কিছু কিছু মুখ আছে দেখলেই মা মা মনে হয়। সেসব মুখ পুরোটাই মমতায় মোড়া। নরম মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে যখন মায়াময় বাক্য নিঃসৃত হয় ওই কণ্ঠ থেকে তখন মনে হয় পৃথিবীতে এর চাইতে মধুরতম সংগীত বুঝি আর নেই। মা মানেই স্নেহের সুশীতল ছায়া। আমার এই অনুভূতি হতো বেগম সুফিয়া কামালের ক্ষেত্রেও। আমার মায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তিনি। আমার কৈশোর বেলায় বিকালে খেলতে খেলতে হঠাৎ হঠাৎ ছুটে আসতাম মায়ের ঘরে। দেখতাম মা তাঁর ঘরে খাটের ওপর বসে হয় কিছু সেলাই করছেন কিংবা কারও সঙ্গে গল্প করছেন। মাঝে মাঝে বেগম সুফিয়া কামাল আসতেন মায়ের সঙ্গে গল্প করার জন্য। দুজনের চেহারা ও গড়নে অদ্ভুত সাদৃশ্য! আমি দু-একবার ভুল কোলে মাথা রেখে একই মমতামাখা স্পর্শ অনুভব করেছি। অনেক পরে মাতৃস্নেহ কিঞ্চিৎ পেয়েছিলাম শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কাছ থেকে। তবে তা স্বল্প সময়ের জন্য। কারণ, যখন তাঁর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়, তখন তিনি শহীদ জননী হিসেবে অগণিত সন্তানের মা।
এবার আর এক মায়ের কথা বলি। তাঁকে দেখেছিলাম সেই ষাটের দশকে। সময়টা বোধহয় চৌষট্টি-পঁয়ষট্টি সালের দিকে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কর্তৃপক্ষ প্রেরিত একটি চিঠিতে আমাদের পরিবারকে জানানো হলো একটা নির্দিষ্ট তারিখে নির্ধারিত কয়েকজনকে বিকালের দিকে কারাগারের দর্শনার্থী কক্ষে যেতে হবে আমার মেজভাইয়ের সঙ্গে পারিবারিক সাক্ষাতের জন্য এবং সেখানে কোনোরকম রাজনৈতিক আলোচনা বা কোনো তথ্য আদান-প্রদান করার ব্যাপারেও সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হলো। নির্ধারিত সময়েই আমরা কয়েকজন উপস্থিত হলাম কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্দিষ্ট দর্শনার্থী কক্ষে। ওই কক্ষের আরেক প্রান্তে বসে আছেন এক ভদ্রমহিলা, তাঁর সঙ্গে তাঁর সন্তানেরা। তাঁর চেহারার দিকে চোখ পড়তেই এক উজ্জ্বল মাতৃরূপ মনটাকে ছুঁয়ে গেল। তিনি এক বিখ্যাত রাজবন্দীর স্ত্রী। আমার মাকে মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম দিলেন ভদ্র মহিলা। আমার মা-ও অস্ফুট কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দিলেন, আমরাও তাঁকে সালাম দিলাম। তিনি স্নেহার্দ্র্য কণ্ঠে আমাদের সালামের উত্তর দিলেন। মায়ের সঙ্গে সামান্য কিছু কথাবার্তাও বোধহয় হয়েছিল। কিছু পরেই পাহারাদারদের মধ্যে এক রকম চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা গেল এবং আমাদের ওপর নির্দেশ জারি হলো, আমরা যেন বেশি উচ্ছ্বাস না দেখাই। এলেন রাজবন্দীদ্বয়। মুজিব ভাই এবং আমার ভাই মন্টু খান। দুজনের পরনে একই ধরনের পোশাক, একই রকমের চুল আঁচড়ানো, দুজনেরই ভারী গোঁফ, আদলও কাছাকাছি, কেবল মুজিব ভাই অনেক দীর্ঘদেহী সুপুরুষ এবং প্রাণবন্ত। সে তুলনায় আমার মেজভাই একটু খাটো। অবশ্য মন্টু খান তাঁর লিডারের একনিষ্ঠ সেবক ও শিষ্য। অদ্ভুত মিল দুজনের। এ বিষয় নিয়ে অন্য কখনো কথা বলা যাবে। একটু পরে ভাবীর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মুজিব ভাই নিজেই। সেই অবরুদ্ধ সময়ে দর্শনার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট প্রায়ান্ধকার প্রকোষ্ঠটিতে মাতৃময়ী এক হৃদয়ের উত্তাপ অনুভব করেছিলাম স্বল্প পরিচয়েই।
শুরুতেই বলেছিলাম কিছু কিছু মুখ আছে যার দিকে চোখ গেলেই মায়ের কথা মনে হয়। সে রকম একটি মুখ দেখেছিলাম ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। সেই মুখ জননীর মুখ, মর্যাদাসম্পন্ন গৃহবধূর মুখ, দায়িত্ববান গৃহবধূর মুখ, পরিপূর্ণ গৃহিণীর মুখ, একজন যোগ্য সহধর্মিণীর মুখ, সর্বংসহা নারীশক্তির মুখ, ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসের মুখ। তাঁকে সাকুল্যে দেখেছি তিনবার। প্রথমবার সেই কারাগারের দর্শনার্থী কক্ষে, দ্বিতীয়বার এবং তৃতীয়বার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। ৩২ নম্বরে এক দিন হঠাৎ দেখা হওয়ায় সালাম দিয়ে চলে এসেছিলাম। আরেকবার বোধহয় আমাকে এবং আমার মেজভাইকে দুপুরে কিছু খেয়ে আসতে হয়েছিল। তাঁকে শেষবার দেখার সময়ও সম্বোধন ভাবী ছাড়া অন্য কিছু মুখ দিয়ে আসেনি। ইতিমধ্যে তিনি তাঁর কর্মগুণে বাঙালি জাতির কাছে স্নেহময়ী জননী হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।তাঁকে গভীরভাবে জেনেছি যখন তখন আর তাঁকে ফিরে পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। তবে তাঁর কথা লিপিবদ্ধ হয়ে আছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র বিভিন্ন অংশে বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব জবানিতেই : “রেণু কয়েকদিন আমাকে খুব সেবা করল। যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছে ছোট বেলায়। ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়। জ্বর একটু ভাল হল।” (পৃষ্ঠা ২১ : অসমাপ্ত আত্মজীবনী) কতখানি অনুভূতি, আস্থা, ভালোবাসা এবং আকর্ষণ থাকলে এভাবে নিবেদিত হওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর বিভিন্ন অংশে রয়েছে এর প্রমাণ।
এ তো এক তরফা ব্যাপার ছিল না কখনো। তিনি লিখেছেন, “...ভাবলাম কিছুদিন লেখা-পড়া করব। মাহিনা বাকি পড়েছিল, টাকা-পয়সার অভাবে। এত টাকা বাড়ি না গেলে আব্বার কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। এক বৎসর মাহিনা দেই নাই। কাপড়-জামাও নতুন করে বানাতে হবে। প্রায় সকল কাপড়ই চুরি হয়ে গেছে। বাড়িতে এসে রেণুর কাছে আমার অবস্থার কথা প্রথমে জানালাম। দিল্লি ও আগ্রা থেকে রেণুকে চিঠি দিয়েছিলাম...। টাকা দিয়ে আব্বা বললেন, “কোন কিছুই শুনতে চাই না। বি.এ পাশ ভালভাবে করতে হবে...।” আব্বা, মা, ভাই-বোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘অমঙ্গল অশ্রুজল’ বোধহয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে। বলল, ‘একবার কলকাতা গেলে আর আসতে চাও না। এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ি এসো।’ (পৃষ্ঠা : ৬১, অসমাপ্ত আত্মজীবনী)।
এই দুই মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কের গভীরতা যে কতখানি ছিল তা পরিমাপ করা দুঃসাধ্য এই ক্ষুদ্র পরিসরে। বিভিন্ন সময়ে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছার চিন্তাভাবনা, সময়োপযোগী পরামর্শ, ত্যাগ এবং চাহিদাবিহীন নির্লোভ চরিত্র পরিবারের প্রতিটি সদস্যের ব্যাপারে দায়িত্ব পালন করা, সন্তানদের লেখাপড়ার দিকে যত্নবান হওয়া, সততা, মানবিকতা এবং সৌজন্য প্রকাশে ন্যূনতম বিচ্যুতির ব্যাপারে সন্তানদের সতর্ক রাখার পাশাপাশি রাজনীতি এবং মানবকল্যাণে নিবেদিত থাকা এমন নিঃশব্দ মহীয়সী নারী যথার্থই বিরল।
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মমিনুল হক খোকা একটি অসাধারণ গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটির নাম ‘অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জ্বল : বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও আমি’। তাঁর লেখা গ্রন্থটির একটি অংশ এখানে তুলে ধরি যা থেকে পাঠক সম্যকভাবে অনুভব করতে পারবেন এই ইতিহাস সৃষ্ট দম্পতির মধ্যে বন্ধন কতখানি অচ্ছেদ্য ছিল। “...হঠাৎ একদিন মিঞা ভাইএর (খোকা ভাই বঙ্গবন্ধুকে এই নামে ডাকতেন) কাছে এলো ভাবীর কাছ থেকে চিঠি। সে চিঠিতে কী লেখা ছিল আমি জানি না। কিন্তু কিছু পরেই তিনি আমাকে বললেন, ‘খোকা তুই যা, তোর ভাবীকে নিয়ে আয় বাড়ি থেকে।’ আমি তখন বি.জি প্রেসের কন্ট্রাক্টের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। যাহোক, মিঞা ভাইএর নির্দেশে টুঙ্গীপাড়া রওনা হলাম। টুঙ্গীপাড়া যেতে পাড়ি দিতে হলো কষ্টকর পথ। কিন্তু পৌঁছে নিরাশ হতে হলো। ভাবীকে নেওয়ার কথা শুনে মামা রেগে উঠে বললেন, ‘ওর নিজেরই কোনো স্থিতি নেই, এখন এ অবস্থায় রেণুকে (ভাবীর ডাক নাম রেণু) পাঠানো যাবে না, তুই ফিরে যা।’ ফিরে এলাম ব্যর্থ মনোরথ হয়ে। মিঞা ভাই সবকিছু শুনে কিছুই বললেন না, কেবল গুম হয়ে বসে রইলেন। কিছুদিন পরে হঠাৎ দেখি মিঞা ভাই নাই। কাউকে কিছু বলেও যাননি। কোনো রাজনৈতিক কাজে গেলে উনি বলে যেতেন। আমাদের জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ একদিন উপস্থিত হলেন, সঙ্গে ভাবী। আমরা তো সবাই হতবাক! এত ছোট বাসা এখানে ভাবীকে নিয়ে থাকা কষ্টকর। যাহোক, ভাবীকে নিয়ে রইলাম সবাই। মিঞা ভাই আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাজ নিয়ে।” (উদ্ধৃত অংশের বানান অবিকৃত রাখা হয়েছে)
মমিনুল হক খোকার স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থটির বিভিন্ন পৃষ্ঠায় পাওয়া যাবে তাঁর ভাবীর ¯েœহময় ঘটনার বর্ণনা। ঢাকায় আসার পর বাসস্থান অনিশ্চিত, কখনো এই এলাকায়, কখনো অন্য এলাকায় বাস। গোয়েন্দাদের নিয়মিত উৎপাত, কোথাও কোনো নিরাপত্তা নেই, তবুও তিনি কোনো অনুযোগ না করে নীরবে এবং হাসিমুখে সব কষ্ট, সব অভাব সহ্য করেছেন বছরের পর বছর। বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর এক জায়গায় বললেন, “... মন চলে গেছে বাড়িতে। কয়েক মাস পূর্বে আমার বড় ছেলে কামালের জন্ম হয়েছে, ভালো করে দেখতেও পারি নাই ওকে। হাসিনা তো আমাকে পেলে ছাড়তেই চায় না। অনুভব করতে লাগলাম যে, আমি ছেলে মেয়ের পিতা হয়েছি। আমার আব্বা ও মাকে দেখতে মন চাইছে। তারা জানেন লাহোর থেকে ফিরে নিশ্চয় একবার বাড়িতে আসবো। রেণু তো নিশ্চয়ই পথ চেয়ে বসে আছে। সে তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সে জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে।” (পৃষ্ঠা : ১৪৬; অসমাপ্ত আত্মজীবনী।)
যে মহীয়সী নারীর বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না, সেই তিনি দশভুজার মতো সামলেছেন ঘর-সংসার, আত্মীয়-স্বজন, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দেখাশোনা করেছেন, আবার নজর রেখেছেন সন্তানদের লেখাপড়া চাহিদা-প্রয়োজনের প্রতি, শিক্ষা দিয়েছেন বিভিন্নভাবে নিজেকে বিকশিত হওয়ার আর দীক্ষা দিয়েছেন সাধারণ মানুষের জীবন সংগ্রামকে অনুভব করার। আবার দেশ ও জাতির প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে ঋজুতার সঙ্গে সবাইকে সাহস জুগিয়েছেন, প্রেরণা দিয়েছেন তাঁর রাজনীতিনিমগ্ন স্বামীকে, পরামর্শ দিয়েছেন নির্ভয়ে পথচলার। যেমনটি আমরা দেখি ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের আগে বিভিন্নজন নানাভাবে বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিচ্ছিল যখন, তখন বেগম মুজিব তাঁকে পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন তিনি যেন সেটাই বলেন যা তাঁর মনে, আদর্শে ধারণ করেন এবং যা বললে আপামর মানুষের মুক্তির পথ সুগম হয়। আবার আইয়ুব খানের কারাগারে অন্তরীণ থাকাকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু লাহোরে সর্বদলীয় বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন তখনও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছার প্রেরণাদায়ক ও আপসহীন বার্তা আমরা লক্ষ্য করি। তিনি বঙ্গবন্ধুকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, যেন কোনো প্রকারের আপস সেখানে করা না হয়। যদিও বঙ্গবন্ধু সেটা কখনই করতেন না, তবুও তাঁর শক্তি, প্রেরণার বড় জায়গাটি ছিলেন এই মহীয়সী নারীই। আমরা দেখি বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে তাঁর জননী প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বারবার বলেছেন, এই মহীয়সী নারী পাশে থেকে বঙ্গবন্ধুকে পরিপূর্ণ করেছেন।
তাঁকে নিয়ে অনেক কথা লেখা যায়। শিশুকালে যাকে স্বামী হিসেবে জেনেছিলেন, মেনেছিলেন, জীবনের শেষ মুহূর্তেও সহমরণ বরণের মধ্য দিয়ে এই পতিব্রতা নারী প্রমাণ করেছেন হৃদয়ে বন্ধন যখন নীতি ও আদর্শের বন্ধনে পরিণত হয় তখন সেই বন্ধন কখনো মৃত্যুর হিংস্র ভ্রুকুটিতেও পরাভূত হয় না।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক জাগরণ।