উরুয়েনা, স্পেন
বইপ্রেমীরা ছোটেন লাইব্রেরি, বইয়ের দোকানে। বই হাতে পেলে আর কিছুই চাই না তাদের। সারা বিশ্বে রয়েছে বইয়ের শহর। সেগুলোর একটি স্পেনের উরুয়েনা। ২০০ মানুষের বসবাস এই শহরে। দোকান আছে ১২টি! পর্যটকদের প্রিয় বইয়ের শহরও এটি।
স্পেনের মাদ্রিদ থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে মাত্র দুই ঘণ্টার দূরত্বে ক্যাস্টিলাই লিওন অঞ্চলে অবস্থিত এক শহর উরুয়েনা। এই শহরে জনসংখ্যা মাত্র ২০০ জন। মধ্যযুগীয় এই শহরটি পরিণত হয়েছে ‘ভিলা ডেল লিব্রো’ বা বইয়ের নগরীতে। এখানে রয়েছে ১২টি বইয়ের দোকান। এই ১২টি দোকানের মধ্যে কিছু দোকানে সব ধরনের বই পাওয়া যায়, যা সব বয়সীর জন্যই। আর কিছু দোকান বিখ্যাত শুধু পুরনো আর দুর্লভ বইয়ের জন্য। ক্যাসিলা লিওন নামের একটি জায়গায় শিশুদের জন্যও আলাদা বইয়ের ব্যবস্থা আছে। তারাও বই কিনতে গিয়ে, পড়তে গিয়ে কখনো নিরাশ হয় না। উরুয়েনায় ‘ইএল সেভেন’ নামের একটি দোকান আছে, যেখানে বিখ্যাত ‘ষাঁড়ের লড়াই’ বিষয়ক বই পাওয়া যায়। ‘দ্য সেলার’ নামের একটি জায়গায় পাওয়া যায় ওয়াইনবিষয়ক বই। এ শহরে প্রাচীন ক্যালিগ্রাফিগুলো শেখানোর জন্য কিছু প্রতিষ্ঠান আছে। কেউ চাইলে সেখানে অক্ষর লেখা শিখতে পারেন। মধ্যযুগে খুঁজে পাওয়া প্রাচীন বইগুলো থেকে এই লেখা শেখানো হয়। এ ছাড়া অনেকের বাড়িতে থাকা পুরনো বই ভালো করে বাঁধাই করে না রাখার কারণে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। উরুয়েনার কিছু জায়গায় কীভাবে বই বাঁধাই করতে হয়, কীভাবে মলাট করতে হয়, সেসব বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়ারও ব্যবস্থা আছে। উরুয়েনা শহরে আছে নানা ধরনের প্রাচীন বই আর ইতিহাসে ভর্তি মিউজিয়াম। এ ছাড়া রয়েছে স্থানীয় লোকাচার বিদ্যার স্কলার জাওকুইন দিয়াজ পরিচালিত মানবজাতিগুলোর বিজ্ঞানসম্মত বিবরণ নিয়ে মিউজিয়াম। ইতিহাস আর শিক্ষার প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ উরুয়েনা ২০০৭ সালে সিদ্ধান্ত নেয় ‘বইয়ের শহর’ হিসেবে নিজেদের পরিচিত করানোর। আন্তর্জাতিক বইয়ের শহরের খাতায় নিজেদের নাম লেখানোর পরই সবাই স্পেনের উরুয়েনাকে ‘বইয়ের শহর’ হিসেবে চিনতে শুরু করে। প্রতি বছর এই শহর অন্তত চল্লিশ হাজারেরও বেশি গ্রন্থানুরাগীকে পায়। বর্তমানে এ শহরের প্রাচীন গেট দিয়ে অন্তত ২১ হাজারেরও বেশি পর্যটক যাওয়া-আসা করে।
বিচরেল, ফ্রান্স
মাত্র ৭০০ মানুষের বসবাস ফ্রান্সের বিট্টলির বিচরেল শহরে। এ শহরে বইয়ের দোকান আছে ১৫টি। দেশ-বিদেশের সাহিত্য, ইতিহাস জানার জন্য এ শহরটি বেশ উপযোগী। বইয়ের এই দোকানগুলোর পাশাপাশি রয়েছে বেশ কিছু মাসিক বইয়ের দোকানও। স্থাপত্য ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত ফ্রান্সের রেনেস শহর থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম দিকে বিচরেলের অবস্থান। বিচরেলে দ্বাদশ শতাব্দীতে স্থাপিত দুর্গের কিছু ধ্বংসাবশেষ এখনো রয়ে গেছে। দুর্গটি স্থাপনের মধ্য দিয়ে এ শহরটির গোড়াপত্তন হয় আলাইন ডি ডিনানের হাত ধরে। পরে বিট্টনির সাংস্কৃতিক পরিষদের পরিচালক বার্নাড লে নেইল ছোট্ট এই শহরটিকে বইয়ের নগরীতে পরিণত করার পরিকল্পনা করেন। দুর্গটি বর্তমানে অব্যবহৃত অবস্থায় থাকলেও বই আর পর্যটকদের শহর হিসেবে সাজাচ্ছে বিচরেলকে সাজাচ্ছে অধিবাসীরা। বিচরেলকে ফ্রান্সের প্রথম বইয়ের শহর বলা হলেও ইউরোপে এটি তৃতীয়। বইয়ের শহর বলে এখানে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের বইয়ের অনুষ্ঠান হয়।
হে-অন-ওয়ে, ওয়েলস
পৃথিবীর সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে পুরনো বইয়ের নগরী ওয়েলসের হে-অন-ওয়ে। ১৯৬১ সালে রিচার্ড বুথ এই শহরকে নামকরণের পাশাপাশি বিশ্বের সর্বপ্রথম বইয়ের শহরে পরিণত করেন। ওয়েলস-ইংলিশ সীমান্তে অবস্থিত ছবির মতো সাজানো শহর হে-অন-ওয়ের উত্তরে রয়েছে ওয়ে নদী, দক্ষিণে ব্ল্যাক মাউন্টেইন, পশ্চিমে ব্রেকন বেকন আর পূর্বে রয়েছে চাষাবাদের জমি। বইয়ের শহর হে-অন-ওয়েতে রয়েছে অসংখ্য ব্যবহৃত বইয়ের দোকান। শহরের চারপাশ আর্ট-ক্র্যাফটের দোকান, দারুণ এন্টিক শপ আর বেশ ভালো মানের কিছু পোশাকের দোকান দিয়ে ঘেরা। প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার শহরটির দোকান আর রাস্তাগুলো যেন একেকটি মেলায় পরিণত হয়। নানা ধরনের মানুষের সমাগমে এলাকাটি হয়ে ওঠে বেশ জাঁকজমক। এখানে তারা বিনিময় করেন নানা ধরনের তথ্য। প্রতি বছরের মে ও জুন মাসে এখানে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় সাহিত্য উৎসব ‘হে সাহিত্য ও শিল্পকলা উৎসব’। উৎসবটি ১৯৮৭ সাল থেকে শুরু হলেও দিন দিন এর জনপ্রিয়তা আরও বাড়ছে। বর্তমানে এই অনুষ্ঠানে অন্তত আড়াই লাখ বইপ্রেমী পর্যটক অংশগ্রহণ করেন।
মান্ডাল, নরওয়ে
নরওয়ের মান্ডাল। এখানকার বেশির ভাগ দোকান তৈরি হয়েছে বিভিন্ন পরিত্যক্ত ভবনে। এ ভবনের মধ্যে রয়েছে ওয়েটিং রুম, মুদির দোকান, ব্যাংক আর পোস্ট অফিস। ১৯৯৫ সালে ‘বইয়ের শহর’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এ শহরটির অবস্থান নরওয়ের জস্টেডালসব্রিন হিমবাহের কাছে মধ্য ফিয়ারল্যান্ডে। ছোট্ট এ শহরটিতে অধিবাসীর সংখ্যা মাত্র ৩০০ জন। শহরটি ছোট হলেও এর প্রাচুর্যতা টিকে আছে বইকে ঘিরে। এ শহরের দোকান নিয়ে একটি কথা প্রচলিত আছে। যদি মান্ডালে থাকা সব বইয়ের তাককে এক সারি করা হয়, তবে এর পুরো দৈর্ঘ্য হবে ২ দশমিক ৫ মাইল লম্বা! বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এ শহরে বইয়ের দোকানগুলো খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। নরওয়ের বার্জেন শহর থেকে ২৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে মান্ডালের অবস্থান।
জিনবোচো, জাপান
জাপানের জিনবাচোতে বর্তমানে প্রায় ১৭০টির বেশি নতুন-পুরনো বইয়ের দোকান, প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান ও সাহিত্যিক সমাজ রয়েছে। এদের বেশির ভাগেরই অবস্থান ইয়াশুকুনি ও হাকুশান সরণির পাশে। নানা ধরনের ইংরেজি বইয়ের সংগ্রহ ছাড়াও এখানে রয়েছে জাপানের সবচেয়ে পুরনো ও দুর্লভ বইয়ের দোকান। টোকিওর জিনবাচো চিওডা অঞ্চলের একটি প্রতিবেশী এলাকা। এ এলাকায় বইয়ের দোকানের সমারোহ দেখার মতো। এখানে আপনি খুঁজে পাবেন সদ্য পাবলিশ হওয়া ভলিউম, নানা ধরনের একাডেমিক বইয়ের সংগ্রহ, আর্টের বই, পুরনো ম্যাগাজিন আর দুর্লভ আর অনেক পুরনো বই। ধরুন আপনি জাপানি ভাষা জানেন না। কিন্তু তবু যদি আপনি এখানকার বইয়ের দোকানগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে বই দেখেন, তবু আপনাকে কেউ কিছু বলবে না! ১৯১৩ সালে অধ্যাপক শিগেও আইওয়ানামি সর্বপ্রথম এ এলাকায় একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চালু করেন। তারপরই সময়ের নানা বিবর্তনে এখানে গড়ে ওঠে বিভিন্ন ধরনের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আর বইয়ের দোকান। বইপ্রেমীদের শহর হয়ে উঠতে এরপর আর বেশি সময় লাগেনি শহরটির।
সেইন্ট-পিয়ের-ডে-ক্লাজেস, সুইজারল্যান্ড
জেনেভা থেকে মাত্র ১৫০ কিলোমিটার পূর্বে সুইস পর্বতমালার কেন্দ্রে সুইজারল্যান্ডের ফ্রেঞ্চ ভাষাভাষী অংশটিতে ছোট্ট একটি সুন্দর শহর সেইন্ট-পিয়ের-ডে-ক্লাজেস। শহরটি একদম ছবির মতো সাজানো। দৃষ্টিনন্দন এই শহর ১৯৯০ সালে প্রথম ‘বইয়ের শহর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেইন্ট-পিয়ের-ডে-ক্লাজেস মূলত বিখ্যাত তার বই উৎসবের জন্য। এই শহরে প্রথমবারের মতো বই উৎসব আয়োজিত হয় ১৯৯৩ সালে। আর এরপর থেকেই প্রতি বছর আগস্টের শেষ সপ্তাহে এটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বই উৎসবে একত্র হন লেখক, সাহিত্যিক, বই প্রকাশকসহ প্রায় ১০০ জন। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসেন পনেরো হাজারেরও বেশি দর্শক। বইয়ের এ শহরে আপনি যে কোনো সময় বইয়ের দোকানে ঘুরে আসতে পারেন। যোগদান করা যায় প্রতি শনিবার অনুষ্ঠিত হওয়া সাহিত্য আড্ডাতেও। ছিমছাম এ শহরের প্রধান চত্বরে ১০টি বইয়ের দোকান রয়েছে। পুরনো প্রচুর বইয়ের সন্ধান এখানে পাওয়া তো যাবেই।