‘আরএমএস টাইটানিক’ জাহাজটির নাম শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ব্রিটিশ শিপিং কোম্পানি ‘হোয়াইট স্টার লাইন’-এর মালিকানাধীন জাহাজ; যা ১১২ বছর ধরে আটলান্টিক মহাসাগরের গভীরে সমাহিত রয়েছে। জাহাজ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের দাবিকৃত সেই ‘আনসিংকেবল টাইটানিক’ আজ কেবল এক করুণ নিয়তি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও বিলাসবহুল জাহাজটি ১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল প্রথম সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়ে সমুদ্রের তলে হারিয়ে যায়...
বিখ্যাত জাহাজ ‘আরএমএস টাইটানিক’। ‘আরএমএস’-এর অর্থ ‘রয়্যাল মেল স্টিমার’। ব্রিটিশ শিপিং কোম্পানি হোয়াইট স্টার লাইনের মালিকানাধীন জাহাজ ছিল এটি। বলা হতো, আনসিংকেবল টাইটানিক। অর্থাৎ টাইটানিক নাকি ডুবতে পারে না। কিন্তু টাইটানিক জাহাজটি তার প্রথম সমুদ্রযাত্রাতে এক করুণ পরিণতির মুখোমুখি হয়েছিল। ১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে গিয়েছিল টাইটানিক। ১৫১৭ জন প্রাণ হারান সেদিন। উদ্ধার করা গিয়েছিল ৭০০ জন যাত্রীকে। যাত্রীদের মধ্যে যারা দুঃখজনকভাবে মারা গেছেন, তারা তৎকালীন সময়ের কিছু ধনী এবং সবচেয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এর দীর্ঘ ৭৩ বছর পর ১৯৮৫ সালে যন্ত্রচালিত অনুসন্ধানের পর টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান একদল বিজ্ঞানী। রবার্ট বালার্ড নামক ফরাসি বিজ্ঞানী টাইটানিককে খুঁজে বের করেন। ২০২৪ সালে টাইটানিক ট্র্যাডেজির ১১২ বছর পূর্ণ হলো। এই বিখ্যাত ট্র্যাজেডি নিয়ে বেশ কয়েকটি বই এবং চলচ্চিত্র ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
১৯১১ সালের ৩১ মে ‘আরএমএস টাইটানিক’ প্রথমবারের মতো সমুদ্রে ভাসানো হয়
কেমন ছিল টাইটানিক?
টাইটানিকের পুরো নাম ছিল ‘আরএমএস টাইটানিক’। ব্রিটিশ শিপিং কোম্পানি হোয়াইট স্টার লাইনের মালিকানাধীন জাহাজ ছিল এটি। ইউনাইটেড কিংডম-এর বেলফাস্টের হারল্যান্ড ওলফ্ শিপইয়ার্ডে এটি তৈরি হয়েছিল। জন পিয়ারপন্ট মরগান নামক একজন আমেরিকান ধনকুবের এবং ইন্টারন্যাশনাল মার্কেন্টাইল মেরিন কোং-এর টাকায় ১৯০৯ সালে টাইটানিকের নির্মাণকাজ শুরু হয়। সেই সময় প্রায় ৭.৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে টাইটানিক তৈরি হয়েছিল। জাহাজের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৮৮২ ফুট দুই ইঞ্চি (প্রায় ২৬৯.১ মিটার)। আর প্রস্থ ছিল প্রায় ৯২ ফিট (২৮ মিটার)। জাহাজটির ওজন ছিল প্রায় ৪৬ হাজার ৩২৮ লং টন। সমুদ্রের জল থেকে জাহাজের ডেকের উচ্ছতা ছিল ৫৯ ফুট (১৮ মিটার)।
টাইটানিক কখন ডুবেছিল?
১৯১২ সালের ১০ এপ্রিলের ঘটনা। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জাহাজ টাইটানিক ক্যাপ্টেন অ্যাডওয়ার্ড জন স্মিথের নেতৃত্বে সাউদাম্পটন থেকে নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। ‘হোয়াইট স্টার লাইন’-এর বিলাসবহুল টাইটানিক নিউইয়র্ক সিটিতে তার প্রথম সমুদ্রযাত্রায় ১৪ এপ্রিল, ২৩:৪০ (জাহাজের সময়) বিশাল একটি আইসবার্গে (হিমশিলা) আঘাত করেছিল। ৮৮২.৫ ফুট লম্বা বিশাল টাইটানিক পরের দিন ১৫ এপ্রিল ০২:২০ (জাহাজের সময়) দুর্ঘটনার ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিট পরে ডুবে যায়। জাহাজের ভিতরে যে ফ্যাসিলিটি আর ডেকোরেশন ছিল, তা ফাইভ স্টার হোটেল থেকে কোনো অংশে কম না। বলা হয়েছিল যে, জাহাজটি তার ১৬টি আলাদা ওয়াটার টাইট আলাদা কম্পার্টমেন্টে ভাগ করা হয়েছিল। যার মধ্যে কমপক্ষে চারটি টিকে থাকতে সক্ষম। কিন্তু হিমশিলার সঙ্গে ধাক্কা লাগার পর পাঁচটি ওয়াটার টাইট কম্পার্টমেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং আকস্মিক এই সংঘর্ষের পরে বিশালাকার জাহাজটি আটলান্টিকে চিরতরে হারিয়ে যায়।
ক্যাপ্টেন অ্যাডওয়ার্ড জন স্মিথ
নৌ অফিসার- লিভারপুল, যুক্তরাজ্য
‘টাইটানিক’ ট্র্যাজেডিতে কতজন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল?
সংঘর্ষের দিন ডুবে যাওয়া টাইটানিক জাহাজটিতে সর্বমোট ২ হাজার ২২৮ জন যাত্রী ছিল। ডুবে যাওয়ার পর জাহাজে থাকা ১ হাজার ৫১৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। তথ্যসূত্র মতে, শেষ পর্যন্ত মাত্র ৭০৫ জন প্রাণে বেঁচে ফিরেছিলেন। যাদের বেশির ভাগ ছিলেন নারী ও শিশু। অপূরণীয় এই ক্ষতির কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, অপর্যাপ্ত লাইফবোটের কারণে হতাহতের সংখ্যা যতটা হওয়া উচিত ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছিল। একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৪৪ জন প্রথম শ্রেণির মহিলা যাত্রীর মধ্যে ৯৭.২২ শতাংশকে উদ্ধার করা হয়েছিল। যখন তাদের ১৭৫ পুরুষ সহযোগীদের মধ্যে মাত্র ৩২.৫৭ শতাংশ লাইফবোটের আশ্রয় পেয়েছিল। আর অন্যদিকে দ্বিতীয় শ্রেণির ১৬৮ জন পুরুষ যাত্রীর মধ্যে মাত্র ১৪ জন বেঁচে ছিলেন।
বেশির ভাগ মৃত্যু হয়েছিল ক্রু সদস্যদের অর্থাৎ ৭০০ জনের প্রাণহানি এবং তৃতীয় শ্রেণির যাত্রীদের মধ্যে ৫০০ জনের প্রাণহানি ঘটে।
যারা টাইটানিক ট্র্যাডেজিতে মারা গিয়েছিল তাদের কী হয়েছিল?
টাইটানিক ট্র্যাজেডির পাঁচ দিন পর ২০ এপ্রিল, জার্মানি থেকে আমেরিকার দিকে যাওয়া একটি জার্মান জাহাজ এসএস ব্রেমেন, টাইটানিকের খোঁজে যাত্রা করেছিল। তারা বর্ণনা করেছিল যে, জীবিত যাত্রীদের পুনরুদ্ধারে করতে গিয়ে তারা উত্তর আটলান্টিকের বুকে দরজা, বালিশ, চেয়ার, টেবিল এবং অসংখ্য হিমায়িত মৃতদেহ ভাসতে দেখেছিল। এটি টাইটানিক চলচ্চিত্রের হিমায়িত দেহের দৃশ্যের মতোই ছিল, যেখানে নায়িকা রোজ একটি দরজার সাহায্যে ভেসেছিলেন। ডুবে যাওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে উদ্ধারকারীরা মাত্র ৩০০ লাশ উদ্ধার করতে পেরেছিল। প্রথম শ্রেণির সব মৃতদেহ তীরে ফিরিয়ে আনা হয়। পরের কয়েক সপ্তাহে টাইটানিকের কিছু মৃতদেহ উপকূলে ভেসে যায়। অন্যদের সমুদ্রে সমাহিত করা হয়। জানা গেছে, পরের দিনগুলোয় অন্য জাহাজের কিছু যাত্রীও পানিতে মৃতদেহ ভেসে থাকতে দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। কত লাশ সমুদ্রে ভেসেছিল এবং কতজন ডেকের নিচে ডুবে মারা গেছে, তার সঠিক সংখ্যা আজও জানা সম্ভব হয়নি। যাই হোক মোট ১ হাজার ৫০০ জনের মধ্যে প্রাথমিকভাবে মাত্র ৩০০টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল এবং আরও শতাধিক জাহাজে পাওয়া গেছে। তবে এখনো প্রায় ১ হাজার ১০০ ভুক্তভোগী হিসাবের বাইরে রয়েছে।
তৎকালীন টাইটানিক জাহাজটি কখনো ডুববে না- কেন বলা হয়েছিল?
টাইটানিকের ডিজাইনার থমাস এন্ড্রু এবং নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের এই দাবির পেছনে আসলে কী কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন? এর মূল কারণ খুঁজে পাওয়া যায় টাইটানিকের নকশায়। মূলত দুটি কারণে টাইটানিককে বলা হয়েছিল আনসিংকেবল। প্রথমত, এই জাহাজের ভিতরে নিচের দিকে ‘ডাবল বটম হাল’ ছিল। অর্থাৎ এর মেইন যে বডি ছিল তার দুটি লেয়ার। এই দুই লেয়ার থাকার সুবিধা হচ্ছে, নিচে একটি যদি কোনো কারণে নষ্ট হয়েও যায়, তাহলে অন্য লেয়ারটির কারণে জাহাজটি ডুববে না। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, পুরো জাহাজের বডিকে ১৬টি আলাদা ওয়াটার টাইট আলাদা কম্পার্টমেন্টে ভাগ করা হয়েছিল। অর্থাৎ প্রত্যেকটি একটি আরেকটি থেকে আলাদা এবং মধ্যবর্তী যাতায়াতের দরজাগুলো ছিল ওয়াটার রেসিস্ট্যান্ট। এরকম কম্পার্টমেন্ট টাইটানিকেই প্রথম যুক্ত করা হয়, এর আগে কখনো কোনো জাহাজে এরকম কম্পার্টমেন্ট যুক্ত করা হয়নি। যদিও বর্তমানে বিশ্বের প্রতিটি জাহাজে এবং ডুবোজাহাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে এই কম্পার্টমেন্ট ব্যবস্থা। কোনো দুর্ঘটনায় জাহাজে পানি ঢোকা শুরু করলে ক্যাপ্টেনের আদেশে নৌযানের যে অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শুধু সেই অংশের কম্পার্টমেন্ট বন্ধ করে দিলে জাহাজের মধ্যে ঢোকা পানি শুধু জাহাজের একটি কম্পার্টমেন্টকেই পূর্ণ করবে, কিন্তু জাহাজের বাদবাকি অংশে পানি ঢুকতে পারবে না। এর ফলে জাহাজে বিশাল ছিদ্র থাকা সত্ত্বেও তা অনায়াসে পানিতে ভেসে থাকতে পারবে। তবে টাইটানিকের ক্ষেত্রে সেই ‘ওয়াটার রেসিস্ট্যান্ট কম্পার্টমেন্ট’ কিংবা ‘ডাবল বটম হাল’ কোনো কাজে আসেনি। কেননা, ধাক্কা লেগেছিল জাহাজের সামনের অংশে ডানদিকে।
তথ্যসূত্র : দ্য মার্জ
তারা সেই বিখ্যাত ব্যক্তি; যারা টাইটানিক ট্র্যাজেডিতে প্রাণ হারিয়েছেন...
১৯১২ সালের ১০ এপ্রিলের ঘটনা। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় এবং বিলাসবহুল জাহাজ ‘আরএমএস টাইটানিক’ ক্যাপ্টেন অ্যাডওয়ার্ড জন স্মিথের নেতৃত্বে সাউদাম্পটন থেকে নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা করেছিল। কিন্তু মাত্র কয়েকদিন পর- ১৪ এপ্রিল হিমশিলার সঙ্গে ধাক্কা লেগে আটলান্টিকের বুকে তলিয়ে যায়। আকস্মিক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৫১৭ জন প্রাণ হারান সেদিন। উদ্ধার করা গিয়েছিল ৭০০ জন যাত্রীকে। যারা সেই ট্র্যাজেডিতে মারা গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন অনেক বিশিষ্ট এবং বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। আজ জানব তেমনি কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তিদের গল্প, যারা ১১২ বছর আগে ‘টাইটানিক ট্র্যাডেজি’তে উদ্ধারকাজে সাহায্য করে প্রাণ হারিয়েছেন...
১. ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড স্মিথ
নাম ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড জন স্মিথ। যিনি ছিলেন তৎকালীন যুক্তরাজ্যের লিভারপুলের একজন নৌ অফিসার। কোটিপতি ক্যাপ্টেন হিসেবে তার ব্যাপক সুখ্যাতি ছিল। সমুদ্রযাত্রায় তিনি প্রায়শই ‘হোয়াইট স্টার লাইন’-এর সেরা জাহাজগুলোর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আর তাই তো জীবনের শেষ সমুদ্রযাত্রায়ও তিনি ‘আরএমএস টাইটানিক’-এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে, ‘আনসিংকেবল টাইটানিক’-এর প্রথম সমুদ্রযাত্রার পরে তিনি অবসর নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। টাইটানিক ট্র্যাডেজিতে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা বলেছেন, ক্যাপ্টেন স্মিথ যাত্রীদের প্রাণ বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি জাহাজের সঙ্গে সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যান। তবে অন্যান্য সূত্র বলছে, প্রাণহানি রোধে তিনি নিষ্ক্রিয় ছিলেন। তার কর্মকা- প্রায়শই ব্যাপক সমালোচিত হয়। তা সত্ত্বেও বিখ্যাত এই ক্যাপ্টেনের মৃত্যু সামুদ্রিক ট্র্যাডেজিগুলোর মধ্যে একটি দুঃখজনক ঘটনা হিসেবে ইতিহাসের পাতায় রয়ে যায়।
২. আইসিডর স্ট্রস
আইসিডর স্ট্রস ছিলেন টাইটানিক জাহাজে প্রাণ হারানো বিখ্যাতদের একজন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ব্যবসায়ী। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর মেসি’স-এর মালিকপক্ষের একজন। তিনি তার সহধর্মিণী ইডারকে নিয়ে টাইটানিকে ভ্রমণ করছিলেন। জানা গেছে, গৃহযুদ্ধের পর স্ট্রস-ইডার দম্পতির প্রথম দেখা হয়েছিল। তখন স্ট্রসের কোনো টাকা-পয়সা ছিল না। তিনি নিউইয়র্কে চলে যান এবং তার ভাইয়ের সঙ্গে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর মেসি’স-এ যাত্রা শুরু করেন। শুধু ব্যবসায়িক জগতে নয়, রাজনৈতিক জগতেও স্ট্রস ছিলেন পরিচিত মুখ। তিনি মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। বলা হয়, স্ট্রসকে লাইফবোটে যাওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি প্রথমে মহিলা ও শিশুদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য প্রস্তাবে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন। স্ট্রস তার স্ত্রীকে লাইফবোটে যাওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। ইডার তখন বলেছিলেন, ‘আমি আমার স্বামীর কাছ থেকে আলাদা হব না। একসঙ্গে বেঁচে আছি, মরবও একসঙ্গে।’ স্ট্রসের মৃতদেহ সমুদ্র থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। কিন্তু ইডারের মৃতদেহ আর পাওয়া যায়নি। তাদের প্রেমের গল্প সেই ট্র্যাজেডির মর্মান্তিক স্মৃতিগুলোর একটি।
৩. জন জ্যাকব অ্যাস্টর
জন জ্যাকব সম্ভবত তৎকালীন সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের একজন, যারা টাইটানিক প্রাণ হারিয়েছেন। তিনি ছিলেন জার্মান-আমেরিকান কোটিপতি এবং অ্যাস্টর পরিবারের সদস্য। তৎকালীন রিয়েল এস্টেট গ্রুপের মালিক। ধারণা করা হয়, ধনাঢ্য এই ব্যবসায়ী ৮৭ মিলিয়ন ডলারের মালিক ছিলেন। যা আজ ২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। অ্যাস্টর কেবল একজন ব্যবসায়ী ছিলেন না। ছিলেন একজন উদ্ভাবক, একজন ঔপন্যাসিক এবং একজন যোদ্ধা; যিনি স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি তার গর্ভবতী স্ত্রী ম্যাডোলিনের সঙ্গে টাইটানিকে ভ্রমণ করছিলেন। তার স্ত্রী ম্যাডোলিন বেঁচে যাওয়া ভাগ্যবানদের একজন। কিন্তু অ্যাস্টর ভাগ্যবান ছিলেন না। তাদের ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল- তার স্ত্রী যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের অনাগত সন্তানের জন্ম দিতে পারেন। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। সেদিন দুর্ঘটনায় লাইফবোটে নারী ও শিশুদের অগ্রাধিকার বেশি দেওয়া হয়েছিল। আর তাই গর্ভবতী স্ত্রীকে তিনি লাইফবোটে তুলে দেন।
৪. টমাস অ্যান্ড্রুজ
তিনি ছিলেন ‘আনসিংকেবল টাইটানিক’-এর প্রধান প্রকৌশলী। যিনি টাইটানিকের নকশা করেছিলেন। জানা গেছে, জাহাজের প্রথম যাত্রার সময় প্রকৌশলীদের জন্য জাহাজের কার্যকারিতা মূল্যায়ন এবং সমস্যাগুলো নোট করা ছিল একটি সাধারণ বিষয়। তাই তিনি টাইটানিকের সাওয়ারি হয়েছিলেন। তিনি টাইটানিকের বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন, যিনি জাহাজটিকে তার সেরা কাজ বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু হিমশিলার সঙ্গে সংঘর্ষের পরপরই জাহাজের ভাগ্য বুঝতে পারেন। বলা হয়, শেষ অবধি তার ক্রিয়াকলাপ ছিল বীরত্বপূর্ণ, কারণ তিনি যাত্রীদের বেঁচে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে যারপর নাই চেষ্টা করেছিলেন। যাত্রীদের সরিয়ে নিতে তিনি জাহাজের বিভিন্ন অংশে তল্লাশি চালিয়েছিলেন। যাত্রীরা আরও দাবি করে যে, তিনি সাগরে চেয়ার ছুড়ে ফেলেছিলেন যাতে লোকেরা তার ওপর ভেসে থাকতে পারে। যদিও কিছু সূত্র বলছে যে, শেষ মুহূর্তে তিনি আসলে ধূমপান করছিলেন। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠরা বলছেন, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি সবাইকে সাহায্য করেছিলেন। তিনি একজন নায়ক হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
৫. বেঞ্জামিন গুগেনহেইম
তিনি ছিলেন ধনাঢ্য গুগেনহেইম পরিবারের সদস্য। একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, যিনি তার বিলাসী জীবনযাপনের জন্য পরিচিত ছিলেন। তিনি খনি উদ্যোক্তা মেয়ার গুগেনহেইমের পঞ্চম পুত্র। বেঞ্জামিন তার স্ত্রী লিওনটাইন আউবার্ট, ভ্যালেট ভিক্টর গিগলিও, চাউফার রেনে পার্নোট এবং আউবার্টের দাসী এমা সেগেসারকে নিয়ে টাইটানিক জাহাজে ভ্রমণ করছিলেন। টাইটানিক যখন প্রথম হিমশিলার সঙ্গে ধাক্কা খয়, বেঞ্জামিন তখন এটিকে ছোট দুর্ঘটনা মনে করেছিলেন। কিন্তু শিগগিরই তার ধারণা আতঙ্কে রূপ নেয়। তিনি বুঝতে পারলেন যে, জাহাজটি সত্যিই ডুবে যাচ্ছে। যখন টাইটানিক ডুবে যাচ্ছিল, গুগেনহেইম তার সেরা পোশাক পরেছিলেন। তার পরিবারের সদস্যদের বলেছিলেন, ‘আমরা আমাদের সেরা পোশাক পরেছি এবং ভদ্রলোকের মতো নিচে যাব।’ তিনি উদ্ধারকাজে প্রতিটি সেকেন্ড ব্যয় করেছিলেন, যাতে মহিলা এবং শিশুরা নিরাপদে লাইফবোটে নেমে যেতে পারে। তিনি একজন বেঁচে যাওয়া লোকের মাধ্যমে তার স্ত্রীর কাছে শেষ বার্তা পাঠিয়েছিলেন যে, ‘তাকে বলুন আমি শেষ পর্যন্ত লড়েছি। এই জাহাজে কোনো মহিলাকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। কারণ তিনি কাপুরুষ নন।’ দুর্ভাগ্যবশত, তার লাশ উদ্ধার করা হয়নি।
৬. আর্চিবল্ড বাট
মেজর আর্চিবল্ড বাট ছিলেন একজন মার্কিন সেনা কর্মকর্তা। ১৯০৮ সাল থেকে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম হাওয়ার্ড টাফ্ট এবং থিওডোর রুজভেল্টের সামরিক সহায়ক হিসেবে কাজ করছিলেন। এই সেনা কর্মকর্তা ছয় সপ্তাহের ছুটি কাটিয়ে টাইটানিকে চড়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছিলেন। জানা গেছে, টাইটানিক যখন ডুবে যাচ্ছিল, বাট বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও শৃঙ্খলা বজায় রেখে লাইফবোটে নারী ও শিশুদের তুলে দিতে সাহায্য করেছিলেন। অনেকে বলেছেন যে, তাকে অনেক পুরুষ যাত্রীদের হুমকি দিতে দেখা গেছে যারা জাহাজের ‘মহিলা এবং শিশুদের’ আগে প্রোটোকল উপেক্ষা করার চেষ্টা করেছিল। তার স্মৃতিচারণের সময়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট টাফট শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেছিলেন, ‘আর্চি যদি মৃত্যুর জন্য একটি সময় বেছে নিতে পারতেন তবে তিনি নিজেকে বেছে নিতেন যা ঈশ্বর তাকে দিয়েছেন। তার জীবন কেটেছে আত্মত্যাগে, অন্যের সেবায়। তাকে যারা চিনতেন সবাই তাকে আর্চি বলে ডাকতেন। এখানে বলার জন্য আমি আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে আসিনি। আমি চেষ্টা করেছি কিন্তু পানিনি। সে আমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিল।’ দুর্ভাগ্যবশত তার লাশ পাওয়া যায়নি।
৭. জ্যাক ফুট্রেল
তিনি একজন অত্যন্ত সফল রহস্যময়ী লেখক। যিনি টাইটানিকে হতাহতের মধ্যে সুপরিচিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। নিউইয়র্ক হেরাল্ড এবং বোস্টন পোস্টের মতো পত্রিকায় কাজ করেছিলেন। যদিও সেগুলো আজ বিলুপ্ত। জনপ্রিয় এই লেখক ‘প্রফেসর অগাস্টাস এস.এফ.এক্স ভ্যান ডুসেন’ নামক কাল্পনিক গল্পের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত ছিলেন। যা ‘দ্য থিংকিং মেশিন’ নামেও পরিচিত। টাইটানিক ভ্রমণে ফুট্রেলের সঙ্গী ছিলেন তার স্ত্রী মে ফুট্রেল। যখন জাহাজটি হিমশিলার সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছিল। ফুট্রেল তার স্ত্রীকে একটি লাইফবোটে তুলে দেন। তার স্ত্রী বেঁচে গিয়েছিলেন। তার স্ত্রী মনে রেখেছেন যে, তিনি শেষবার তাকে জন জ্যাকব অ্যাস্টরের সঙ্গে ডেকের ওপর ধূমপান করতে দেখেছিলেন। একই বছর তিনি মারা যাওয়ার পর তার বই ‘মাই লেডিস গার্টার’ প্রকাশিত হয়েছিল। বইটিতে তার ছবির নিচে একটি লাইন যোগ করে তার স্ত্রী লিখেছিলেন, ‘টাইটানিকের নায়কদের উদ্দেশে, আমি আমার স্বামীর লেখা বইটি উৎসর্গ করছি। দুর্ভাগ্যবশত তার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
৮. হেনরি বি. হ্যারিস
হেনরি ছিলেন একজন সফল আমেরিকান ব্রডওয়ে প্রযোজক, থিয়েটার মালিক। তার সুপরিচিত কাজের মধ্যে রয়েছে ‘সোলজারস অব ফরচুন’, ‘স্ট্রংহার্ট’ এবং ‘দ্য থার্ড ডিগ্রি অ্যান্ড স্ট্রংহার্ট’। তিনি ইউরোপ সফরের পর তার স্ত্রী রেনিকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার পথে টাইটানিকে ভ্রমণ করেছিলেন। টাইটানিক ডুবে যাওয়ার সময় রেনি তার হাত ভেঙে ফেলেছিলেন। তিনি তার স্বামী হ্যারিসকে ফেলে যেতে চাননি, তবে তিনি দাবি করেন ‘হ্যারি তাকে তুলে নিয়ে একজন নাবিকের বাহুতে ফেলে দেয় এবং তারপর একটি কম্বল ফেলে দেয়। যা সে কয়েক ঘণ্টা ধরে আমাকে প্রচণ্ড ঠান্ডা থেকে রক্ষা করেছিল। রেনি বেঁচে গিয়েছিলেন, কিন্তু হেনরি আর ফেরেননি। রেনি তার স্বামীর কাজ গ্রহণ করেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম মহিলা নাট্য নির্মাতাদের একজন হয়েছিলেন। দুঃখের বিষয়, হ্যারিসের লাশ পাওয়া যায়নি।
৯. উইলিয়াম টমাস স্টেড
তিনি তৎকালীন একজন বিখ্যাত অনুসন্ধানী সাংবাদিক এবং একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক ছিলেন। তাকে প্রায়ই ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বিখ্যাত সাংবাদিক’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি শান্তি সম্মেলনে যাওয়ার সময় টাইটানিকে ভ্রমণ করেছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি শান্তি এবং সামাজিক সংস্কারের জন্য উকিল হিসেবে কাজ করেছিলেন। তিনি শিশু পতিতাবৃত্তির বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। তিনি জুলিয়াস ব্যুরো নামে পরিচিত একটি ম্যাগাজিনও প্রকাশ করেছিলেন। তিনি একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তি ছিলেন। বলা হয় যে, টমাস স্টেড নাকি তার কাল্পনিক গল্পে টাইটানিকের ডুবে যাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণীও করেছিলেন। ১৮৮৬ সালে, তিনি একটি গল্প লিখেছিলেন, যা টাইটানিক ট্র্যাজেডির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, অপর্যাপ্ত লাইফবোটের কারণে ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃখজনক সামুদ্রিক বিপর্যয় ঘটবে। গল্পটির নাম ছিল ‘হাউ দ্য মেইল স্টিমার ওয়েন্ট ডাউন ইন মিড আটলান্টিক বাই অ্যা সারভাইভার।’ এতে লাইফবোটের ঘাটতির কারণে জাহাজে থাকা মূল ৭০০ জনের মধ্যে মাত্র ২০০ জন যাত্রী এবং ক্রু সদস্য জাহাজটি ডুবে যাওয়া থেকে বেঁচে যায়। শেষ সময় জাহাজের কেবিনে কাটিয়েছেন।
১০. জন থায়ার
জন থায়ার তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শক্তিশালী কোম্পানি পেনসিলভানিয়া রেলরোডের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। থায়ের তার পরিবারের সঙ্গে ভ্রমণ করছিলেন। তার স্ত্রী ও ছেলে বেঁচে গেলেও তিনি বেঁচে ফেরেননি। তারা বার্লিন ভ্রমণ শেষে ফেরার পথে টাইটানিকে ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি তার স্ত্রী এবং ছেলেকে লাইফবোটে তুলে দিয়েছিলেন। জানা গেছে, সমস্ত লাইফবোট চলে যাওয়ার পরে থায়ারকে ‘দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’ দেখাচ্ছিল। তার পুত্র জন থায়ার জুনিয়র, তার বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে একটি স্মৃতিকথা লিখেছিলেন। জন থায়ারের দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি।