রবিবার, ৮ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা স্বাধীনতা সংগ্রামের নির্ভীক সহযাত্রী

ফরিদা ইয়াসমিন

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা স্বাধীনতা সংগ্রামের নির্ভীক সহযাত্রী

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মহানায়ক। যিনি বাঙালি জাতিকে আত্মপরিচয় দিয়েছেন। একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন বলে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা হয়ে ওঠার পেছনে যার ছিল অসাধারণ ভূমিকা, তিনি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ প্রেক্ষাপটে এক অনন্য ভূমিকা ছিল বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছার। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের পুরোটা সময় ব্যয় করেছেন দেশের জনগণের সেবায়। জীবনের বেশির ভাগ সময় জেলে কাটিয়েছেন। আর সেই সময়গুলোতে কান্ডারির মতো হাল ধরেছিলেন বেগম মুজিব। তিনি দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রেরণা জুগিয়েছেন, পরামর্শ দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী হয়ে প্রতিটি কাজের প্রেরণার উৎস হয়েছেন, সহযোদ্ধা হয়ে জীবনভর লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন। নির্ভীক সহযাত্রী হিসেবেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জীবন দিয়েছেন। ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঘাতকদের বুলেটের নির্মম আঘাতে জীবন দিতে হয়েছে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে। দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছাড়া ছোট্ট রাসেলসহ পরিবারের সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় সেদিন। বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। জন্মমাসেই বুলেটের নির্মম আঘাতে প্রাণ দিতে হয় বেগম মুজিবকে। ফজিলাতুন নেছার জন্ম ৮ আগস্ট। আজ তাঁর জন্মদিন। জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধা জানাই তাঁকে। শুভ জন্মদিন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা।

বঙ্গবন্ধুর জীবনে এবং বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে ও দেশের মানুষের জীবনে বঙ্গমাতা ছিলেন আলোকবর্তিকা। তাই একটি স্বাধীন দেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যে নামটি জড়িত তা হচ্ছে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে আজীবন প্রিয়তম স্বামী শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়াসঙ্গী ছিলেন শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব।

খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয় বেগম ফজিলাতুন নেছার। শ্বশুর-শাশুড়ি ও দেবর-ননদের সঙ্গেই তিনি বেড়ে ওঠেন। স্বামী শেখ মুজিবকে প্রায়ই কারাগারে থাকতে হতো। কারাগারের বাইরে থাকলেও রাজনীতির কাজে তাঁকে ছুটে বেড়াতে হতো। তাই ছোটবেলা থেকেই বেগম মুজিবকে পরিবারের অন্যদের সঙ্গে কাটাতে হয়েছে। স্বামীকে তিনি খুব কমই কাছে পেয়েছেন। বেগম ফজিলাতুন নেছার জন্মদিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর মা সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিনি স্বামীকে খুব কম সময়ই কাছে পেতেন। আমি যদি আমাদের জীবনটার দিকে ফিরে তাকাই এবং আমার বাবার জীবনটা যদি দেখি কখনো একটানা দুটি বছর আমরা কিন্তু বাবাকে কাছে পাইনি। স্ত্রী হিসেবে আমার মা ঠিক এভাবে বঞ্চিত ছিলেন। কিন্তু কখনো কোনো দিন কোনো অনুযোগ-অভিযোগ তিনি করতেন না। তিনি সব সময় বিশ্বাস করতেন, তাঁর স্বামী দেশের জন্য কাজ করছেন, মানুষের জন্য কাজ করছেন, মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করছেন।’

ফজিলাতুন নেছার দাদা ছিলেন জমিদার। প্রচুর জমিজমা। সব সম্পত্তি ফজিলাতুন নেছার নামে দিয়ে যান। সেই সম্পত্তি থেকে টাকা আসত ফজিলাতুন নেছার নামে। সেই সব টাকা ফজিলাতুন নেছার শ্বশুর তাঁর হাতেই তুলে দিতেন। কিন্তু বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব একটি টাকাও খরচ করতেন না। তিনি জানতেন তাঁর স্বামী রাজনীতি করেন, দেশের জন্য কাজ করেন, তাঁর টাকার প্রয়োজন। তিনি টাকা জমিয়ে রেখে স্বামীর হাতে তুলে দিতেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘রেণু যা কিছু জোগাড় করত বাড়ি গেলে এবং দরকার হলে আমাকেই দিত। কোনো দিন আপত্তি করে নাই, নিজে মোটেই খরচ করত না। গ্রামের বাড়িতে থাকত, আমার জন্যই রাখত।’ (পৃষ্ঠা-২৫)। আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে কলকাতা থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর লেখাপড়ায় ছেদ পড়ল। তিনি আবার লেখাপড়া শুরু করবেন ভাবলেন। কিন্তু মাইনে বাকি, কাপড়চোপড় কেনা ইত্যাদি কারণে টাকার প্রয়োজন পড়ল। সহযোগিতার হাত বাড়ালেন তাঁর স্ত্রী রেণু। বঙ্গবন্ধু লিখেন, ‘আব্বা মা ভাইবোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে দাঁড়িয়ে আছে।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, পৃঃ ৬১)। বেগম ফজিলাতুন নেছা বঙ্গবন্ধুর সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয়ে নজর রাখতেন। আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর লেখাপড়ার ক্ষতি না হয় সে ব্যাপারেও তাঁর দৃষ্টি ছিল। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে লিখেন, ‘পরীক্ষার কিছুদিন পূর্বে কলকাতায় চলে আসি। হোস্টেল ছেড়ে দিয়েছি। আমার ছোটবোনের স্বামী বরিশালের অ্যাডভোকেট আবদুর রব সেরনিয়াবাত তখন পার্ক সার্কাসে একটি বাসা ভাড়া নিয়েছেন। আমার বোনও থাকতেন, তার কাছেই উঠলাম। কিছুদিন পরে রেণুও কলকাতায় এসে হাজির। রেণুর ধারণা পরীক্ষার সময় সে আমার কাছে থাকলে আমি নিশ্চয়ই পাস করব। বিএ পরীক্ষা দিয়ে পাস করলাম।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ৭২)। এ ছাড়া আন্দোলনের সময়গুলোতে নিজ বাড়িতে পরম মমতায় নির্যাতিত নেতা-কর্মীর আত্মীয়-স্বজনকে বেগম মুজিব আপ্যায়ন করতেন, সুবিধা-অসুবিধার কথা শুনে ব্যবস্থা নিতেন। নেতা-কর্মীরা তাঁর মাঝেই আশার আলো দেখতেন। আন্দোলনের প্রেরণা পেতেন বেগম মুজিবের বক্তব্য থেকে।

শেখ হাসিনা তাঁর মা ফজিলাতুন নেছা সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘একটি টাকাও মা নিজের জন্য খরচ করতেন না, সব জমিয়ে রাখতেন। কারণ জানতেন যে, আমার বাবা রাজনীতি করেন। তাঁর টাকার অনেক দরকার। দাদা সব সময় ছেলেকে টাকা দিতেন, তার পরেও মা তাঁর ওই অংশটুকু, বলতে গেলে নিজেকে বঞ্চিত করে টাকাটা বাবার হাতে সব সময়ই তুলে দিতেন। এভাবেই তিনি সহযোগিতা শুরু করেন, তখন কতইবা বয়স। পরে যখন ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন হয়, সে নির্বাচনে নির্বাচনী কাজে সবাই সম্পৃক্ত, আমার মা’ও সে সময় কাজ করেছেন।’

নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর মন্ত্রিসভার সদস্য হলেন শেখ মুজিব। ১৯৫৪ সালের ৩০ মে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিপরিষদ বাতিল করে দিয়ে শাসনতন্ত্রের ৯২ (ক) ধারা জারির মাধ্যমে প্রদেশে গভর্নরের শাসন প্রবর্তন করেন। সেই ধারা অনুসারেই পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ১৪ দিনের নোটিস দিয়ে পুরো পরিবারকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। ফজিলাতুন নেছা মুজিব কেবল ঢাকায় এসেছেন। তেমন লোকজনকে চেনেন না। কোথায় যাবেন, কোথায় উঠবেন! কিন্তু ভেঙে পড়েননি বেগম মুজিব। শেখ হাসিনা সেই দিনের কথা স্মরণ করে বলেছেন, ‘মন্ত্রী থাকা অবস্থায় ওই বাসায় মানুষে মানুষে গমগম করত। কিন্তু ওই দিন সব ফাঁকা, আমার আব্বার ফুফাতো ভাই, আমার এক নানা এলেন, বাড়ি খোঁজার চেষ্টা। নাজিরাবাজারে একটা বাড়ি পাওয়া গেল, সেই বাসায় আমাদের নিয়ে উঠলেন। এভাবেই একটার পর একটা ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে। কিন্তু একটা জিনিস বলব, মাকে কখনো ভেঙে পড়তে দেখিনি। যত কষ্টই হোক, আমার বাবাকে কখনো বলেননি যে, তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও বা চলে আস বা সংসার কর বা সংসারের খরচ দাও। কখনো না। সংসারটা কীভাবে চলবে, সম্পূর্ণভাবে তিনি নিজে করতেন। জীবনে কোনো প্রয়োজনে আমার বাবাকে বিরক্ত করেননি। মেয়েদের অনেক আকাক্সক্ষা থাকে স্বামীদের কাছ থেকে পাওয়ার। শাড়ি, গহনা, বাড়ি, গাড়ি কত কিছু। এত কষ্ট তিনি করেছেন জীবনে কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলেননি। কিছু চাননি। ১৯৫৪ সালের পরেও বাবাকে বারবার গ্রেফতার হতে হয়েছে। তারপর ১৯৫৫ সালে তিনি আবার মন্ত্রী হন, মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। আমরা ১৫ নম্বর আবদুল গনি রোডে এসে উঠি।’

বারবার শেখ মুজিব পরিবারকে ঘরছাড়া হতে হয়েছে। বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব দৃঢ়চিত্তে সবকিছু মোকাবিলা করেছেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে নতুন আশ্রয়ের খোঁজ করেছেন, কিন্তু ছিল না কোনো অনুযোগ-অভিযোগ। আইয়ুব খান মার্শাল ল ঘোষণা করলেন, শেখ মুজিব করাচিতে ছিলেন। তাড়াতাড়ি চলে এলেন। তারপরই ১১ অক্টোবর দিবাগত রাতে অর্থাৎ ১২ অক্টোবর শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হলো। গ্রেফতার করার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে যে নগদ টাকা ছিল, গাড়ি ছিল সবকিছু সিজ করে নিয়ে যাওয়া হলো। সে সময় সবাইকে বাড়ি থেকে বের করে দিল। মালপত্তর নিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েসহ বেগম মুজিব রাস্তায়। একজন একটা বাসা দিল। দুই কামরার বাসাতে ফজিলাতুন নেছা ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোনো রকমে উঠলেন।

 

আবার শুরু হলো বাড়ি খোঁজা। অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে তিনি সবকিছু সামাল দিয়েছেন। শেখ হাসিনা সেদিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘আব্বার বিরুদ্ধে তখন একটার পর একটা মামলা দিচ্ছে, এই মামলা-মোকদ্দমা চালানো, কোর্টে যাওয়া এবং বাড়ি খোঁজা সমস্ত কাজ আমার মা অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে করতেন।’

শুধু নিজের পরিবার-পরিজন নয়, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অসুখ-বিসুখে তাদের পরিবারের খোঁজখবর নেওয়া, যারা জেলখানায় আটক ছিল তাদের পরিবারকে প্রয়োজনে বাজার-সদাই করে দিতেন। এসব করতে গিয়ে কখনো কখনো তাঁর গহনা বিক্রি করতে হয়েছে। এমনকি নিজের পরিবারের অভাব-অনটন তিনি খুব হাসিমুখেই মেনে নিয়েছেন এবং বিভিন্ন সময়ে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে তা কাটিয়ে উঠেছেন। তিনি কখনো তা ছেলেমেয়েদের বুঝতে দেননি। শেখ মুজিবের কাছে বাঙালির অধিকার আদায় ছাড়া ক্ষমতার কোনো আকর্ষণ ছিল না। বঙ্গমাতাও সেই আদর্শে নিজেকে ও নিজের সন্তানদের গড়ে তোলেন। জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করেছেন এভাবে- ‘এমনও দিন গেছে বাজার করতে পারেননি। আমাদের কিন্তু কোনো দিন বলেননি আমার টাকা নাই, বাজার করতে পারলাম না। চাল-ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করেছেন, আচার দিয়ে বলেছেন প্রতিদিন ভাত ভালো লাগে নাকি; আজকে আমরা গরিব খিচুড়ি খাব। এটা খেতে খুব মজা। আমাদের সেভাবে তিনি খাবার দিয়েছেন। একজন মানুষ তার চরিত্র কতটা দৃঢ় থাকলে যে কোনো অবস্থা মোকাবিলা করার মতো ক্ষমতা ধারণ করতে পারে। অভাব-অনটনের কথা, হা-হুতাশ কখনো মার মুখে শুনিনি।’

উত্তাল দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছায়ার মতো ছিলেন বেগম মুজিব। শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণায় সেসব দিনের কথা উঠে আসছে। ‘১৯৬২ সালে আবার আব্বা গ্রেফতার হলেন, ১৯৬৪ সালে আবার গ্রেফতার হলেন। আমি যদি হিসাব করি কখনো দেখিনি দুটো বছর তিনি একনাগাড়ে কারাগারের বাইরে ছিলেন। জেলখানায় থাকলে সেখানে যাওয়া, আব্বার কী লাগবে সেটা দেখা, তার কাপড়চোপড়, খাওয়া-দাওয়া, মামলা-মোকদ্দমা চালানো সবই কিন্তু মা করে গেছেন। পাশাপাশি সংগঠনের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ তাঁর ছিল। বিশেষ করে ছাত্রলীগ তো তিনি নিজের হাতেই গড়ে তোলেন। ছাত্রলীগের পরামর্শ, যা কিছু দরকার তিনি দেখতেন।’ ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের পক্ষে জনসমর্থন আদায় ও জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে লিফলেট হাতে রাস্তায় নেমেছিলেন বঙ্গমাতা। তিনি নিজের অলঙ্কার বিক্রি করে সংগঠনের প্রয়োজনে খরচ করেছেন। বিভিন্ন হামলা-মামলা, বিশেষ করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিষয়ে বেগম মুজিবকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। শেখ মুজিব যখন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে নেতাদের সঙ্গে বসতেন, বেগম মুজিব সব সময় খেয়াল রাখতেন কী সিদ্ধান্ত হচ্ছে। তিনি সময়মতো তাঁর মতামত দিতেন কিন্তু কখনো তাঁদের সঙ্গে বৈঠকে বসতেন না। তিনি তাঁর বার্তাটি পৌঁছে দিতেন।

 

আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক ডাকলেন, সেখানে যেতে হবে। বড় বড় নেতা সবাই তাঁকে নিয়ে যাবেন। কিন্তু ফজিলাতুন নেছা বলে দিলেন যে প্যারোলে যাওয়া যাবে না। যদি মুক্তি দেন তখনই যাবেন। নেতারা বেগম মুজিবকে বললেন, আপনি তো বিধবা হবেন। বেগম মুজিব বলেছিলেন, ‘আমি তো একা না। এখানে তো ৩৪ জন আসামি, তারা যে বিধবা হবে এটা আপনারা চিন্তা করেন না? আমার একার কথা চিন্তা করলে চলবে? আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ৩৫ জনের মধ্যে ৩৪ জনই তো বিবাহিত। মামলা না তুললে তিনি যাবেন না।’

তাঁর যে দূরদর্শিতা রাজনীতিতে, সেটাই কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার পথ খুলে দিয়েছে। কারণ সেদিন যদি বঙ্গবন্ধু প্যারোলে যেতেন তাহলে কোনো দিনই আর বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এরপর অসহযোগ আন্দোলনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে বেগম মুজিব দৃঢ়চিত্তের পরিচয় দিয়েছেন। বেগম মুজিব কখনো নিজের কথা ভাবেননি। তিনি সব সময় অন্যদের কথা ভেবেছেন, দেশের স্বার্থের কথা ভেবেছেন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের নেপথ্যেও ছিল তাঁর সঠিক দিকনির্দেশনা। ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, তুমি তোমার মনের কথাই সে সময়ে বলবে। তোমার স্বপ্নের কথা বলবে।’ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আজ সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণ। বঙ্গবন্ধু কোনো লিখিত ভাষণ দেননি। বঙ্গবন্ধু তাঁর মনের কথাগুলো বলেছিলেন বলে আজ এটিই শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় শ্রেষ্ঠতম স্থানে পৌঁছেছে।

শেখ মুজিবুর রহমানের ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থের ভূমিকায় মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা লিখেন, ‘সব সময় আমার মায়ের কথা মনে পড়ে। আমার মা যে কত রাজনীতি সচেতন ছিলেন, কত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন, আমার আব্বাকে তিনি লেখার প্রেরণা দিতেন। খাতাগুলি কিনে দিতেন আবার আব্বা যখন জেল থেকে মুক্তি পেতেন তখন খাতাগুলি সংগ্রহ করে সযতেœ রেখে দিতেন।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেন, ‘আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু-আমাকে কয়েকটি খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’ (পৃষ্ঠা ১)

বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে লেখার প্রেরণা দিতেন বলে আমরা পেয়েছি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘আমার দেখা নয়াচীন’ ‘কারাগারের রোজনামচা’-এর মতো অসাধারণ সব বই। আমরা জানতে পারছি অনেক অজানা ইতিহাস। বেগম ফজিলাতুন নেছা জানতেন শেখ মুজিব অনেক দূর যাবেন। তার জীবনকাহিনি হবে ইতিহাসের উপাদান। কতটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হলে তিনি শেখ মুজিবকে কারাগারে খাতা দিয়ে আসতেন আর বারবার তাঁর নিজের কথা লেখার তাগাদা দিতেন।

২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন এবং শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তারপর ফজিলাতুন নেছার একরকম বন্দীজীবন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তিনি বিলাসী জীবনে ফিরে যেতে পারতেন। কিন্তু নিজের গড়া ৩২ নম্বরের বাড়িতেই থেকে যান। সারা জীবন ছায়ার মতো স্বামীর পাশেই ছিলেন। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিনি বলেছিলেন, ‘ওনাকে যখন মেরে ফেলেছ আমাকেও মেরে ফেল’।

ব্যক্তিজীবনেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেগম ফজিলাতুন নেছাকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখতেন। বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের নানা পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতেন। তিনি নিজে নানাভাবে ফজিলাতুন নেছার অবদানের কথা বলে গেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ ১৯৭২ সালে রাজধানীর আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “আমার জীবনেও আমি দেখেছি যে, গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনো দিন আমার স্ত্রী আমাকে বাধা দেয় নাই। এমনও আমি দেখেছি যে, আমার জীবনের ১০/১১ বছর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনো দিন মুখ খুলে আমার ওপর প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে বোধহয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসত। এমন সময়ও আমি দেখেছি যে আমি যখন জেলে চলে গেছি, আমি এক আনা পয়সা দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলেমেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তাঁর দান যথেষ্ট রয়েছে। পুরুষের নাম ইতিহাসে লেখা হয়। মহিলার নাম বেশি ইতিহাসে লেখা হয় না। সে জন্য আজকে আপনাদের কাছে কিছু ব্যক্তিগত কথা বললাম। যাতে পুরুষ ভাইরা আমার, যখন কোনো রকমের সংগ্রাম করে নেতা হন বা দেশের কর্ণধার হন তাদের মনে রাখা উচিত, তাদের মহিলাদেরও যথেষ্ট দান রয়েছে এবং তাদের স্থান তাদের দিতে হবে।”

স্বাধীনতার পর এ সমাজ স্বাধীনতাযুদ্ধে নির্যাতিতা নারীদের গ্রহণ করতে চায়নি। তিনি এসব নির্যাতিত নারীকে মায়ের মমতায় বুকে টেনে নেন।... বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশে বঙ্গমাতা বলেন, ‘আমি তোমাদের মা।’ অনেক বীরাঙ্গনাকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়ে সামাজিকভাবে পুনর্বাসন করেন।

প্রচারবিমুখ মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। পর্দার অন্তরালে থেকে দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে নিরন্তর প্রেরণা জুগিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নে নিজের স্বপ্ন মিলিয়েছেন ফজিলাতুন নেছা। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে ছায়ার মতো থেকে শক্তি জুগিয়েছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে নির্ভীক সহযাত্রী হিসেবে একটি স্বাধীন দেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে নাম তা ফজিলাতুন নেছা মুজিব। স্বাধীনতার দীর্ঘ সংগ্রামে অনন্য ভূমিকার জন্য তিনি হয়েছেন বঙ্গমাতা।

লেখক : সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব; সদস্য, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি।

সর্বশেষ খবর