আত্মবোধের উত্থান নজরুলের সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটি লক্ষণীয় বিষয়। তাঁর এ আত্মসত্তার জাগরণে তিনি সমসাময়িক কালকে যেমন ধারণ করেছেন, তেমনি তাঁর বাণী ও দর্শন, তাঁর চিন্তা ও চেতনা কালকে অতিক্রম করে গেছে বার বার। তিনি উদ্ভাসিত হয়েছেন অপূর্ব মহিমায়। তিনি যেমন সময়কে ধারণ করেছেন, তেমনি পরবর্তীকালে সময় তাঁকে ধারণ করেছে। অবলীলায় জেগে উঠেছেন নজরুল সময়ের প্রয়োজনে। সময়ের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে নজরুল চেতনার উন্মেষ, উত্থান ও জাগরণের তীব্রতা সৃষ্টি করেছে। নজরুল বহু বছর পরেও হয়ে ওঠেন প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। নজরুলের কবিতা বা গানের যে অন্তঃস্থিত বাণী, যে শক্তির প্রাবল্য, তা যে কোনো আন্দোলন, প্রতিবাদ, অধিকার আদায়ের সংগ্রামী চেতনার উৎসকেন্দ্র হয়ে ওঠে। তাই সময়ে সময়ে কালে কালে বাঙালির জনমানসে জীবন্ত প্রতিভূ হয়ে ওঠেন নজরুল। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, নজরুল চিরতরুণ। তরুণ এবং তারুণ্যের সঙ্গেই নজরুলের একসত্তা একপ্রাণ একবন্ধন। তরুণরাই নজরুলকে ভালোবেসেছে সবচেয়ে বেশি। তরুণরাই উদ্বেলিত হয়েছে বার বার, উত্থিত হয়েছে বার বার, সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে বার বার। তখন নজরুল অনিবার্য।
নজরুল তাঁর সৃষ্টির মধ্যে নানা বিষয়কে উপজীব্য করে তুলেছেন। প্রকৃতি, প্রেম, মানবতা এবং জীবনের নানা বিষয়কে আলোকপাত করেছেন তাঁর কাব্যমূল্য, সাহিত্যমূল্য, সংগীতমূল্য চিরন্তন ও শাশ্বত; কিন্তু তাঁর রুদ্ররূপ তাঁকে দিয়েছে অসামান্য উচ্চতা। প্রখর উত্তাপ আর বিপুল উজ্জ্বলতা। আর এ উচ্চতা দিয়েছে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। মানুষ নিজের প্রয়োজনেই নজরুলমুখী হয়েছে। নজরুল যেন মহাশক্তির আধার তাই মানুষের জাগরণে, ন্যায়ের সংগ্রামে বিপুল বিস্তারী সাহস, অমিত শক্তির তেজোদীপ্ততা নজরুলের কাছ থেকেই নিতে হয়, এ যেন অনিবার্য। নজরুল বিদ্রোহী ও ভাঙ্গার গান কবিতা লিখেছেন ১৯২১ সালে। সে সময়ে ব্রিটিশ ভারতের পরাধীন জাতির কাছে এ কবিতা দুটি যেন নবলোকের ঊষ্ণধারায় উত্তপ্ত করে তোলে জনচিত্ত। তাই নজরুল প্রণম্য হয়ে ওঠেন প্রতিভূ হয়ে ওঠেন জনমানুষের। তাঁকে হুলিয়া নিয়ে পালিয়ে থাকতে হয়, জেলেও যেতে হয়। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে নজরুল ৫২ থেকেই ব্যাপক চর্চিত হয়েছেন অজস্র ঘটনা প্রবাহে। ১৯৬৯ সালে বাঙালির ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান বাঙালি জাতিকে দিয়েছে নব প্রেরণা, নবশক্তি, নতুন দিশা। গণ-আন্দোলনের নবধারা, নবরূপ, উত্থান বাঙালি জাতির অস্তিত্ব, চেতনা, নিজ অধিকার এবং অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে। সে সময় আন্দোলন নতুন মাত্রা পায় দেশব্যাপী এক বিশাল জনঅভ্যুত্থান বাঙালির নতুন ইতিহাস তৈরি করে। সারা দেশ ছিল উদ্দীপিত-উত্তপ্ত প্রবল বিক্ষোভ আর সাহসের। বহু মানুষ শহিদ হন। সে সময়ের পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
ইতিহাস সৃষ্টিকারী ওই গণ-অভ্যুত্থান নজরুলের গান ও কবিতা ক্ষুব্ধ জনতার অন্তর প্রেরণায় নজরুলের ভাঙ্গার গান কবিতাটি গান হিসেবে আন্দোলনের প্রাণময় শক্তি হয়ে ওঠে। গানটি হলো- ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট/ রক্তজমাট শিকল-পুজোর পাষাণ বেদি/ ওরে ও তরুণ ঈশান/ বাজা তোর প্রলয় বিষাণ/ ধ্বংস-নিশান/ উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।’ কুমিল্লাতে ইতিমধ্যে কবি বন্দিশালার অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন গ্রেপ্তার হয়ে। কবিতাটি পরে সুরারোপ করে গানে রূপান্তরিত হওয়ার পর ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এ গানের সঙ্গে নৃত্য রূপায়ণ পরিবেশনা জনচিত্তে প্রবলভাবে দোলা দেয়। একই সঙ্গে বিদ্রোহী কবিতাও চর্চিত হয় মহাশক্তির প্রলয়ংকর রূপ নিয়ে। ‘বল বীর- / বল উন্নত মম শির/ শির নেহারি আমারি, নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রির/ বল বীর/ বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ ভূলোক দুলোক গোলক ভেদিয়া, খোদার আসন আরশ ছেদিয়া/ উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর/ মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ¦লে রাজ রাজটিকা দীপ্ত জয়শ্রীর/ বল বীর/ আমি চির উন্নত শির’, ‘বিদ্রোহী’- নামে এই ১৪১ পঙ্ক্তির কবিতাটি ভাঙ্গার গানের কয়েকদিন আগেই লেখা ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে। এ কবিতায় কবি মহাশক্তি রূপে মানবসত্য আবিষ্কার করেছেন ‘আমি’ এখানে মানবজাতির প্রতিভূ, মানবতার সত্য শক্তির উদ্বোধন করেছেন। এ ‘আমি’র মধ্য দিয়ে কবি আত্মবোধের তীব্র প্রকাশ ঘটিয়েছেন এ ‘আমি’ তখন আর ‘আমি’ থাকে না, সমগ্র মানব সত্তার প্রতিনিধি হয়ে যায়। এই মহাশক্তিই মহামানবের মহাকালের যাত্রায় অসম্ভব শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে প্রলয়ংকরী হয়ে উঠেছে। মহাশক্তির মহাকল্লোল মহাধ্বনি রূপে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। মহাকালে মহাবিশ্বের বৈশি^ক প্রেক্ষাপট এবং স্থানিক প্রাসঙ্গিকতা এ কবিতার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সুতরাং বিশ্বজনীন মানবীয় আবেদন প্রবলভাবে উচ্চকিত হয়েছে।
’৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান যেন স্বাধিকার থেকে মহান স্বাধীনতার যাত্রায় প্রথম পর্ব। যার ফলে ১৯৭১ সালের বাঙালির অবিস্মরণীয় ইতিহাস প্রকম্পিত করে সারা বিশ্ব। আর এ প্রকম্পণের নেপথ্যে নজরুলের গান ও কবিতা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধার অন্তরপ্রেরণায় নজরুল দারুণভাবে জেগে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীর মনে দারুণ উদ্দীপনা সাহসের প্রলয় তৈরি হয়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আবৃত্তি, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গান, ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম মোরা ঝর্ণার মতো চঞ্চল/ মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়, মোরা প্রকৃতির সচ্ছল’ এ ছাড়া কবির ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতাটিও শক্তির আহ্বান কবিতাটি গানে রূপান্তরিত হয়ে শৌর্য-বীর্যের বিশাল আবেদন সৃষ্টি করে। ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর, তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখীর ঝড়/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ আসছে এবার অনাগত প্রলয় নেশার নৃত্য পাগল/ সিন্ধুপারের সিংহদ্বারে ধমক হেনে ভাঙ্গলো আগল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নজরুলের অনেক গান, কবিতা ও প্রবন্ধ উচ্চারিত হয় সে সময়। বাংলার প্রকৃতি নিয়ে ভালোবাসার চিত্র আঁকেন নজরুল- ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী-জননী/ ফুল ও ফসলে কাদামাটি জলে ঝলমল করে লাবণী’। কবির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অপূর্ব সৃষ্টি- ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান/ মুসলিম তার নয়নমনি হিন্দু তাহার প্রাণ।’ কবি দেশকে নিয়ে মাতৃভূমি নিয়ে আবেগ প্রবণ হয়েছেন- ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি’ কবি সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত বীরত্বগাথা তৈরি করেছেন গানে, ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার/ ওহে লঙ্ঘিত হবে রাত্রি নিশিথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার’। এভাবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে মুক্তিযুদ্ধে নজরুল তুমুলভাবে আলোড়িত ও জাগ্রত হয়েছেন। তাঁর আরও লেখায় বাংলাদেশ নামটি ব্যবহার করেছেন বহুবার বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, নজরুল একদিকে যেমন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মহান পুরুষ অন্যদিকে ঐক্যবদ্ধ-শক্তিবদ্ধ বাঙালি জাতিসত্তা নির্মাণে একক মহান উদ্গাতা।
স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে যে উত্থান গণ-জোয়ার তৈরি হয়েছিল ১৯৯০ সালে সেখানেও নজরুল সরব। সেখানেও নজরুলের সৃষ্টি উন্মাদনা জাগিয়েছে, প্রাণ জাগিয়েছে। তারুণ্যের জয়গান অবলীলায় বেজে উঠেছে। সব শেষে ২০২৪ সালে বাংলাদেশে, দুঃশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যে অভূতপূর্ব জনউত্থান সৃষ্টি করেছে সেখানেও নজরুলের সৃষ্টি ছাত্রদের ভয়হীন করেছে, নির্ভীক করেছে, বাধাহীন করেছে। বিপুল ত্যাগ ও সাহসের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতা সরকারের পতন ঘটিয়েছে। এ আন্দোলন-সংগ্রামে নজরুলের গান ও কবিতা মিছিলে সমাবেশে বার বার উচ্চারিত হয়েছে, বিস্ফোরিত হয়েছে তারুণ্য। নজরুল সব সময় অসাম্যের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, নীতিহীনতার বিরুদ্ধে আর এ আন্দোলনে এ বিষয়গুলোই প্রণোদনা শক্তিরূপ উদ্দামতা সৃষ্টি করেছে। চলেছে শক্তির আরাধনা আর তাই তরুণরা হয়েছে দৃঢ়-অবিচল- শক্তিধর এক বিশাল তরঙ্গ। নজরুলের গান ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, মোরা ঝর্ণার মতো চঞ্চল এবং তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা যেন অযুত স্রোতের ধারায় আশ্চর্য প্রেরণা শক্তি। সৃষ্টি করে উত্তাল তরঙ্গের শক্তিনির্ভর প্রকাশ।
একইভাবে আরেকটি বিষয় প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ করার মতো তাহলো পশ্চিমবঙ্গের তিলোত্তমা ধর্ষণ ও নির্মম বীভৎস হত্যাকান্ড। এখানেও কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ, এমনকি সারা ভারতে বিশাল প্রতিবাদ, উত্তাপ-উত্তেজনায় কাঁপছে ভারত। পশ্চিমবঙ্গের এই নারকীয় ঘটনায় এর আগে সাধারণ জনগণের এতবড় স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন আর কখনো দেখা যায়নি। সেখানেও রাস্তায় রাস্তায় ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানের সঙ্গে সংগ্রামী, নৃত্য লক্ষণীয়। পাশাপাশি বলবীর বল উন্নত মম শির’ আবৃত্তি, গান- মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, যে প্রাণশক্তি জুগিয়ে যাচ্ছে তা অবিস্মরণীয়। দেখা যায়, সেখানেও নজরুলই উজ্জীবন ও প্রেরণা শক্তি। সেখানেও নজরুল জীবন্ত।
এর আগে ভারতের সুরকার এ আর রহমান ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানটির প্রচলিত সুর বিকৃত করায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল বাঙালির মধ্যে অর্থাৎ দুই বাংলাতে প্রবল প্রতিরোধ মুখর হয়। প্রতিবাদের তীব্রতায় এ আর রহমান হার মানতে বাধ্য হন। এতে বোঝা যায়, নজরুলের গান ও সুর, জনগণের মাঝে কত প্রিয়, নজরুল কত স্পর্শকাতর।
নজরুল বাঙালির কবি, বাঙালির পথ-নির্দেশক শক্তি ও প্রেরণার উৎস। প্রতিবাদের অবলম্বন উদ্দামতার জন্য নজরুল, সাহসী চেতনার জন্য নজরুল, অধিকারের প্রশ্নে নজরুল জনবিস্ফোরণের জন্য, ন্যায় সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নজরুলের কাছে যেতেই হয়। নজরুল জেগে ওঠেন বার বার শৌর্য-বীর্য ও গৌরবে। বাঙালির সংকটে-সংগ্রামে-উত্তরণে অনিবার্য হয়ে ওঠেন নজরুল।