রবিবার, ৮ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

মৃত্যুমাঝে ঢাকা আছে যে অন্তহীন প্রাণ

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক

মৃত্যুমাঝে ঢাকা আছে যে অন্তহীন প্রাণ

‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’

- কাজী নজরুল ইসলাম

 

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব-এঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাতে ১১১ বছর পূর্বে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ রচিত পঙ্ক্তিমালার সাহায্যে নিবন্ধের শিরোনাম সাজাতে হলো। সত্যিই তাঁর মৃত্যুমাঝে ঢাকা পড়েছে এক অন্তহীন প্রাণ। জীবনভর বেগম মুজিব যেভাবে আত্মস্বার্থ বিসর্জন করে নিজ জীবনকে পরার্থে উৎসর্গ করে গেছেন তা এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অসাধারণ দিকদর্শী চিন্তাচেতনার ফলে বাঙালি জাতি যে কতবার উপকৃত হয়েছে তা আমরা উপলব্ধি করি। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘নারী’ কবিতা তাই আজ আমাদের স্মৃতিতে বারবার ভেসে আসে।

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৩০ সনের ৮ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম রেণু। শৈশবেই তিনি পিতৃহারা হন। মাত্র তিন বছর বয়সে পিতা শেখ জহুরুল হক পরলোকগমন করেন। মাতৃসান্নিধ্যও তাঁর জীবনে স্থায়ী হয়নি। শিক্ষাজীবন শুরু হয় গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে। কিন্তু তা দীর্ঘায়িত হয়নি। কৈশোর অতিক্রমের পূর্বেই তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায় সূচনা হয়। তৎকালীন প্রতিশ্রুতিশীল ছাত্রনেতা, বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ তরুণ শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তিনি শৈশবেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। লক্ষণীয়, যে বয়সে বাংলার মেয়েরা পুতুল খেলে, দাদা-দাদি, নানা নানি ও বয়স্কদের কাছ থেকে রূপকথা, পুঁথিপাঠ, বিবিধ লোককাহিনি শোনে, সে বয়সে সবার অজান্তেই বিধাতা রেণুকে ভিন্নভাবে বিকশিত করতে চেয়েছেন। তিনি লাভ করেছেন একান্নবর্তী পরিবারের গার্হস্থ্য দায়িত্ব। এ-শিক্ষা কেউ তাঁকে দেয়নি। সংসারধর্ম সম্পাদন, পরিবারের সবার প্রতি দায়িত্ব পালনের দীক্ষা তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই অর্জন করেছেন। সহজাত বৃত্তি ও প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা ক্রমান্বয়ে তাঁকে পূর্ণতা দিয়েছে। আমরা বলেছি, বঙ্গমাতার ডাক নাম ছিল রেণু। পুষ্পরেণুর সৌরভ যেভাবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে অনুরূপভাবেই তিনি তাঁর ¯েœহ, আদর-যত্ন, ভালোবাসা ও মমতা দিয়ে সবাইকে আপন করে নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ও বঙ্গমাতার দুই কন্যা- শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং তিন পুত্র- শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন। কিন্তু আমরা বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা এবং তাঁদের পুত্রদের আর কখনো দেখব না।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট একাত্তরের পরাজিত শক্তি এবং তাদের এ দেশীয় দোসরদের ষড়যন্ত্রে কতিপয় আদর্শচ্যুত ও স্বজাতিদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক সেনাসদস্য বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছে। ব্যতিক্রম কেবল বঙ্গবন্ধু কন্যা, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোটবোন শেখ রেহানা। প্রবাসে থাকার কারণে নরপশুরা তাদের নাগাল পায়নি। বিশ্ব-ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা কারবালার হত্যাকান্ড। কিন্তু সীমারের অনুসারীদেরও কিঞ্চিৎ মানবিক বোধ ছিল। নারী ও শিশু হত্যার অপরাধ থেকে তারা বিরত ছিল। কিন্তু পনেরোই আগস্টের নরপিশাচদের তা ছিল না। ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র দীর্ঘকাল এ কুচক্রী ও কুলাঙ্গারদের লালন করেছে, বিদেশি দূতাবাসে চাকরি ও পদোন্নতি দিয়ে তোষণ করেছে। পঁচাত্তর পরবর্তী রাষ্ট্রপরিচালকদেরও স্বৈরাচারী আচরণ ছিল বীভৎস ও চরম অমানবিক।

আমাদের ইতিহাসও সে-কথা বলে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, ঘনিষ্ঠজনদের হত্যাকারীরা ভেবেছিল হত্যাকান্ডের মাধ্যমে সবকিছু নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের সে-দুরাশা সফল হয়নি, হবেও না কোনো দিন। বাঙালির জাগরণ ও অগ্রযাত্রাকে কখনো প্রতিহত করা যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনারই জয় হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতি হয়েছে সংগঠিত ও অধিকতর সুসংহত। সংবিধানে কালো অধ্যায় ‘বব’ বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত হত্যাকারীদের বিচারের মাধ্যমে দন্ডাদেশ কার্যকর হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচারকার্য চলমান আছে ও কতিপয় শীর্ষ অপরাধীদের শাস্তি ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতিতে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের গভীর অবদান অনস্বীকার্য। বিদ্যুৎ চমকের মতো তা বিভিন্ন সময় অভিব্যক্ত হয়েছে। তাঁর এ পরিচয় প্রথম লক্ষ্য করা যায় ১৯৪৬ সনে কলকাতার দাঙ্গার সময়। সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী স্মৃতিচারণে লিখেছেন, এ দাঙ্গায় বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন বিপন্ন করে ডা. বিধানচন্দ্র রায়, অভিনেতা ছবি বিশ্বাসসহ বহু হিন্দু-মুসলমানদের জীবন রক্ষা করেছিলেন। কলকাতায় দাঙ্গা থেমে গেলেও নতুন করে শুরু হয় বিহারে, নোয়াখালীতে।

বিহারের কয়েক লাখ উদ্বাস্তুকে বাংলায় পুনর্বাসনের দায়িত্ব ছিল প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। তার ইচ্ছা ছিল সম্ভাবনাদীপ্ত নেতা শেখ মুজিব যেন সে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি জানতেন বেগম মুজিবের শরীর ভালো নয়। উল্লেখ্য, ১৯৪৪ সালে তাদের একটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে।  কিন্তু সে বাঁচেনি। এ আঘাত নিদারুণ। বেগম মুজিব শারীরিক ও মানসিকভাবে দারুণ ভেঙে পড়েন। এ অবস্থায় মুজিবের উচিত  তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের সঙ্গে অবস্থান করা।

 

কিন্তু বেগম মুজিবের বিবেচনা স্পষ্ট, ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়ে তিনি দেশের ও মানুষের কল্যাণকে বড় করে দেখেছেন। পত্র মারফত তিনি স্বামীকে সে কথাই জানিয়ে দিয়েছেন। এ চিঠির কথা শুনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘Mujib, she is a very precious gift to you from God. Don’t neglect her’. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু ক্যান্টনমেন্টে বন্দী ছিলেন। তাঁর মুক্তির দাবিতে উত্তাল সারা দেশ। আইয়ুব খানের মসনদ টলটলায়মান। রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে তিনি গোল টেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। প্রস্তাব করা হয়, বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্ত হয়ে এ বৈঠকে উপস্থিত হতে পারেন। পূর্ববাংলার অনেক রাজনৈতিক নেতা-কর্মী তা সমর্থনও করলেন। কিন্তু বেগম মুজিব তা চাননি। তাঁর সিদ্ধান্ত ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সম্পর্কে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন-‘আমার মনে পড়ে একদিনের কথা। যখন উচ্চ পর্যায়ের সব নেতারা আব্বাকে প্যারোলে নিয়ে যাওয়ার জন্য বন্দীখানায় হাজির। এয়ারপোর্টে পিআইএ প্লেন তৈরি। তখন আমার মা অত্যন্ত শক্ত সিদ্ধান্ত নিলেন। খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গে মা আমাকে পাঠালেন আব্বাকে একটা সংবাদ দিয়ে আসতে। আমি সেই সংবাদ নিয়ে হাজির হই। ভেতরে আমাদের অনেক নেতা থাকলেও আমাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় গেটের বাইরে আব্বার সঙ্গে দেখা করার জন্য। অনেক চেষ্টার পর কয়েক মিনিটের জন্য আমি দেখা পাই এবং মার কথাটা আব্বাকে জানাই।’ এর পরের ঘটনা আরও দুঃখজনক।

আব্বা ৩৪ জন আসামিসহ বন্দী মুক্তি ও আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ছাড়া প্যারোলে যেতে রাজি হলেন না দেখে নেতারা বেশ খেপে গেলেন। তারা অনেকে ৩২ নম্বর বাড়িতে এলেন, মাকে অনেক ভয় দেখালেন। আব্বাকে মেরে ফেলবে, মা বিধবা হবে, আমরা পিতৃহারা হব এ ধরনের কথা শোনাতেও ছাড়েনি। মার একই কথা, ৩৪ জন বন্দীকে রেখে এবং মামলা প্রত্যাহার না করলে প্যারোলে আব্বা যাবেন না, বাংলার মানুষও তা চায় না। আমার মায়ের একই কথা বাংলার মানুষের যে দাবি সে দাবির বাইরে আব্বা যাবে না। বিধবা হলে মা হবেন। পিতৃহারা হলে তার সন্তানরা হবে কিন্তু তাতে অন্য কার কি হবে? শুধু মাকে নয়, কোনো নেতা সেদিন আমাকেও দু’কথা শোনাতে ছাড়েনি। আমি সহ্য করতে না পেরে সেই দুই নেতাকে কিছু কথা শোনাই এবং মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ি। আমার মা অত্যন্ত দেশপ্রেমিক ছিলেন, দেশের জন্য জীবনের যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে সদাপ্রস্তুত এবং দৃঢ় মনোবল নিয়ে আমাকে শুধু বললেন, ‘ধৈর্য ধর, আল্লাহর রহমতে তোর আব্বার কিছু হবে না। তিনি মুক্তি পাবেন। এটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।’ বিপদে ধৈর্য হারা হতে হয় না। আমার মায়ের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছিল। জয় হয়েছিল তাঁর ধৈর্য, সাহস আর আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাসের। ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে নেয় এবং আব্বাকেসহ সব রাজবন্দীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৪ মার্চ আইয়ুব খানের পতন হয়। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অসীম ক্ষমতা ছিল আমার মায়ের।”

আমরা অনুভব করি বেগম মুজিব আপসহীনতার প্রতিজ্ঞায় কত সুদৃঢ় ও অনমনীয় ছিলেন। কন্যা শেখ হাসিনা সে-কথাই বিবৃত করেছেন। প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে না থেকেও রাজনীতির সত্যজ্ঞানে তিনি যে কত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন, রাজনীতির জটিল সমীকরণ সমাধানে কতটা উচ্চতর নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করতেন ও আত্মস্বার্থ ত্যাগে তিনি কতটা বলিষ্ঠ ছিলেন তা আমরা আজ উপলব্ধি করি। বেগম মুজিবের অবদান মূল্যায়ন করতে গেলে তা দুটি পর্বে বিভক্ত করে দেখতে হবে। প্রথম পর্বের পরিধি ১৯৪৪ থেকে ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত। এ পরিসরেই টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠেছেন বাঙালি জাতির অসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু ও জাতির জনক। তাঁকে বিবিধ ঘাত-প্রতিঘাত যেমন সহ্য করতে হয়েছে, 

তেমনি জনগণকে সংলগ্ন করে ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে সংগ্রাম করে বিজয়ী হয়ে উঠতে হয়েছে। এক্ষেত্রে এ মহীয়সী নারীর পরিচর্যা, শুশ্রƒষা, ভালোবাসা, নির্দেশনা শুধু তাঁকে শক্তি জোগায়নি, তাঁর আত্মবিশ্বাসকে করেছে সুদৃঢ়। বেগম মুজিব শত বিপদে যেমন থাকতেন নিরুদ্বেগ ও শান্ত তেমনি প্রবল আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মাঝেও থাকতেন একেবারেই ধীরস্থির ও প্রশান্ত।

আমাদের সবার জানা যে বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘ কারাবাসকালে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সন্তান ও আত্মীয়-স্বজন শুধু নয়, বঙ্গবন্ধুর বৃহত্তম পরিবার অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সব নেতাকর্মীসহ দেশের সাধারণ মানুষের বিভিন্ন চাহিদা পূরণে তিনি সারাজীবন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। যে কোনো প্রয়োজনে বেগম মুজিবের কাছে সহজেই যাওয়া যায় এটিই ছিল সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের জায়গা। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বর্বর পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক নিপীড়িত-নিগৃহীত মহিলাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তিনি তাঁর নিজ বাড়িতেই প্রথম কাজ শুরু করেন। দেশের দুস্থ সব জনগোষ্ঠীর ভরসার স্থান ছিল বেগম মুজিবের বাসস্থান। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু নিয়োজিত হয়েছিলেন দেশগঠনে। তাঁর স্বপ্ন ছিল এ দেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা। তাঁর এ অভিযাত্রায়ও একান্ত সঙ্গী ও প্রেরণা ছিলেন বেগম মুজিব। বঙ্গবন্ধু দেশগঠনের কাজ সমাপ্ত করতে পারেননি।

পাকিস্তানি পরাজিত শক্তি ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের ষড়যন্ত্রে তিনি সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হন। বেগম মুজিবও স্বামী, সন্তানদের সঙ্গে শহিদ হয়েছেন। নীলিমা ইব্রাহিম বলেছেন তিনি ‘সহমরণে’ গিয়েছেন। এ অভিধা তাঁর জন্য সুপ্রযোজ্য। দীর্ঘ ৪২ বছর স্বামীর সংসারে তিনি কাটিয়েছেন। স্বামী রাজনৈতিক কারণে কারারুদ্ধ থাকাকালেও স্বামীর কল্যাণ ও মুক্তি কামনায় তাঁর প্রতিটি প্রহর অতিবাহিত হয়েছে। সেই স্বামীকে ছাড়া তিনি কিভাবে বাঁচবেন? আমরা তাঁকে মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের প্রমীলার সঙ্গেও তুলনা করতে পারি। স্বামীর মৃত্যুতে স্বেচ্ছায় সহমরণকে প্রমীলা আলিঙ্গন করেছেন। তখন দিনের সূর্য অস্তমিত হচ্ছে। মেঘনাদ ও প্রমীলার চিতার আগুন অনুকূল বাতাসে আরও জ¦লে উঠেছে। প্রিয় পুত্র ও পুত্রবধূর অকাল মৃত্যুতে রাবণের দু-চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়েছে। তাদের চিতার দিকে তাকিয়ে একটি কথাই তখন তিনি উচ্চারণ করেছেন: ‘বিসর্জিল প্রতিমা যেন দশমী দিবসে।’

১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকান্ডের সংবাদে বাংলার সর্বত্রই সেদিন অনুরূপ অশ্রু বিসর্জিত হয়েছিল। এটি আজ সর্বজনবিদিত যে দীর্ঘ কারাবাস জীবনে বেগম মুজিব কিভাবে পৌনঃপৌনিক প্রচেষ্টা চালিয়ে কারাগারে কাগজ-কলম পৌঁছে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বার বার অনুরোধ করে রোজনামচা লেখার জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন, সহায়তা করেছিলেন, তার ফলেই আমরা পেয়েছি বঙ্গবন্ধু রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়া চীন’। এই গ্রন্থত্রয়ের জন্য বেগম মুজিব আমাদের নিকট চিরদিন প্রণম্য হয়ে থাকবেন। এ বিরল অবদানের মাধ্যমে বঙ্গমাতা শেখ বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব বাংলাদেশের ইতিহাসে অনপনেয় স্বাক্ষর রেখে গেছেন।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চেয়ারম্যান, পরিচালনা বোর্ড, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা।

সর্বশেষ খবর