জন্মের পর যেদিন প্রথম শুনতে পেলাম, ‘অতি ছোট হয়ো না ছাগলে খাবে পাতা, অতি বড় হয়ো না ঝরে যাবে মাথা।’ বাক্যটা শোনার পর শিরায় শিরায় মেঘলা আকাশ ছোটাছুটির মতো টেনশনের উপসর্গগুলো ঘুরপাক খেতে লাগল। পৃথিবীতে কত কিছুর জন্ম হয়। পুরাণ শাস্ত্রে বলা আছে- চুরাশি লাখবার জন্মগ্রহণের পর মানব জন্ম হয়। আর মানব জন্মই শ্রেষ্ঠ জন্ম। আমি পাতা হয়ে জন্মগ্রহণ করেছি। পাতা হয়ে জন্মগ্রহণের আগে কত লাখবার জন্মগ্রহণ করেছি, তার হিসাব জানি না। আর কত লাখবার জন্মগ্রহণ করলে মানব জন্মগ্রহণ করব, সেটাও আমার অজানা। তবে পাতা হয়ে জন্মগ্রহণের পর একটা জিনিস লক্ষ্য করছি, পৃথিবীর প্রায় সব গাছের পাতা সবুজ। তা দেখে আমি হইনি অবুঝ। অথচ মানব জন্মে কত বিচিত্র রূপ। তবে টেনশনে পড়েছি নিজের মৃত্যু নিয়ে। টেনশনের কারণ হলো, গাছের ডাল থেকে ঝরে গিয়ে অপ্রিয় কোথাও পড়ে নিজের পাতা জনমের পরিসমাপ্তি টানতে হয় কিনা! শুধু ফাঁসির আসামির শেষ ইচ্ছা থাকে না, মানব জন্মে প্রতিটি মানুষ মরার আগে শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে চায়। আমারও শেষ ইচ্ছা আছে। যেখানে সেখানে পড়ে মরলে তো জন্মের সার্থকতা আসবে না, শেষ ইচ্ছা পূরণ হবে না। ইদানীং কেন যেন নির্দিষ্ট বয়সের আগেই আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার টেনশন আমাকে ঘিরে ধরেছে।
আগুনে পোড়ার চেয়ে কচিপাতা অবস্থায় ক্ষুধার্ত ছাগলের পেটে গিয়ে মরলেও শান্তি পাব। তবুও আগুনে পড়ে মরতে চাই না। আগুনে পুড়ে মরার কথা মনে হলে লজ্জাবতী গাছের পাতা স্পর্শ করার মতো মৃত্যুর স্পর্শের অনুভূতিতে ভয়ে নিজের মনকে গুটিয়ে ফেলি। প্রচন্ড ঝড়েও আমি যদি উড়ে গিয়ে নদ-নদীতে পড়ি, তাহলে আমার সবুজ শরীর ঠুকরে ঠুকরে খাবে ক্ষুধার্ত মাছ। তাদের ক্ষুধা নিবারণ হবে। আমার শরীর অন্যের উপকারে আসতে পারবে, তাতে আমি খুশিই হব।
কিছু মানুষ যেমন মৃত্যুর আগে ‘মরণোত্তর দেহদান’ ঘোষণা করে যান- মৃত্যুর পর তার দেহ অন্যের জন্য কাজে লাগবে- তাই আমিও ভাবি মৃত্যুর পর মাছও যদি আমার সবুজ শরীর খেয়ে বেঁচে থাকে, তাতে আমি দেহদান করা মানুষের মরে যাওয়ার মতো এক ধরনের শান্তি নিয়ে মরতে পারব, মরে গিয়েও শান্তি পাব। কিন্তু কে কীভাবে মৃত্যুবরণ করবে তা কেউ জানে না। যারা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের মূল্যবান মানবজীবন ধ্বংস করে দেয়, তারা জানে। কিন্তু এ মানুষগুলো বিবেকহীন বোকা মনে হয় আমার কাছে। পাতার জীবনে আমাদের অনেক সময় অকালে ঝরে যেতে হয়! কিন্তু মানুষ নিজেকে তার মনুষ্যত্ববোধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না? যদি চুরাশি লাখবার জন্মগ্রহণ শেষে মানব জন্মগ্রহণের সুযোগ আসে, তাহলে যে মানুষ, মানবজনম উপভোগ না করে নিজেকে শেষ করে দেয়; তার চেয়ে বোকা আর কি দুনিয়ায় আছে?
একজন মানুষ জন্মগ্রহণের পর তাকে বিবেক, আবেগ-অনুভূতি সব দিয়ে থাকেন সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু সে কেন পরিবেশ-পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না? না পারার কারণটা কী? আমি যখন মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণের সুযোগ পাব, তখন যেন নিজের বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আর মানুষ হয়ে যেন মানুষের উপকারে আসতে পারি। জানি না, এখন পর্যন্ত কত লাখবার জলজীব, গাছপালা, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি হয়ে জন্মগ্রহণ করেছি; আর কোন স্তরে কত লাখবার জন্মগ্রহণ থেকে দূরে আছি। আর কতবার যে মৃত্যু হয়েছে তারও সঠিক তথ্য জানি না। পূর্ব জনমের কোনো স্মৃতি আমার মনে নেই। থাকলে হয়তো বলতে পারতাম কত লাখবার জন্মগ্রহণ করেছি। আর কতবার জন্মগ্রহণ করলে মানবকুলে জন্মগ্রহণ করব। জন্মগ্রহণ করেই কান্নাকাটি শুরু করব! বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনের কাছে শ্রেষ্ঠ উপহার হিসেবে সন্তানের আবির্ভাব হওয়ায় তারা অনাবিল আনন্দ প্রকাশ করবেন। সন্তানের জন্ম ঘিরে কত আয়োজন চলতে থাকবে। ধীরে ধীরে সবার সেবাযতেœ বড় হয়ে উঠব। শিক্ষাদীক্ষায় নিজেকে গড়ে তুলে প্রকৃত মানুষ হয়ে মানুষের সেবা করব। নিজের মানবজনম সার্থক করব। মানুষের জন্মগ্রহণ প্রক্রিয়া একভাবেই হয় কিন্তু তাদের মৃত্যু কতভাবে হয়! সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জল হোসেনের কী নির্মম মৃত্যু হলো। ভাবা যায়? এই মৃত্যুচিন্তা মাথায় নিয়ে একদিন তো স্বপ্নে দেখি গণপিটুনির মতো না হলেও গুল তৈরি করার মতো আমাকে তামাকপাতা যেভাবে আগুনে পুড়িয়ে পাটার ওপরে রেখে শীল দিয়ে পিষে গুঁড়া করছেন গ্রামের এক মাঝবয়সি নারী। তিনি নেশা হিসেবে দাঁতের ব্যথা দূর করার জন্য গুল দেন দাঁতে। তাতে তার সাময়িক ব্যথা দূর হয় ঠিকই কিন্তু তিনি যে ধীরে ধীরে নিজের জীবনটাই ধ্বংস করে দিচ্ছেন, তা তিনি নিজেও জানেন না। তাকে পরামর্শ দেওয়ার মতো গ্রামে কেউ নেই। মনে করলাম, আমি যদি তামাকপাতা হতাম তাহলে সত্যিটা ভূত হয়ে বুঝিয়ে হোক, আর ভয় দেখিয়ে হোক-তাকে গুল খাওয়া থেকে বিরত রাখতাম। এভাবে ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ আমার পাতার শরীরে শিশির পড়ামাত্র ঘুম ভেঙে গেল। আমার শিরায় শিরায় টেনশনের উপসর্গগুলো বাড়তে লাগল। অতিরিক্ত টেনশনে মানুষের শারীরিক অবস্থা সুস্থ থাকে না, রাগের মাথায় কখন কী করে ফেলে নিজেও বুঝতে পারে না। তবে নিজের ক্ষতি হলে বুঝতে পারে। তখন আর ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সময় থাকে না। আমি পাতা হয়েও টেনশনে পড়ে গেলাম। পাতা হিসেবে আমি বড় লিপি প্যাড পাতা হব নাকি ছোট পিগমি উইড হয়ে জন্মগ্রহণ করব। ছোট গাছের পাতা নাকি বড় গাছের পাতা হয়ে জন্মগ্রহণ করব সে দোষ কী আমার? শিশু ধনী ঘরে জন্মগ্রহণ করবে নাকি গরিবের ঘরে জন্মগ্রহণ করবে এসব কি সে নিজে নির্ধারণ করতে পারে? না সে পারে না। সৃষ্টিকর্তাই তো নির্ধারণ করে দেন। তবে জন্মগ্রহণ করে কর্ম করতে হবে। কর্মফলের ওপর নির্ভর করে নাকি পরবর্তী জন্ম? মৃত্যুর মধ্য দিয়েই নতুন জন্মগ্রহণ হবে আবার। তবে আমার পাতা জীবনের মৃত্যু কীভাবে হবে? সেটা নিয়েই এ সময় বড্ড টেনশন বাড়ছে।
পূর্ব পুরুষরা বলেছেন, আগের দিনের মানুষ মরা পাতা সংগ্রহ করত। সে পাতা দিয়ে তারা ভাত-তরকারি রান্না করে খেত। কিন্তু আমি কচিপাতা থেকে এখন পরিণত পাতা হয়ে গেছি। কবে যে ডাল থেকে বাতাসে টুপ করে ঝরে পড়ে যাব! আমি যে কোনো আগুনে পুড়তে চাই না। আমাকে আগুনে পুড়িয়ে খারাপ কিছু তৈরি করুক, তা আমি চাই না। আমি চাই রান্না করে খাওয়ার জন্য ক্ষুধার্ত কেউ একজন আমাকে কুড়িয়ে নিয়ে যাক। আমাকে পুড়িয়ে সেই আগুনে খাবার তৈরি করুক। তাহলেই আমার পাতাজন্ম সার্থক হবে। এর পরের জন্মে আমি কী হব?