিস্ট। ভালোবাসা যেন অন্যকে আপন করে নেওয়া নয়, শুধুই শো অফ বা টাইম পাস! অথবা তরুণ প্রজন্মের ভাষায় কুল, সোয়্যাগ, জোস, প্যারা জাতীয় কিছু অর্থহীন শব্দ!

 

সেদিন এক বিয়ের জন্য কন্যা দেখতে গিয়েছিলাম। ঘটা করে পাত্র-পাত্রী দেখাতে আমার প্রবল আপত্তি। অনেকটা গরু-ছাগলের হাটের মতো কারবার। কিন্তু এড়ানোর উপায় ছিল না। জীবনে প্রথম পাত্রী দেখা, তাই প্রবল উৎসাহ নিয়েই গেলাম। কিন্তু উপস্থিত পাত্রীর সেখানে দাবি কী ছিল শুনবেন? ‘বিয়ে করতে চাই শুধু বিদেশ যাওয়ার জন্য। ছেলে পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট তো?’ শুনলাম কন্যা স্নাতকের পর দুবছর ঢাকায় বেকার বসা এবং তার ভাষাতেই সে ইংরেজিতে কাঁচা, তাই এমন পাত্র খোঁজা, যার যোগ্যতায় সে বিদেশ নামের স্বপ্নের দেশে উন্নত জীবনের সুযোগ পাবে!

সেদিন এক কন্যার মা বলছিলেন, তার মেয়ের জন্য সুপাত্র চাই। তার ধারণা গণমাধ্যমের সুবাদে, হরেক মানুষের সঙ্গে আমার কারবার। যদিও আমি ঘটক নই, কিন্তু তারপরও ইচ্ছে হলো তার চাহিদার সুপাত্রের গুণাবলি শুনতে। তো প্রশ্ন করলাম, সুপাত্র কেমন চাই? বর হতে হবে লম্ব^ায় ৬ ফিট। অভিজাত ও শিক্ষিত পরিবার আবশ্যকীয় শর্ত। ছেলে কালো না ধলা সেটা গুরুত্বপূর্ণ হবে না, যদি ছেলের ক্যারিয়ার হয় ঝলমলে? ছেলের যোগ্যতা যেহেতু তার কর্মে, তাই কন্যার মার প্রবল শর্ত- সাংবাদিক তো প্রশ্নই ওঠে না। পত্রিকার সাংবাদিক বাতিল, ক’টা পত্রিকা ঠিকমতো বেতন দেয়! টেলিভিশনের সাংবাদিক? ও তো শুধুই এক্সপোজার। সেই এক্সপোজার বরং তার মেয়ে নিজেই পেতে পারে। আজকাল নাকি টেলিভিশনে কাজ করার জন্য মেয়েদের মেধা নয়, সৌন্দর্যই একমাত্র কাম্য। ভাগ্য ভালো আমার, যে আমলে একুশে টিভিতে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম, সে আমলে মেধার দৌড়ে টেকার জন্য লিখিত, মৌখিক পরীক্ষাসহ, ক্যামেরার সামনেও পরীক্ষা দিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে টিকতে হয়েছিল। বাঘা বাঘা সুন্দরীদের ফেলেই জায়গা করে নিতে পেরেছিলাম মেধার জোরে। কিন্তু আজ নাকি সব চ্যানেলে সুন্দর মুখের জয়জয়কার। সে ঝলমলে মুখের মগজে মেধা না থাকুক, মুখে শুদ্ধ ও স্পষ্ট করে কথা বলার ক্ষমতা না থাকুক, জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান না থাকুকÑ সৌন্দর্য থাকতেই হবে। আর এখন মেকআপের গুণে সৌন্দর্য তো হাতের মুঠোয়। নকল চুল আর নকল পাপড়িতে হৃদয়ের ভাষা আজ ম্রিয়মাণ! মহিলার ভাষায়, সৌন্দর্যের ভিত্তিতেই যেহেতু যোগ্যতা নির্ধারণ হয় টেলিভিশনে, আর পাত্রী নিজেই সুন্দরী, তাই সাংবাদিক পাত্রের ভ্যালু নেই। অনিশ্চিত চাকরি আর সামান্য বেতনের সাংবাদিক তাই বাদ। ডাক্তার পাত্রের নাকি এখন আর দাম নেই। সরকারি ডাক্তারকে বাংলাদেশের কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে বদলি করবে! ঢাকাবাসী মেয়ের কি সম্ভব গ্রামে গিয়ে বসবাস? প্রাইভেট প্র্যাকটিসে চেম্বার করতে গিয়ে নাকি সংসার চুলোয় ওঠে! টাকা আছে, জীবন নেই! স্কুল, কলেজ শিক্ষক একেবারেই বাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেও চলবে না। তবে হ্যাঁ, শিক্ষক পাত্র যদি দেশের বাইরে যায়, তবে এ পাত্রকে লিস্টে রাখা যায়। বিবিএ, এমবিএ এর নাকি ইদানীং দাম পড়ে যাচ্ছে, ভূরি ভূরি সংখ্যায় বেড়ে যাওয়ার কারণে। আজকাল নাকি অফিস অ্যাসিস্টেন্ট হতেও বিবিএ, এমবিএ লাগে। তাই আপাতত বিবিএ, এমবিএও বাদ। সাদামাটা উকিল অবশ্যই নয়, ব্যারিস্টারি ডিগ্রি থাকলে তাও ভাবা যায়! কিন্তু পশার জমাতে চুল সাদা হয়ে যাবে না তো! ব্যবসায়ী? শুনতে যেন কেমন লাগে! আয় ব্যবসায়ীদের মতোই চাই, কিন্তু ব্যবসায়ী পাত্র মোটেই নয়। সরকারি চাকরিতে বেতন বাড়ার সুবাদে বিসিএসের দাম বেড়েছে বটে, কিন্তু কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হলে খুব ভালো হয়। বেতন? ওই মাসে দেড় দুই লাখের কম হলে কিন্তু চলবে না। ঢাকায় ছেলের বাড়ি অবশ্যই থাকতে হবে। ভাই বোন না থাকলে আরও ভালো। বড় ছেলে অবশ্যই নয়। ছেলের ওপর যেন নির্ভরশীল না হয় পিতৃ পরিবার। তার কন্যা যেন থাকে দুধে-ভাতে, ঝাড়া হাত-পা নিয়ে। এ যেন বিয়ের বন্ধন নয়, ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিট ইনভেস্টমেন্ট।

রোজ ডে, প্রপোজ ডে, চকলেট ডে, হাগ ডে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে! কত উৎসব-কত্ত প্রেম। আদৌ কি ভালোবাসা? আজকাল বিয়ে ভালোবাসা সব কমার্শিয়াল। এসব বাণিজ্যিক, ঝাঁ চকচকে লোক দেখানো আয়োজনে সব আছে, শুধু নেই ভালোবাসা।

বিয়ে যেন বন্ধন নয়, শর্তের লিস্ট। ভালোবাসা যেন অন্যকে আপন করে নেওয়া নয়, শুধুই শো অফ বা টাইম পাস! অথবা তরুণ প্রজন্মের ভাষায় কুল, সোয়্যাগ, জোস, প্যারা জাতীয় কিছু অর্থহীন শব্দ!

এত চাহিদা, এত জাঁকজমকপূর্ণ আদান-প্রদানে বিয়ে কি টিকছে? হলুদ সন্ধ্যা, মেহেদি সন্ধ্যা, সংগীত সন্ধ্যা, বিয়ে, বৌভাত নামক আমদানি করা শত আচার-অনুষ্ঠানের পরও দেড় দুই বছরের মাথায় ভেঙে যাচ্ছে বিয়ে। এত লোক দেখানো বিয়ে তখন হয়ে যায় কাদা ছোড়াছুড়ির আবর্জনা। জানেন কি, গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী শুধু ঢাকা শহরেই গত বছরে গড়ে প্রতি ঘণ্টায় একটি করে তালাকের আবেদন হয়েছে। তালাকের আবেদন সবচেয়ে বেশি বেড়েছে উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায়, প্রায় ৭৫ শতাংশ। দক্ষিণ সিটিতে বেড়েছে ১৬ শতাংশ। যদি গত ছয় বছরের হিসাব দেই, তাহলে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে অর্ধ লাখের বেশি তালাকের আবেদন জমা পড়েছে। এ হিসাবেই মাসে গড়ে ৭৩৬টি, দিনে ২৪টির বেশি এবং ঘণ্টায় একটি তালাকের আবেদন করা হচ্ছে।

রোজ ডে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে-এর গিফটের আদান-প্রদান, রাতভর ইমো, ভাইবার, ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট, ভিডিও কলের ভালোবাসা কোথায়, কেমন করে উড়ে যায়? কেন ফিকে হয়ে যায় প্রেমের উত্তেজনা! বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত সাত বছরে তালাকের প্রবণতা ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। জানেন কি, সবচেয়ে বেশি তালাক হয় কোন জেলায়? গণমাধ্যমের রিপোর্ট বলছে, সেটি হচ্ছে বরিশাল, গড়ে প্রতি হাজারে ২.৭ জন এবং সবচেয়ে কম চট্টগ্রাম ও সিলেটে। গড়ে প্রতি হাজারে ০.৬ জন। দুঃখজনক হচ্ছে তালাকের হার বেশি শিক্ষিত স্বামী-স্ত্রীদের মধ্যে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এই তথ্য শফী হুজুর পেলে আবার না জানি কোন প্রাগৈতিহাসিক ফরমান জারি করেন, কে জানে!!

ঠাট্টা নয়, কিন্তু এ যুগে বাংলাদেশে এখন তালাকের সবচেয়ে বড় কারণ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সমঝোতার অভাব। যৌতুকের দাবি, স্বামী বা স্ত্রীর সন্দেহবাতিকগ্রস্ততা, পরকীয়া, মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, পুরুষত্বহীনতা, এমনকি ফেসবুকে আসক্তি, স্ত্রীর অবাধ্যতা, ইসলামী শরিয়ত না মেনে চলা, বদমেজাজ, সন্তান না হওয়া বিভিন্ন কারণে প্রতিনিয়ত তালাক হচ্ছে।

যৌতুকবিরোধী প্রচারণা এবং এ সংক্রান্ত আইন সংশোধন করার পরও বছরের পর বছর যৌতুক সংক্রান্ত সহিংসতার ঘটনা বেড়েই চলেছে।

আইন বলে যৌতুক গ্রহণ, প্রদান বা যৌতুকে সহায়তা বা চুক্তি করলে কিংবা যৌতুক নিয়ে মিথ্যা মামলা করলে পাঁচ বছরের জেল ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা। এমন বিধান সত্ত্বেও মানবাধিকার সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৫ হাজার ৬৯৯ জন নারী যৌতুকসংক্রান্ত সহিংসতার শিকার হয়েছে। আর যৌতুকের কারণে হত্যাকা- ও আত্মহত্যার হারও বেড়েছে অনেক বেশি। সম্ভবত নারীর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা এবং সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এই চর্চা অব্যাহত থাকবে। এত আইন, এত প্রতিবাদ কিন্তু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন হয়েছে কি! বাংলাদেশে তিন তালাক নিষিদ্ধ হয়েছে দীর্ঘদিন। মুসলিম বৈবাহিক আইন অনুযায়ী ‘তালাকে আহসান’ এবং ‘তালাকে ইহসান’ পদ্ধতি আছে। ‘তালাকে তৌফিজ’ পদ্ধতি সবার জন্য বৈধ করে দেওয়া হয়েছে। যে পদ্ধতির বলে স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ তাদের বিয়ে ভাঙার ইচ্ছে প্রকাশ করতে পারেন। যদিও তিন মাসের মধ্যে মত পরিবর্তিত হলে সে তালাক আর কার্যকরী হবে না। কিন্তু আইনি মাধ্যমে ভালোবাসার বন্ধন ভাঙা-গড়ার এ খেলা কি জীবনে ভালোবাসার নিশ্চয়তার সুযোগ দেবে!

পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের দৌরাত্ম্যে নাকি মানুষ মূলত পলিগ্যামি বলে এক মানুষে ভালোবাসা ক্লান্তিকর হওয়ার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় আমরা সমাজটাকে ব্যাখ্যা করছি। আকাশ মিতুকে নিয়ে কত গালিগালাজ শুনলাম। আমরা কি আমার ঘর আমার বেহেশত বানাতে পেরেছি!

এত বিচ্ছেদ, এত তালাক! ভবিষ্যতের পৃথিবীতে বিবাহ বলে আদৌ কোনো প্রথা থাকবে কি? ভ্যালেন্টাইন্স দিবসের বাণিজ্যিক ভালোবাসার মতো, বিয়ে বিচ্ছেদও কি বাণিজ্যিক উপাদান হয়ে যাবে এক সময়? হয়তো একসময় ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র মতো ডিভোর্স ডে পালিত হবে বাণিজ্যিকভাবে! কে জানে!

তারপরেও দিন শেষে কেন জানি মনে হয়, চারদিকে ঈর্ষা, হিংসা, লোভের পৃথিবীতে এ বাণিজ্যিক চকমকি ভালোবাসারও প্রয়োজন আছে। হোক না লোক দেখানো। হোক না কিছু পণ্যের বেচাকেনা, হোক না কিছু শো অফ। লোক দেখানোর আয়োজনে অন্তত কিছুটা সময় তো আমরা বিরত থাকব অন্যের অমঙ্গল সাধনের কর্ম থেকে। নয়তো কবিগুরুর ভাষায়ই বলতে হবে, ‘ভালোবেসে সুখ যদি নাহি, তবে কেন...তবে কেন মিছে ভালোবাসা।’

            লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর